রূপনগর by শওকত চৌধুরী
মিলনের
প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে বদমাশটার গালে একটা ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতে।
বদমাশটা আর কেউ নয় তার ছোট ভাই রঞ্জু। বদমাশটা বলছে কি-না সে দোকানে যেতে
পারবে না। পারবে না কী জন্য? পার্টি কি সে নিজে করে?
মিলন চড়-থাপড়ের দিকে গেল না। এখন মাথা গরম করলে হবে না। যখন সময় খুব অস্থির থাকে তখন মাথা সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা রাখতে হয়। তার চেয়ে বড় ব্যাপার তার এখন প্রচণ্ড সিগারেটের তৃষ্ণা পাচ্ছে। এই তৃষ্ণা বেশিক্ষণ বুকে চেপে রাখা ঠিক হবে না। তার উচিত এখন রঞ্জুকে কাঁধে হাত রেখে অনুরোধ করে বলা।
রঞ্জু?
জি।
যাবি আর আসবি। এখান থেকে বাবুলের দোকানে যেতে কতক্ষণ লাগে? বড়জোর পাঁচ মিনিট! এক প্যাকেট সিগারেট এনে দিবি- দুশ টাকা বখশিশ পাবি। তুই না আমার ভাই!
রঞ্জু কোনো কথা বলল না। তার হাতের আঙুলগুলো এখন কাঁপছে। কপালে এবং সদ্য ফিনফিনে গজিয়ে ওঠা গোঁফের জায়গায় ঘাম জেগে উঠেছে।
রঞ্জু? অ্যাই রঞ্জু? তুই কী ভয় পাচ্ছিস? তুই ভীতু ধরনের মুখ করেছিস কেন? রঞ্জু?
রঞ্জু শুধু ভয়ই পাচ্ছে না। তার কান্নাও পাচ্ছে। বাবুলের দোকানের সামনে কয়েকটা ছেলে সবসময় টুলের উপর বসে থাকে। তারা তাকে দেখলেই মিলনের কথা জানতে চায়। শুধু মিলনের কথা নয়, তারা প্রায় তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করে। তাদের মধ্যে যার নাম নুরুল, রোগা পাতলা মতো, সে প্রায় তার প্যান্টের জিপার ধরে টান দিতে চায়। এটা কোন ধরনের মজা কে জানে! সেদিন সে বাবুলের দোকানে মশার কয়েল আনতে গিয়েছিল। নুরুল ছিল টুলের উপর শোয়া। তার শিয়রে বসে চা খাচ্ছিল অন্য একজন। তার নাম গেনু।
গেনু বলল- রঞ্জু না?
রঞ্জু কোনো উত্তর করল না। সে প্রায় দৃষ্টিশূন্য হয়ে চারপাশটা দেখতে থাকল। চারপাশে সব মিলে জনাকুড়ি মানুষ।
অ্যাই বড় ভাইরা কথা বললে উত্তর দিস না কেন? কিসে পড়িস তুই?
নাইনে।
নুরুল শোয়া থেকে উঠল না। সে শুয়ে শুয়ে পা নাচাতে থাকল।
বদি মাস্টারের মেয়ে সঙ্গে পড়ে। উত্তরমুখীতে।
রঞ্জু কিছুই বুঝতে পারল না। কীভাবে বদি মাস্টারের মেয়ের বিষয়টা চলে এলো- সেটাও সে ধরতে পারল না।
জিজ্ঞেস করল গেনু বদির মেয়ে কোন গ্র“পে পড়ে।
গেনু মুখ থেকে চায়ের কাপ নামাল।
মেয়েটা কোন গ্র“পে?
সাইন্সে।
তুই?
রঞ্জুর প্রায় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো।
সাইন্সে।
অ্যাই খেলা, না?
রঞ্জুর হাত-পা থর থর করে কাঁপছে। অ্যাই খেলা না-- কথার অর্থ কী? বদি মাস্টারের মেয়ে নতুন এই স্কুলে এসেছে। তার সঙ্গে এখনও তার দু-চারটার বেশি কথা হয়নি। কিন্তু এই লোকগুলো কি তার এই কথাটা বিশ্বাস করবে?
নুরুল উঠে বসল। তার মুখ কঠিন।
এদিকে আয়।
রঞ্জু ভয়ে ভয়ে কাছে গেল।
কী কিনবি?
মশার কয়েল।
চা খাবি?
রঞ্জুর বুকের ভেতরটায় আতংকে বমি বমি ভাব জেগে উঠল। এই লোকটা তাকে চা খেতে বলছে! লোকটা তাকে চা খেতে বলছে কেন?
একটা চা খাও সোনা! বদি মাস্টারের মেয়ের সঙ্গে পড়- একটু চা না খেলে হয়! প্লিজ, খাও!
পরের ঘটনা আর রঞ্জুর মনে নেই। তার মনে হল সে প্রায় হঠাৎ করেই দৃষ্টি শূন্য হয়ে গেছে। চারপাশের লোকজন কাউকেই সে আর দেখতে পাচ্ছে না। গলার ঘাম নেমে বুকের গেঞ্জির একটা অংশ ভিজে গেছে। এর ভেতর সে একবার খেয়াল করল- লোকটা তার প্যান্টের জিপার একবার উঠানো এবং একবার নামানো ধরনের অদ্ভুত একটা খেলা করছে। আর এক দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করছে- চায়ে কয় চামচ চিনি লাগবে আপনার? দু’চামচে হবে? বেশি সুগার খাবেন না সোনা! ডায়াবেটিসে পড়বেন! বুঝতে পেরেছেন?
সেদিন রাতে রঞ্জুর শরীরে জেঁকে জ্বর এলো। সে বাসায় কাউকে কিছু বলল না। সামনে তার পরীক্ষা। তারপরও তাকে সকাল সকাল পড়ার টেবিল থেকে উঠে পড়তে হল। মোটা দুটো চাদর গায়ে জড়িয়ে যখন সে শুতে গেল- তখন মাত্র রাত এগারটা। রাত এগারটায় কারও ঘুম গাঢ় হয় না। রঞ্জুর হল। ঘুম গাঢ় হওয়ার কারণেই কিনা সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নটা টিনাকে নিয়ে। স্বপ্নে টিনা খুব অবাক হয়ে বলছে- এই ছেলে তুমি আমার সঙ্গে কথা বল না কেন?
রঞ্জু কী বলবে খুঁজে পেল না। অনেকক্ষণ পর সে বলল- তুমি সেকশন সি-তে আর আমি এ-তে।
আমার তো মনে হয় তুমি আমাকে লজ্জা পাও। লজ্জা পাও কেন?
রঞ্জু আবারও কী বলবে বুঝতে পারল না।
তোমাকে নাকি গেনুরা ধরেছে? ধরে নাকি জিপার টানাটানি করেছে?
রঞ্জুর কান লাল হয়ে উঠল। এ ঘটনা তো টিনার জানার কথা নয়। টিনা জানল কী করে!
কোক খাবে?
রঞ্জু একবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ নীল হয়ে আছে। আজ কয়েক দিন ধরে বেশ রোদ হচ্ছে। প্রচণ্ড রোদ।
এটা খাও।
রঞ্জু খেয়াল করল অর্ধেক খাওয়া কোকের ক্যানটা টিনা তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। কী আশ্চর্য সে কি টিনার মুখে লাগা কোকটা খাবে?
কী ব্যাপার নাওনা কেন? আমার মুখে লাগা জিনিস খেতে তোমার সমস্যা আছে?
এমন সময় রঞ্জুর ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুমের ভেতর তার তীব্র পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল। সে পাগলের মতো বিছানার পাশে রাখা পানির জগটা খুঁজতে শুরু করল।
২.
আজ বাবুলের দোকানে লোক সমাগম কম।
সম্প্রতি গেনুরা একটা মোটর সাইকেল কিনেছে। জাপানের তৈরি। মোটরসাইকেলের আয়নার দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছে নুরুল। আয়নায় তাকিয়ে সিগারেট টানার অর্থ কী কে জানে। ভয়ংকর কিছু?
রঞ্জু বলল- বাবুল ভাই এক প্যাকেট সিগারেট।
কোনটা?
গোল্ডলিফ।
আর কিছু?
না।
তুমি তো প্রায় মশার কয়েল কেন। কয়েল দেব?
জি না বাবুল ভাই।
সিগারেটের টাকা পরিশোধ করার সময় রঞ্জু খেয়াল করল তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নুরুল।
কিরে উত্তরমুখী, খবর কী?
রঞ্জু কিছু বলল না।
তোর ভাইজান কোথায়?
ভাইয়া বাসায় নেই।
কোথায় গেছে?
রঞ্জুর বুকটা ধক করে উঠল। লোকটা তার হাতের সিগারেটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লোকটা কি তাহলে সে যে মিথ্যা বলছে সেটা বুঝে ফেলেছে?
কোথায় গেছে বললি না?
আমি জানি না।
লোকটা শক্ত করে রঞ্জুর কাঁধটা চেপে ধরল।
চালাক হয়ে গেছিস তাই না? এমন একটা ‘চাপ’ দেব মুখ দিয়ে ভক করে রক্ত বের হয়ে আসবে। উত্তরমুখীর বাচ্চা উত্তরমুখী, যা এখান থেকে!
পাশ থেকে গেনু বলল- যাস না ক্যান? দৌড় দে!
রঞ্জু দৌড়াল না। সে মাথা নিচু করে এক পা এক পা ঘরের দিকে এগুতে থাকল বাসার দিকে।
কোনো এক বিচিত্র কারণে রঞ্জু উত্তরমুখী স্কুলের কাছে এসে একবার দাঁড়াল। স্কুলের পেছনের দিকে কবুতরের জন্য কয়েকটা কাঠের তৈরি ঘর করা হয়েছে। সে ঘরগুলোতে এখন আর কোনো কবুতর নেই। কারা যেন সব কবুতর জবাই করে খেয়ে ফেলেছে। রঞ্জু অনেকক্ষণ ধরে কবুতরের ঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। সবচেয়ে ডান পাশের যে ঘরটা- সেখানে একটা সাদা কবুতর থাকত। ওটাকে সে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত। পাউরুটির টুকরো হাতে নিলে ওটা উড়ে আসত হাতে। বিচিত্র একটা আওয়াজ করতে করতে পাউরুটি খেত। রঞ্জুর কেন হঠাৎ করে এই স্মৃতিগুলো মনে পড়ল- কে জানে।
৩.
আজ সকাল থেকেই বেশ শীত পড়ছে। ঘাসের উপর নরম হয়ে ছড়িয়ে আছে রোদ। শিখাকে সকাল সকাল কলেজের উদ্দেশে বের হতে হয়েছে। অবশ্য শিখা একা বের হয়নি। তার সঙ্গে রঞ্জুও আছে। সে রঞ্জুর একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে। রঞ্জুর হাতটা ধরে থাকলে একটু ভরসা লাগে।
গলির পথটা পেরুনোর পর হঠাৎ রঞ্জু বলল- ভাইয়া আর আসবে না, তাই না আপা?
কে বলল তোকে? আসবে। অবশ্যই আসবে।
তুমি কীভাবে জানো ভাইয়া আসবে?
শিখা কোনো উত্তর করল না।
টিনা বলেছে এই শহরে যারা একবার হারিয়ে যায় তারা আর আসে না।
শিখা আবারও কিছু বলল না।
ভাইয়াকে ওরা মেরে ফেলেছে, তাই না আপা?
শিখা দাঁড়িয়ে পড়ল। রঞ্জু কী তাহলে এখনও বিশ্বাস করে মিলন এক দিন ফিরে আসবে?
আজ তিন মাস হয়ে গেল! ওরা কি আমাদেরও মেরে ফেলবে আপা?
শিখা কোনো কথার উত্তর করল না। সে খেয়াল করল রঞ্জুর চোখগুলো ভারী হয়ে আসছে। সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ডলছে।
৪.
বাবুলের দোকান পর্যন্ত ওরা আর কোনো কথা বলল না। বাবুলের দোকানের বাম পাশে ইউক্যালিপটাসের গাছটার নিচে এসে রঞ্জু প্রায় থমকে দাঁড়াল।
শিখা বলল- কী হয়েছে রঞ্জু?
রঞ্জু কোনো কথা বলল না। তাদের সামনে দুটো ছেলে বিপরীত মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত মোটরসাইকেলের আয়নায় তাদের দেখার চেষ্টা করছে। শিখা রঞ্জুর হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল। আচ্ছা ছেলেগুলো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কেন? তারা কি এখন যে কোনো সময় শিখার দিকে এগিয়ে আসবে? শিখার দিকে এগিয়ে এসে কী করবে? শরীরের সঙ্গে শরীর লাগিয়ে বিশ্রী ভঙ্গিতে বলবে- একটা উপহার দিতাম! সাইজটা তো বললেন না?
শিখার গলা শুকিয়ে আসছে। তাদের এখন খুব দ্রুত পা চালানো উচিত।
শিখা এবং রঞ্জু এখন প্রায় দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন পথ শেষ হচ্ছে না। আচ্ছা বাবুলের ছোট্ট দোকানটা পার হতে তাদের এত সময় লাগছে কেন?
তারা কি কোনো দিনই বাবুলের দোকানটা পার হতে পারবে না?
মিলন চড়-থাপড়ের দিকে গেল না। এখন মাথা গরম করলে হবে না। যখন সময় খুব অস্থির থাকে তখন মাথা সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা রাখতে হয়। তার চেয়ে বড় ব্যাপার তার এখন প্রচণ্ড সিগারেটের তৃষ্ণা পাচ্ছে। এই তৃষ্ণা বেশিক্ষণ বুকে চেপে রাখা ঠিক হবে না। তার উচিত এখন রঞ্জুকে কাঁধে হাত রেখে অনুরোধ করে বলা।
রঞ্জু?
জি।
যাবি আর আসবি। এখান থেকে বাবুলের দোকানে যেতে কতক্ষণ লাগে? বড়জোর পাঁচ মিনিট! এক প্যাকেট সিগারেট এনে দিবি- দুশ টাকা বখশিশ পাবি। তুই না আমার ভাই!
রঞ্জু কোনো কথা বলল না। তার হাতের আঙুলগুলো এখন কাঁপছে। কপালে এবং সদ্য ফিনফিনে গজিয়ে ওঠা গোঁফের জায়গায় ঘাম জেগে উঠেছে।
রঞ্জু? অ্যাই রঞ্জু? তুই কী ভয় পাচ্ছিস? তুই ভীতু ধরনের মুখ করেছিস কেন? রঞ্জু?
রঞ্জু শুধু ভয়ই পাচ্ছে না। তার কান্নাও পাচ্ছে। বাবুলের দোকানের সামনে কয়েকটা ছেলে সবসময় টুলের উপর বসে থাকে। তারা তাকে দেখলেই মিলনের কথা জানতে চায়। শুধু মিলনের কথা নয়, তারা প্রায় তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করে। তাদের মধ্যে যার নাম নুরুল, রোগা পাতলা মতো, সে প্রায় তার প্যান্টের জিপার ধরে টান দিতে চায়। এটা কোন ধরনের মজা কে জানে! সেদিন সে বাবুলের দোকানে মশার কয়েল আনতে গিয়েছিল। নুরুল ছিল টুলের উপর শোয়া। তার শিয়রে বসে চা খাচ্ছিল অন্য একজন। তার নাম গেনু।
গেনু বলল- রঞ্জু না?
রঞ্জু কোনো উত্তর করল না। সে প্রায় দৃষ্টিশূন্য হয়ে চারপাশটা দেখতে থাকল। চারপাশে সব মিলে জনাকুড়ি মানুষ।
অ্যাই বড় ভাইরা কথা বললে উত্তর দিস না কেন? কিসে পড়িস তুই?
নাইনে।
নুরুল শোয়া থেকে উঠল না। সে শুয়ে শুয়ে পা নাচাতে থাকল।
বদি মাস্টারের মেয়ে সঙ্গে পড়ে। উত্তরমুখীতে।
রঞ্জু কিছুই বুঝতে পারল না। কীভাবে বদি মাস্টারের মেয়ের বিষয়টা চলে এলো- সেটাও সে ধরতে পারল না।
জিজ্ঞেস করল গেনু বদির মেয়ে কোন গ্র“পে পড়ে।
গেনু মুখ থেকে চায়ের কাপ নামাল।
মেয়েটা কোন গ্র“পে?
সাইন্সে।
তুই?
রঞ্জুর প্রায় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো।
সাইন্সে।
অ্যাই খেলা, না?
রঞ্জুর হাত-পা থর থর করে কাঁপছে। অ্যাই খেলা না-- কথার অর্থ কী? বদি মাস্টারের মেয়ে নতুন এই স্কুলে এসেছে। তার সঙ্গে এখনও তার দু-চারটার বেশি কথা হয়নি। কিন্তু এই লোকগুলো কি তার এই কথাটা বিশ্বাস করবে?
নুরুল উঠে বসল। তার মুখ কঠিন।
এদিকে আয়।
রঞ্জু ভয়ে ভয়ে কাছে গেল।
কী কিনবি?
মশার কয়েল।
চা খাবি?
রঞ্জুর বুকের ভেতরটায় আতংকে বমি বমি ভাব জেগে উঠল। এই লোকটা তাকে চা খেতে বলছে! লোকটা তাকে চা খেতে বলছে কেন?
একটা চা খাও সোনা! বদি মাস্টারের মেয়ের সঙ্গে পড়- একটু চা না খেলে হয়! প্লিজ, খাও!
পরের ঘটনা আর রঞ্জুর মনে নেই। তার মনে হল সে প্রায় হঠাৎ করেই দৃষ্টি শূন্য হয়ে গেছে। চারপাশের লোকজন কাউকেই সে আর দেখতে পাচ্ছে না। গলার ঘাম নেমে বুকের গেঞ্জির একটা অংশ ভিজে গেছে। এর ভেতর সে একবার খেয়াল করল- লোকটা তার প্যান্টের জিপার একবার উঠানো এবং একবার নামানো ধরনের অদ্ভুত একটা খেলা করছে। আর এক দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করছে- চায়ে কয় চামচ চিনি লাগবে আপনার? দু’চামচে হবে? বেশি সুগার খাবেন না সোনা! ডায়াবেটিসে পড়বেন! বুঝতে পেরেছেন?
সেদিন রাতে রঞ্জুর শরীরে জেঁকে জ্বর এলো। সে বাসায় কাউকে কিছু বলল না। সামনে তার পরীক্ষা। তারপরও তাকে সকাল সকাল পড়ার টেবিল থেকে উঠে পড়তে হল। মোটা দুটো চাদর গায়ে জড়িয়ে যখন সে শুতে গেল- তখন মাত্র রাত এগারটা। রাত এগারটায় কারও ঘুম গাঢ় হয় না। রঞ্জুর হল। ঘুম গাঢ় হওয়ার কারণেই কিনা সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নটা টিনাকে নিয়ে। স্বপ্নে টিনা খুব অবাক হয়ে বলছে- এই ছেলে তুমি আমার সঙ্গে কথা বল না কেন?
রঞ্জু কী বলবে খুঁজে পেল না। অনেকক্ষণ পর সে বলল- তুমি সেকশন সি-তে আর আমি এ-তে।
আমার তো মনে হয় তুমি আমাকে লজ্জা পাও। লজ্জা পাও কেন?
রঞ্জু আবারও কী বলবে বুঝতে পারল না।
তোমাকে নাকি গেনুরা ধরেছে? ধরে নাকি জিপার টানাটানি করেছে?
রঞ্জুর কান লাল হয়ে উঠল। এ ঘটনা তো টিনার জানার কথা নয়। টিনা জানল কী করে!
কোক খাবে?
রঞ্জু একবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ নীল হয়ে আছে। আজ কয়েক দিন ধরে বেশ রোদ হচ্ছে। প্রচণ্ড রোদ।
এটা খাও।
রঞ্জু খেয়াল করল অর্ধেক খাওয়া কোকের ক্যানটা টিনা তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। কী আশ্চর্য সে কি টিনার মুখে লাগা কোকটা খাবে?
কী ব্যাপার নাওনা কেন? আমার মুখে লাগা জিনিস খেতে তোমার সমস্যা আছে?
এমন সময় রঞ্জুর ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুমের ভেতর তার তীব্র পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল। সে পাগলের মতো বিছানার পাশে রাখা পানির জগটা খুঁজতে শুরু করল।
২.
আজ বাবুলের দোকানে লোক সমাগম কম।
সম্প্রতি গেনুরা একটা মোটর সাইকেল কিনেছে। জাপানের তৈরি। মোটরসাইকেলের আয়নার দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছে নুরুল। আয়নায় তাকিয়ে সিগারেট টানার অর্থ কী কে জানে। ভয়ংকর কিছু?
রঞ্জু বলল- বাবুল ভাই এক প্যাকেট সিগারেট।
কোনটা?
গোল্ডলিফ।
আর কিছু?
না।
তুমি তো প্রায় মশার কয়েল কেন। কয়েল দেব?
জি না বাবুল ভাই।
সিগারেটের টাকা পরিশোধ করার সময় রঞ্জু খেয়াল করল তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নুরুল।
কিরে উত্তরমুখী, খবর কী?
রঞ্জু কিছু বলল না।
তোর ভাইজান কোথায়?
ভাইয়া বাসায় নেই।
কোথায় গেছে?
রঞ্জুর বুকটা ধক করে উঠল। লোকটা তার হাতের সিগারেটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লোকটা কি তাহলে সে যে মিথ্যা বলছে সেটা বুঝে ফেলেছে?
কোথায় গেছে বললি না?
আমি জানি না।
লোকটা শক্ত করে রঞ্জুর কাঁধটা চেপে ধরল।
চালাক হয়ে গেছিস তাই না? এমন একটা ‘চাপ’ দেব মুখ দিয়ে ভক করে রক্ত বের হয়ে আসবে। উত্তরমুখীর বাচ্চা উত্তরমুখী, যা এখান থেকে!
পাশ থেকে গেনু বলল- যাস না ক্যান? দৌড় দে!
রঞ্জু দৌড়াল না। সে মাথা নিচু করে এক পা এক পা ঘরের দিকে এগুতে থাকল বাসার দিকে।
কোনো এক বিচিত্র কারণে রঞ্জু উত্তরমুখী স্কুলের কাছে এসে একবার দাঁড়াল। স্কুলের পেছনের দিকে কবুতরের জন্য কয়েকটা কাঠের তৈরি ঘর করা হয়েছে। সে ঘরগুলোতে এখন আর কোনো কবুতর নেই। কারা যেন সব কবুতর জবাই করে খেয়ে ফেলেছে। রঞ্জু অনেকক্ষণ ধরে কবুতরের ঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। সবচেয়ে ডান পাশের যে ঘরটা- সেখানে একটা সাদা কবুতর থাকত। ওটাকে সে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত। পাউরুটির টুকরো হাতে নিলে ওটা উড়ে আসত হাতে। বিচিত্র একটা আওয়াজ করতে করতে পাউরুটি খেত। রঞ্জুর কেন হঠাৎ করে এই স্মৃতিগুলো মনে পড়ল- কে জানে।
৩.
আজ সকাল থেকেই বেশ শীত পড়ছে। ঘাসের উপর নরম হয়ে ছড়িয়ে আছে রোদ। শিখাকে সকাল সকাল কলেজের উদ্দেশে বের হতে হয়েছে। অবশ্য শিখা একা বের হয়নি। তার সঙ্গে রঞ্জুও আছে। সে রঞ্জুর একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে। রঞ্জুর হাতটা ধরে থাকলে একটু ভরসা লাগে।
গলির পথটা পেরুনোর পর হঠাৎ রঞ্জু বলল- ভাইয়া আর আসবে না, তাই না আপা?
কে বলল তোকে? আসবে। অবশ্যই আসবে।
তুমি কীভাবে জানো ভাইয়া আসবে?
শিখা কোনো উত্তর করল না।
টিনা বলেছে এই শহরে যারা একবার হারিয়ে যায় তারা আর আসে না।
শিখা আবারও কিছু বলল না।
ভাইয়াকে ওরা মেরে ফেলেছে, তাই না আপা?
শিখা দাঁড়িয়ে পড়ল। রঞ্জু কী তাহলে এখনও বিশ্বাস করে মিলন এক দিন ফিরে আসবে?
আজ তিন মাস হয়ে গেল! ওরা কি আমাদেরও মেরে ফেলবে আপা?
শিখা কোনো কথার উত্তর করল না। সে খেয়াল করল রঞ্জুর চোখগুলো ভারী হয়ে আসছে। সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ডলছে।
৪.
বাবুলের দোকান পর্যন্ত ওরা আর কোনো কথা বলল না। বাবুলের দোকানের বাম পাশে ইউক্যালিপটাসের গাছটার নিচে এসে রঞ্জু প্রায় থমকে দাঁড়াল।
শিখা বলল- কী হয়েছে রঞ্জু?
রঞ্জু কোনো কথা বলল না। তাদের সামনে দুটো ছেলে বিপরীত মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত মোটরসাইকেলের আয়নায় তাদের দেখার চেষ্টা করছে। শিখা রঞ্জুর হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল। আচ্ছা ছেলেগুলো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কেন? তারা কি এখন যে কোনো সময় শিখার দিকে এগিয়ে আসবে? শিখার দিকে এগিয়ে এসে কী করবে? শরীরের সঙ্গে শরীর লাগিয়ে বিশ্রী ভঙ্গিতে বলবে- একটা উপহার দিতাম! সাইজটা তো বললেন না?
শিখার গলা শুকিয়ে আসছে। তাদের এখন খুব দ্রুত পা চালানো উচিত।
শিখা এবং রঞ্জু এখন প্রায় দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন পথ শেষ হচ্ছে না। আচ্ছা বাবুলের ছোট্ট দোকানটা পার হতে তাদের এত সময় লাগছে কেন?
তারা কি কোনো দিনই বাবুলের দোকানটা পার হতে পারবে না?
No comments