হায়রে নির্বাচন! হায়রে দেশ!
৫ জানুয়ারির ভোটের আগের দিন রাস্তায় নেমেছি। রাস্তায় মানুষ নেই বেশি, যানবাহন আরও নেই। ফুলার রোড থেকে ধানমন্ডি পর্যন্ত কোনো চিহ্নমাত্র নেই নির্বাচনেরও! কোনো ভোট, কোনো সাড়াশব্দ, কোনো পোস্টার-ব্যানার ছাড়াই এই দুই এলাকার সাংসদেরা ইতিমধ্যে নির্বাচিত হয়ে গেছেন! ভোটের আগে উৎসব নামে এই এলাকায়, সারা শহরে। এবার নিস্পৃহতা, বিতৃষ্ণা আর আশঙ্কার বিষাদ গ্রাস করেছে শীত, কুয়াশা আর আবছা আলোর ঢাকাকে। এই শহরে আর এই দেশে এক অদ্ভুত নির্বাচন হয়েছে। এমন নির্বাচন নিয়ে কথা বলার রুচি হয় না। তবু চোখের সামনে গণতন্ত্রের এই শবযাত্রা পুরোপুরি এড়িয়ে যাই কীভাবে! আমার একসময়ের এক ছাত্রী বর্তমানে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে কর্মরত। তার কম্পিউটারের ডেস্কটপে নেত্রী শেখ হাসিনা আর তাঁর সুযোগ্য পুত্রের ব্যাডমিন্টন খেলারত ছবি।
সে একনিষ্ঠ আওয়ামী লীগভক্ত। তার এলাকায় ভোট হবে। ভোটে অংশ নেবে আওয়ামী লীগ, তার প্রতিদ্বন্দ্বীও আওয়ামী লীগ। সে যাবে ভোট দিতে? খুবই লজ্জা পায় এ প্রশ্ন শুনে। বলে, ‘না স্যার, ভোট দেব না এবার, এটা কোন ভোট!’ এটি আসলেই কোনো ভোট নয়, কোনো নির্বাচন নয়। এই নির্বাচনে একটিমাত্র ভোট পড়ার আগেই নির্বাচিত হয়ে গেছে পরবর্তী সরকার! এই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। যাঁদের আছে, তাঁদেরও সুযোগ নেই আওয়ামী লীগ বা তার লেজুড়বৃত্তিকারী বাদে অন্য কোনো প্রার্থীকে পছন্দ করার। এই নির্বাচনে ভোট দেননি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বা স্পিকার। কারণ, তাঁদের এলাকায় ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এই নির্বাচনে ভোট দেননি প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া ও দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দলের নেতা এরশাদ। কারণ, তাঁরা গৃহ বা হাসপাতালবন্দী। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এই নির্বাচনে ভোট দেননি দেশের আরও অসংখ্য মানুষ। কারণ, তাঁরা বিবেকের কাছে বন্দী। সংসদ নির্বাচনের নামে পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব এই নির্বাচনী তামাশা তবু নীরবে সহ্য করতে হয়েছে মানুষকে। এই নির্বাচনেরও অবশ্য সমর্থক আছে! ভোটের দিন সাড়ে ১২টার দিকে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল খুলে দেখি, সেখানে প্রবল উৎসাহে নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন একজন নারী পর্যবেক্ষক। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ বাদ দিয়েছে ভারত আর ভুটান বাদে পৃথিবীর বাকি সব দেশ। পর্যবেক্ষণে নেই দেশের সিংহভাগ পর্যবেক্ষকও। আছে যে গুটি কয়েক সংগঠন, তিনি তার একটির প্রধান। তিনি আমাদের জানালেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে লোকে ভোট দিতে না গেলেও বড় শহরগুলোতে লোকে ভোট দিয়েছে! তাঁর উপস্থিতিতে সেই টিভি চ্যানেলের একজন প্রতিবেদক মিরপুর বাঙলা কলেজ থেকে লাইভ প্রতিবেদনে জানালেন সেই ভোটের বিবরণ। এই কেন্দ্রে ভোটার আড়াই হাজারের বেশি। তখন পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন ৩০৭ জন! হ্যাঁ, ভোট দিচ্ছে বটে কিছু মানুষ! এই নির্বাচনের সমর্থকেরা বলেছেন, জামায়াত আসেনি বলে বিএনপি আসেনি নির্বাচনে। এটি অসত্য, কারণ বিএনপি একবারও দাবি তোলেনি জামায়াতকে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার।
এই নির্বাচনের সমর্থকেরা বলেছেন, জামায়াতকে বাদ দিলে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করা হবে পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে। এটি বিভ্রান্তিকর, কারণ নির্বাচনের জন্য ইতিমধ্যে আদালতের রায়ে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছে জামায়াত। বাকি কাজ অর্থাৎ জামায়াতকে ১৮ দলের জোট থেকে বের করে দেওয়া সম্ভব স্রেফ দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই ক্ষমতা আওয়ামী লীগ সরকারের আছে, চাইলেই একমুহূর্তে তারা করতে পারে এটি। বিচিত্র এই দেশে সরকারের স্তাবকেরা সরকারের কাছে এই দাবি না তুলে বিএনপিকে বলছে নিজে নিজে কাট্টি নিতে জামায়াতের সঙ্গে! এই নির্বাচনের সমর্থকেরা বলেছেন, নির্বাচনে বিএনপি জিতে এলে বিঘ্নিত হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই রব গত কয়েক বছরে হাজারোবার তুলেও তাদের ভয় তবু নির্বাচনে জিতবে বিএনপিই! যদি তা-ই হতো, সেটাই হচ্ছে গণতন্ত্র! গণতন্ত্র মানলে এই ভয় আর আশঙ্কা মেনেই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এককাট্টা হওয়া উচিত ছিল তাদের। বিএনপি জিতে এসে বিচার বিঘ্নিত করলে বিএনপি হটাও আন্দোলনে মানুষকে শামিল করার চেষ্টা করা উচিত ছিল তাদের। এই নির্বাচনের সমর্থকেরা তা করেননি, জনগণের মতামত আর বিচার বিবেচনাবোধের ওপর আস্থা নেই তাঁদের। নির্বাচনহীন নির্বাচনের পরও তাই আমরা তাঁদের দেখব এই নির্বাচনের জয়গান গাইতে। দেশের সিংহভাগ মানুষের ভোটাধিকার হত্যা করার এক আততায়ী সরকারকে সমর্থন করতে! ৫ জানুয়ারি তবু বাংলাদেশের ইতিহাসে নিখাদ কলঙ্কজনক এক দিন হয়ে রইবে। এই নির্বাচনের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তার বৈধতা প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং জনসমর্থন অতিসামান্য। সেই সরকার হবে আন্তর্জাতিকভাবেও একঘরে। সেই সরকারের অধীনে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা পিছিয়ে যাবে বহুদূর। আমার মনে হয় না মুক্তিযুদ্ধ আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বারবার জয়ী বাঙালি জাতির প্রাপ্য হতে পারে এমন একটি সরকার।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments