সবার আগে বাংলাদেশপন্থী হোন
নিউইয়র্কে ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানী খোবরাগাদেকে গ্রেপ্তার করে অপদস্ত করার ঘটনায় এক মোগল কাহিনি মনে পড়ল। পারস্যের রাষ্ট্রদূত সম্রাট শাজাহানের দিল্লির দরবারে আসেন কিন্তু কিছুতেই কুর্নিশ করেন না। তো তাঁকে শায়েস্তা করার জন্য এক ফন্দি কষলেন বাদশাহ শাজাহান। দরবারে ঢোকার মুখের বড় দরজাটা বন্ধ করে ছোট খিড়কিটা খোলা রাখলেন। ভাবলেন, এবার তো বেয়াড়া কূটনীতিককে তাঁর সামনে মাথা নত করতেই হবে। আমাদের দেশেও আমরা এখনো দেখি, বড় অতিথিদের জন্য বড় দরজাটা হাট করে খোলা হয়, আর সাধারণ মানুষদের ঢুকতে হয় বড় লোহার দরজার সঙ্গের ছোট একটি দরজা দিয়ে মাথা নত করে। যা হোক, দূত ঘটনা বুঝে পেছন ফিরে শরীরের পশ্চাদ্দেশটা আগে দরবারে ঢোকালেন। শাজাহান খাপ্পা হয়ে ফোড়ন কাটলেন, এ কী ঘোড়া ঢুকছে কেন আমার দরবারে! উল্লেখ্য, ঘোড়া আস্তাবলে ঢোকে পশ্চাদ্দেশ এগিয়ে দিয়ে। চটপটে দূতের ঝটপট উত্তর, আপনি কি মনে করেন এই দরবার ঘোড়ার আস্তাবলের চেয়ে ভালো কিছু! সম্রাটের তখন লাজবাব হওয়া ছাড়া উপায় নেই। মোগলরা যেহেতু পারস্য দেশের শাহেনশাহদেরই জ্ঞাতিভাই, তাই ঈর্ষা-রেষারেষিটা একটু বেশিই ছিল তাদের মধ্যে। কথার যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা কূটনীতিকদের কাজের অংশ। বলা হয়, কূটনীতিক তিনিই, যিনি দেশের স্বার্থে অবলীলায় মিথ্যা বলেন।
কিন্তু দেবযানীকে রাস্তা থেকে হাতকড়া পরিয়ে আটক করা হয়েছে, জামাকাপড় খুলে তল্লাশি করা হয়েছে কোনো কূটনৈতিক কর্মের জন্য নয়। তিনি মিথ্যা বলেছিলেন টাকার জন্য। তাঁর বাড়িতে ভারত থেকে ‘কাজের লোক’ হিসেবে যে মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিলেন, ভিসা আবেদনে তাঁর বেতন সম্পর্কে মার্কিন-মানে যে বেতন দেওয়ার কথা ছিল, কার্যত দিতেন তার বহু গুণ কম। কাজ করাতেন সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি। ভারত সরকার অবশ্যই দেবযানীর প্রতি আইনানুগ আচরণ করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক করতে পারে। পারে দিল্লির মার্কিন কূটনীতিকদের সুযোগ-সুবিধা বাতিল করতে। কিন্তু ভারতীয় কূটনীতিকেরা যে বিদেশে গৃহকর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করেন, তা ঢাকবেন কী করে? সামনে নির্বাচন, তাই ভোটারদের জাতীয়তাবাদী আবেগকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৃত্রিম বিবাদ ভারত করে দেখাবে। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, ভারতীয় কূটনীতিকদের কারও কারও গৃহকর্মী-শোষণের ঘটনাটাকে জাতীয়তাবাদী জোশ দিয়ে ঢেকে রাখা। এ ঘটনার অন্য দিকও আমাদের পাঠ করা দরকার। একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কেবল নিজ রাষ্ট্রের সীমানায়ই কার্যকর নয়, তা বিদেশে সেই রাষ্ট্রের নাগরিক ও কূটনীতিকদের অধিকার ও সম্মান রাখার ওপরও নির্ভরশীল। ভারত তার একজন কূটনীতিকের সম্মান রক্ষার মধ্যেই তার সার্বভৌম ক্ষমতার প্রমাণ রাখতে চাইছে। দেবযানী অপরাধ করুন বা না করুন, ভারতকে এভাবে তার নাগরিকদের চোখে ও বিদেশিদের কাছে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামর্থ্য দেখাতেই হবে। এই সামর্থ্য ভারতের হয়েছে জাতীয়তাবাদী জিগির তুলে নয়,
অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটানোর মাধ্যমে। অহরহই বাংলাদেশের নাগরিক তো বটেই, অনেক বড় বড় কর্মকর্তাও দেশে বিদেশি কূটনীতিকদের কথায় বা কাজে অপদস্ত হন। বড় অর্থনীতির হাতে এভাবে ছোট অর্থনীতির পয়মাল হওয়া নতুন নয়। কয়েকটি ঘটনা খুলে দেখা যাক। সম্প্রতি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং সেই বিচারে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়া নিয়ে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছে। সেই বেতাল দেশের একজন মাত্র এমপি এর বিরোধিতা করে বলেছেন, এটা বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়, এ ব্যাপারে পাকিস্তানের নাক গলানো উচিত নয়। একাত্তরের স্বাধীনতা ঘোষণা করা বাংলাদেশে নাক গলিয়ে নাকসহ আরও অনেক কিছুই কাটা পড়েছিল পাকিস্তানের। নব্বইয়ের দশকে আফগানিস্তানে হাত গলিয়ে হাত পুড়েছিল দেশটির। এখনো তাদের উদ্ধত স্বভাব গেল না। বাংলাদেশ ভুল-সঠিক যা-ই করুক, তা করছে নিজের দেশের মাটিতে, নিজের দেশের নাগরিকদের সঙ্গে। এ ব্যাপারে নাক গলানো সার্বভৌমত্বের প্রতি টিটকারি ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশ সরকার এর জোর প্রতিবাদ করেছে, অনলাইন-ব্লগে অনেককেই সোচ্চার থাকতে দেখা গেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বারবারই নিজের সামর্থ্যের চেয়ে বেশি অভিলাষ দেখাতে গিয়ে আরও দুর্বলই হয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশ নিজের সামর্থ্যকে সর্বদাই ছোট করে দেখে।
বিশ্বে যারই একটু শিং গজিয়েছে, সে-ই কোনো কোনো ভাবে বাংলাদেশিদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে থাকে। নব্য ধনী আরব রাষ্ট্রগুলোর আমাদের শ্রমিকদের সঙ্গে আচরণ, তুরস্কের মতো দেশের বাংলাদেশকে উপদেশ দানের ঘটনা আমরা মনে রাখছি। আরব-পাকিস্তান-তুরস্কের অযাচিত বাণীবর্ষণ বিষয়ে যাঁরা সোচ্চার, তাঁরাই আবার ভারতীয় উৎসাহী আচরণ নিয়ে মূক ও বধির। গত পাঁচ বছরে দেশটির কূটনীতিক ও নেতা-নেত্রীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য, কথা বলা ও বৈঠক করা নিয়ে রাজনৈতিক সমাজের একটি অংশের সম্পূর্ণ নীরবতা বাংলাদেশের জন্য ভালো ফল দেবে না। বিদেশিদের ভরসা করে স্বদেশিদের একটি অংশকে মোকাবিলা করা স্বাধীন দেশের নাগরিকের জন্য লজ্জার বিষয়। আমরা যেমন আমাদের জাতীয় অন্তঃকোন্দলকে আন্তর্জাতিক কোন্দলে রূপান্তরিত হতে দিতে পারি না, তেমনি আমাদের রাজনৈতিক সমস্যাকে ভারত-মার্কিনের হিসাব-নিকাশের ঘুঁটি বানাতে দিতেও পারি না। আরেক দল যুদ্ধাপরাধীর বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ ও আপত্তি উত্থাপনকারী পাকিস্তানের নাক গলানোয় প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে না পারলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাড়ানো নাকে চুমু খাচ্ছেন। এমনকি অনেকে সরকারের আচরণে রুষ্ট হয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ-জাতিসংঘসহ যাকে পাচ্ছে তারই হস্তক্ষেপ চাইছে। জনবিচ্ছিন্নতা ও জনগণের প্রতি অনাস্থা এভাবে দুই দলই প্রমাণ করছে।
আসলে বিদেশিদের প্রতি বাঙালিদের বিভিন্ন অংশের বিভিন্নমুখী আকর্ষণের কারণ জাতীয় হীনম্মন্যতাই শুধু নয়, রাজনৈতিক ঘরানাগুলোর পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের বাড়াবাড়িও বটে। বাংলাদেশিরা প্রথম বিবাদ করে ভাই-বোনে, তারপর প্রতিবেশীর সঙ্গে, তারপর বদনাম করে সবার। আমাদের রাজনীতির একটি পক্ষ অন্য পক্ষকে এতই ঘৃণা করে যে প্রতিপক্ষের ঘর পোড়াতে বাইরের লোক ডাকতে দ্বিধা করে না। মীরজাফরের জোগানে কখনো ঘাটতি হয়নি বলেই মগ-হার্মাদ-তুর্কি-ইংরেজরা আমাদের ওপর শত শত বছর ছড়ি ঘোরাতে পেরেছে। শেষ বিচারে হাসিনা-খালেদা এ দেশেরই মানুষ, এ দেশেই তাঁদের ভালোমন্দের দীর্ঘ ইতিহাস। তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এ দেশের মাটিতে ছাড়া আর কোথাও থাকার কথা নয়। দেশে যদি তাঁরা আস্থা হারান, কোনো বিদেশির কাছেই তাঁরা দাম পাবেন না। আবার মার্কিন মন্ত্রী-উপদেষ্টা আমাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে অযাচিত চাপ দেন, তখন কোনো বাংলাদেশির খুশি হওয়া উচিত নয়। যখন আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে কোনো দেশের পক্ষ থেকে অন্যায্য চাপাচাপি করা হয়, তখন আসলে রাষ্ট্র, সংবিধান, নাগরিকতা সবকিছুই অসম্মানিত ও লাঞ্ছিত হয়। আফগানিস্তানের পুতুল শাসক হামিদ কারজাই পর্যন্ত অভিযোগ করেছেন, আমেরিকা তাঁকে সম্মান করে না। আমরা কী করছি?
আমাদের নেতা-নেত্রী, জোট-মহাজোট, গণমাধ্যম-নেটমাধ্যম সবাই মিলে প্রকাশ্যে বিভিন্ন পক্ষের হস্তক্ষেপের সাফাই গাইছি। বাংলা নামের দেশ, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এর স্বাধীনতা, এর নাগরিকতার সম্মান সব খুইয়ে তখন আমরা দলের মাপে ছোট হতে থাকি, গোষ্ঠীর মাপে সংকীর্ণ হতে থাকি, ব্যক্তির মাপে ক্ষুদ্র হয়ে যাই, তখনই ওই মোগল গল্পের মতো আমাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় বড় দরজা। কেবল খোলা থাকে খিড়কি পথ। ১৬ কোটি বাংলাদেশির জন্য খিড়কি পথ নয়, সদর দরজাটা উন্মুক্ত করুন। কারও হস্তক্ষেপ চাইবার আগে ভাবুন, বাঙালি বা মুসলমান যাই হোন, সবার আগে বাংলাদেশি হোন। যে রঙেরই জাতীয়তাবাদী হোন, দেশপ্রেম নিয়োজিত করুন অর্থনৈতিক বিকাশে। অর্থনীতি সবল না হলে পাকিস্তানকে বকাবাদ্য করতে পারবেন, ভারতকে হিংসা করবেন, আমেরিকা বিষয়ে উদাসীন থাকবেন; কিন্তু দেশের স্বার্থ ও নাগরিকের অধিকার কিছুই বাঁচাতে পারবেন না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
bagharu@gmail.com
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
bagharu@gmail.com
No comments