সময়চিত্র- অদ্ভুত সংসদ, অনিশ্চিত যাত্রা by আসিফ নজরুল
দশম জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে ২৯ জানুয়ারি। এমনিতে সংসদের উদ্বোধনী দিনটিকে ঘিরে থাকে নানা আগ্রহ আর উদ্দীপনা।
এ দিন রাষ্ট্রপতি সংসদে ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণ নিয়ে বিরোধী দল তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। পত্রিকায় তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিশদ আলোচনা হয়। প্রথম দিনেই বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে সাধারণত। ওয়াকআউটের আগে গরম কিছু বাক্যবিনিময় হয় সংসদে। টিভির সামনে এসব দেখে আমরা নানা আলোচনায় জড়িয়ে পড়ি। সংসদের কার্যকারিতার জন্য আসলে কী কী করা দরকার, তা নিয়ে আশাবাদ আর হায়-হুতাশ চলে। সংসদীয় কমিটিগুলো কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়েও চলে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এবার তার অনেক কিছু নেই। এই সংসদে প্রকৃত বিরোধী দল নেই, এতে এমনকি প্রকৃত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার বহু কারণ রয়েছে।
সংসদ আইন তৈরি, সংশোধন আর সরকারের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রতিষ্ঠান। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে সংসদ। একমাত্র এর প্রতিনিধিরা হন জনগণ কর্তৃক সরাসরিভাবে নির্বাচিত। সংসদীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক এই বৈশিষ্ট্যই এবার সংসদে অনেকাংশে অনুপস্থিত। এই সংসদে এমন বহু প্রতিনিধি রয়েছেন, যাঁদের জেতার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, যাঁদের এলাকার মানুষ চেনে না, কেউ
কেউ এলাকায় যান কদাচিৎ। এমন বহু প্রতিনিধিও আছেন, যাঁরা আসলে নির্বাচিতই হয়ে আসেননি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৫১টি আসনে জয়। একটিমাত্র ভোট পড়ার আগে, নির্বাচনের দিন আসার আগেই দশম সংসদে তার চেয়ে বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়ে গেছেন ‘জনপ্রতিনিধিরা’। এই সংসদের আইনগত, নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এই সংসদ যদি শুধু সংবিধান রক্ষার নির্বাচন হয়ে থাকে, তাহলে এর আয়ু যত কম হবে, তত তা মঙ্গলজনক হবে দেশের জন্য।
২.
দশম সংসদ নিয়ে তবু আমাদের অনিশ্চয়তা কাটছে না। এই সংসদ পাঁচ বছরই থাকবে, এমন কথা বলার অনৈতিক ও অযৌক্তিক মনোভাব দেখাচ্ছেন সরকারি দলের কিছু নেতা। ইতিপূর্বে দেশে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে এ ধরনের একতরফা নির্বাচন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ দুটি নির্বাচনকেই অবৈধ আখ্যায়িত করেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে তাকে সম্পূর্ণভাবে অমান্য করতে সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী এরশাদের লাজলজ্জা আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কম ছিল। তিনি জোর করে দুই বছর পর্যন্ত থাকতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিএনপির আত্মগ্লানি ছিল। তাই নির্বাচনের আগেই বিএনপি সেটি শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য, এমন ঘোষণা দিয়েছিল। নির্বাচনের দেড় মাসের মাথায় নতুন নির্বাচনের জন্য সংসদ ভেঙে দিয়েছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সাংসদ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যার হিসাবে ২০১৪ সালের নির্বাচন ১৯৮৮ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের চেয়েও বেশি অগ্রহণযোগ্য ও একতরফা। কিন্তু এই নির্বাচনের মাধ্যমে অদ্ভুত ও নজিরবিহীন এক সংসদ গঠন করার পর এটিই পাঁচ বছরের জন্য বিরোধী দল ও জাতিকে মেনে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে এখন।
দশম সংসদের পক্ষের লোকদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে এই সংসদের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। এটি ঠিক যে আমাদের সংবিধান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন নিষেধ করেনি। কিন্তু অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টিকেও আমাদের সংবিধান অনুমোদন করেনি। যে দেশে কোনো স্কুলের অভিভাবক সমিতি বা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একটি আসনে বহু লোক দাঁড়িয়ে যান, সেখানে সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কেউ না দাঁড়ানোই একটি চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রমাণ। ১৯৯০ সালের পর কোনো নির্বাচনে একটি আসনেও এমন ঘটনা ঘটেনি, শুধু ১৯৯৬ সালে ৪৮টি আসনে এটি ঘটেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকে তাই আমরা অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলি, একই বিবেচনায় ২০১৪ সালের নির্বাচন বহুগুণ বেশি অস্বাভাবিক।
অস্বাভাবিকতা এক অর্থে বৈধতার সংকটের ইঙ্গিতবাহী। সরকারি কাজে যখন একটিমাত্র টেন্ডার প্রদানের ঘটনা ঘটে, তখন আমরা এটি অস্বাভাবিক বলে ধরে নিই। কোনো সন্ত্রাসী বা মাস্তানের ভয়ে অন্যরা টেন্ডার প্রদানে বিরত থাকে, এমন রিপোর্ট পত্রিকায় বের হয়, টেন্ডার বাতিল করা হয়। তখন কি আমরা বলি, আইনগতভাবে একটি টেন্ডার পড়লে সেটিই বৈধ ধরে নিতে হবে? বলি না। কারণ, আইন মানে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে অন্যকে অংশ নিতে বাধা দিয়ে বা নিরুৎসাহিত করে নিজের স্বার্থোদ্ধার নয়।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, নতজানু নির্বাচিত কমিশন ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে, তা গত ৩০ বছরে আমরা আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলকে বলতে শুনেছি। এবারের নির্বাচনে তা জোরালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন আওয়ামী লীগের পক্ষে এমন কিছু নজিরবিহীন কাজ করেছে, যা আইনের চোখেও অবৈধ। নির্বাচন কমিশন সময় পার হওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার গ্রহণ করেছে, অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও দলের প্রার্থীরা নিজেরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করার পরও কমিশন তা গ্রহণ করতে অসম্মতি জানিয়েছে। কমিশন যেভাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের নিষেধ সত্ত্বেও দলটির প্রার্থীদের লাঙল প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদাও, যাঁর ভূয়সী প্রশংসা আওয়ামী লীগ বহু সময়ে করে থাকে।
এমন একতরফা নির্বাচনেও ভুয়া ভোট পড়েছে, কেন্দ্র দখল হয়েছে এবং প্রশাসন নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দিয়েছে—এমন সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনে কারচুপি, সন্ত্রাস ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যে হারে নির্বাচনের দিনই সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা-ও ছিল নজিরবিহীন।
দশম সংসদের বৈধতার সংকট রয়েছে আরও বহু ক্ষেত্রে। এই নির্বাচন যে সরকারের অধীনে হয়েছে, তা থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করা, নবম সংসদ থাকা অবস্থায় দশম সংসদের শপথ গ্রহণ, একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির অবস্থান গ্রহণ বৈধ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের যৌক্তিক-অযৌক্তিকতা নিয়ে নানা তর্ক হয়তো তবু সম্ভব। কিন্তু আমরা কি এই নিরেট সত্যকে অস্বীকার করতে পারি যে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে দশম নির্বাচনের ফলাফল এ রকম হতো না? এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমনকি জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি বা বিএনএফ যেভাবে বিজয়ী হয়েছে, তা কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সম্ভব হতো না।
৩.
২০১৩ সালের স্থানীয় নির্বাচনসমূহ ও দেশি-বিদেশি সব জরিপ অনুযায়ী দশম নির্বাচনে বিরাট ব্যবধানে বিজয়ী হওয়ার কথা ছিল বিএনপির। তারা নির্বাচন বর্জন করায় সমালোচনা রয়েছে সমাজে। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিএনপির অনুপস্থিতির মধ্যেও সরকার, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন যে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা রেখেছে, তাতে নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে বিএনপির আশঙ্কা প্রমাণিত হয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতাও তাতে ফুটে উঠেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সকেও তাই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিতে দেখেছি এই নির্বাচনের পর।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরোধকে আমরা ছোট করে এনেছিলাম গত বছরের ডিসেম্বরে তারানকোর সফরকালে। প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে নির্বাচনকালে জাতীয় সরকারের একটি মডেল কি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি আগামী নির্বাচনের জন্য? নির্বাচনকালীন সরকার শুধু কেন, পুরো মেয়াদের জন্যই কি প্রধানমন্ত্রীর সর্বগ্রাসী ক্ষমতা কমিয়ে অন্তত ভারতীয় মডেলের একটি ভারসাম্যমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা আমরা ভাবতে পারি? বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে অবিলম্বে নতুন নির্বাচনের জন্য সহায়ক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনার উদ্যোগ কি এই সংসদ গ্রহণ করতে পারে না?
আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো’। দশম সংসদের জন্ম যেভাবেই হোক, ভালো কাজ করার সুযোগ তো তার রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দশম সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি বা পেলেও ভোট দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের বেদনা, হতাশা, বঞ্চনাবোধ দূর করার আশু পদক্ষেপ এই সংসদকে নিতে হবে।
জনসমর্থনহীন ও বৈধতার সংকটে জর্জরিত সরকারকে টিকে থাকতে হয় জনগণকে নিষ্পেষিত করে, চরম অত্যাচার আর অনাচার করে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকায় এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। আমরা চাই না এমন উদাহরণ বাংলাদেশে তৈরি হোক স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের হাতে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments