কপিরাইট : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত by খান মাহবুব
মহাকাল
মানুষকে দেহনাশের মাধ্যমে লোকসমাজ থেকে ধীরে ধীরে অন্তরাল করে ফেলে।
মানুষের সারাজীবনের শ্রম-ঘামের সম্মিলনের মাধ্যমে অর্জিত ধন-সম্পদও
দেহনাশের পর সমাজে খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না। তবে মেধাজাত সৃষ্টকর্ম
থাকলে তা জীবনকাল ও মৃত্যুর পরও সমানভাবে মানুষকে প্রাসঙ্গিক ও সমাদৃত করে।
পরিতাপের বিষয় বস্তুগত সম্পদ অর্জন, রক্ষণ ও বৃদ্ধিতে মানুষের চিন্তা ও
প্রচেষ্টা অবিরাম। কিন্তু মেধাসম্পদের সুরক্ষা এবং এ থেকে আর্থিক প্রাপ্তির
অধিকার নিশ্চিত করতে মানুষের প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়।
মানুষের চিন্তা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে উদ্ভাবনী মেধাসম্পদকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়- যথা : ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি (পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন); অন্যটি কপিরাইট (সাহিত্য ও শৈল্পিক কাজের পরিমণ্ডল) মানব মনের সব সৃষ্টিই মেধাসম্পদ। মানুষের সৃষ্টিশীল সব কর্মই স্রষ্টা বা মালিকের অনুমতি ছাড়া পুনরুৎপাদন, বাণিজ্যিক বা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারে স্রষ্টার অধিকারকে হরণ করা হয়। এই জন্যই কালের বিবর্তনে এবং মানুষের অধিকার সচেতনতার ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কপিরাইট ধারণার উদ্ভব হয়েছে। কপিরাইট রক্ষায় সৃষ্টিশীল মানুষের আর্থিক ও নৈতিক অধিকার প্রাপ্তির মিলিত দাবির ফলে ১৮৮৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কনভেনশনে পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন ইত্যাদি সৃষ্টিকারীদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে অগ্রগণ্য। বাংলাদেশসহ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৭৩। এ ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে বিভিন্ন দেশের মেধাস্বত্বধারীদের প্রাপ্ত অধিকারের পার্থক্য কমিয়ে এনে একটা সমন্বয় সাধন করতে ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগোসহ অন্যরা ১৮৮৬ সালে বার্ন-এ একটি কনভেনশন করে- যা বার্ন কনভেনশন নামে খ্যাত। এই কনভেনশনে স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের প্রতি অধিক দায়িত্বশীলতা দেখিয়ে এই মতে উপনীত হয়- যে কপিরাইট সুরক্ষার জন্য কোনো কর্মকে রেজিস্ট্রিকৃত হতে হবে না। যে মুহূর্তে কর্মটি সৃষ্টি হয় আপনাআপনি সেটি সে মুহূর্ত থেকে সুরক্ষা পাবে। বার্ন কনভেনশনে আরও বলা হয়- যখন সৃজনকর্ম প্রদর্শন ব্যবহার করা হবে তখন স্রষ্টার নামসহ তার স্বীকৃতি ও উপস্থাপনায় বাধ্যতামূলক। এই নৈতিক অধিকার স্রষ্টার রাইট টু-প্যাটারনিটি ও রাইট টু ইন্টেগ্রিটিকে সুরক্ষা দেয়। বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালের ৪ মে এই চুক্তি মান্য করে চলতে সম্মত হয়ে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
বিশ্বমানবের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সুরক্ষার প্রত্যয়ে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়াইপো (WIPO, ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপ্রার্টি অর্গানাইজেশন)। বাংলাদেশ ১৯৮৫ সালে ওয়াইপোর সদস্যভুক্ত হয়। এই সংস্থার সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ১৮৪। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ রক্ষায় বিশ্বে প্রথম সুসংহত কপিরাইট আইন ‘দি স্ট্যাটিউট অব অ্যানি ১৯১০ সালে ইংল্যান্ডে প্রবর্তিত হয়। কপিরাইট নিয়ে উন্নত বিশ্ব সোচ্চার হলেও বাংলাদেশে এই শব্দটির সঙ্গেই সাধারণ মানুষের পরিচয় কম। যে দেশের মানুষ নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে অপরের স্বত্ববান সম্পদ দখলে ভ্রুক্ষেপ করে না; এমনকি রাষ্ট্রের বন-বাদাড়, নদী-নালা, দখলে-মগ্ন রাষ্ট্রের মালিক ধনলোভী একশ্রেণীর জনগোষ্ঠী সে দেশের মানুষের সুকুমার মননের সৃষ্টি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ রক্ষার তাগাদা খুব একটা অনুভব করে না।
রাষ্ট্রীয়ভাবে কপিরাইট সুরক্ষার জন্য স্বাধীনতার পর থেকে পেটেন্ট রাইট অফিস শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করতে শুরু করে। মগবাজারের একটি ভাড়া বাড়িতে কামালউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে অফিসটি চলে। ১৯৭৩ সালে সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামতের ভিত্তিতে পাকিস্তান আমলে কার্যকর ১৯৬২ সালের কপিরাইট অধ্যাদেশের কিছু ধারাকে সংশোধন করে পাকিস্তানি আমলের আঞ্চলিক পেটেন্ট রাইট অফিসকে জাতীয় পর্যায়ের একটি সংযুক্ত দফতরের দায়িত্ব দিয়ে স্থাপন করে রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটের কার্যালয়। বাংলাদেশের প্রথম কপিরাইট রেজিষ্ট্রার নুরুল আলম (কার্যকাল ১-৬-১৯৭৩ থেকে ৩-৩-১৯৭৮)। প্রথম পর্যায়ে কপিরাইট রেজিস্ট্রারের কার্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। ১৯৮৭ সালে কপিরাইট অফিস সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হয়। এরশাদ সরকারের আমলে কপিরাইট অফিস আগারগাঁওয়ের জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে কপিরাইট অফিসে লোকবল ২৯ জন (অনুমোদিত লোকবল ৪৯ জন)। বাংলাদেশে বলবৎ কপিরাইট আইন ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত ১৭টি অধ্যায় ও ১০৫টি ধারা বিদ্যামান)-এর বিধান মতে কপিরাইট অফিস একটি আধা বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান। যথার্থ আইন ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ হরণের বিপরীতে প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ রক্ষায় তদারককারী আন্তর্জাতিক সংস্থার (যেমন : UNESCO, WIPO, WTO) সদস্য বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন দেশের কপিরাইট সুরক্ষার জন্য যে সব কনভেনশন হয়েছে বাংলাদেশ অধিকাংশ কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে (যেমন প্যারিস কনভেনশন ১৮৮৩, বার্ন কনভেনশন ১৮৮৬, ইউনিভার্সেল কপিরাইট কনভেনশন ট্রিপস ১৯৯৪,) সব কিছুর পরেও এ দেশে সচেতনতার অভাবে কপিরাইট রক্ষার আন্দোলন উপেক্ষিত। কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করে পাইরেসির মাধ্যমে আমাদের সৃজনশীল কর্ম বিশেষত বইয়ের বাজার আজ এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। পাইরেসি শুধু সৃজনকর্মের স্রষ্টার আর্থিক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে না, নতুন কর্ম সৃষ্টিতেও উদ্যম, উৎসাহ ও সামর্থ্যকে হ্রাস করছে। কপিরাইট লঙ্ঘনজনিত অপরাধ, অপরাধের প্রকৃতি এবং তার বিপরীতে শাস্তির বিধানের বর্ণনা রয়েছে। এক্ষেত্রে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। দেওয়ানি আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা ক্ষতিপূরণ আদায়, ফৌজদারি আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা সংক্রান্ত শাস্তির বিধান রয়েছে (ধারা-৭৫-৮১)। কিন্তু অনুমোদনবিহীন প্রকাশনার বা পাইরেসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেন রেকর্ড গড়েছে।
ঢাকার নীলক্ষেতের বইয়ের বাজারে কোন বই, কে লেখক, কে প্রকাশক ইত্যাদি এখানকার বই উৎপাদকদের কাছে কোনো বিচার্য বিষয় নয়। মূল্যায়নের বিষয় হচ্ছে বইটি পুনরুৎপাদন হলে বাজারে চাহিদা কত বা কস্ট বেনিফিট এনালাইসিজে উৎপাদিত বইয়ের বাজার ইতিবাচক কী না। এখানে সিন্ডিকেট করে, গ্র“প করে পাইরেটেড বই প্রকাশ হয়। পাইরেটেড বই প্রকাশের ক্ষেত্রে বিভাজন আছে, অর্থাৎ সৃজনশীল বই, কম্পিউটার বিষয়ক বই, ডাক্তারি বই কারা প্রকাশ করবে তা সুনির্দিষ্ট। নীলক্ষেত বাজারে পাইরেসি বই উৎপাদক চক্র এতটাই সংঘবদ্ধ যে উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা দেখে মনে হবে যেন এ এক সুচারু সৃজনশীল কর্ম। এক্ষেত্রে আইনের বিধানের কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে বলে তাদের কাছে মনে হয় না। নীলক্ষেতে বই বিক্রেতাদের কাছে এসব পাইরেসি বই বিক্রি অন্যায় ও অনৈতিক বলতে গেলে বিক্রেতারা পাল্টা বলে- ‘এসব নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। কম পয়সায় পায় ক্রেতা, প্রয়োজন মিটে যায়- এ পর্যন্তই। আর আমাদের এসব নিয়ে এত ভাববার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বইয়ের পাইকারি বাজার বাংলাবাজারেও পাইরেসি নিয়ে দেন-দরবার করে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। ঢাকার বাইরের বইয়ের বাজারও পাইরেটেড বইয়ে সয়লাব।
সরকারের কপিরাইট আইন, এই আইনের অধীনে কপিরাইট টাস্কফোর্স আছে। অভাব, যথার্থ আন্তরিকতা ও উদ্দীপ্ত দায়িত্ববোধের। আমরা মনে করি কপিরাইট লঙ্ঘনকারীরা জ্ঞাতসারে এই কাজটি করে। তাই সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে হেদায়েতের আলো দিলেই চলবে না, প্রয়োজন আইনের যথার্থ প্রয়োগের। এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, কপিরাইট টাস্কফোর্স ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত মাত্র ৯টি অভিযান পরিচালনা করেছে, যা নিতান্তই কম। কপিরাইট আইনের ৯৩(১) ধারায় সাব-ইন্সপেক্টরের নিুতর পদাধিকারী নন এমন যে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই পাইরেসি সংক্রান্ত কর্মের সব অনুলিপি বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী এবং অনুলিপি তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সব প্লেট বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী যেখানেই পাওয়া যাক তা জব্দ করতে পারেন। ৯৯ ধারায় কপিরাইট রেজিস্ট্রারকে দেওয়ানি আদালতের অনুরূপ কিছু ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। কপিরাইট অফিস আরও আন্তরিক হলে বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে থেকেও অনেক করতে পারে।
আজকাল বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত অনেক বই বাজারে আসার দু’চার দিন পরই কোনো কোনো ওয়েবসাইটে দেয়া হয় লেখক বা প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকে, মেধাস্বত্বকে বুড়ো আঙুল প্রদর্শন করে!
বাংলাদেশে বলবৎ কপিরাইট আইনে সৃজনশীল কর্মের স্রষ্টার মৃত্যুর পর ৬০ বছর কপিরাইটের দাবিদার থাকে। এই সময়সীমা পার হলে সৃষ্টিকর্মের স্বত্ব পাবলিক ডমেইন-এ চলে আসে। এ সময় এ সৃষ্টকর্মকে জনসম্পদ বলা যায়। অর্থাৎ সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তবে কপিরাইটের সময়সীমা পার হলেও সৃজনশীল কর্মের প্রতি অর্থনৈতিক প্রাপ্তির অধিকারের দাবি অগ্রাহ্য হলেও সৃষ্টার সৃজনকর্মের উপর নৈতিক অধিকার চিরকাল বহমান থাকে। তাই এরিস্টটল, প্লেটো কিংবা সক্রেটিসের বই চিরকাল রচয়িতা হিসেবে তাদের নামেই নামাঙ্কিত থাকবে।
উন্নত বিশ্ব মেধাস্বত্বের বিষয়ে সচেতন এবং এ অধিকার রক্ষায় আইনের বিধি-বিধান ও তার প্রতিপালনে দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠাবান। পাইরেসি বা কপিরাইট ভঙ্গকারীদের তারা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। উদাহরণস্বরূপ বলতে হয়- সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার এক তরুণ না বুঝে একটা গান অনুমতি না নিয়ে ডাউন লোড করে। বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশের আতঙ্কে ছেলেটি আÍহত্যা করে বলে জানা যায়। বিষয়টি নিয়ে কোরিয়ার গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু করে। আর আমাদের দেশে এ মাটির সঙ্গে মিশে থাকা বাউল গানকে কতই না রঙ মাখিয়ে রিমিক্স করা হচ্ছে। কিন্তু কেউ কি দেখার আছে? অথচ কপিরাইট আইনের বিধান শক্তিশালী ও স্বচ্ছ। কপিরাইট আইনের ধারা ২এ আছে, ‘অনুলিপি অর্থ বর্ণ, চিত্র, শব্দ বা অন্য কোনো মাধ্যমে ব্যবহার করিয়া লিখিত, শব্দ রেকর্ডিং, চলচ্চিত্র, গ্রাফিক্স চিত্র বা অন্য কোনো বস্তুগত প্রকৃতি বা ডিজিটাল সংকেত আকারে পুনরুৎপাদন (স্থির বা চলমান), দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক বা পরাবাস্তব’। অথাৎ কোনোরূপ অনুলিপির বিধান নেই বিনানুমতিতে।
বিশ্বের উন্নত দেশে মুদ্রণ ও প্রকাশনা এককভাবে সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক শিল্প বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের উপাদান বই, সংবাদপত্র, পত্রিকা, সাময়িকী ও বৈজ্ঞানিক জার্নাল। বিশ্বের প্রকাশনা শিল্পের আর্থিক মূল্য ১১৯ মিলিয়ন ডলার। বছরে বিশ্বে ১ মিলিয়ন বই ও প্রায় ৬৬০০টি সংবাদপত্র প্রতিদিন প্রকাশিত হয়। প্রতি মাসে হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ, জার্নাল, বই অনলাইনে প্রকাশিত হয়। এসব প্রকাশনার রচয়িতা, অনুবাদক, সাংবাদিক, বৈজ্ঞানিকরা সবাই তাদের সৃজন কর্মের জন্য কপিরাইটের দাবিদার। এ রচয়িতাদের রচনা কতটুকু মেধাস্বত্বের রক্ষা পাচ্ছে তা ভাববার বিষয়। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফটোকপি করে যে ‘কোর্স প্যাক’ প্রদান করা হয় তা অনুমোদিত। তাই এ ক্ষেত্রে রিপ্রোডাকশন রাইটস্ অর্গানিজেশন (চজঙঝ) নামক এক প্রকার যৌথ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান মধ্যস্থতাকারী হয়ে প্রয়োজনীয় কপিরাইট ছাড়পত্র পেতে সাহায্য করে। বর্তমানে ৫০টির মতো দেশে এ প্রতিষ্ঠানে সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কাজ করছে। এ জাতীয় তিনটি প্রতিষ্ঠান দি কপিরাইট লাইসেন্সিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সোসাইটি অব সিঙ্গাপুর লিমিটেড, দি রিপ্রোডাকশন রাইটস সোসাইটি অফ নাইজিরিয়া, দি কপিরাইট ক্লিয়ারেন্স সেন্টার অফ আমেরিকা।
আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অবস্থাও পাইরেসির কারণে নাকাল। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এম আই বি) তথ্যমতে চলতি বছর অডিও বাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ এক কোটি টাকার কম এবং রিলিজকৃত অ্যালবামের সংখ্যা শতকের ঘরে পৌঁছতে পারেনি। যার জন্য দায়ী পাইরেসি অথচ ২০০৭ সালেও এ সেক্টরে বিনিয়োগ ছিল পাঁচ কোটি টাকা এবং নতুন প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০টি। আমাদের দেশে কপিরাইট নিয়ে সচেতনতা নেই। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেনি কোনো কপিরাইট সমিতি। সারা বিশ্বময় মেধাস্বত্ব রক্ষায় বিভিন্ন সমিতি গড়ে উঠলেও আমাদের দেশে এই জাতীয় উদ্যোগ একেবারেই অনুপস্থিত। তবে বাংলাদেশে বলবৎ আইনে কপিরাইট সমিতি (ধারা ৪১-৪৭) গঠন লাইসেন্স গ্রহণের সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের টকশোনির্ভর সুশীল সমাজ মেধাস্বত্বের রক্ষায় একটা মেধাস্বত্ব সমিতিও গড়ে তুলেনি। বাংলাদেশের কপিরাইটের বিষয় দেখভাল করার একমাত্র প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটের কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি আগারগাঁয়ের ছায়াশীতল জাতীয় গ্রন্থাগারের ভেতর শীতলভাবেই কাজ করে। এই কার্যালয়ের তথ্য মতে ৩১ অক্টোবর ২০১২ তারিখ পর্যন্ত কপিরাইট আইনে রেজিস্ট্রেশনকৃত কর্মের সংখ্যা ১১৬৯৯টি (রেকর্ড কর্ম ৬৮৯, শিল্পকর্ম ৭১১০টি এবং সাহিত্যকর্ম ৩৯০০টি)। ২০১৩ সালে কপিরাইটের জন্য আবেদনকৃত ৪৯৯টি কর্মের মধ্যে ৩৭২টিকে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে। যদিও কপিরাইট অফিসে প্রয়োজনীয় জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অপ্রতুলতা রয়েছে। কপিরাইটের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন মেধাস্বত্বের রক্ষার প্রত্যয়ে উজ্জীবিত নাগরিক সমাজ। প্রয়োজন কপিরাইট অফিসের অটোমেশন। কারণ দেশের যে-কোনো প্রান্তে বসে যেন কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের যাবতীয় কাজ করা যায়, তার ব্যবস্থা ত্বরিত গ্রহণ প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত কাজে যেন ঢাকার কপিরাইট অফিসে না-আসতে হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারিভাবে কপিরাইট অফিসের জন্য ঢাকার আগারগাঁয়ে প্রাপ্ত জমিতে স্বনির্ভর কপিরাইট অফিস স্থাপন হলে এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেধাসম্পদ রক্ষার প্রধান তিনটি নিয়ামক (আইন, ব্যবস্থাপনা, আইনের প্রয়োগ) প্রয়োগ কাম্য মাত্রায় নেই। অবশ্যই মেধাস্বত্বের রক্ষণে প্রয়োজনীয় করণীয় গ্রহণের মাধ্যমে শুধু সৃজনকর্ম নয়, এ কে পণ্যে রূপান্তর করতে বিনিয়োগকৃত অর্থেরও মুনাফা নিশ্চত করা দরকার। কেননা, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গত শতাব্দী ছিল আইটির (ওঞ); আর এ শতাব্দী হবে আইপির (ওচ, ইনটেলেকচুয়াল প্রোপ্রার্টি)।
প্রযুক্তির হাওয়া বিশ্বকে এফোঁড়-ওফোঁড় করছে। প্রযুক্তির প্রভুত্ব আমরা মানতে বাধ্য। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে যেভাবে তথ্যভাণ্ডার সৃষ্টি করে ব্যবহারকারীদের দ্রুত ও সহজে হাতের নাগালে তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে লেখকের মেধাস্বত্ব নিয়ে বিশ্ব আজ চিন্তিত। প্রযুক্তির সম্প্রসারণশীল বক্তব্য হচ্ছে : ‘যা নাই ভূগোলে/ তা আছে গুগলে।’ কিন্তু প্রযুক্তিবিদরা নিজেদের ডামাডোল বাজাতে গিয়ে বেমালুম ভুলে যান- ভূগোলের জ্ঞান নিয়েই কিন্তু গুগলের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই সৃষ্টিরও মেধাস্বত্বের রক্ষণ প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তির অবারিত দ্বার খুলে দিতে গিয়ে মেধাস্বত্বের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হচ্ছে। মেধাস্বত্বের রক্ষায় আইনের মান্যতা ছাড়াও সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশ্বাসভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপন করে সৃষ্টিশীল কর্মের মর্যাদা রক্ষার বোধে মিছিলে শামিল হওয়া।
মানুষের চিন্তা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে উদ্ভাবনী মেধাসম্পদকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়- যথা : ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি (পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন); অন্যটি কপিরাইট (সাহিত্য ও শৈল্পিক কাজের পরিমণ্ডল) মানব মনের সব সৃষ্টিই মেধাসম্পদ। মানুষের সৃষ্টিশীল সব কর্মই স্রষ্টা বা মালিকের অনুমতি ছাড়া পুনরুৎপাদন, বাণিজ্যিক বা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারে স্রষ্টার অধিকারকে হরণ করা হয়। এই জন্যই কালের বিবর্তনে এবং মানুষের অধিকার সচেতনতার ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কপিরাইট ধারণার উদ্ভব হয়েছে। কপিরাইট রক্ষায় সৃষ্টিশীল মানুষের আর্থিক ও নৈতিক অধিকার প্রাপ্তির মিলিত দাবির ফলে ১৮৮৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কনভেনশনে পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন ইত্যাদি সৃষ্টিকারীদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে অগ্রগণ্য। বাংলাদেশসহ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৭৩। এ ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে বিভিন্ন দেশের মেধাস্বত্বধারীদের প্রাপ্ত অধিকারের পার্থক্য কমিয়ে এনে একটা সমন্বয় সাধন করতে ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগোসহ অন্যরা ১৮৮৬ সালে বার্ন-এ একটি কনভেনশন করে- যা বার্ন কনভেনশন নামে খ্যাত। এই কনভেনশনে স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের প্রতি অধিক দায়িত্বশীলতা দেখিয়ে এই মতে উপনীত হয়- যে কপিরাইট সুরক্ষার জন্য কোনো কর্মকে রেজিস্ট্রিকৃত হতে হবে না। যে মুহূর্তে কর্মটি সৃষ্টি হয় আপনাআপনি সেটি সে মুহূর্ত থেকে সুরক্ষা পাবে। বার্ন কনভেনশনে আরও বলা হয়- যখন সৃজনকর্ম প্রদর্শন ব্যবহার করা হবে তখন স্রষ্টার নামসহ তার স্বীকৃতি ও উপস্থাপনায় বাধ্যতামূলক। এই নৈতিক অধিকার স্রষ্টার রাইট টু-প্যাটারনিটি ও রাইট টু ইন্টেগ্রিটিকে সুরক্ষা দেয়। বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালের ৪ মে এই চুক্তি মান্য করে চলতে সম্মত হয়ে চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
বিশ্বমানবের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সুরক্ষার প্রত্যয়ে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়াইপো (WIPO, ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপ্রার্টি অর্গানাইজেশন)। বাংলাদেশ ১৯৮৫ সালে ওয়াইপোর সদস্যভুক্ত হয়। এই সংস্থার সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ১৮৪। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ রক্ষায় বিশ্বে প্রথম সুসংহত কপিরাইট আইন ‘দি স্ট্যাটিউট অব অ্যানি ১৯১০ সালে ইংল্যান্ডে প্রবর্তিত হয়। কপিরাইট নিয়ে উন্নত বিশ্ব সোচ্চার হলেও বাংলাদেশে এই শব্দটির সঙ্গেই সাধারণ মানুষের পরিচয় কম। যে দেশের মানুষ নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে অপরের স্বত্ববান সম্পদ দখলে ভ্রুক্ষেপ করে না; এমনকি রাষ্ট্রের বন-বাদাড়, নদী-নালা, দখলে-মগ্ন রাষ্ট্রের মালিক ধনলোভী একশ্রেণীর জনগোষ্ঠী সে দেশের মানুষের সুকুমার মননের সৃষ্টি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ রক্ষার তাগাদা খুব একটা অনুভব করে না।
রাষ্ট্রীয়ভাবে কপিরাইট সুরক্ষার জন্য স্বাধীনতার পর থেকে পেটেন্ট রাইট অফিস শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করতে শুরু করে। মগবাজারের একটি ভাড়া বাড়িতে কামালউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে অফিসটি চলে। ১৯৭৩ সালে সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামতের ভিত্তিতে পাকিস্তান আমলে কার্যকর ১৯৬২ সালের কপিরাইট অধ্যাদেশের কিছু ধারাকে সংশোধন করে পাকিস্তানি আমলের আঞ্চলিক পেটেন্ট রাইট অফিসকে জাতীয় পর্যায়ের একটি সংযুক্ত দফতরের দায়িত্ব দিয়ে স্থাপন করে রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটের কার্যালয়। বাংলাদেশের প্রথম কপিরাইট রেজিষ্ট্রার নুরুল আলম (কার্যকাল ১-৬-১৯৭৩ থেকে ৩-৩-১৯৭৮)। প্রথম পর্যায়ে কপিরাইট রেজিস্ট্রারের কার্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। ১৯৮৭ সালে কপিরাইট অফিস সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হয়। এরশাদ সরকারের আমলে কপিরাইট অফিস আগারগাঁওয়ের জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে কপিরাইট অফিসে লোকবল ২৯ জন (অনুমোদিত লোকবল ৪৯ জন)। বাংলাদেশে বলবৎ কপিরাইট আইন ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত ১৭টি অধ্যায় ও ১০৫টি ধারা বিদ্যামান)-এর বিধান মতে কপিরাইট অফিস একটি আধা বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান। যথার্থ আইন ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ হরণের বিপরীতে প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ রক্ষায় তদারককারী আন্তর্জাতিক সংস্থার (যেমন : UNESCO, WIPO, WTO) সদস্য বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন দেশের কপিরাইট সুরক্ষার জন্য যে সব কনভেনশন হয়েছে বাংলাদেশ অধিকাংশ কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে (যেমন প্যারিস কনভেনশন ১৮৮৩, বার্ন কনভেনশন ১৮৮৬, ইউনিভার্সেল কপিরাইট কনভেনশন ট্রিপস ১৯৯৪,) সব কিছুর পরেও এ দেশে সচেতনতার অভাবে কপিরাইট রক্ষার আন্দোলন উপেক্ষিত। কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করে পাইরেসির মাধ্যমে আমাদের সৃজনশীল কর্ম বিশেষত বইয়ের বাজার আজ এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। পাইরেসি শুধু সৃজনকর্মের স্রষ্টার আর্থিক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে না, নতুন কর্ম সৃষ্টিতেও উদ্যম, উৎসাহ ও সামর্থ্যকে হ্রাস করছে। কপিরাইট লঙ্ঘনজনিত অপরাধ, অপরাধের প্রকৃতি এবং তার বিপরীতে শাস্তির বিধানের বর্ণনা রয়েছে। এক্ষেত্রে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। দেওয়ানি আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা ক্ষতিপূরণ আদায়, ফৌজদারি আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা সংক্রান্ত শাস্তির বিধান রয়েছে (ধারা-৭৫-৮১)। কিন্তু অনুমোদনবিহীন প্রকাশনার বা পাইরেসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেন রেকর্ড গড়েছে।
ঢাকার নীলক্ষেতের বইয়ের বাজারে কোন বই, কে লেখক, কে প্রকাশক ইত্যাদি এখানকার বই উৎপাদকদের কাছে কোনো বিচার্য বিষয় নয়। মূল্যায়নের বিষয় হচ্ছে বইটি পুনরুৎপাদন হলে বাজারে চাহিদা কত বা কস্ট বেনিফিট এনালাইসিজে উৎপাদিত বইয়ের বাজার ইতিবাচক কী না। এখানে সিন্ডিকেট করে, গ্র“প করে পাইরেটেড বই প্রকাশ হয়। পাইরেটেড বই প্রকাশের ক্ষেত্রে বিভাজন আছে, অর্থাৎ সৃজনশীল বই, কম্পিউটার বিষয়ক বই, ডাক্তারি বই কারা প্রকাশ করবে তা সুনির্দিষ্ট। নীলক্ষেত বাজারে পাইরেসি বই উৎপাদক চক্র এতটাই সংঘবদ্ধ যে উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা দেখে মনে হবে যেন এ এক সুচারু সৃজনশীল কর্ম। এক্ষেত্রে আইনের বিধানের কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে বলে তাদের কাছে মনে হয় না। নীলক্ষেতে বই বিক্রেতাদের কাছে এসব পাইরেসি বই বিক্রি অন্যায় ও অনৈতিক বলতে গেলে বিক্রেতারা পাল্টা বলে- ‘এসব নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। কম পয়সায় পায় ক্রেতা, প্রয়োজন মিটে যায়- এ পর্যন্তই। আর আমাদের এসব নিয়ে এত ভাববার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বইয়ের পাইকারি বাজার বাংলাবাজারেও পাইরেসি নিয়ে দেন-দরবার করে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। ঢাকার বাইরের বইয়ের বাজারও পাইরেটেড বইয়ে সয়লাব।
সরকারের কপিরাইট আইন, এই আইনের অধীনে কপিরাইট টাস্কফোর্স আছে। অভাব, যথার্থ আন্তরিকতা ও উদ্দীপ্ত দায়িত্ববোধের। আমরা মনে করি কপিরাইট লঙ্ঘনকারীরা জ্ঞাতসারে এই কাজটি করে। তাই সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে হেদায়েতের আলো দিলেই চলবে না, প্রয়োজন আইনের যথার্থ প্রয়োগের। এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, কপিরাইট টাস্কফোর্স ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত মাত্র ৯টি অভিযান পরিচালনা করেছে, যা নিতান্তই কম। কপিরাইট আইনের ৯৩(১) ধারায় সাব-ইন্সপেক্টরের নিুতর পদাধিকারী নন এমন যে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই পাইরেসি সংক্রান্ত কর্মের সব অনুলিপি বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী এবং অনুলিপি তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সব প্লেট বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী যেখানেই পাওয়া যাক তা জব্দ করতে পারেন। ৯৯ ধারায় কপিরাইট রেজিস্ট্রারকে দেওয়ানি আদালতের অনুরূপ কিছু ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। কপিরাইট অফিস আরও আন্তরিক হলে বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে থেকেও অনেক করতে পারে।
আজকাল বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত অনেক বই বাজারে আসার দু’চার দিন পরই কোনো কোনো ওয়েবসাইটে দেয়া হয় লেখক বা প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকে, মেধাস্বত্বকে বুড়ো আঙুল প্রদর্শন করে!
বাংলাদেশে বলবৎ কপিরাইট আইনে সৃজনশীল কর্মের স্রষ্টার মৃত্যুর পর ৬০ বছর কপিরাইটের দাবিদার থাকে। এই সময়সীমা পার হলে সৃষ্টিকর্মের স্বত্ব পাবলিক ডমেইন-এ চলে আসে। এ সময় এ সৃষ্টকর্মকে জনসম্পদ বলা যায়। অর্থাৎ সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তবে কপিরাইটের সময়সীমা পার হলেও সৃজনশীল কর্মের প্রতি অর্থনৈতিক প্রাপ্তির অধিকারের দাবি অগ্রাহ্য হলেও সৃষ্টার সৃজনকর্মের উপর নৈতিক অধিকার চিরকাল বহমান থাকে। তাই এরিস্টটল, প্লেটো কিংবা সক্রেটিসের বই চিরকাল রচয়িতা হিসেবে তাদের নামেই নামাঙ্কিত থাকবে।
উন্নত বিশ্ব মেধাস্বত্বের বিষয়ে সচেতন এবং এ অধিকার রক্ষায় আইনের বিধি-বিধান ও তার প্রতিপালনে দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠাবান। পাইরেসি বা কপিরাইট ভঙ্গকারীদের তারা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। উদাহরণস্বরূপ বলতে হয়- সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার এক তরুণ না বুঝে একটা গান অনুমতি না নিয়ে ডাউন লোড করে। বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশের আতঙ্কে ছেলেটি আÍহত্যা করে বলে জানা যায়। বিষয়টি নিয়ে কোরিয়ার গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু করে। আর আমাদের দেশে এ মাটির সঙ্গে মিশে থাকা বাউল গানকে কতই না রঙ মাখিয়ে রিমিক্স করা হচ্ছে। কিন্তু কেউ কি দেখার আছে? অথচ কপিরাইট আইনের বিধান শক্তিশালী ও স্বচ্ছ। কপিরাইট আইনের ধারা ২এ আছে, ‘অনুলিপি অর্থ বর্ণ, চিত্র, শব্দ বা অন্য কোনো মাধ্যমে ব্যবহার করিয়া লিখিত, শব্দ রেকর্ডিং, চলচ্চিত্র, গ্রাফিক্স চিত্র বা অন্য কোনো বস্তুগত প্রকৃতি বা ডিজিটাল সংকেত আকারে পুনরুৎপাদন (স্থির বা চলমান), দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক বা পরাবাস্তব’। অথাৎ কোনোরূপ অনুলিপির বিধান নেই বিনানুমতিতে।
বিশ্বের উন্নত দেশে মুদ্রণ ও প্রকাশনা এককভাবে সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক শিল্প বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের উপাদান বই, সংবাদপত্র, পত্রিকা, সাময়িকী ও বৈজ্ঞানিক জার্নাল। বিশ্বের প্রকাশনা শিল্পের আর্থিক মূল্য ১১৯ মিলিয়ন ডলার। বছরে বিশ্বে ১ মিলিয়ন বই ও প্রায় ৬৬০০টি সংবাদপত্র প্রতিদিন প্রকাশিত হয়। প্রতি মাসে হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ, জার্নাল, বই অনলাইনে প্রকাশিত হয়। এসব প্রকাশনার রচয়িতা, অনুবাদক, সাংবাদিক, বৈজ্ঞানিকরা সবাই তাদের সৃজন কর্মের জন্য কপিরাইটের দাবিদার। এ রচয়িতাদের রচনা কতটুকু মেধাস্বত্বের রক্ষা পাচ্ছে তা ভাববার বিষয়। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফটোকপি করে যে ‘কোর্স প্যাক’ প্রদান করা হয় তা অনুমোদিত। তাই এ ক্ষেত্রে রিপ্রোডাকশন রাইটস্ অর্গানিজেশন (চজঙঝ) নামক এক প্রকার যৌথ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান মধ্যস্থতাকারী হয়ে প্রয়োজনীয় কপিরাইট ছাড়পত্র পেতে সাহায্য করে। বর্তমানে ৫০টির মতো দেশে এ প্রতিষ্ঠানে সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কাজ করছে। এ জাতীয় তিনটি প্রতিষ্ঠান দি কপিরাইট লাইসেন্সিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সোসাইটি অব সিঙ্গাপুর লিমিটেড, দি রিপ্রোডাকশন রাইটস সোসাইটি অফ নাইজিরিয়া, দি কপিরাইট ক্লিয়ারেন্স সেন্টার অফ আমেরিকা।
আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অবস্থাও পাইরেসির কারণে নাকাল। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এম আই বি) তথ্যমতে চলতি বছর অডিও বাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ এক কোটি টাকার কম এবং রিলিজকৃত অ্যালবামের সংখ্যা শতকের ঘরে পৌঁছতে পারেনি। যার জন্য দায়ী পাইরেসি অথচ ২০০৭ সালেও এ সেক্টরে বিনিয়োগ ছিল পাঁচ কোটি টাকা এবং নতুন প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০টি। আমাদের দেশে কপিরাইট নিয়ে সচেতনতা নেই। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেনি কোনো কপিরাইট সমিতি। সারা বিশ্বময় মেধাস্বত্ব রক্ষায় বিভিন্ন সমিতি গড়ে উঠলেও আমাদের দেশে এই জাতীয় উদ্যোগ একেবারেই অনুপস্থিত। তবে বাংলাদেশে বলবৎ আইনে কপিরাইট সমিতি (ধারা ৪১-৪৭) গঠন লাইসেন্স গ্রহণের সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের টকশোনির্ভর সুশীল সমাজ মেধাস্বত্বের রক্ষায় একটা মেধাস্বত্ব সমিতিও গড়ে তুলেনি। বাংলাদেশের কপিরাইটের বিষয় দেখভাল করার একমাত্র প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটের কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি আগারগাঁয়ের ছায়াশীতল জাতীয় গ্রন্থাগারের ভেতর শীতলভাবেই কাজ করে। এই কার্যালয়ের তথ্য মতে ৩১ অক্টোবর ২০১২ তারিখ পর্যন্ত কপিরাইট আইনে রেজিস্ট্রেশনকৃত কর্মের সংখ্যা ১১৬৯৯টি (রেকর্ড কর্ম ৬৮৯, শিল্পকর্ম ৭১১০টি এবং সাহিত্যকর্ম ৩৯০০টি)। ২০১৩ সালে কপিরাইটের জন্য আবেদনকৃত ৪৯৯টি কর্মের মধ্যে ৩৭২টিকে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে। যদিও কপিরাইট অফিসে প্রয়োজনীয় জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অপ্রতুলতা রয়েছে। কপিরাইটের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন মেধাস্বত্বের রক্ষার প্রত্যয়ে উজ্জীবিত নাগরিক সমাজ। প্রয়োজন কপিরাইট অফিসের অটোমেশন। কারণ দেশের যে-কোনো প্রান্তে বসে যেন কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের যাবতীয় কাজ করা যায়, তার ব্যবস্থা ত্বরিত গ্রহণ প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত কাজে যেন ঢাকার কপিরাইট অফিসে না-আসতে হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারিভাবে কপিরাইট অফিসের জন্য ঢাকার আগারগাঁয়ে প্রাপ্ত জমিতে স্বনির্ভর কপিরাইট অফিস স্থাপন হলে এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেধাসম্পদ রক্ষার প্রধান তিনটি নিয়ামক (আইন, ব্যবস্থাপনা, আইনের প্রয়োগ) প্রয়োগ কাম্য মাত্রায় নেই। অবশ্যই মেধাস্বত্বের রক্ষণে প্রয়োজনীয় করণীয় গ্রহণের মাধ্যমে শুধু সৃজনকর্ম নয়, এ কে পণ্যে রূপান্তর করতে বিনিয়োগকৃত অর্থেরও মুনাফা নিশ্চত করা দরকার। কেননা, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গত শতাব্দী ছিল আইটির (ওঞ); আর এ শতাব্দী হবে আইপির (ওচ, ইনটেলেকচুয়াল প্রোপ্রার্টি)।
প্রযুক্তির হাওয়া বিশ্বকে এফোঁড়-ওফোঁড় করছে। প্রযুক্তির প্রভুত্ব আমরা মানতে বাধ্য। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে যেভাবে তথ্যভাণ্ডার সৃষ্টি করে ব্যবহারকারীদের দ্রুত ও সহজে হাতের নাগালে তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে লেখকের মেধাস্বত্ব নিয়ে বিশ্ব আজ চিন্তিত। প্রযুক্তির সম্প্রসারণশীল বক্তব্য হচ্ছে : ‘যা নাই ভূগোলে/ তা আছে গুগলে।’ কিন্তু প্রযুক্তিবিদরা নিজেদের ডামাডোল বাজাতে গিয়ে বেমালুম ভুলে যান- ভূগোলের জ্ঞান নিয়েই কিন্তু গুগলের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই সৃষ্টিরও মেধাস্বত্বের রক্ষণ প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তির অবারিত দ্বার খুলে দিতে গিয়ে মেধাস্বত্বের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হচ্ছে। মেধাস্বত্বের রক্ষায় আইনের মান্যতা ছাড়াও সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশ্বাসভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপন করে সৃষ্টিশীল কর্মের মর্যাদা রক্ষার বোধে মিছিলে শামিল হওয়া।
No comments