সময়চিত্র- শাবাশ আওয়ামী লীগ by আসিফ নজরুল
একজন মানুষও ভোট দেয়নি। নির্বাচনের দিন
পর্যন্ত আসেনি। তবু আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটের মিত্ররা আগামী পাঁচ বছরের
জন্য নির্বাচিত হয়ে গেছে!
ভোটহীন, প্রার্থীহীন ও
নির্বাচনহীন নির্বাচনে জেতার এই অনন্য রেকর্ড এই ভূবিশ্বে একটি দলই করতে
পেরেছে। সেটি আমাদের প্রিয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নেতারা আমাদের অভিবাদন
গ্রহণ করুন।
এই নির্বাচনী বিজয়ের মাহাত্ম্য বলে শেষ করা যাবে না। এই বিজয় সম্পন্ন করার জন্য আওয়ামী লীগ মহাজোট সরকারকে সর্বদলীয় সরকারে রূপান্তরিত করেছে, রওশন এরশাদ ও রাশেদ খান মেননকে একসঙ্গে শপথ গ্রহণ করিয়েছে, জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র পরে ‘শিশুতোষ’ গণ্য করে এড়িয়ে গেছে! এই বিজয় সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশন সময় পার হওয়ার পরও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার গ্রহণ করেছে, অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও দলের প্রার্থীরা নিজেরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করার পরও কমিশন তা গ্রহণ করতে অসম্মতি জানিয়েছে। কমিশন জাতীয় পার্টির অসম্মত ও প্রত্যাহারে ব্যর্থ প্রার্থীদের জোর করে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগে বিলীনকামী জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিকে উদারহস্তে নৌকায় চড়িয়েছে! ‘সার্চ কমিটির’ মাধ্যমে গঠিত নির্বাচন কমিশন ‘রিসার্চ’ করে করে এভাবে এক অভাবিত নির্বাচনহীন নির্বাচনের পরিকল্পনা সম্পন্ন করেছে! এই কমিশন এমন একটি অবাধ নির্বাচন করতে পারবে, তা সবচেয়ে বেশি বুঝতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ। দলের নেতাদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাকে অভিনন্দন!
এই বিজয় সম্পন্ন করার জন্য আরও বহু কাণ্ডকীর্তি হয়েছে। বিজয় সম্পন্ন করার প্রয়োজনে সন্ত্রাস দমনের বাহিনী র্যাব এরশাদ অসুস্থ তা বুঝতে পেরেছে, অচিরেই হয়তো অন্য কোনো সংস্থা তার মানসিক অসুস্থতাও খুঁজে বের করবে। এই বিজয়যাত্রা এরশাদের অর্ধযুগের সংসার ‘তছনছ’ করেছে, রওশাদ এরশাদকে শহীদ মিলনের স্মৃতিবিজড়িত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ে এসেছে, কাজী জাফর ‘মীর জাফর’ কিংবা ‘মীরমদন’ কি না সেই গুরুতর বিতর্ক জাতিকে উপহার দিয়েছে। এই বিজয়ের পথে সচরাচর জামানত হারানো বাম নেতারা নৌকায় বিলীন হয়েছেন, গডফাদার, মাদক ব্যবসায়ী বা চোরাকারবারি হিসেবে স্বনামধন্যদেরও বিজয় নিশ্চিত করতে বাকিরা সরে গেছে। বিএনএফ নামে একটি দলের হাইব্রিড জন্ম হয়েছে। এই বিজয়ের রূপকারদের অভিনন্দন।
গণতন্ত্রের এই নব অধ্যায় নির্মাণের পথে বাদ সাধতে চেয়েছিল প্রধান বিরোধী দল। তাই তাদের অফিস বিরতিহীনভাবে পুলিশ-র্যাবে অবরুদ্ধ রয়েছে, বয়সের ভারে ন্যুব্জ বিএনপির নেতাদের রিমান্ডের আদেশ হয়েছে, বাকি নেতারা বাড়িঘর ছেড়ে টেলিফোন বন্ধ রেখে আত্মগোপন করেছেন। বিএনপি অফিস থেকে অবরুদ্ধ, নিঃসঙ্গ ও অসুস্থ সন্ত্রাসী রুহুল কবির রিজভী গ্রেপ্তার হয়েছেন, রিজভীর ডামি সালাহ উদ্দিন আহমদ গোপন ভিডিও বার্তায় পারদর্শী হয়ে লাদেন খেতাব পেয়েছেন। ‘নতুন গণতন্ত্রের শত্রু’ খালেদা জিয়াকে ক্ষুব্ধ মানুষের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন যে বিএনপি নির্বাচনে এলে তাদের সঙ্গেও আসন ভাগাভাগি করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরও সর্বদলীয় করা যেত! খালেদা জিয়া তা ভাবতে পারেননি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির এই অসাধারণ সম্প্রীতির কথা ভেবেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী!
বাংলাদেশে নির্বাচন মানে ছিল কালোটাকা আর পেশিশক্তির খেলা। এই অশুভ প্রবণতা থেকে নির্বাচনকে রক্ষা করার জন্য দেশে ডজন ডজন আইন আর আচরণবিধি হয়েছে, শত শত গোলটেবিল আলোচনা হয়েছে, সেখান থেকে বহু সংবিধান বিশেষজ্ঞ আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। নির্বাচনকে কলুষমুক্ত করার বেশুমার ডলার, ইউরো আর বাংলাদেশি টাকা খরচ হয়েছে, এনজিও শিল্পের বিপুল বিকাশ হয়েছে, বহু ধারণাপত্র, প্রস্তাব আর ‘ইন-ডেপথ’ গবেষণার প্রসব হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে কালোটাকা আর পেশিশক্তির আস্ফাালন তাতে একটুও কমে যায়নি। এবারের মহান নির্বাচনে এক নিমেষে দেড় শতাধিক আসনে সেই আস্ফাালনকে নিশ্চিহ্ন করা গেছে। যেসব আসনে একতরফা নির্বাচন হবে, সেখানেও এই কালোটাকা আর পেশিশক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা প্রায় ধূলিসাৎ হয়েছে। পেশিশক্তি আর কালোটাকা দমনের জন্য নির্বাচনহীন নির্বাচনের এই অভিনব, অচিন্তনীয় আর অসাধারণ পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য আওয়ামী লীগের চেয়ে আর বেশি প্রশংসা কে পেতে পারে!
এই মহান বিজয়ের পথ তাই বলে নিষ্কণ্টক ছিল না। এই বিজয় রুখতে বিরোধী দলের জঙ্গিরা শহরে-গ্রামে আওয়ামী লীগের লোকদের পুড়িয়ে বা কুপিয়ে হত্যা করছে, পুলিশ-র্যাব নির্বিচারে গুলি ছুড়ে জঙ্গিদের হত্যা করছে, রহস্যময় নাশকতার ঘটনায় সাধারণ মানুষ প্রাণ দিচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে ককটেল আর পেট্রলবোমা মারার জন্য দোষারোপ করেছে।
দেশের সুশীল সমাজের অধিকতর বিদগ্ধ অংশটি শুধু বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, অন্য অংশ শুধু পুলিশ আর রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর সন্ত্রাসের নিন্দা করেছে। মিডিয়ার অধিকতর ‘প্রগতিশীল’ একটি অংশ শুধু জঙ্গিদের ককটেলে পোড়া মৃতদেহের ছবি ছাপছে, ‘সরকারবিরোধী’ অংশটি ছাপছে শুধু পুলিশের গুলিতে নিহতদের ছবি! সুশীল সমাজ আর মিডিয়া যে কত ‘অনিরপেক্ষ’ তা এই নির্বাচনের ডামাডোলে এভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নেতারা কেন এত দিন সুশীল সমাজ আর মিডিয়াকে তুলাধোনা করেছেন, তা ‘সচেতন নাগরিক সমাজ’ এখন বুঝতে পারছে। তাদের পক্ষ থেকে তাই নেতাদের অভিবাদন!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আওয়ামী লীগের একজন বর্ষীয়ান নেতা বহু আগে নেলসন ম্যান্ডেলা, আব্রাহাম লিংকন আর মহাত্মা গান্ধীর সমষ্টি বলে বর্ণনা করেছিলেন। উদার হূদয় এই গুণমুগ্ধ ব্যক্তি পরে রাষ্ট্রপতির পদকে অলংকৃত করেছিলেন। কিন্তু আমরা এত দিনে বুঝতে পারছি যে তিনি আসলে প্রধানমন্ত্রীর যথেষ্ট তারিফ করতে পারেননি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিছু ক্ষেত্রে ম্যান্ডেলা-লিংকনদের সবার সমষ্টিরও ঊর্ধ্বে। ম্যান্ডেলা আর লিংকনরা মিলে তাঁর মতো বন্ধুত্বময় নির্বাচনের কথা ভাবতে পারবেন না! লাস্কি থেকে শুরু করে হান্টিংটন পর্যন্ত পৃথিবীর তাবত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিলেও গণতন্ত্রের এমন নতুন দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পারবেন না। তিনি নতুনভাবে গণতন্ত্রকে বিনির্মাণ করেছেন। আসুন, আমরা তাঁর অবদানকে নতশিরে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি।
এই নির্বাচনের বিজয়যাত্রার পথে শত মানুষ প্রাণ দিয়েছে, হাজার মানুষ আহত হয়েছে, হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আরও বহু ক্ষয়ক্ষতি ভবিষ্যতে হয়তো হবে। কিন্তু এত কিছুর বিনিময়ে হলেও সংবিধান তো আমরা রক্ষা করতে পেরেছি! অতীতে কোনো সামরিক বা বেসামরিক সরকার বা কোনো তত্ত্বাবধায়ক সংবিধান রক্ষার জন্য এতটা ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। পেরেছে শুধু আওয়ামী লীগের সরকার। দেশি-বিদেশি সব মূর্খের নসিহত প্রত্যাখ্যান করে এই সরকার একটি নজিরবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান, গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতির অধিকারকে রক্ষা করেছে।
আসুন, আমরা মুক্তকণ্ঠে আওয়ামী লীগ সরকারের গুণকীর্তন করি! আওয়ামী লীগের বিজয়ের বন্দনা করি! জয় হোক আওয়ামী লীগের!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments