বাংলাদেশ ইনকর্পোরেটেড by ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
অনেক
উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় নেতৃত্ব যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে গোটা
দেশবাসীকে ভাববন্ধনে আবদ্ধ করতে ইনকর্পোরেট ধারণা বা প্রেরণাকে ব্যবহার
করতে চাইছেন, তখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন সম্ভাবনা সমৃদ্ধ সমাজে অনুরূপ
চিন্তা-চেতনার বিকাশ ও প্রয়াস-প্রচেষ্টার পরিবেশ আজ কোন পর্যায়ে?
শোষণ-বঞ্চনা ও বণ্টন বৈষম্যের ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকল থেকে ‘মুক্তির
সংগ্রামে’ বিজয় লাভের ৪৩ বছর পূর্তির এই দিনে এ প্রশ্ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক
বলেই প্রতীয়মান হয়। একটি ভালো সঙ্গীত সৃষ্টিতে গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও
বাদ্যযন্ত্রীর সমন্বিত প্রয়াস যেমন অপরিহার্য, তেমনি দেশ বা সংসারের
সামষ্টিক অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সব পক্ষের সহযোগিতা ছাড়া সুচারুরূপে
সম্পাদন সম্ভব নয়। আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার বেলায়, এমনকি যে
কোনো উৎপাদন ও উন্নয়ন উদ্যোগে ভূমি, শ্রম ও পুঁজি ছাড়াও মালিক-শ্রমিক সব
পক্ষের সমন্বিত ও পরিশীলিত প্রয়াস-প্রচেষ্টাই সব সাফল্যের চাবিকাঠি বলে
বিবেচিত হচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের দ্বারা দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা
বৃদ্ধি ছাড়াও সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়াসকে, সমাজবিজ্ঞানীরা যাকে কর্পোরেট
কালচারের প্রেরণা হিসেবে শনাক্ত করেন, সেখানেও সুসমন্বয়ের আবশ্যকতা
অপরিহার্য। স্থান-কাল-পাত্রের পর্যায় ও অবস্থানভেদে উন্নয়ন ও উৎপাদনে
সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করাও সামগ্রিক সামষ্টিক
ব্যবস্থাপনার একটা অন্যতম উপায় ও উপলক্ষ।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নকামী কল্যাণ অর্থনীতিতে সব পক্ষকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন এবং সব প্রয়াস-প্রচেষ্টায় সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বিক উদ্দেশ্য অর্জনের অভিপ্রায়ে অয়োময় প্রত্যয়দীপ্ত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। একজন কর্মচারীর পারিতোষিক তার সম্পাদিত কাজের পরিমাণ বা পারদর্শিতা অনুযায়ী না হয়ে কিংবা কাজের সফলতা-ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব বিবেচনায় না এনে যদি দিতে হয় অর্থাৎ কাজ না করেও সে যদি বেতন পেতে পারে কিংবা তাকে বেতন দেয়া হয়, তাহলে দক্ষতা অর্জনের প্রত্যাশা আর দায়িত্ববোধের বিকাশ ভাবনা মাঠে মারা যাবে। এ ধরনের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হতে থাকলে যে কোনো উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা উন্নয়ন প্রয়াস ভর্তুকির পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য। দারিদ্র্য প্রপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে পাবলিক সেক্টর বেকার ও অকর্মণ্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে, তাহলে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা না যায় উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
অনাবশ্যক ব্যয় পরিহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে পুঁজি-ভূমি-শ্রমের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে মুনাফা অর্জন কোম্পানি ব্যবস্থাপনার অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। জাপানে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক কোম্পানিগত প্রাণ। সেখানে শ্রমিক যাতে তার সর্বাধিক মনোযোগ কোম্পানির জন্য দিতে পারে সে জন্য স্ত্রীকে দেয়া হয়েছে সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বহনের ভার। কোম্পানির কাজে সার্বক্ষণিক মনোযোগ দেবে স্বামী। সংসার চালানোর বিষয় নিয়ে অফিস থেকে বাসায় ফোন যাবে না- বাসা থেকে কোন ফোন আসবে না কোম্পানিতে। জাপানে নারীদের চাকরি, ব্যবসা, প্রশাসন, রাজনীতিতে বড় একটা দেখা যায় না। তার কারণ সমাজ তাদের সংসার চালানোর দায়িত্ব দিয়ে পুরুষদের উৎপাদন কর্মে পূর্ণ মনোনিবেশে সহায়তা করার দায়িত্ব দিয়েছে। স্বামীর বেতনের টাকা মাস শেষে পারিবারিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। স্ত্রী ওই হিসাব অপারেট করেন। সংসারের যাবতীয় খরচপাতি স্বামীর সম্মতিতে স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। স্বামী প্রতি সপ্তাহের শুরুর দিনে তার সাপ্তাহিক হাত খরচ বাবদ টাকা পেয়ে থাকেন। সেই টাকা দিয়ে পুরো সপ্তাহ তার চলতে হয়। সুতরাং স্বামীর পক্ষে অপব্যয় কিংবা বাড়তি খরচ করার কোনো সুযোগ সেখানে নেই। পারিবারিক সঞ্চয় এভাবে প্রথাগত ব্যবস্থাদির দ্বারা উৎসাহিত হচ্ছে। জাপানের নারীরা বাইরের কাজে তেমন অবদান রাখছেন না ঠিকই, কিন্তু গৃহে যে দায়িত্ব তারা পালন করেন, তার আর্থিক ও তাৎপর্য মূল্য অনেক বেশি।
জাপানে কলকারখানা কিংবা অফিস-আদালতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন হয় না। অর্থবছর শুরুর পরপরই একটি নির্দিষ্ট দিনে শ্রমিক-মালিক পক্ষ একত্রে বসে বিগত বছরের আয়-ব্যয়ের স্থিতিপত্র সামনে নিয়ে খোলাখুলি আলোচনায় বসে স্থির করে আগামী বছরে বেতন বেশি হবে, না কম হবে। কোম্পানি টিকলে আমি টিকব- এই নীতিতে বিশ্বাসী সবাই যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকে। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী কিংবা তার ছেলেকে কর্মকালীন আলাদা করে শনাক্ত করা যায় না। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সবাই নিজেকে ওই কোম্পানির চাকুরে হিসেবে বিবেচনা করে। বছর শেষে কোম্পানির নিট লাভ-লোকসান যা হয়, তাই-ই তার প্রকৃত পাওনা। কোম্পানিতে বড় সাহেব, ছোট সাহেব বলে কোনো ভেদ-বিভেদ নেই। আছে কর্মক্ষমতা দক্ষতা আর দায়িত্ব অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস। সেখানে একজন সাধারণ কর্মীরও অবদান রাখার সুযোগ আছে। কোম্পানির সার্বিক অগ্রগতির পেছনে পরামর্শ দেয়ার স্বীকৃতি আছে সবার। সনি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ মরিতা সান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে প্রথমে তিনি পরিদর্শনে যান কারখানার টয়লেটগুলো। তিনি মনে করতেন টয়লেট ও অন্যান্য আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রাখার দায়িত্বে রয়েছে যেসব শ্রমিক, তাদেরও যথেষ্ট অবদান রাখার অবকাশ আছে উৎপাদনে। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন, উৎপাদন শ্রমিকেরা অবসরে যখন টয়লেটে আসে, তখন তা যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পায়, তাহলে তাদের মন প্রসন্ন হয়। সিটে ফিরে গিয়ে তারা উৎপাদনে পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারে। এর ফলে উৎপাদনের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। এভাবে দিনে যদি ১০০০ টেলিভিশন উৎপাদিত হয় কোনো কারখানায়, মরিতা সানের মতে, তার মধ্যে ন্যূনতম ৪টি টেলিভিশন উৎপাদন বেশি হয় শ্রমিকের প্রসন্ন মন-মানসিকতার কারণে। তিনি সবাইকেই উৎপাদনের যোগ্য অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন। ফলে শ্রেণী ও পর্যায় ভেদে সবাই যার যার কাজ তা সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পাদন করে। হোন্ডা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা নিজেই হোন্ডা মোটরসাইকেলের ডিজাইন করতেন গভীর রাতে। গভীর মনোনিবেশ সহকারে তিনি যাতে এ কাজ করতে পারেন, সে জন্য তার স্ত্রীও তার সঙ্গে রাত জাগতেন। রাতে ফেরিওয়ালা মিষ্টি আলু বিক্রি করত সুন্দর সুরে গান করে। ফেরিওয়ালার গানের সুরে হোন্ডা সাহেবের মনোনিবেশে যাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়, সে জন্য তার স্ত্রী ফেরিওয়ালার পুরো আলু কিনে নিয়ে তাকে ঘরে ফিরে যেতে অনুরোধ করতেন। এ হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি বলে বলীয়ান জাপানে পথিকৃৎদের প্রতিষ্ঠার কাহিনী। টয়োটা পরিবারের উত্থান একজন ব্যক্তির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। অনুসন্ধিৎসা ও গভীর নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সামান্য অবস্থা থেকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এক বিশাল শিল্প সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। কোয়ালিটির প্রশ্নে কোনো আপস নেই- পরিবেশনে, মুন্সিয়ানায় ও আন্তরিকতায় কমতি নেই। ডিজাইন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গভীর অভিনিবেশ সহকারে এমন সচেতন ও একাগ্রতার সমাহার ঘটানো হয়ে থাকে, যাতে উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে অপচয়-বাতিল-পরিত্যক্তের পরিমাণ কমে আসে।
জাপানে ইনকর্পোরেটেডের চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে পুনর্গঠন প্রয়াসের সময় থেকে। জাপান ইনকর্পোরেটেডের নিয়ন্ত্রণে প্রধান তিনটি পক্ষ হল- রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা আর বেসরকারি শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ব্যক্তিত্ব। সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রকৌশলী ফুকুদা যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন জাপানের বিশৃঙ্খল অর্থনীতিকে পথে আনার জন্য ‘অর্থনৈতিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। ওহিরা, যিনি এক সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনিও তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন অর্থনীতিতে ভালো না করতে পারলে নিস্তার নেই। জাপানের আমলা শ্রেণীও সার্বিক জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে নিবেদিত চিত্ত। সেখানে বেসরকারি খাতের পোশক প্রতিষ্ঠানই হল গোটা সরকারি আমলা শ্রেণী। উন্নয়নশীল অনেক দেশে আমলারা নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যার যার মন্ত্রণালয় বা বিভাগে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অবস্থান নিয়ে থাকেন। রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা শুধু রাজস্ব বাড়াবার কথা ভেবে বসে থাকেন। বর্ধিত রাজস্ব আদায়ের নামে শিল্প বিকাশের পথ রুদ্ধ হচ্ছে কিনা কিংবা অন্য বিভাগের কর্মসূচি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কিনা এবং এর ফলে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হচ্ছে কিনা, তা দেখার কথা যেন তাদের নয়। মনে রাখতে হবে, একটি ক্ষেত্রে আপাত কিছু ছাড় দেয়ায় অর্থনীতির অপর কার্যক্রম গতিশীলতা পেলে সার্বিকভাবে অর্থনীতিই লাভবান হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পর্যটন দফতর তাদের মোটেলের ভাড়ার হার সামান্য হ্রাস করলে অধিক পর্যটক আসতে আগ্রহী হতে পারে। তাতে পর্যটন মোটেলের আয় হয়তো একটু কম হবে, তবে বেশি পর্যটক এলে অন্যান্য দফতর ও ক্ষেত্রের আয় বাড়বে। কেননা ট্যুরিস্টরা শুধু মোটেলে ঘুমাতে আসেন না। সেখানকার কুটির শিল্পজাত পণ্যসহ আরও অনেক সামগ্রীর বিক্রি বাড়লে উৎপাদন সংশ্লিষ্ট সবার আয় বাড়বে। এটা হল সমন্বয়ের ব্যাপার। জাপানের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও সংগঠিত নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। সবাই এক সূত্রে কথা বলেন সরকারের সঙ্গে। সেখানে দলাদলি নেই। এক অ্যাসোসিয়েশন অন্য অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে শত্র“তা বা বৈরিতা পোষণ করে না। সেখানকার ফেয়ার ট্রেড কমিশন কারও প্রতি কটাক্ষ করে নয়, বরং নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণকেই তার ধর্ম মনে করে। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির জয়-জয়কার।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নকামী কল্যাণ অর্থনীতিতে সব পক্ষকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন এবং সব প্রয়াস-প্রচেষ্টায় সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বিক উদ্দেশ্য অর্জনের অভিপ্রায়ে অয়োময় প্রত্যয়দীপ্ত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। একজন কর্মচারীর পারিতোষিক তার সম্পাদিত কাজের পরিমাণ বা পারদর্শিতা অনুযায়ী না হয়ে কিংবা কাজের সফলতা-ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব বিবেচনায় না এনে যদি দিতে হয় অর্থাৎ কাজ না করেও সে যদি বেতন পেতে পারে কিংবা তাকে বেতন দেয়া হয়, তাহলে দক্ষতা অর্জনের প্রত্যাশা আর দায়িত্ববোধের বিকাশ ভাবনা মাঠে মারা যাবে। এ ধরনের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হতে থাকলে যে কোনো উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা উন্নয়ন প্রয়াস ভর্তুকির পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য। দারিদ্র্য প্রপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে পাবলিক সেক্টর বেকার ও অকর্মণ্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে, তাহলে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করা না যায় উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
অনাবশ্যক ব্যয় পরিহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে পুঁজি-ভূমি-শ্রমের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে মুনাফা অর্জন কোম্পানি ব্যবস্থাপনার অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। জাপানে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক কোম্পানিগত প্রাণ। সেখানে শ্রমিক যাতে তার সর্বাধিক মনোযোগ কোম্পানির জন্য দিতে পারে সে জন্য স্ত্রীকে দেয়া হয়েছে সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বহনের ভার। কোম্পানির কাজে সার্বক্ষণিক মনোযোগ দেবে স্বামী। সংসার চালানোর বিষয় নিয়ে অফিস থেকে বাসায় ফোন যাবে না- বাসা থেকে কোন ফোন আসবে না কোম্পানিতে। জাপানে নারীদের চাকরি, ব্যবসা, প্রশাসন, রাজনীতিতে বড় একটা দেখা যায় না। তার কারণ সমাজ তাদের সংসার চালানোর দায়িত্ব দিয়ে পুরুষদের উৎপাদন কর্মে পূর্ণ মনোনিবেশে সহায়তা করার দায়িত্ব দিয়েছে। স্বামীর বেতনের টাকা মাস শেষে পারিবারিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। স্ত্রী ওই হিসাব অপারেট করেন। সংসারের যাবতীয় খরচপাতি স্বামীর সম্মতিতে স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। স্বামী প্রতি সপ্তাহের শুরুর দিনে তার সাপ্তাহিক হাত খরচ বাবদ টাকা পেয়ে থাকেন। সেই টাকা দিয়ে পুরো সপ্তাহ তার চলতে হয়। সুতরাং স্বামীর পক্ষে অপব্যয় কিংবা বাড়তি খরচ করার কোনো সুযোগ সেখানে নেই। পারিবারিক সঞ্চয় এভাবে প্রথাগত ব্যবস্থাদির দ্বারা উৎসাহিত হচ্ছে। জাপানের নারীরা বাইরের কাজে তেমন অবদান রাখছেন না ঠিকই, কিন্তু গৃহে যে দায়িত্ব তারা পালন করেন, তার আর্থিক ও তাৎপর্য মূল্য অনেক বেশি।
জাপানে কলকারখানা কিংবা অফিস-আদালতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন হয় না। অর্থবছর শুরুর পরপরই একটি নির্দিষ্ট দিনে শ্রমিক-মালিক পক্ষ একত্রে বসে বিগত বছরের আয়-ব্যয়ের স্থিতিপত্র সামনে নিয়ে খোলাখুলি আলোচনায় বসে স্থির করে আগামী বছরে বেতন বেশি হবে, না কম হবে। কোম্পানি টিকলে আমি টিকব- এই নীতিতে বিশ্বাসী সবাই যার যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকে। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী কিংবা তার ছেলেকে কর্মকালীন আলাদা করে শনাক্ত করা যায় না। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সবাই নিজেকে ওই কোম্পানির চাকুরে হিসেবে বিবেচনা করে। বছর শেষে কোম্পানির নিট লাভ-লোকসান যা হয়, তাই-ই তার প্রকৃত পাওনা। কোম্পানিতে বড় সাহেব, ছোট সাহেব বলে কোনো ভেদ-বিভেদ নেই। আছে কর্মক্ষমতা দক্ষতা আর দায়িত্ব অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস। সেখানে একজন সাধারণ কর্মীরও অবদান রাখার সুযোগ আছে। কোম্পানির সার্বিক অগ্রগতির পেছনে পরামর্শ দেয়ার স্বীকৃতি আছে সবার। সনি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ মরিতা সান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে প্রথমে তিনি পরিদর্শনে যান কারখানার টয়লেটগুলো। তিনি মনে করতেন টয়লেট ও অন্যান্য আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রাখার দায়িত্বে রয়েছে যেসব শ্রমিক, তাদেরও যথেষ্ট অবদান রাখার অবকাশ আছে উৎপাদনে। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন, উৎপাদন শ্রমিকেরা অবসরে যখন টয়লেটে আসে, তখন তা যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পায়, তাহলে তাদের মন প্রসন্ন হয়। সিটে ফিরে গিয়ে তারা উৎপাদনে পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারে। এর ফলে উৎপাদনের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। এভাবে দিনে যদি ১০০০ টেলিভিশন উৎপাদিত হয় কোনো কারখানায়, মরিতা সানের মতে, তার মধ্যে ন্যূনতম ৪টি টেলিভিশন উৎপাদন বেশি হয় শ্রমিকের প্রসন্ন মন-মানসিকতার কারণে। তিনি সবাইকেই উৎপাদনের যোগ্য অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন। ফলে শ্রেণী ও পর্যায় ভেদে সবাই যার যার কাজ তা সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পাদন করে। হোন্ডা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা নিজেই হোন্ডা মোটরসাইকেলের ডিজাইন করতেন গভীর রাতে। গভীর মনোনিবেশ সহকারে তিনি যাতে এ কাজ করতে পারেন, সে জন্য তার স্ত্রীও তার সঙ্গে রাত জাগতেন। রাতে ফেরিওয়ালা মিষ্টি আলু বিক্রি করত সুন্দর সুরে গান করে। ফেরিওয়ালার গানের সুরে হোন্ডা সাহেবের মনোনিবেশে যাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়, সে জন্য তার স্ত্রী ফেরিওয়ালার পুরো আলু কিনে নিয়ে তাকে ঘরে ফিরে যেতে অনুরোধ করতেন। এ হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি বলে বলীয়ান জাপানে পথিকৃৎদের প্রতিষ্ঠার কাহিনী। টয়োটা পরিবারের উত্থান একজন ব্যক্তির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। অনুসন্ধিৎসা ও গভীর নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সামান্য অবস্থা থেকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এক বিশাল শিল্প সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। কোয়ালিটির প্রশ্নে কোনো আপস নেই- পরিবেশনে, মুন্সিয়ানায় ও আন্তরিকতায় কমতি নেই। ডিজাইন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গভীর অভিনিবেশ সহকারে এমন সচেতন ও একাগ্রতার সমাহার ঘটানো হয়ে থাকে, যাতে উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে অপচয়-বাতিল-পরিত্যক্তের পরিমাণ কমে আসে।
জাপানে ইনকর্পোরেটেডের চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে পুনর্গঠন প্রয়াসের সময় থেকে। জাপান ইনকর্পোরেটেডের নিয়ন্ত্রণে প্রধান তিনটি পক্ষ হল- রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা আর বেসরকারি শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ব্যক্তিত্ব। সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রকৌশলী ফুকুদা যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন জাপানের বিশৃঙ্খল অর্থনীতিকে পথে আনার জন্য ‘অর্থনৈতিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। ওহিরা, যিনি এক সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনিও তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন অর্থনীতিতে ভালো না করতে পারলে নিস্তার নেই। জাপানের আমলা শ্রেণীও সার্বিক জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে নিবেদিত চিত্ত। সেখানে বেসরকারি খাতের পোশক প্রতিষ্ঠানই হল গোটা সরকারি আমলা শ্রেণী। উন্নয়নশীল অনেক দেশে আমলারা নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যার যার মন্ত্রণালয় বা বিভাগে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অবস্থান নিয়ে থাকেন। রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা শুধু রাজস্ব বাড়াবার কথা ভেবে বসে থাকেন। বর্ধিত রাজস্ব আদায়ের নামে শিল্প বিকাশের পথ রুদ্ধ হচ্ছে কিনা কিংবা অন্য বিভাগের কর্মসূচি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কিনা এবং এর ফলে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হচ্ছে কিনা, তা দেখার কথা যেন তাদের নয়। মনে রাখতে হবে, একটি ক্ষেত্রে আপাত কিছু ছাড় দেয়ায় অর্থনীতির অপর কার্যক্রম গতিশীলতা পেলে সার্বিকভাবে অর্থনীতিই লাভবান হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পর্যটন দফতর তাদের মোটেলের ভাড়ার হার সামান্য হ্রাস করলে অধিক পর্যটক আসতে আগ্রহী হতে পারে। তাতে পর্যটন মোটেলের আয় হয়তো একটু কম হবে, তবে বেশি পর্যটক এলে অন্যান্য দফতর ও ক্ষেত্রের আয় বাড়বে। কেননা ট্যুরিস্টরা শুধু মোটেলে ঘুমাতে আসেন না। সেখানকার কুটির শিল্পজাত পণ্যসহ আরও অনেক সামগ্রীর বিক্রি বাড়লে উৎপাদন সংশ্লিষ্ট সবার আয় বাড়বে। এটা হল সমন্বয়ের ব্যাপার। জাপানের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও সংগঠিত নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। সবাই এক সূত্রে কথা বলেন সরকারের সঙ্গে। সেখানে দলাদলি নেই। এক অ্যাসোসিয়েশন অন্য অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে শত্র“তা বা বৈরিতা পোষণ করে না। সেখানকার ফেয়ার ট্রেড কমিশন কারও প্রতি কটাক্ষ করে নয়, বরং নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণকেই তার ধর্ম মনে করে। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির জয়-জয়কার।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments