শিক্ষায় বৈষম্য ও রাজনীতির তালেবানীকরণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মাশ্রয়ী দল ও গোষ্ঠীগুলোর দাপট ক্রমবর্ধমান এবং সাম্প্রতিক ভোটের রাজনীতিতে এ ধরনের দল ও গোষ্ঠীর দর-কষাকষি ক্ষমতানির্ধারক ভূমিকায় পৌঁছে যাচ্ছে বলে আশঙ্কার কারণ রয়েছে। বিশেষত, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপির রহস্যজনক বয়কটের পেছনে জামায়াত-শিবিরের প্রবল চাপ বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে বলে ধারণা করি। জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধিদের আলোচনা বৈঠকগুলোয় দুই পক্ষ সমঝোতা ফর্মুলায় উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টির মুহূর্তে বেগম জিয়ার টেলিফোন-নির্দেশনা পুরো আলোচনাকেই ভন্ডুল করে দিয়েছিল বলে জানা গেছে। ওই নির্দেশনায় শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বহাল রেখে কোনো সমঝোতা ফর্মুলায় রাজি না হতে বিএনপি প্রতিনিধিদের তিনি সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করে দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। ‘আপসহীন নেত্রীর’ এহেন আপসবিমুখ অবস্থানই আওয়ামী লীগকে স্বর্ণসুযোগ এনে দিয়েছিল।
একতরফা নির্বাচনী প্রহসন বলুন আর ভোটারবিহীন তামাশা বলুন, চাতুর্যের খেলায় হেরে গেলেন বেগম জিয়া ও তারেক রহমান। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে একতরফা করার জন্য আওয়ামী লীগ ফাঁদ পেতেছিল—এটা তো অজানা ছিল না। এতৎসত্ত্বেও বেগম জিয়ার একগুঁয়েমির রহস্য কী? এটা অবশ্য ঠিক যে বেগম জিয়ার বাঘা বাঘা উপদেষ্টাকে সুপরিকল্পিতভাবে একের পর এক জেলে ঢুকিয়ে মহাজোটের চাণক্যপ্রবররা কূটচালে নিজেদের জয়ের ক্ষেত্রটা নির্বিঘ্ন করে নিয়েছিলেন কয়েক মাসের সাধনায়! শেষের দিকে এসে বেগম জিয়ার পদক্ষেপগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিল, যেসব উপদেষ্টা তাঁকে পরিচালিত করছিলেন, তাঁদের মধ্যে মেকিয়াভ্যালিয়ান কূটবুদ্ধির ঘাটতি রয়েছে। তা সত্ত্বেও জনসমর্থনের জোয়ার ১৮-দলীয় জোটের পক্ষে থাকার ব্যাপারকে বেগম জিয়া বিবেচনায় নিলেন না কেন, সেটা বোঝা মুশকিল। বাংলাদেশের ১৯৫৪, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলোয় জনগণের ইচ্ছা ও সমর্থনের তোড়ে বারবার সাজানো ছক তছনছ হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। অথচ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে চাণক্যনীতিই বাজিমাত করল। মহাজোটের প্রকারান্তরে নিজেদের ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার জন্য এহেন চাণক্যনীতি সমর্থনযোগ্য নয়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত কলামগুলোয় আমি ধারাবাহিকভাবে আহ্বান জানিয়েছি, এহেন অনৈতিক ‘মেকিয়াভ্যালিয়ান রাজনীতির’ চোরাপথ পরিহার করতে। কারণ, জনগণের রাজনীতি হিসেবে গণতন্ত্রের যে ধারণা, সেখানে মেকিয়াভ্যালিয়ান ধূর্ততার প্রতিযোগিতার চেয়ে জনগণের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভালোবাসা ও সমর্থনই ভোটের নির্বাচনে বিজয়ী দল বা জোটের শাসনের অধিকার অর্জনের নৈতিক ভিত্তি হয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ওই নৈতিক ভিত্তিকে ধসিয়ে দিয়েছে, আমার দুঃখটা এটাই। বছর দুয়েক আগেই বোঝা যাচ্ছিল, মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা বেশ কমছে।
২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরের অবস্থান কর্মসূচির বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত জামায়াত-শিবির যে অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নৈরাজ্যকর তাণ্ডব ঘটাল, তখন তো মনেই হচ্ছিল, ওই রাতেই বোধ হয় সরকারের পতন ঘটবে। কিন্তু নিশীথের সুদক্ষ অপারেশন যেভাবে ঢাকায় সমাবেশকারীদের বিতাড়িত করেছিল, সেটা বেগম জিয়া ও জামায়াত-শিবিরের তাবৎ নীলনকশাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল বলা চলে। (এটাও উল্লেখযোগ্য যে ঘণ্টা দুয়েক আগেই অভিযানের খবর পেয়ে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের ঘটনাস্থলে রেখে দ্রুত পালিয়ে গিয়েছিলেন জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা।) এরপর শুরু হলো গোয়েবলসীয় প্রচারণা। সাঈদীর চন্দ্রাভিযানের মতো সচিত্র, ডিজিটাল প্রচারাভিযান এ দেশের গ্রামে-গঞ্জে-নগরে কোটি কোটি ধর্মপরায়ণ মানুষকে খেপিয়ে দিল মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে। এহেন টালমাটাল প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তার ভাটার টান যতখানি অবদান রেখেছে, তার চেয়েও বেশি বিপর্যয় ঘটিয়েছে এই প্রচারাভিযান। ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কারণে প্রতিবারই তাদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে জনগণ, যার দৃষ্টান্ত আমরা ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে দেখেছি। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে যে বিপজ্জনক ডাইমেনশন এ দেশের ভোটের রাজনীতিতে যুক্ত হলো, সেটা জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত বাহিনীর তাণ্ডব ও খুন-জখমের নির্ভেজাল ফ্যাসিবাদী সহিংসতা এবং কওমি মাদ্রাসার নিরীহ ছাত্রদের মাঠে নামানোর অপপ্রয়াস।
রাজনীতির এই ক্রমবর্ধমান তালেবানীকরণ অবশ্যম্ভাবীভাবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী জোটের ভোটের রাজনীতিতে জোয়ার নিয়ে এসেছে। বিএনপির রাজনীতির ‘নাটের গুরু’ তারেক রহমানের ভুল চালের শিকার হয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় (কিংবা ১৯-দলীয়) জোট ওয়াকওভার দিলেও আগামী উপজেলা নির্বাচনে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে। তবে এ তালেবানি ফ্রন্টের উত্থানের প্রধান কৃতিত্ব জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেই দিতে হবে। কারণ, সত্তর দশকের শেষার্ধ ও আশির দশকের পুরো সময় এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মাদ্রাসাশিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে শনৈঃ শনৈঃ বেড়ে উঠতে দেওয়া হয়েছিল। জমিয়াতুল মোদারেসিন নেতা মওলানা মান্নান এ ব্যাপারে এরশাদের প্রধান সহযোগী ছিলেন। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এনজিও এবং ধনাঢ্য ব্যক্তি ও সংস্থার অঢেল অর্থসাহায্য প্রকাশ্যে ও গোপনে আলাদিনের চেরাগের ভূমিকা পালন করেছে এ দেশের গ্রামে-গঞ্জে, আনাচকানাচে রাতারাতি মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে। আমার গবেষণা গ্রন্থ দ্য পোভার্টি ডিসকার্স অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিচার্স ইন বাংলাদেশ-এ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মাদ্রাসাশিক্ষার এই অবিশ্বাস্য বিস্তারের কাহিনি তুলে ধরেছি।
১. ১৯৭৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ২৭ বছরে বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে ১ দশমিক ৬৫ গুণ, কিন্তু দাখিল মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৭ গুণ।
২. উল্লিখিত সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ছাত্রছাত্রী বেড়েছিল ১ দশমিক ৯৭ গুণ, কিন্তু দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ১২ দশমিক ১৩ গুণ।
৩. গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজারেরও বেশি। ওই মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫ লাখ বলে ধারণা করা হয়। এ সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি কর্তৃপক্ষেরও জানা নেই। কারণ, কওমি মাদ্রাসাগুলোয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই।
৪. ইবতেদায়ি মাদ্রাসা বাদ দিয়েই অন্যান্য দাখিল, ফাজিল ও কামিল ডিগ্রি প্রদানকারী মাদ্রাসাগুলোয় বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে সরকারি ব্যয়ের ২১ দশমিক ১৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল শিক্ষা খাতে। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে ওই অনুপাত নামিয়ে আনা হয়েছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশে (আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী)। ২০১৩-১৪ সালের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এখনো ১২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ জিডিপির শতাংশ হিসাবে, যা মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ওই ব্যয় বরাদ্দকে টেনে ২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে নামিয়ে ফেলেছিলেন। বর্তমান সরকার নিজেদের শিক্ষাবান্ধব সরকার দাবি করলেও শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। ইউনেসকো তার সব সদস্যদেশকে জিডিপির ন্যূনপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় হিসেবে বরাদ্দ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ করেছে প্রায় ৩০ বছর আগে। বাংলাদেশও ওই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারী দেশ। কিন্তু আশির দশক থেকে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ ডামাডোলে শরিক হয়ে গত ৩০ বছরে আমরা শিক্ষার বাজারীকরণ ও পণ্যকরণের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। আর এ জন্যই প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা মহাসুখে বাজারের হাতে সোপর্দ করে চলেছি। এর পরিণামে শিক্ষা আজ এ দেশে বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে, যেখানে ধনাঢ্য মা-বাবার সন্তানদের জন্য মহার্ঘ্য পণ্য হিসেবে উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষা বিক্রয়ের হাজার হাজার মুনাফালোভী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নাটকীয় গতিতে এগিয়ে চলেছে। উন্নত পুঁজিবাদী কোনো দেশেই প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে বাজারব্যবস্থাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, অথচ বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে ১২ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে।
১. ১৯৭৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ২৭ বছরে বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে ১ দশমিক ৬৫ গুণ, কিন্তু দাখিল মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৭ গুণ।
২. উল্লিখিত সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ছাত্রছাত্রী বেড়েছিল ১ দশমিক ৯৭ গুণ, কিন্তু দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ১২ দশমিক ১৩ গুণ।
৩. গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজারেরও বেশি। ওই মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫ লাখ বলে ধারণা করা হয়। এ সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি কর্তৃপক্ষেরও জানা নেই। কারণ, কওমি মাদ্রাসাগুলোয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই।
৪. ইবতেদায়ি মাদ্রাসা বাদ দিয়েই অন্যান্য দাখিল, ফাজিল ও কামিল ডিগ্রি প্রদানকারী মাদ্রাসাগুলোয় বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে সরকারি ব্যয়ের ২১ দশমিক ১৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল শিক্ষা খাতে। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে ওই অনুপাত নামিয়ে আনা হয়েছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশে (আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী)। ২০১৩-১৪ সালের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এখনো ১২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ জিডিপির শতাংশ হিসাবে, যা মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ওই ব্যয় বরাদ্দকে টেনে ২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে নামিয়ে ফেলেছিলেন। বর্তমান সরকার নিজেদের শিক্ষাবান্ধব সরকার দাবি করলেও শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। ইউনেসকো তার সব সদস্যদেশকে জিডিপির ন্যূনপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় হিসেবে বরাদ্দ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ করেছে প্রায় ৩০ বছর আগে। বাংলাদেশও ওই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারী দেশ। কিন্তু আশির দশক থেকে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ ডামাডোলে শরিক হয়ে গত ৩০ বছরে আমরা শিক্ষার বাজারীকরণ ও পণ্যকরণের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। আর এ জন্যই প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা মহাসুখে বাজারের হাতে সোপর্দ করে চলেছি। এর পরিণামে শিক্ষা আজ এ দেশে বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে, যেখানে ধনাঢ্য মা-বাবার সন্তানদের জন্য মহার্ঘ্য পণ্য হিসেবে উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষা বিক্রয়ের হাজার হাজার মুনাফালোভী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নাটকীয় গতিতে এগিয়ে চলেছে। উন্নত পুঁজিবাদী কোনো দেশেই প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে বাজারব্যবস্থাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, অথচ বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে ১২ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া—কোনো দেশেই প্রাথমিক শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় বাজারকে প্রবেশাধিকর দেওয়া হয়নি, একক মানসম্পন্ন একক পাঠ্যসূচির বাইরেও যার যা ইচ্ছা পড়াতেও দেওয়া হয় না। এ দেশের মাদ্রাসাশিক্ষক এবং বিশেষত কওমি মাদ্রাসাশিক্ষার ‘স্বাধীনতা’ তো কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ‘তালেবান’ শব্দটি চালু হয়েছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের ভূখণ্ডে অবস্থিত হাজার হাজার মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে গঠিত যোদ্ধাবাহিনীর পরিচয় দেওয়ার জন্য। এটা পাকিস্তান-আফগান মডেল। তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের মিছিলের প্রধান স্লোগানই ছিল, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। ২০ থেকে ২৫ বছর আগের এই স্লোগান প্রদানকারীরা এখন আমাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে তার একটা মহড়া আমরা দেখেছি মাত্র। রাজনীতির তালেবানীকরণের এই ক্রমবর্ধমান ধারা রুখতে হবে শিক্ষার তালেবানি ধারা বদলানোর মাধ্যমেই। আমাদের নীতিপ্রণেতারা কি শুনছেন?
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
No comments