খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের চিন্তা- পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ by জাকির হোসেন লিটন
বিএনপি
চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার অথবা গৃহবন্দী করার চিন্তা মাথায়
রেখেই এগোচ্ছে সরকার। সরকারের বারবার ঘোষণা সত্ত্বেও হরতাল-অবরোধের কারণে
দেশের পরস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি
মাসে শুরু হতে যাওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সময় চলমান লাগাতার অবরোধ ও
হরতাল অব্যাহত রাখা হলে গ্রেফতারের বিষয়টি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যেতে পারে।
এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে দু’টি মামলা
করা হয়েছে। অবরোধে আরো কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেই তাকে আসামি করে আরো মামলা
করা হবে। তবে বিরোধী জোটের প্রধানকে গ্রেফতার করা হলে দেশের পরিস্থিতি কোন
দিকে যেতে পারে তা নিয়ে শেষ মুহূর্তে ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। আওয়ামী
লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। সূত্র আরো জানায়, কিছু দিন
আগে বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করে রাখা
হয়েছিল। এরই মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় ৩০ জন আহত
হওয়ার ঘটনায় তাকে হুকুমের আসামি করে মামলা করা হয়। কিন্তু ওই দিন খালেদা
জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ এবং পাশের দেশ ভারতে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সফরের কারণে আর সে দিকে এগোতে
পারেনি সরকার। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে বিএনপির গুলশান
কার্যালয়ে গেলে তাকে ঢুকতে না দেয়ার অভিযোগ এবং অবরোধ ও হরতাল প্রত্যাহার
না করায় আবারো গ্রেফতারের বিষয়টি সরকারের বিভিন্ন ফোরামে সক্রিয়ভাবে
আলোচনায় আসে। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল
অবরোধ-হরতাল অব্যাহত থাকলে প্রয়োজনে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হবে বলে
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
গতকাল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত
সেনগুপ্ত খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, আগামী ২
ফেব্রুয়ারির মধ্যে অবরোধ প্রত্যাহার না করলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে
প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের
গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাও প্রয়োজনে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের হুঁশিয়ারি
দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে নব নিযুক্ত ডিএমপি কমিশনারও
বলেছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে তাকে গ্রেফতার করা হবে।
জানা গেছে, বিরোধী জোটের চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনের কৌশল হিসেবে
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শীর্ষ নেতাদের মতো খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতারের
খবরটি অনেক আগেই মাঠে ছড়িয়ে দেয় সরকারপক্ষ। এর মাধ্যমে মূলত বিরোধী
নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া ও জনমত যাচাই করা হচ্ছিল। মনে করা হচ্ছিল,
জোটপ্রধানকে গ্রেফতারের হুমকি দেয়া হলে বিরোধী নেতাকর্মীরা হরতাল অবরোধ বাদ
দিয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হবে। এতে দেশের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সে
জন্য সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকেরা ‘আগামী সাত দিনের মধ্যে’ পরিস্থিতি
স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে জনগণকে বারবার আশ্বস্ত করেন। কিন্তু গত ২৫ দিনেও
চলমান সঙ্কটের কোনো সমাধান না হয়ে দেশের ক্ষতির বোঝা বেড়েই চলেছে। টানা
অবরোধের মধ্যে সারা দেশে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৪০ জন। আহত
হয়েছেন কয়েক শ’ মানুষ। চলমান এ রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের অর্থনীতি
বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাইরে থেকে মালামাল আসতে না পারায় রাজধানীতে
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। নাশকতাকারীদের দেখা মাত্র গুলিÑ
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রধানদের এমন ঘোষণার পরও মানুষের স্বাভাবিক
জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিও
বিশৃঙ্খলাকারীদের দমনে পুলিশ প্রশাসনকে আরো কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এরপরও বিজিবি, র্যাব-পুলিশি পাহারায় চলা যানবাহনে নিয়মিত হামলা ও
অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। হতাহত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এতে চরম উদ্বেগ আর
আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। এমন প্রেক্ষাপটে আরো নড়েচড়ে বসছেন সরকারের
নীতিনির্ধারকেরা। আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা আলাপকালে জানান,
‘সর্বশক্তি নিয়োগ’, ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’, ‘সরকার আরো কঠোর হবে’,
‘প্রয়োজনে খালেদাকেও গ্রেফতার’ এবং বারবার ‘সাত’ দিনের কথা বলা হলেও এখনো
দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের
নীতিনির্ধারকেরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। তাই সরকার এখন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের
মাধ্যমে শেষ অস্ত্রটি ব্যবহার করতে চায়। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে
সারা দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতো সরকারও উদ্বিগ্ন। তাই
পরীক্ষার সময় অবরোধ চালু রাখা হলে সেই সুযোগটি কাজে লাগানো হবে। এতে
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সাধারণ মানুষের সমর্থনও পাওয়া যাবে বলে মনে
করা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা
হচ্ছে। এর মাধ্যমে গ্রেফতারের পথটি খোলা রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া পুরনো
মামলাগুলো তো রয়েছেই। আরেকজন নেতা জানান, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের বিষয়টি
আগেই চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু ভারতে বারাক ওবামার সফর এবং কোকোর মৃত্যুতে তা
সম্ভব হয়নি। কারণ ওই সময় গ্রেফতার করা হলে ওবামার কাছে সরকার সম্পর্কে বড়
ধরনের নেতিবাচক বার্তা যেত। আর কোকোর মৃত্যুর কারণে এখন সময় নেয়া হচ্ছে।
কারণ, পুত্র হারানোর এ শোকের মধ্যে তাকে গ্রেফতার করা হলে এটি চরম অমানবিক
বলে জনগণ সরকারকে আরো ধিক্কার দিত। সে জন্য এখন একটু সময় নেয়া হচ্ছে। এ
ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: দীপু মনি এমপি
বলেন, বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতির নামে এভাবে গুপ্ত হামলা করে, মানুষ
পুড়িয়ে মেরে, মা-বোনদের বুক খালি করলে তাকেও ছাড় দেয়া হবে না। হরতাল
অবরোধের নামে প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে খেসারত দিতে হবে। কারণ,
সাধারণ একজন মানুষের মতো তিনিও আইনের ঊর্ধ্বে নন। আরেক যুগ্ম সাধারণ
সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি বলেন, খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশে
সন্ত্রাসীরা ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে। পেট্রল মেরে মানুষ হত্যা করছে। তাই এর
দায় তাকেই নিতে হবে। তিনি তো আইনের ঊর্ধ্বে নন। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি নয়া দিগন্তকে বলেন, খালেদা জিয়া এখন আর রাজনীতির
মধ্যে নেই। তিনি এখন ধ্বংস ও নৈরাজ্যের মধ্যে আছেন। তাই তার জন্য আইন আলাদা
হতে পারে না।
No comments