সমঝোতার সূত্র সন্ধান by ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

গত সপ্তাহে আমরা ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্র“য়ারি এবং ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে’র চারটি ‘মডেল’ হিসেবে উল্লেখ করেছি। বিরোধী দল নির্বাচনের রায় মেনে নিয়ে বিজয়ীকে অভিনন্দন জানিয়েছে- সেরকম ব্যতিক্রমী ঘটনা কেবল একবারই ঘটেছে। ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে পরাজিত হওয়ার পর জেনারেল ওসমানী সংবাদ সম্মেলন করে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এর বাইরে প্রতিটি নির্বাচনের পরই বিরোধী দল নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। সন্দেহ নেই, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের তালিকায় এবারে আরেকটি মডেল সংযোজিত হতে যাচ্ছে। একে বলা যেতে পারে ‘নির্বাচনবিহীন নির্বাচন’। যে নির্বাচনের ফলাফল নির্বাচনের আগেই ঘোষিত হয়ে যায়। ৩০০ আসনের নির্বাচনে ১৫৪ আসনের ফলাফল ইতিমধ্যেই আমাদের জানা হয়ে গেছে। বাকি আসনগুলোতেও কেবল সামান্য আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা।
এ নির্বাচন অনেকটা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনের মডেলের কাছাকাছি হলেও দু’য়ের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। ১৯৯৬-এর সেই নির্বাচন ছিল একটি পূর্বঘোষিত আনুষ্ঠানিকতার নির্বাচন। তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি নীতিগতভাবে বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয় এবং তদনুযায়ী সংবিধান সংশোধনে সম্মত হয়। কিন্তু বিরোধীদলীয় সদস্যদের গণপদত্যাগের কারণে সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য তখন সংসদে ছিল না। এ অবস্থায় তিন মাসের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে আবার নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়ে তবেই ওই নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করা হয়। সে কারণে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশ না নিলেও তা হতে দিয়েছে। এবারে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিরোধী দলের দাবি মেনে নেয়া বা কোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। ফলে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে তাতে জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং জাতীয় অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নির্ধারিত ৫ জানুয়ারি তারিখে বিরোধী দল ও জোট নির্বাচন হতে দেবে বলে মনে হয় না। সরকার জোর করে নির্বাচনের আয়োজন করতে গেলে সংকট আরও ভয়ংকর রূপ নেবে বলে সব মহলের আশংকা।
এ ক্ষেত্রে সরকারকেই অগ্রণী হয়ে সমঝোতার সূত্র সন্ধান করতে হবে।
লক্ষ্য করার বিষয়, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ছিল আওয়ামী লীগের। জামায়াতে ইসলামী তখন ছিল আওয়ামী লীগের দোসর। আর বিএনপি সরকার সে দাবি মানতে নারাজ। রাজনীতির নির্মম পরিহাসে এবারে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। এবারে বিএনপির দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তা মানতে নারাজ। আর জামায়াতে ইসলামী এবারে বিএনপির দোসর।
২.
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে তা কার্যকর করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে তা খুবই গুরুতর। আমাদের প্রচলিত আইনে এ ধরনের অপরাধে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ডই বিধেয়। তাতে বলার কিছু নেই। তবে এই বিচার নিয়ে সরকার দেশের ভেতরের চেয়েও বেশি বিপাকে পড়ছে বিদেশে। ভারত ছাড়া প্রায় সব দেশই এই বিচার ও মৃত্যুদণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছে।
আজকের পৃথিবীতে অধিকাংশ রাষ্ট্রেই মৃত্যুদণ্ড নেই। আমি নিজেও এর পক্ষে নই। বহুবার এ নিয়ে লিখেছি। আগামীতেও লিখব। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যদি কখনও কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ হয়, তাহলে আমাদের দণ্ডবিধি থেকে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাব। এই ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনে প্রাণের চেয়ে মূল্যবান আর কোনো বস্তু নেই। আমরা যা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখি না, তা নষ্ট করার অধিকার আমাদের নেই। সেজন্যই কারও মৃত্যু নিয়ে উল্লাস করাটা সুরুচির পরিচায়ক মনে করি না। চরম শত্র“ও যদি মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাতে উল্লসিত না হয়ে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়াই মুসলমানের জন্য বিধেয়। যার মোদ্দা অর্থ : ‘আমরা সবাই আল্লাহর জন্যই এবং তাঁর কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে’। আদালত যাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যাওয়ার পর তার অপকর্মের দায় পরিশোধ হয়ে যায়। তাকে তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ‘প্রাণ’ দিয়ে সেই দায় পরিশোধ করতে হয়েছে। অতএব দণ্ড ভোগের পর দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে কারও মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আরও কিছু প্রাণ নিঃশেষ করার বর্বরতাও কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
৩.
বিষয়টি অন্যদিক থেকেও দেখা প্রয়োজন। রাজনীতির মঞ্চে চিরসত্য বা অভ্রান্ত মতবাদ বলে কিছু নেই। সময়ের সঙ্গে মানব সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তনে এক সময়ের ‘সত্য’ অন্য সময়ে ‘অসত্যে’ পরিণত হতে পারে। এক সময় সবাই ‘জানত’ সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। সেই ‘সত্যে’র বিরোধিতা করে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার তত্ত্ব প্রচার করতে গিয়ে কোপার্নিকাসকে রাজদণ্ডে প্রাণ দিতে হয়েছে। ধর্মের বিধিবিধান অমান্য করার কারণে যুগে যুগে কতজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে; আবার অন্যযুগে ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করার ‘অপরাধে’ অন্যত্র কতজনকে নিগৃহীত হতে হয়েছে। তাই কোনো রাজনৈতিক মতবাদ বা সিদ্ধান্তকে ‘চিরন্তন’ মনে করা যথার্থ নয়। আমাদের চোখের সামনে তার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর কথাই ধরা যাক। ব্রিটিশ আমলে এই দলটি মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার ঘোরতর বিরোধী ছিল। এ কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের সঙ্গে তার বৈরী সম্পর্ক এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, এই দলের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদীকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
ব্রিটিশ আমলে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠন ‘জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ্’ ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মিত্র। এই দলটিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিল। ১৯৪৬ সালে বাংলা ও আসামের বিভক্তির সময় সিলেট জেলা ছিল আসামের অংশ। মুসলমান অধ্যুষিত জেলা হিসেবে এই জেলা পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। কিন্তু তার করিমগঞ্জ মহকুমায় গণভোট দেয়া হল। সেটি কার ভাগে পড়বে- পাকিস্তান, না ভারত- তা নির্ধারণ করার জন্য। ওই গণভোটের সময় ‘জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ্’-এর সর্বভারতীয় নেতারা সেখানে গিয়ে ভারতের পক্ষে দিবারাত্র প্রচারণা চালিয়েছিলেন। মূলত সে কারণেই শতকরা ৮০ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত এই জেলার গণভোটের রায় ভারতের পক্ষে গিয়েছিল, যা কোনোভাবেই যৌক্তিক ছিল না। সিলেটের অন্যান্য এলাকাসহ করিমগঞ্জ যে কোনো বিচারে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অংশে থাকাই যৌক্তিক ছিল।
অতএব দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের সেই দিনগুলোতে কট্টর ইসলামী দলগুলো, বিশেষ করে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মীয় নেতারা, মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রকল্পের সমর্থক ছিলেন না। তারা কার্যত কংগ্রেসের অখণ্ড ভারত প্রকল্পকেই সমর্থন দিয়েছেন। তাদের প্রতিপক্ষ ‘ইংরেজি শিক্ষিত ও মধ্যপন্থী’ মধ্যবিত্ত মুসলমানদের আন্দোলনেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুসলিম লীগের ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ কতটা যৌক্তিক ছিল, কিংবা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য কতটা কল্যাণকর হয়েছে, উপমহাদেশে বসবাসরত পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ মানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশে তার প্রভাব কতটা ইতিবাচক এবং কতটা নেতিবাচক হয়েছে, সে আলোচনায় আমরা এখানে যাব না। তবে আজ এতদিন পর হলেও বর্তমানের বাস্তবতায় কেউ নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলতে পারেন, উপমহাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর অধিকাংশকে দুই প্রান্তে দুটি ক্ষুদ্রতর ভূখণ্ডে বৃত্তবন্দি করে বৃহত্তর ভারতে প্রায় ২০ কোটি মুসলমানকে চতুর্বর্ণের পশ্চাতে ‘পঞ্চম বর্ণে’র অসহায় অবস্থানে ফেলে আসা দূরদর্শিতার কাজ হয়েছে কিনা।
লক্ষ্য করার বিষয়, ব্রিটিশ আমলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সেদিনের মুসলিম লীগের লড়াকু সৈনিক যারা ছিলেন- শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী ও তাদের সহযোগীরা- তারাই মাত্র এক দশক পরই সে রাষ্ট্রটি ভেঙে ফেলার আওয়াজ তুলেছেন। তার চেয়েও লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এক্ষেত্রে পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামী দল-উপদল চলে এসেছে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে। এবারে তারা পাকিস্তান ‘রক্ষা’ করার জন্য জান কোরবান করে মাঠে নামলেন এবং লাখো মানুষের জান কবজ করার কাজে শরিক হতেও কুণ্ঠিত হলেন না। কাজেই, সময়ের ব্যবধানে রাজনীতিতে কার অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা কেবল সময়ই বলে দিতে পারে। ধরা যাক, আজকের বাংলাদেশ কোনো বহিঃশত্র“র দ্বারা আক্রান্ত হল। সেক্ষেত্রে বর্তমানের বাস্তবতায় কার কী অবস্থান হবে? সেক্ষেত্রে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদেরই কেউ কেউ যে ‘রাজাকারে’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না, তা হলফ করে বলা যায় কি?
অন্যদিকে একাত্তরে যারা পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার বেদনায় মুহ্যমান হয়েছেন, তাদের মধ্যে দু’ধরনের মানুষ চিহ্নিত করা যায়। একাংশ স্পষ্টতই জেনে-বুঝেই পাক-বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে। তারা রাজাকার, আল-বদর হয়ে পাক-বাহিনীকে পথ দেখিয়েছে। তাদের ধ্বংসযজ্ঞে শরিক হয়েছে অথবা নানা দুষ্কর্মে জোগান দিয়েছে। আরেকটি অংশ পাক-বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও অপকর্মে শরিক হয়নি, কিন্তু ব্রিটিশ আমলে বাংলার মুসলমানদের প্রতি উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদার, ধনিক ও ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণীর চরম অবজ্ঞা ও অবমাননার স্মৃতি তখনও তারা বিস্মৃত হতে পারেননি। তাই চোখের সামনে ‘স্বপ্নের পাকিস্তান’ ভেঙে যেতে দেখে তারা হতাশ হয়েছেন, তীব্র বেদনাবোধ করেছেন।
এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। প্রথমোক্ত শ্রেণীর অনেকে হয়তো এখনও তাদের একাত্তরের ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত হতে চান না। কিন্তু দ্বিতীয় অংশে যারা সেদিন অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতার নিরিখে পাকিস্তান ভেঙে যেতে দেখে কষ্ট পেয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বাস্তবতা তারা মেনে নিয়েছেন। তারা এখন বাংলাদেশকে আঁকড়ে ধরেই তাদের ব্রিটিশ আমলের ‘বাঙাল’ জীবনের গ্লানিময় স্মৃতির পীড়ন থেকে রক্ষা পেতে চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক। অতএব আজকের দিনে বাংলাদেশের সীমান্ত বা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা সম্মুখ সারিতেই থাকবেন, তা অবধারিত। অর্থাৎ, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা যেমন আজকের প্রেক্ষাপটে রাজাকারের ভূমিকায় চলে যেতে পারে, তেমনি একাত্তরের পাকিস্তানপন্থীরাও অনেকে আজকের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় চলে আসতে পারেন। সেই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতাকে সামনে রেখেই আমাদের জাতীয় ঐক্যের সর্বজনীন ভিত্তি নির্মাণ করতে হবে। বিভাজন নয়, ঐক্যের সূত্র সন্ধান করাই হবে প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কাজ। বাংলাদেশের জাতি গঠনের চলমান প্রক্রিয়ায় এ বিষয়টি অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
৪.
আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী কিছু দল-উপদল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সুবাদে তারা সেই কাজটি করতেও পারেন। জামায়াতে ইসলামীর কিছু কার্যকলাপ দৃষ্টে এ রকম দাবি ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু দল নিষিদ্ধ করলেই সে দলের চিন্তাভাবনার বিলুপ্তি ঘটে না। দু-চারজন ছাড়া সে দলের সমর্থকরা দেশ ছেড়ে যাবে না। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সে দলের কার্যক্রম কখনও থেমে থাকেনি। এখন দেশের অন্যতম নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল।
দল নিষিদ্ধ করা রাজনীতির ভিন্নমত মোকাবেলার কার্যকর পথ নয়। রাজনীতির ভিন্নমত মোকাবেলা করতে হবে রাজনীতি দিয়েই। অপরাজনীতির বিপরীতে নীতির রাজনীতি দিয়ে। নইলে হিতে-বিপরীত ঘটার আশংকাই বেশি। আফগানিস্তানে আল কায়েদা ও তালেবান নিষিদ্ধকরণ তার দৃষ্টান্ত। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লাখো প্রাণের বিনিময়ে। রাজনৈতিক সামাজিক বিবাদ-বিসংবাদ কিংবা বিভ্রান্তি ১৬ কোটি মানুষের এই দেশকে সাময়িকভাবে মেঘাচ্ছন্ন করতে পারে, কিন্তু এই কষ্টার্জিত-রক্তার্জিত স্বাধীনতাকে কখনই ম্লান করতে পারবে না। সেই বিশ্বাস হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
গত সপ্তাহে এই কলামে এ নিয়ে নানা মত ও পথের উল্লেখ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছিলাম। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বর্তমান সরকারের অহেতুক অনড় অবস্থান পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। এখন এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারকেই আগ বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকেই বিরোধী দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানের সূত্র বের করতে হবে এবং তদনুযায়ী সংকট নিরসনে অগ্রণী হতে হবে। এক্ষেত্রে সাংবিধানিক সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যেমন জরুরি, তেমনি জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিবদমান পক্ষগুলোকে সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের পথে নিয়ে আসতে হবে। সেজন্য সব পক্ষকেই কম-বেশি ছাড় দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে সম্পন্ন হওয়ার সব সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। এজন্য সরকারের অযৌক্তিক অনমনীয়তাকেই আমরা বেশি দায়ী করব। এখন সংসদ ভেঙে দিয়ে তিন মাস সময় নেয়ার যে সুযোগের কথা সরকারের পক্ষ থেকে এতকাল বলা হয়েছে, সে সুযোগও আর আছে বলে মনে হয় না। এ কারণেই গত সপ্তাহে আমরা দশম সংসদের পাশাপাশি একাদশ সংসদের নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা বলেছিলাম। ইতিমধ্যে সরকারি দলের মুখপাত্ররাও সে রকম কথা বলছেন। কিন্তু বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া এ কথা বলা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
সারা দেশে এখন যা ঘটছে, তা দৃষ্টে বর্তমান সরকারের উচিত হবে কালবিলম্ব না করে বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা সন্ধান করা এবং তদনুযায়ী সমঝোতায় উপনীত হয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি মডেলে ৫ জানুয়ারি ‘আনুষ্ঠানিকতার নির্বাচন’ সম্পন্ন করে তার অব্যবহিত পরে ‘একাদশ সংসদে’র নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া এবং সব দলের অংশগ্রহণে সেই নির্বাচনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া।
বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির ও যুদ্ধাপরাধবিরোধী জনমত চাঙ্গা করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এই পথে সংকটের একতরফা সমাধান প্রত্যাশা করা যৌক্তিক হবে না। দেশটা সবার। এ মুহূর্তে সরকারের পক্ষে যে জনমত, সরকারের বিপক্ষে তার চেয়ে মোটেই কম নয়। সেই বাস্তবতা অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কিছুটা সময় এখনও আছে।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক

No comments

Powered by Blogger.