তারানকোর সফর : অতঃপর? by বেগম জাহান আরা
যা
আমরা নিজেরা পারিনি, তা পেরেছেন অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। সরকারি ও
বিরোধী দলের নেতাদের এক টেবিলে বসিয়ে সূচনা করে দিয়েছেন সামনাসামনি কথা
বলার। মানে সংলাপের। আর্জেন্টিনিয়ান তারানকোকে বলা হয় ঝানু কূটনীতিক।
মানতেই হবে। ছয়দিন বিরামহীন দৌড়ঝাঁপ করে দুই দলের শক্ত আড়ি ভাঙিয়েছেন।
সামনাসামনি কথা বলেছেন দুই দলের নেতারা। অবশ্যই তারানকোর মধ্যস্থতায়।
সংলাপের ফলাফল দেখার কথা তার ছিল না। সেটা পরিণত বুদ্ধির মানুষরা আশাও করেন
না নিশ্চয়। তারানকোও জানতেন, আমরাও জানি সংলাপের বিষয়বস্তু কী। নেতারা
বলছেন, শুরু হওয়া সংলাপ চলতে থাকবে। এটা ইতিবাচক তো বটেই। তাই তারানকোর
‘মিশন সংলাপ’ সফল হওয়ার পর দুই দলের বাক-সম্পর্ককে স্বাগত জানিয়েছেন
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে কথাও বলেছেন। এতে বোঝা
যায় তার খুশিটা। স্বাগত জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও।
ক’দিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এসেছিলেন সফরে। বাংলাদেশের
রাজনৈতিক সংকট এবং প্রায় অচলাবস্থা নিয়ে তিনিও আলোচনা করেছেন নেতাদের
সঙ্গে। চীনও বসে নেই। রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে দুই দলের সমঝোতা নিয়ে ভাবছে
চীনও। ভাবছে ইউরোপও। এক বান্ধবী বলল, নিশ্চয় বাংলাদেশে ইউরেনিয়ামের সন্ধান
পাওয়া গেছে!
তারানকো বেশ কয়েকবার বলেছেন, বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচন চায় জাতিসংঘ। সেটা তো বাংলাদেশের মানুষও চায়। কিন্তু সব রাজনৈতিক দল কি তা চায়? যদি তাই হতো, তাহলে সমঝোতার পথ খুলে যেত। প্রধানমন্ত্রী নিজেই একবার বলেছেন, তিনি শান্তি চান, প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না। হয়তো এমন সদিচ্ছাই তার ছিল। কিন্তু পারিষদ, দল হয়তো তাকে সেটা করতে দিচ্ছে না। প্রায় একদলীয় নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটা সবাই জেনেও ভুল পথে হাঁটছেন। এর আগেও এমন চেষ্টা হয়েছে। লাভবান হয়নি কেউ। টেকেওনি তেমন নির্বাচনের ফল। শুধু শুধু অপচয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। অপচয় হয়েছে পর্যাপ্ত মানুষের শ্রম। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। আর শেষ ফল হিসেবে জেদ আর ক্ষমতার লোভের পরাজয় মানতেই হয়েছে। আরও একটা বিষয় ভাবতে হবে। যে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলেই ধরে নিচ্ছেন সচেতন ও যুক্তিবাদী মানুষ, সেই নির্বাচনে অর্থ অপচয়ের প্রয়োজনই বা কী? মনোনয়ন দিয়েই কাজ চলতে পারে। আপসে-আপ জয়ী হচ্ছে প্রার্থীরা- তাহলে একদলীয় নির্বাচন, থুক্কু, মনোনয়নে অসুবিধা কোথায়? বান্ধবী আবার বলল, একদলে সবাই কি একমতের অনুসারী? তাহলে একটা আসনের জন্য একাধিক আবেদনপত্র জমা পড়ে কেন?
বলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন তো হতেই হবে। খাঁটি কথা। বাংলাদেশে বহু রাজনৈতিক দল আছে। প্রতিটা দলই নেতাসর্বস্ব। বেশ বোঝা যায়, দলের মধ্যে গণতন্ত্র নেই। মত প্রকাশসহ কোনো বিষয়ে স্রোতের উল্টোদিকে কেউ কথা বলতে চায় না। যারাই বলতে গেছে, তাদেরই দল ছাড়তে হয়েছে। এই তো পাঁচ বছর আগেও দলের নীতিতে সংস্কার আনতে চেয়ে বড় দুই দলই ভাঙা ভাঙা অবস্থায় পৌঁছেছিল। অনেক কষ্টে সামলে নিলেও ফাটল কিন্তু সারেনি। ঝরেও পড়েছে কিছু। তারা আবার নতুন দলও গড়েছে। এটাও একরকম গণতান্ত্রিক অধিকার তো বটেই। কিন্তু এতে কারও কি বড় কোনো লাভ হয়েছে? আমার মতে, দলকে শক্তিশালী এবং কার্যক্রমে ন্যায়পর করতে দলীয় ঐক্য দৃঢ় করার জন্য ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের রাশ টেনে ধরতে হয়। সংযমী হতে হয় মতামত আদান-প্রদানে। এসব কথা রাজনীতির মানুষরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক ভালো জানেন। কিন্তু মানতে পারেন না। দল করতে গিয়ে দাস হওয়াও ঠিক নয়, আবার টেক্কা দেয়ার মনোভাবও ঠিক নয়।
কথাগুলো এজন্য বললাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যখন বাতিল করা হয়, তখন আজকের অবস্থাটা কল্পনা করতে হতো। এযাবৎ যা দেখেছি, দুটি বড় দলের সংস্কৃতি হল, নির্বাচনের ফল মানতে না চাওয়া। তাই বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সংসদে বসেনই না। ফলে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবদানও রাখতে পারেন না। ফলে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পাস হয়ে যায় প্রায় নিরাপদে, আপসে কোনো বাধা না পেয়ে। এটাকেও কি গণতান্ত্রিক চর্চা বলা যায়? নির্বাচনে জিতে সংসদ বর্জন করাকেও গণতান্ত্রিক চর্চা বলা যায় না। আর সংসদ বর্জন করেও সংসদ সদস্য হিসেবে ষোলো আনা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করাকেও বলা যায় না গণতান্ত্রিক চর্চা। অথচ বড় দুটি দলই এমনটা করেছে। গণতন্ত্র চর্চা মানে শুধু নির্বাচন নয়। শুধু সাংবিধানিক বিধি-রীতি নয়। এ কথাগুলো টিভি টকশোতে বলছেন আলোকিত মানুষরা। সেই সুবাদেই বলছি কথাগুলো।
রাজনৈতিক সংকটে যখন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বারবার, তখনই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের ঘোষণা এল। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে তরুণ প্রজš§ ছুটে গেল শাহবাগ চত্বরে। গণজাগরণের তীর্থস্থান। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়টা তো চত্বর প্রজন্মেরই বিজয়। সেই রায় যখন কার্যকর হবে, তখন তারা আবেগাক্রান্ত হবেই। ফেসবুকে অজস্র লেখালেখি। অজস্র ছবি শাহবাগ চত্বরের। আলোক ঝলমল জনজোয়ারের সেই ছবিটা দেখলাম আবার ‘পোস্টে’। একটু পরই যেন দপ করে নিভে গেল সব আলো। আঁধারে ঢেকে গেল বাতিঘর। মানুষগুলোর মনের বাতিঘরের কথা বলছি। ঝুলে থাকল মোল্লার ফাঁসির ক্রিয়াকর্ম। ফাঁসি দেয়ার আদেশ স্থগিত ঘোষণা করা হল। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার নাভি পিল্লাই। এতেই কি গণেশ উল্টে গেল? পরে জানা গেল, আপিল বিভাগের শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করবে না সরকার। তাহলে সন্ধ্যাবেলা স্টান্ট খবর ঘোষণা করার কী প্রয়োজন ছিল? রায় কার্যকরে ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’র মতো তড়িঘড়ি করার কারণ নিয়ে মানুষজন তো ভাববেই। ওদিকে জেগে আছে শাহবাগ। আমরা জানি, রায় কার্যকর হবেই। দু’দিন আগে বা পরে। আমার বিচারে যুদ্ধাপরাধীরা যে অন্যায়, অমানবিক ও নৃশংস কর্মকাণ্ড করেছে অসহায় নিরীহ মানুষদের ওপরে, তার ক্ষমা হয় না। হাজার বছর পরও এই কুকীর্তির কথা মনে রাখবে বাংলার মানুষ। ঘৃণায় কুঞ্চিত করবে মুখ। অনেক আগেই এদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল।
কাদের মোল্লার ফাঁসি স্থগিত হওয়ার ঘটনায় আমিও স্থগিত করেছিলাম লেখা। আহা কি আনন্দ! এই কলম দিয়েই লেখতে পারছি যে, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে, ১২-১২-২০১৩ তারিখ রাত ১০টা ১ মিনিটে। এ দেশের মাটিতে অন্তত একজন রাজাকার-ঘাতক-নির্যাতক এবং প্রমাণিত জঘন্য মানুষ শাস্তি পেল অবশেষে। হোক না তা স্বাধীনতার ৪২ বছর পর। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে স্বাধীনতা ও মানবতার বিপক্ষের একজন শত্র“ তো শেষ হল। শুরু হল পাপ স্খলন প্রক্রিয়া। টিভি সংবাদেই দেখলাম শাহবাগের বাতিঘর। শত-সহস্র তরুণ প্রজšে§র হাতে বিজয়ের আলো। মুখে সাফল্যের হাসি। কণ্ঠে উজ্জীবনী সোগান। মন ভরে যায় ওদের তারুণ্য দেখলে। মৃত্যু ভুলে যাই ওদের হাতের আলো দেখলে। জীবনকে আলোকিত করতে পারে ওরাই। কিন্তু আরও কথা আছে। ফিরে আসি বাস্তবতায়। নির্বাচনের বিষয়গুলো এখনও স্বচ্ছ হল না। কে কী বলল, কে কী বোঝাল, সেটা বড় কথা নয়। দেশের জন্য, ষোলো কোটি মানুষের জন্য যা কল্যাণকর, তাই করতে হবে নেতাদের। এমন প্রতিশ্র“তি দিয়েই তারা নির্বাচনে জিতে আসেন। আশা ভঙ্গ হলে জনগণ তো কথা বলবেই। অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবও ক’দিন আগে বলেছেন, বিরোধী দল নির্বাচনে না এলে লোকজন ভোট দিতে আসবে না। এই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে কোন ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে নির্বাচন?
এলাকার বাচ্চারা প্রতিবারই কিছু না কিছুর আয়োজনে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান করে। এবার মনমরা সবাই। কারও কারও পরীক্ষা শেষ হয়নি। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র দেখে যারা পরীক্ষা দিয়েছে, তারা ভয়ে ভয়ে আছে। না জানি আবার কবে পরীক্ষার ঘোষণা শোনা যায়। মায়েরা উৎকণ্ঠিত। পত্র-পত্রিকায় অটোপ্রমোশনের প্রস্তাবও দেখলাম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও কাহিল। শুক্রবার সারাদিন ক্লাস করে কোনোরকমে সিলেবাসের পড়া শেষ করছে। পরীক্ষা দিয়ে পাসও করবে। শিখবে কতটুকু?
বারবার আমরা প্রজন্মের কথা বলি। উঠতি প্রজন্মরা বেড়ে উঠছে প্রতিদিন। কী দেখছে তারা? কী শিখেছে তারা? ওদের সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি করতেই হবে রাজনৈতিক নেতাদের। কবিই শুধু বলেননি, ‘আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে’; আমাদের মনেও প্রজন্মের জন্য সেই প্রার্থনা নিরন্তর। নির্বাচন তো আমরা চাই-ই। সমঝোতা করে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন হোক, সেটাই চাই। আর সেটা বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ দায় রাজনৈতিক নেতাদের। বিশেষ করে বড় দলের। কিন্তু সেই দলের নেতারা যদি আন্দোলন দমনে সমঝোতার বদলে গুলি করার কথা বলেন, তখন ভাষা হারিয়ে ফেলি। তবুও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মানবিক ও রাজনৈতিক সমাধান আশা করি। এই আশা নিয়েই অসহায় আমজনতা বেঁচে আছে। আর কি-ই বা করতে পারি আমরা?
বেগম জাহান আরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, গবেষক
তারানকো বেশ কয়েকবার বলেছেন, বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচন চায় জাতিসংঘ। সেটা তো বাংলাদেশের মানুষও চায়। কিন্তু সব রাজনৈতিক দল কি তা চায়? যদি তাই হতো, তাহলে সমঝোতার পথ খুলে যেত। প্রধানমন্ত্রী নিজেই একবার বলেছেন, তিনি শান্তি চান, প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না। হয়তো এমন সদিচ্ছাই তার ছিল। কিন্তু পারিষদ, দল হয়তো তাকে সেটা করতে দিচ্ছে না। প্রায় একদলীয় নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটা সবাই জেনেও ভুল পথে হাঁটছেন। এর আগেও এমন চেষ্টা হয়েছে। লাভবান হয়নি কেউ। টেকেওনি তেমন নির্বাচনের ফল। শুধু শুধু অপচয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। অপচয় হয়েছে পর্যাপ্ত মানুষের শ্রম। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। আর শেষ ফল হিসেবে জেদ আর ক্ষমতার লোভের পরাজয় মানতেই হয়েছে। আরও একটা বিষয় ভাবতে হবে। যে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলেই ধরে নিচ্ছেন সচেতন ও যুক্তিবাদী মানুষ, সেই নির্বাচনে অর্থ অপচয়ের প্রয়োজনই বা কী? মনোনয়ন দিয়েই কাজ চলতে পারে। আপসে-আপ জয়ী হচ্ছে প্রার্থীরা- তাহলে একদলীয় নির্বাচন, থুক্কু, মনোনয়নে অসুবিধা কোথায়? বান্ধবী আবার বলল, একদলে সবাই কি একমতের অনুসারী? তাহলে একটা আসনের জন্য একাধিক আবেদনপত্র জমা পড়ে কেন?
বলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন তো হতেই হবে। খাঁটি কথা। বাংলাদেশে বহু রাজনৈতিক দল আছে। প্রতিটা দলই নেতাসর্বস্ব। বেশ বোঝা যায়, দলের মধ্যে গণতন্ত্র নেই। মত প্রকাশসহ কোনো বিষয়ে স্রোতের উল্টোদিকে কেউ কথা বলতে চায় না। যারাই বলতে গেছে, তাদেরই দল ছাড়তে হয়েছে। এই তো পাঁচ বছর আগেও দলের নীতিতে সংস্কার আনতে চেয়ে বড় দুই দলই ভাঙা ভাঙা অবস্থায় পৌঁছেছিল। অনেক কষ্টে সামলে নিলেও ফাটল কিন্তু সারেনি। ঝরেও পড়েছে কিছু। তারা আবার নতুন দলও গড়েছে। এটাও একরকম গণতান্ত্রিক অধিকার তো বটেই। কিন্তু এতে কারও কি বড় কোনো লাভ হয়েছে? আমার মতে, দলকে শক্তিশালী এবং কার্যক্রমে ন্যায়পর করতে দলীয় ঐক্য দৃঢ় করার জন্য ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের রাশ টেনে ধরতে হয়। সংযমী হতে হয় মতামত আদান-প্রদানে। এসব কথা রাজনীতির মানুষরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক ভালো জানেন। কিন্তু মানতে পারেন না। দল করতে গিয়ে দাস হওয়াও ঠিক নয়, আবার টেক্কা দেয়ার মনোভাবও ঠিক নয়।
কথাগুলো এজন্য বললাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যখন বাতিল করা হয়, তখন আজকের অবস্থাটা কল্পনা করতে হতো। এযাবৎ যা দেখেছি, দুটি বড় দলের সংস্কৃতি হল, নির্বাচনের ফল মানতে না চাওয়া। তাই বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সংসদে বসেনই না। ফলে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবদানও রাখতে পারেন না। ফলে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পাস হয়ে যায় প্রায় নিরাপদে, আপসে কোনো বাধা না পেয়ে। এটাকেও কি গণতান্ত্রিক চর্চা বলা যায়? নির্বাচনে জিতে সংসদ বর্জন করাকেও গণতান্ত্রিক চর্চা বলা যায় না। আর সংসদ বর্জন করেও সংসদ সদস্য হিসেবে ষোলো আনা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করাকেও বলা যায় না গণতান্ত্রিক চর্চা। অথচ বড় দুটি দলই এমনটা করেছে। গণতন্ত্র চর্চা মানে শুধু নির্বাচন নয়। শুধু সাংবিধানিক বিধি-রীতি নয়। এ কথাগুলো টিভি টকশোতে বলছেন আলোকিত মানুষরা। সেই সুবাদেই বলছি কথাগুলো।
রাজনৈতিক সংকটে যখন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বারবার, তখনই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের ঘোষণা এল। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে তরুণ প্রজš§ ছুটে গেল শাহবাগ চত্বরে। গণজাগরণের তীর্থস্থান। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়টা তো চত্বর প্রজন্মেরই বিজয়। সেই রায় যখন কার্যকর হবে, তখন তারা আবেগাক্রান্ত হবেই। ফেসবুকে অজস্র লেখালেখি। অজস্র ছবি শাহবাগ চত্বরের। আলোক ঝলমল জনজোয়ারের সেই ছবিটা দেখলাম আবার ‘পোস্টে’। একটু পরই যেন দপ করে নিভে গেল সব আলো। আঁধারে ঢেকে গেল বাতিঘর। মানুষগুলোর মনের বাতিঘরের কথা বলছি। ঝুলে থাকল মোল্লার ফাঁসির ক্রিয়াকর্ম। ফাঁসি দেয়ার আদেশ স্থগিত ঘোষণা করা হল। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার নাভি পিল্লাই। এতেই কি গণেশ উল্টে গেল? পরে জানা গেল, আপিল বিভাগের শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করবে না সরকার। তাহলে সন্ধ্যাবেলা স্টান্ট খবর ঘোষণা করার কী প্রয়োজন ছিল? রায় কার্যকরে ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’র মতো তড়িঘড়ি করার কারণ নিয়ে মানুষজন তো ভাববেই। ওদিকে জেগে আছে শাহবাগ। আমরা জানি, রায় কার্যকর হবেই। দু’দিন আগে বা পরে। আমার বিচারে যুদ্ধাপরাধীরা যে অন্যায়, অমানবিক ও নৃশংস কর্মকাণ্ড করেছে অসহায় নিরীহ মানুষদের ওপরে, তার ক্ষমা হয় না। হাজার বছর পরও এই কুকীর্তির কথা মনে রাখবে বাংলার মানুষ। ঘৃণায় কুঞ্চিত করবে মুখ। অনেক আগেই এদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল।
কাদের মোল্লার ফাঁসি স্থগিত হওয়ার ঘটনায় আমিও স্থগিত করেছিলাম লেখা। আহা কি আনন্দ! এই কলম দিয়েই লেখতে পারছি যে, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে, ১২-১২-২০১৩ তারিখ রাত ১০টা ১ মিনিটে। এ দেশের মাটিতে অন্তত একজন রাজাকার-ঘাতক-নির্যাতক এবং প্রমাণিত জঘন্য মানুষ শাস্তি পেল অবশেষে। হোক না তা স্বাধীনতার ৪২ বছর পর। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে স্বাধীনতা ও মানবতার বিপক্ষের একজন শত্র“ তো শেষ হল। শুরু হল পাপ স্খলন প্রক্রিয়া। টিভি সংবাদেই দেখলাম শাহবাগের বাতিঘর। শত-সহস্র তরুণ প্রজšে§র হাতে বিজয়ের আলো। মুখে সাফল্যের হাসি। কণ্ঠে উজ্জীবনী সোগান। মন ভরে যায় ওদের তারুণ্য দেখলে। মৃত্যু ভুলে যাই ওদের হাতের আলো দেখলে। জীবনকে আলোকিত করতে পারে ওরাই। কিন্তু আরও কথা আছে। ফিরে আসি বাস্তবতায়। নির্বাচনের বিষয়গুলো এখনও স্বচ্ছ হল না। কে কী বলল, কে কী বোঝাল, সেটা বড় কথা নয়। দেশের জন্য, ষোলো কোটি মানুষের জন্য যা কল্যাণকর, তাই করতে হবে নেতাদের। এমন প্রতিশ্র“তি দিয়েই তারা নির্বাচনে জিতে আসেন। আশা ভঙ্গ হলে জনগণ তো কথা বলবেই। অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবও ক’দিন আগে বলেছেন, বিরোধী দল নির্বাচনে না এলে লোকজন ভোট দিতে আসবে না। এই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে কোন ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে নির্বাচন?
এলাকার বাচ্চারা প্রতিবারই কিছু না কিছুর আয়োজনে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান করে। এবার মনমরা সবাই। কারও কারও পরীক্ষা শেষ হয়নি। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র দেখে যারা পরীক্ষা দিয়েছে, তারা ভয়ে ভয়ে আছে। না জানি আবার কবে পরীক্ষার ঘোষণা শোনা যায়। মায়েরা উৎকণ্ঠিত। পত্র-পত্রিকায় অটোপ্রমোশনের প্রস্তাবও দেখলাম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও কাহিল। শুক্রবার সারাদিন ক্লাস করে কোনোরকমে সিলেবাসের পড়া শেষ করছে। পরীক্ষা দিয়ে পাসও করবে। শিখবে কতটুকু?
বারবার আমরা প্রজন্মের কথা বলি। উঠতি প্রজন্মরা বেড়ে উঠছে প্রতিদিন। কী দেখছে তারা? কী শিখেছে তারা? ওদের সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি করতেই হবে রাজনৈতিক নেতাদের। কবিই শুধু বলেননি, ‘আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে’; আমাদের মনেও প্রজন্মের জন্য সেই প্রার্থনা নিরন্তর। নির্বাচন তো আমরা চাই-ই। সমঝোতা করে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন হোক, সেটাই চাই। আর সেটা বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ দায় রাজনৈতিক নেতাদের। বিশেষ করে বড় দলের। কিন্তু সেই দলের নেতারা যদি আন্দোলন দমনে সমঝোতার বদলে গুলি করার কথা বলেন, তখন ভাষা হারিয়ে ফেলি। তবুও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মানবিক ও রাজনৈতিক সমাধান আশা করি। এই আশা নিয়েই অসহায় আমজনতা বেঁচে আছে। আর কি-ই বা করতে পারি আমরা?
বেগম জাহান আরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, গবেষক
No comments