রাজনৈতিক সংকটে বিপন্ন কৃষি ও শিল্প খাত by ড. আর এম দেবনাথ
কীসের
ওপর লিখব? দুধের ওপর, হাঁস-মুরগির ওপর, না চায়ের ওপর? লেখা যায় শাকসবজির
ওপর। লেখা যায় পরিবহনের দুর্দিনের খবর। পোশাক শিল্পের কথা তো সব সময়ই লেখা
হচ্ছে। আবাসন শিল্প? কোনটা ছেড়ে কোনটার ওপর লিখব? চারদিকে অন্ধকার,
ধ্বংসযজ্ঞ, অগ্নিকাণ্ড, বিশৃংখলা। ত্রাহি ত্রাহি ভাব সর্বত্র। এই যেমন
দুগ্ধশিল্প। ভীষণ জরুরি একটা শিল্প যা পুষ্টি জোগায় অথচ যার অভাব প্রকট।
১৯৬০-৬৫ সালের দিকে এক সের (এক কেজির কিছু কম) দুধের দাম গ্রামাঞ্চলে ছিল
তিন আনা-চার আনা (চার আনা = ২৫ পয়সা)। এই দুধের দাম এখন ঢাকায় যদি ‘পিউর’
হয় তাহলে লিটারপ্রতি ৭৫-৮০ টাকা। সেই দুধ সেদিন কাগজে দেখলাম ‘ঘোষেরা’
মাটিতে ফেলে দিচ্ছে। ঘটনাস্থল জামালপুরের মাদারগঞ্জের ঘোষপাড়া। ডজন ডজন গরু
পালক দুধের বাজার না পেয়ে দুধ ফেলে দিচ্ছে মাটিতে। এতে ভোক্তারা
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শহরে যাদের সংখ্যা ৮-১০ লাখ। আর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
শত শত, হাজার হাজার পশুপালক, যাদের পেশাই গাই-গরু পালন করা আর দুধ বিক্রি
করা।
পত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম, একদিনের হরতাল বা ব্লকেডে কমপক্ষে ৫ লাখ লিটার দুধ নষ্ট হয়। ‘মিল্ক ভিটা’ প্রতিদিন ২৫ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। এ ব্যবসাটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পরিবহনের অভাবে ‘মিল্ক ভিটা’ তার সংগ্রহের কাজ করতে পারছে না। দেশের তিনটি বড় শহরেই ৩০ হাজার দুধ বিক্রয় কেন্দ্র আছে। এগুলো বন্ধ। এতে প্রায় ১০ লাখ সমবায়ী কৃষক এরই মধ্যে ১৫০ কোটি টাকার লোকসান দিয়েছে। অবুঝ শিশুরা এমনিতেই দুধ খেতে পায় না। গত ১৫-২০ দিন ধরে শিশুরা দুধের মুখ আর দেখছেই না। এদিকে পোলট্রি শিল্পের অবস্থা কী? এ শিল্পটি প্রায় ‘খতম’। এতে ব্যাংকগুলোর প্রচুর ফিন্যান্স আছে। দুধের জন্য হয়তো এত নেই। মোরগ-মুরগি চাষে রত খামারের এক-তৃতীয়াংশই বন্ধ। এ পোলট্রি শিল্প তিন মাসে চার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বলে খবর ছাপা হয়েছে। হাঁস-মুরগির চাহিদা নেই। ৩৫ টাকায় বাচ্চা উৎপাদন করে বিক্রি করতে হয় ১৫-২০ টাকায়। হরতাল-অবরোধের কারণে এক-তৃতীয়াংশ বাচ্চা বিক্রি হয়। পরিবহনের অসুবিধা, ক্রেতার অভাব। বাজারে ডিম নেই। ক্রেতাও নেই। আমাদের দরকার ছিল এখন মাছ-মাংস ও ডিম। চালের সমস্যা নেই। চালে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সমন্বিত জীবনের জন্য সমন্বিত-সুষম খাদ্যের জন্য দরকার মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ। এ পুরো খাতই এখন হরতাল-অবরোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত বললে ভুল হবে। এ খাত যে মার খেয়েছে তার থেকে উঠে দাঁড়াতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এর বোঝা পড়বে ব্যাংকগুলোর ওপর। এ কথায় পড়ে আসছি।
এদিকে দেখা যাচ্ছে চা শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা এরই মধ্যে ১০০ কোটি টাকার লোকসান দিয়েছে। সব চা বাগানের পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা নেই। ফলে পাতা নষ্ট হচ্ছে। চট্টগ্রামের নিলাম হাউসে চা পাঠানো যাচ্ছে না। সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ। নষ্ট হচ্ছে চায়ের গুণগত মান। অনেক বাগানে স্টক পড়ে আছে অবিক্রীত অবস্থায়। কিছুদিন পর এসব চায়ের কোনো বিক্রয় মূল্য থাকবে না। দুধ, ডিম, হাঁস-মুরগি, চা এসবই কৃষি খাতের বিষয়। এসব খাত পুড়ছে, দগ্ধ হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে, ব্যবসায়িকভাবে। তবে কি মূল কৃষি খাতের কাজ চলছে ভালোভাবে? নিশ্চয় না। এখন আমনের মৌসুম। বোরোর আয়োজনের সময়। প্রচুর ফলন হয়েছে। কিন্তু ধান-চালের দাম নেই। সরকার কিনবে চাল। এটা কৃষকের নেই, আছে মিলারদের। অতএব কৃষকের মাথায় হাত। এ সময় যাও কিছুটা দাম পাওয়া যেত তাও সম্ভব হচ্ছে না, কারণ চাল উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যেতে পারছে না। ট্রাক নেই। ড্রাইভার, হেলপার, শ্রমিক বেকার। তাদের রোজগার নেই, কারণ মালিকের দৈনিক আয় বন্ধ। অতএব তারা উপোসে। মালিকরা ব্যাংকের ‘লোনের’ টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। দেখা যাচ্ছে এর বোঝা, মানে পরিবহন শিল্পের বোঝাও ব্যাংকের ওপর পড়ছে।
এটা ডিসেম্বর মাস। ব্যাংকের বছর শেষ এ মাসে। বহু ব্যাংকের মুনাফা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। অনেক ব্যাংকের শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ বাড়বে। এতে দেখা দেবে মূলধন ঘাটতি। এদিকে কৃষক তো ধান-চালের দাম পাচ্ছে না। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। তাকে বোরোর প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। তার টাকার দরকার। বাধ্য হয়ে ধান-চাল বিক্রি করছে জলের দামে। বোরো ফসল পড়েছে বিপদে। সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারছে না। কৃষি উপকরণ পরিবাহিত হচ্ছে না। বলাই বাহুল্য, এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে বোরো উৎপাদনে। মজা হচ্ছে, কৃষক যখন দাম পাচ্ছে না তখনও কিন্তু ভোক্তারা মূল্য দিচ্ছে বেশি। বাজারে চালের দাম চড়া। চাল ঢাকায় আসতে পারছে না। অবরোধ। শুক্রবার একটা স্বস্তির দিন। সেদিনও বাস-ট্রাক-প্রাইভেট গাড়ি, সিএনজি পোড়ানো হচ্ছে। দিনে-রাতে সব সময়। ঢাকায় কম তো মফস্বলে বেশি, মফস্বলে কম তো ঢাকায় বেশি। কোনো রেয়াত নেই। ফলে পুরো কৃষি খাত শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। চলছে না ট্রাক-বাস, চলছে না নৌকা, চলছে না ট্রেন। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্য আনা-নেয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। এর কুফল পড়েছে খাদ্যমূল্যে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য জিনিসের দাম বাড়লে মানুষ তা ভোগ না করে পুষিয়ে নিতে পারে। কিন্তু চাল, আটা, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ইত্যাদির দাম বাড়লে, সয়াবিনের দাম বাড়লে মানুষের কোনো বিকল্প থাকে না।
এখন শীতকাল। এ সময় মানুষ একটু স্বস্তিতে থাকে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, নতুন আলু, পটোল, টমেটো, গাজর, বেগুন, লেটুস পাতা, ডাঁটা, লাউশাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, মুলা ইত্যাদি প্রাণভরে খাওয়ার এখনই সময়। এ সময় একটু সস্তা থাকে এসবের দাম। অথচ বিধি বাম। আঠারো দলীয় জোটের অবরোধ-হরতাল এবং এর সংশ্লিষ্ট ভাংচুর, ধ্বংসযজ্ঞ আজ মানুষের স্বপ্নকে চুরমার করে দিচ্ছে। এখনই পুঁটি মাছের চচ্চড়ি, ভাজা খাওয়ার সময়। এখনই দেশী কই খাওয়ার সময়, বাচা মাছ খাওয়ার সময়। টেংরা মাছ খাওয়ার সময়। নদীর মাছ খাওয়ার সময়। নিষ্ঠুর বাংলাদেশী রাজনীতির কারণে এসব আজ দুঃস্বপ্ন। ঢাকার আশপাশ থেকে শাকসবজি আসছে না, মাছ আসছে না টানা হরতাল, টানা অবরোধের কারণে।
শনিবার ছুটির দিন। সেদিনও অবরোধ। রাতেও অবরোধ, দিনেও অবরোধ। নৌকাতেও অবরোধ, ট্রেনেও অবরোধ, রাস্তায়ও অবরোধ। নরসিংদীর শাকসবজিওয়ালারা অভিশাপ দিচ্ছেন দিন-রাত। কোনো ক্রেতা নেই। ঢাকা থেকে পাইকাররা যেতে পারছে না। যেসব কৃষক শস্য আগাম বিক্রি করে দিয়েছে- সেই ক্ষতি এখন পাইকারদের। আবার যারা আগাম বিক্রি করেনি- সেই ক্ষতি কৃষকের। পাইকাররা পুষিয়ে নেয়। ফাঁকফোকর দিয়ে কিছু মাল ঢাকাস্থ করে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে। ফলে তার লোকসান কিছুটা পোষায়। কিন্তু ক্ষুদ্র কৃষকের সেই সুযোগ নেই। তারা পোশাক শিল্পের মালিক নন যে ‘ধমক’ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে সব সুযোগ আদায় করে নেবেন। তাদের মরণ মানে মরণই। বাঁচার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের কোনো বীমা সুযোগ নেই। তাদের অনেকের ব্যাংকঋণ আছে, কিন্তু খাতায় তাদের নাম থাকলেও ঋণের টাকা নিয়েছে টাউট-বাটপাররা, যারা দেশ ‘চালায়’, যারা ‘ঢাকার মালিকদের’ সঙ্গে ‘ভার্টিকালি’ সংযুক্ত।
দেখা যাচ্ছে মাসাধিককাল ধরে ঘটমান ধ্বংসযজ্ঞে বাংলাদেশের কৃষি এক গভীর জলে পড়েছে। নাক ভাসানো অবস্থা তার আর নেই। অথচ এই কৃষি আমাদের অনেকটা বাঁচিয়ে রেখেছে খাইয়ে। আবার তাদের ছেলেরাই বিদেশ থেকে রোজগার করে ডলার পাঠায়, যা পাচার করে ঢাকার অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা, ব্যবসায়ীরা, শিল্পপতিরা। বর্তমান ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কৃষি, বন, পশু সম্পদকে বাঁচিয়ে তোলা আগামী সরকারের পক্ষে কঠিন এক কাজ হবে। কৃষি থেকে বিচ্যুত লোকেরা শহরে এসে আশ্রয় নেয়, কাজ পায় আবাসন শিল্পে। লাখ লাখ শ্রমিক আবাসন শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এ শিল্প বহুদিন ধরে মরণাপন্ন। ক্রেতা নেই। ‘কালো টাকার’ বাজার আবাসন শিল্প। সে টাকা বিনিয়োগের ব্যবস্থা সরকার করেছে গত বাজেটে। কিন্তু রাজস্ব বিভাগ এসব মানে না। তাদের প্রশ্ন করার অভ্যাস রয়েছে অপরিবর্তিত। ফলে ক্রেতা নেই। অবরোধ-হরতালের কারণে কাজ বন্ধ। সিমেন্ট, বালু, ইট, পাথর ও অন্যান্য মালামাল সাইটে নেয়ার কোনো কায়দা নেই। ট্রাক চলে না। চট্টগ্রাম থেকে পণ্য আসে না। ক্রেতা নেই, সরবরাহ নেই, ব্যাংকের কড়াকড়ি। এতে ধুঁকে ধুঁকে মরছে আবাসন শিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে আরও বিশটি শিল্প। সেগুলোরও একই অবস্থা। ‘ত্রাহি মধুসূদন’! এ শিল্পের কাছেও ব্যাংকের পাওনা হাজার হাজার কোটি টাকা। তারা আসছে সুদ মওকুফের জন্য, ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য, ‘ব্লকড অ্যাকাউন্ট’ করার জন্য যাতে সুদ আর ধার্য করা না হয়। তাদের সিমেন্ট আমদানির ‘পিএডি’কে করতে হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। তারা ‘এলটিআর’ ‘ওভারভিউ’ রাখছেনÑ টাকা শোধ করতে পারছেন না।
পোশাক শিল্প চরম সংকটে। এদের সমস্যা অনেক। ইদানীং ১২০০ কোটি টাকা মূল্যের একটি পোশাক কারখানা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর মালিককে অতি সহজ শর্তে ৪০০ কোটি টাকার ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মালিকরা এখন অভিযোগ করছেন, ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করছেন। তারা চলে যাচ্ছেন অন্যত্র। ক্রেতারা শত হোক অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে চান না। ঠিক যেন শ্রীলংকার অবস্থা! অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমাদের অঞ্চলে পোশাক শিল্পে শ্রীলংকা ছিল অগ্রণী। কিন্তু শ্রীলংকা আক্রান্ত হয় গৃহযুদ্ধে- সিংহলি বনাম তামিল। সিংহলিরা সংখ্যালঘু তামিল হিন্দু-মুসলমানকে কোনো অধিকার দেবে না। এ নিয়ে বিরোধ। গৃহযুদ্ধ চলেছে দীর্ঘদিন। শ্রীলংকা ভীষণভাবে মার খায় পোশাক শিল্পে। এখন তাদের নামও শুনি না। বলা বাহুল্য, সেই সুবিধা আমরাও পেয়েছি। আজ অনেকটা এমনই অবস্থা আমাদের। আর কিছুদিন এভাবে চললে বিদেশী ক্রেতারা বসে থাকবে না। তারা বিকল্প বাজার খুঁজবে। এটি হলে কার কী হবে জানি না, ৩০-৪০ লাখ নারী শ্রমিক বেকার হবে। বাড়বে সামাজিক অস্থিরতা। বহু ছোট ছোট শিল্প মারা যাবে। কারণ এ নারী শ্রমিকদের ওপর ভর করে অনেক চুড়ি, শাড়ি, লিপস্টিক, স্নো ইত্যাদির কারখানা দেশে গড়ে উঠেছে।
দেখা যাচ্ছে, একটা সমস্যা আরেকটা সমস্যায় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। কৃষি মরছে, দুগ্ধশিল্প মরছে, হাঁস-মুরগি-ডিম শিল্প মরছে, চা শিল্প মরছে। আবাসন শেষ হচ্ছে, গার্মেন্ট শেষ হচ্ছে। তাহলে রইল কী? রইলাম ‘আমরা আর মামুরা’। তাই নয় কি?
ড. আরএম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
পত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম, একদিনের হরতাল বা ব্লকেডে কমপক্ষে ৫ লাখ লিটার দুধ নষ্ট হয়। ‘মিল্ক ভিটা’ প্রতিদিন ২৫ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। এ ব্যবসাটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পরিবহনের অভাবে ‘মিল্ক ভিটা’ তার সংগ্রহের কাজ করতে পারছে না। দেশের তিনটি বড় শহরেই ৩০ হাজার দুধ বিক্রয় কেন্দ্র আছে। এগুলো বন্ধ। এতে প্রায় ১০ লাখ সমবায়ী কৃষক এরই মধ্যে ১৫০ কোটি টাকার লোকসান দিয়েছে। অবুঝ শিশুরা এমনিতেই দুধ খেতে পায় না। গত ১৫-২০ দিন ধরে শিশুরা দুধের মুখ আর দেখছেই না। এদিকে পোলট্রি শিল্পের অবস্থা কী? এ শিল্পটি প্রায় ‘খতম’। এতে ব্যাংকগুলোর প্রচুর ফিন্যান্স আছে। দুধের জন্য হয়তো এত নেই। মোরগ-মুরগি চাষে রত খামারের এক-তৃতীয়াংশই বন্ধ। এ পোলট্রি শিল্প তিন মাসে চার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বলে খবর ছাপা হয়েছে। হাঁস-মুরগির চাহিদা নেই। ৩৫ টাকায় বাচ্চা উৎপাদন করে বিক্রি করতে হয় ১৫-২০ টাকায়। হরতাল-অবরোধের কারণে এক-তৃতীয়াংশ বাচ্চা বিক্রি হয়। পরিবহনের অসুবিধা, ক্রেতার অভাব। বাজারে ডিম নেই। ক্রেতাও নেই। আমাদের দরকার ছিল এখন মাছ-মাংস ও ডিম। চালের সমস্যা নেই। চালে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সমন্বিত জীবনের জন্য সমন্বিত-সুষম খাদ্যের জন্য দরকার মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ। এ পুরো খাতই এখন হরতাল-অবরোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত বললে ভুল হবে। এ খাত যে মার খেয়েছে তার থেকে উঠে দাঁড়াতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এর বোঝা পড়বে ব্যাংকগুলোর ওপর। এ কথায় পড়ে আসছি।
এদিকে দেখা যাচ্ছে চা শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা এরই মধ্যে ১০০ কোটি টাকার লোকসান দিয়েছে। সব চা বাগানের পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা নেই। ফলে পাতা নষ্ট হচ্ছে। চট্টগ্রামের নিলাম হাউসে চা পাঠানো যাচ্ছে না। সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ। নষ্ট হচ্ছে চায়ের গুণগত মান। অনেক বাগানে স্টক পড়ে আছে অবিক্রীত অবস্থায়। কিছুদিন পর এসব চায়ের কোনো বিক্রয় মূল্য থাকবে না। দুধ, ডিম, হাঁস-মুরগি, চা এসবই কৃষি খাতের বিষয়। এসব খাত পুড়ছে, দগ্ধ হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে, ব্যবসায়িকভাবে। তবে কি মূল কৃষি খাতের কাজ চলছে ভালোভাবে? নিশ্চয় না। এখন আমনের মৌসুম। বোরোর আয়োজনের সময়। প্রচুর ফলন হয়েছে। কিন্তু ধান-চালের দাম নেই। সরকার কিনবে চাল। এটা কৃষকের নেই, আছে মিলারদের। অতএব কৃষকের মাথায় হাত। এ সময় যাও কিছুটা দাম পাওয়া যেত তাও সম্ভব হচ্ছে না, কারণ চাল উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যেতে পারছে না। ট্রাক নেই। ড্রাইভার, হেলপার, শ্রমিক বেকার। তাদের রোজগার নেই, কারণ মালিকের দৈনিক আয় বন্ধ। অতএব তারা উপোসে। মালিকরা ব্যাংকের ‘লোনের’ টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। দেখা যাচ্ছে এর বোঝা, মানে পরিবহন শিল্পের বোঝাও ব্যাংকের ওপর পড়ছে।
এটা ডিসেম্বর মাস। ব্যাংকের বছর শেষ এ মাসে। বহু ব্যাংকের মুনাফা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। অনেক ব্যাংকের শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ বাড়বে। এতে দেখা দেবে মূলধন ঘাটতি। এদিকে কৃষক তো ধান-চালের দাম পাচ্ছে না। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। তাকে বোরোর প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। তার টাকার দরকার। বাধ্য হয়ে ধান-চাল বিক্রি করছে জলের দামে। বোরো ফসল পড়েছে বিপদে। সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারছে না। কৃষি উপকরণ পরিবাহিত হচ্ছে না। বলাই বাহুল্য, এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে বোরো উৎপাদনে। মজা হচ্ছে, কৃষক যখন দাম পাচ্ছে না তখনও কিন্তু ভোক্তারা মূল্য দিচ্ছে বেশি। বাজারে চালের দাম চড়া। চাল ঢাকায় আসতে পারছে না। অবরোধ। শুক্রবার একটা স্বস্তির দিন। সেদিনও বাস-ট্রাক-প্রাইভেট গাড়ি, সিএনজি পোড়ানো হচ্ছে। দিনে-রাতে সব সময়। ঢাকায় কম তো মফস্বলে বেশি, মফস্বলে কম তো ঢাকায় বেশি। কোনো রেয়াত নেই। ফলে পুরো কৃষি খাত শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। চলছে না ট্রাক-বাস, চলছে না নৌকা, চলছে না ট্রেন। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্য আনা-নেয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। এর কুফল পড়েছে খাদ্যমূল্যে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য জিনিসের দাম বাড়লে মানুষ তা ভোগ না করে পুষিয়ে নিতে পারে। কিন্তু চাল, আটা, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ইত্যাদির দাম বাড়লে, সয়াবিনের দাম বাড়লে মানুষের কোনো বিকল্প থাকে না।
এখন শীতকাল। এ সময় মানুষ একটু স্বস্তিতে থাকে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, নতুন আলু, পটোল, টমেটো, গাজর, বেগুন, লেটুস পাতা, ডাঁটা, লাউশাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, মুলা ইত্যাদি প্রাণভরে খাওয়ার এখনই সময়। এ সময় একটু সস্তা থাকে এসবের দাম। অথচ বিধি বাম। আঠারো দলীয় জোটের অবরোধ-হরতাল এবং এর সংশ্লিষ্ট ভাংচুর, ধ্বংসযজ্ঞ আজ মানুষের স্বপ্নকে চুরমার করে দিচ্ছে। এখনই পুঁটি মাছের চচ্চড়ি, ভাজা খাওয়ার সময়। এখনই দেশী কই খাওয়ার সময়, বাচা মাছ খাওয়ার সময়। টেংরা মাছ খাওয়ার সময়। নদীর মাছ খাওয়ার সময়। নিষ্ঠুর বাংলাদেশী রাজনীতির কারণে এসব আজ দুঃস্বপ্ন। ঢাকার আশপাশ থেকে শাকসবজি আসছে না, মাছ আসছে না টানা হরতাল, টানা অবরোধের কারণে।
শনিবার ছুটির দিন। সেদিনও অবরোধ। রাতেও অবরোধ, দিনেও অবরোধ। নৌকাতেও অবরোধ, ট্রেনেও অবরোধ, রাস্তায়ও অবরোধ। নরসিংদীর শাকসবজিওয়ালারা অভিশাপ দিচ্ছেন দিন-রাত। কোনো ক্রেতা নেই। ঢাকা থেকে পাইকাররা যেতে পারছে না। যেসব কৃষক শস্য আগাম বিক্রি করে দিয়েছে- সেই ক্ষতি এখন পাইকারদের। আবার যারা আগাম বিক্রি করেনি- সেই ক্ষতি কৃষকের। পাইকাররা পুষিয়ে নেয়। ফাঁকফোকর দিয়ে কিছু মাল ঢাকাস্থ করে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে। ফলে তার লোকসান কিছুটা পোষায়। কিন্তু ক্ষুদ্র কৃষকের সেই সুযোগ নেই। তারা পোশাক শিল্পের মালিক নন যে ‘ধমক’ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে সব সুযোগ আদায় করে নেবেন। তাদের মরণ মানে মরণই। বাঁচার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের কোনো বীমা সুযোগ নেই। তাদের অনেকের ব্যাংকঋণ আছে, কিন্তু খাতায় তাদের নাম থাকলেও ঋণের টাকা নিয়েছে টাউট-বাটপাররা, যারা দেশ ‘চালায়’, যারা ‘ঢাকার মালিকদের’ সঙ্গে ‘ভার্টিকালি’ সংযুক্ত।
দেখা যাচ্ছে মাসাধিককাল ধরে ঘটমান ধ্বংসযজ্ঞে বাংলাদেশের কৃষি এক গভীর জলে পড়েছে। নাক ভাসানো অবস্থা তার আর নেই। অথচ এই কৃষি আমাদের অনেকটা বাঁচিয়ে রেখেছে খাইয়ে। আবার তাদের ছেলেরাই বিদেশ থেকে রোজগার করে ডলার পাঠায়, যা পাচার করে ঢাকার অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা, ব্যবসায়ীরা, শিল্পপতিরা। বর্তমান ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কৃষি, বন, পশু সম্পদকে বাঁচিয়ে তোলা আগামী সরকারের পক্ষে কঠিন এক কাজ হবে। কৃষি থেকে বিচ্যুত লোকেরা শহরে এসে আশ্রয় নেয়, কাজ পায় আবাসন শিল্পে। লাখ লাখ শ্রমিক আবাসন শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এ শিল্প বহুদিন ধরে মরণাপন্ন। ক্রেতা নেই। ‘কালো টাকার’ বাজার আবাসন শিল্প। সে টাকা বিনিয়োগের ব্যবস্থা সরকার করেছে গত বাজেটে। কিন্তু রাজস্ব বিভাগ এসব মানে না। তাদের প্রশ্ন করার অভ্যাস রয়েছে অপরিবর্তিত। ফলে ক্রেতা নেই। অবরোধ-হরতালের কারণে কাজ বন্ধ। সিমেন্ট, বালু, ইট, পাথর ও অন্যান্য মালামাল সাইটে নেয়ার কোনো কায়দা নেই। ট্রাক চলে না। চট্টগ্রাম থেকে পণ্য আসে না। ক্রেতা নেই, সরবরাহ নেই, ব্যাংকের কড়াকড়ি। এতে ধুঁকে ধুঁকে মরছে আবাসন শিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে আরও বিশটি শিল্প। সেগুলোরও একই অবস্থা। ‘ত্রাহি মধুসূদন’! এ শিল্পের কাছেও ব্যাংকের পাওনা হাজার হাজার কোটি টাকা। তারা আসছে সুদ মওকুফের জন্য, ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য, ‘ব্লকড অ্যাকাউন্ট’ করার জন্য যাতে সুদ আর ধার্য করা না হয়। তাদের সিমেন্ট আমদানির ‘পিএডি’কে করতে হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। তারা ‘এলটিআর’ ‘ওভারভিউ’ রাখছেনÑ টাকা শোধ করতে পারছেন না।
পোশাক শিল্প চরম সংকটে। এদের সমস্যা অনেক। ইদানীং ১২০০ কোটি টাকা মূল্যের একটি পোশাক কারখানা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর মালিককে অতি সহজ শর্তে ৪০০ কোটি টাকার ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মালিকরা এখন অভিযোগ করছেন, ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করছেন। তারা চলে যাচ্ছেন অন্যত্র। ক্রেতারা শত হোক অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে চান না। ঠিক যেন শ্রীলংকার অবস্থা! অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমাদের অঞ্চলে পোশাক শিল্পে শ্রীলংকা ছিল অগ্রণী। কিন্তু শ্রীলংকা আক্রান্ত হয় গৃহযুদ্ধে- সিংহলি বনাম তামিল। সিংহলিরা সংখ্যালঘু তামিল হিন্দু-মুসলমানকে কোনো অধিকার দেবে না। এ নিয়ে বিরোধ। গৃহযুদ্ধ চলেছে দীর্ঘদিন। শ্রীলংকা ভীষণভাবে মার খায় পোশাক শিল্পে। এখন তাদের নামও শুনি না। বলা বাহুল্য, সেই সুবিধা আমরাও পেয়েছি। আজ অনেকটা এমনই অবস্থা আমাদের। আর কিছুদিন এভাবে চললে বিদেশী ক্রেতারা বসে থাকবে না। তারা বিকল্প বাজার খুঁজবে। এটি হলে কার কী হবে জানি না, ৩০-৪০ লাখ নারী শ্রমিক বেকার হবে। বাড়বে সামাজিক অস্থিরতা। বহু ছোট ছোট শিল্প মারা যাবে। কারণ এ নারী শ্রমিকদের ওপর ভর করে অনেক চুড়ি, শাড়ি, লিপস্টিক, স্নো ইত্যাদির কারখানা দেশে গড়ে উঠেছে।
দেখা যাচ্ছে, একটা সমস্যা আরেকটা সমস্যায় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। কৃষি মরছে, দুগ্ধশিল্প মরছে, হাঁস-মুরগি-ডিম শিল্প মরছে, চা শিল্প মরছে। আবাসন শেষ হচ্ছে, গার্মেন্ট শেষ হচ্ছে। তাহলে রইল কী? রইলাম ‘আমরা আর মামুরা’। তাই নয় কি?
ড. আরএম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
No comments