বিশ্বায়নের কাল নজরদারিতে পেরেশান নাগরিককুল by কামাল আহমেদ
ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের
নিরাপত্তা—এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্যের মাপকাঠি নিয়ে চরম বিতর্কের মধ্যে
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এ দুই দেশের গোয়েন্দা কার্যক্রমের বিস্ময়কর
বিস্মৃতির যেসব তথ্য সম্প্রতি ফাঁস হতে শুরু করেছে, তাতে অনেকেরই
আক্কেলগুড়ুম হওয়ার কথা।
বিশ্বের শক্তিধর দুই রাষ্ট্রের
এসব গোপন এবং অনেকের মতে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী কার্যক্রমের বিশদ
তথ্যের সূত্র যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) একজন সাবেক
বিশ্লেষক এডওয়ার্ড স্নোডেন।
স্নোডেনের কাছ থেকেই জানা গেল বিশ্বব্যাপী টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের আড়িপাতা কার্যক্রম কতটা বিস্তৃত ছিল। তিনি আরও জানালেন যে যোগাযোগ খাতের বিভিন্ন বহুজাতিক এবং বৈশ্বিক কোম্পানি গ্রাহকদের অজ্ঞাতসারেই তাদের সম্পর্কে তথ্যভান্ডার যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে কীভাবে খুলে দিয়েছিল। যদিও গুগল, ফেসবুক, ইয়াহুর মতো কোম্পানিগুলো প্রিজম নামের প্রকল্পে তাদের কোনো ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছে। এসব নজরদারি যে শুধু নিজেদের নাগরিকদের মধ্যেই সীমিত ছিল তা নয়, অনেক বন্ধুরাষ্ট্রের নাগরিকেরাও এ তৎপরতার লক্ষ্য ছিলেন। সরকারিভাবে বরং বলা হচ্ছে যে তারা তাদের নাগরিকদের ক্ষেত্রে আইনের বাইরে কিছুই করেনি। অর্থাৎ, নিজেদের কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রে সন্দেহ হলে তারা আইনসম্মত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ওই নজরদারির কাজটি করেছে। কিন্তু তাদের সীমানার বাইরে যেসব বিশ্বনাগরিক, তাদের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি এনএসএর কাছে বিবেচ্য নয়, অথবা তাদের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ সে রকম নির্দেশনাই তাদের দিয়েছে।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান শুক্রবার ২১ জুন এডওয়ার্ড স্নোডেনের বরাতে আরও বড় আকারে নজরদারির আরেকটি তথ্য প্রকাশ করেছে। এবারের অভিযোগটির কেন্দ্রে রয়েছে ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান জিসিএইচকিউ। তারা ব্রিটেনে উচ্চক্ষমতার ইন্টারনেট সংযোগের অবকাঠামো ফাইবার অপটিকস সংযোগের প্রায় ২০০টি স্থানে হস্তক্ষেপ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে হওয়া সব ধরনের তথ্য আদান-প্রদান এবং টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড হস্তগত করে সেগুলো যুক্তরাজ্যের এনএসএর সঙ্গে ভাগাভাগি করেছে। গার্ডিয়ান জানায়, এভাবে তারা দৈনিক বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি এ ধরনের তথ্যপ্রবাহের রেকর্ড সংগ্রহ করেছে। ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার বা এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ছবি, মন্তব্য বা স্ট্যাটাস কোনো কিছুই এ নজরদারি পেতে রাখা জাল থেকে বাদ যায় না। এ বিশাল তথ্যভান্ডার বাছাইয়ের দক্ষযজ্ঞ পরিচালনায় তাদের যে সময় প্রয়োজন, সেই সময়টা পাওয়ার জন্য এসব সংগৃহীত তথ্য তারা ৩০ দিন পর্যন্ত মজুত রাখে তাদের বিশেষ মজুতাগারে।গার্ডিয়ান বলছে, টেম্পোরা নামের এ কার্যক্রম চলছে ১৮ মাস ধরে।
জিসিএইচকিউ সাধারণ নিরীহ মানুষের ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা তথ্য আদান-প্রদানে আড়ি পেতে যেসব তথ্য হস্তগত করছে তা আইনসম্মত না বেআইনি, সে বিষয় নিয়ে একধরনের অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। ফলে এ বিষয়ে বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে সোচ্চার একটি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী বিগ ব্রাদার ওয়াচের নিক পিকলস প্রশ্ন তুলেছেন, কারও কারও ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহের জন্য আদালত অথবা আইনগত ক্ষমতার অধিকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি আবশ্যক বলে যে যুক্তি দেওয়া হয়, সেটা যদি সত্য হয় তাহলে অগণিত নিরীহ মানুষের কথোপকথন বা তথ্য আদান-প্রদানে এ ধরনের নজরদারি বা জাল ফেলার প্রয়োজন হবে কেন?
অপর আরেকটি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী লিবার্টির প্রধান শমি চক্রবর্তী বিবিসির রেডিও ফোরের টুডে অনুষ্ঠানে বলেছেন, কারও বাসার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কেউ বইপত্র চুরি করে নিয়ে গিয়ে বস্তায় ভরে ফেলে রাখলেই বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাঁর মতে, চুরি করা বইপত্র চোর কোনো কাজে না লাগালেও যাঁর বইপত্র চুরি হয়েছে, তাতে যে তিনি কম লাঞ্ছিত বোধ করবেন, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র, উভয় দেশের রাজনীতিকেরাই নিজেদের নাগরিকদের এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন যে তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বেআইনিভাবে লঙ্ঘন করা হয়নি এবং এসব গোয়েন্দা কার্যক্রম রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাজ্যে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা আইনপ্রণেতাদের সামনে হাজির হয়ে দাবি করেছেন, এসব গোপন নজরদারির মাধ্যমে তাঁরা অনেক সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা নস্যাৎ করে দিতে পেরেছেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও গার্ডিয়ান-এ তাঁদের নজরদারির গভীরতা ও বিস্মৃতির তথ্য প্রকাশ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই জানিয়েছেন যে এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কারণেই নাকি তাঁরা অলিম্পিকের সময় সন্ত্রাসী হামলার একাধিক পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে পেরেছেন।
ইন্টারনেটের ওপর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের এই যে বৈশ্বিক আধিপত্য, তাতে তাদের নাগরিকদের অধিকার তেমন একটা লঙ্ঘিত না হলেও বাকি দুনিয়ার নিরীহ নাগরিকদের ব্যক্তিগত, গোপনীয়তা এবং স্বাধীনতার অনেকটাই ইতিমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। অন্য দেশগুলোরও সার্বভৌমত্বের পরিধি, অন্তত নিজেদের নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্র অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তবু কিছুটা খোলামেলাভাবে তাদের অস্বস্তির কথা প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্যের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে তাদের এ তৎপরতার বিস্তারিত।
বৃহৎ শক্তির প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ও দাপটের মুখে নিজেদের আবরু হারানোর বিষয়টা বুঝে ওঠার আগেই বাংলাদেশে আসছে আরেকটি নজরদারির ব্যবস্থা। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যাতে ক্ষতিকর বা উসকানিমূলক ছবি এবং তথ্যের প্রচার বন্ধ করা যায়, সে জন্য সরকার ছাঁকনি (ফিল্টার) বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ৩১ মের নিউ এজ পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিটিআরসি) এ ফিল্টার বসানোর জন্য ইতিমধ্যে ছয়টি কোম্পানিকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করেছে। সুতরাং, বাংলাদেশের ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি ব্যবহারকারীদের অচিরেই আন্তর্জাতিক নজরদারির পর আবার দেশীয় পাহারাদারদের খবরদারির কবলে পড়তে হবে। আর এর ফলে সরকারের রাজনৈতিক চরিত্র বদলের সঙ্গে নিজেদের সুর বদলে না নিলে কার কপালে কী ঘটবে বলা মুশকিল।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীরা ফেসবুক বা টুইটার ব্যবহারে কতটা আগ্রহী এবং সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমকে কে কীভাবে কাজে লাগাচ্ছেন তা জানার জন্য বছর কয়েক আগে আমি একবার উদ্যোগী হয়েছিলাম। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই বছর চারেক ধরে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার একটি করে টুইটার অ্যাকাউন্টের অনুসারী। অবশ্য এগুলো যে তাঁদেরই অর্থাৎ তাঁরা নিজেরা অথবা তাঁদের অনুমোদিত কেউ এগুলো পরিচালনা করেন—সেটা আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। ফেসবুকেও তাঁদের নামে অ্যাকাউন্ট আছে, কিন্তু সেগুলো তাঁরা পরিচালনা করেন অথবা তাতে কী প্রকাশিত হচ্ছে সেগুলোর খোঁজখবর রাখেন, এমনটা আমার মনে হয় না।
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে আমি দুই দিন (১৮ ও ২২ জুন) তাঁদের নামের অ্যাকাউন্টগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে দেখলাম। আমার এ আগ্রহের কারণ অবশ্য সংসদে পাস হওয়া নতুন সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল, ২০১৩, যাতে এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত সন্দেহজনক উসকানিমূলক মন্তব্য, ছবি, প্রচারণা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাক্ষ্য বা প্রমাণ হিসেবে আদালতে বিবেচ্য হবে। বিষয়টিতে পুলিশ এবং তদন্তকারীর হাতে যে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েই অনেকে রীতিমতো আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। আমার কৌতূহলও সেখানেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেল টুইটারে প্রধানমন্ত্রীর নামে ছয়টি অ্যাকাউন্ট আছে, যার চারটিতে তাঁর ছবিও ব্যবহূত হয়েছে। টুইটারে ‘অ্যাট দ্য রেট চিহ্নসহ শেখ হাসিনা’ নামে যে অ্যাকাউন্ট আছে, তাতে তাঁকে অনুসরণ করেন ছয় হাজার ৫৮৮ জন। এ অ্যাকাউন্ট ২০০৯ থেকে চালু আছে। এই নামে যেসব টুইট আছে তার মধ্যে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখের একটি টুইটে লেখা আছে, ‘ওয়ান বাই ওয়ান উই উইল গো আফটার ইচ অ্যান্ড এভরিওয়ান অব দেম’ (আমরা এক এক করে তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করব)। এ রকম আরেকটি অ্যাকাউন্ট ‘অ্যাট দ্য রেট চিহ্ন শেখ হাসিনা বিডি’। এ অ্যাকাউন্টে তাঁকে অনুসরণ করেন ৭৩ জন। সেখানে ২৮ জানুয়ারির একটি টুইটে লেখা আছে, ‘উই উইল ডেফিনিটলি গেট অল দ্য রাজাকারস, কিল দেম অ্যান্ড মেক আ ওয়ান্ডারফুল কান্ট্রি উইথ হোপ অ্যান্ড ড্রিম’ (আমরা অবশ্যই সব রাজাকারকে ধরব, তাদের হত্যা করব এবং আশা ও স্বপ্নময় এক চমৎকার দেশ গড়ে তুলব)। আবার ফেসবুকে তাঁর একটি অ্যাকাউন্টে {দেশরত্ন ২০০৯ (আইডি)} সবার আগে চোখে পড়ে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচিতি। তাঁর নামের অন্য কয়েকটি অ্যাকাউন্টে অন্যদের এমন সব মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো তিনি অথবা তাঁর পক্ষে দায়িত্বশীল কেউ দেখভাল করলে প্রকাশিত হতো বলে মনে হয় না।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার নামে অবশ্য ফেসবুক ও টুইটারে একটি করে অ্যাকাউন্টই পাওয়া গেছে। তবে এসব অ্যাকাউন্টেও এমন তথ্য বা প্রচারসামগ্রী আছে, যা সরকারের বিবেচনায় আপত্তিকর বলে গণ্য হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে এখানে ৫ মের কিছু ভিডিওর কথা উল্লেখ করা যায়।
ফেসবুকের বন্ধুদের কাছ থেকে হরহামেশাই অভিযোগ শুনি যে অনাকাঙ্ক্ষিত ছবি, ভিডিও, মন্তব্য ইত্যাদি ট্যাগিংয়ের জ্বালায় তাঁরা চরমভাবে বিরক্ত। নিজের টাইমলাইন বা ওয়ালে কী থাকবে বা থাকবে না, সেটার ওপর অনেকেরই সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিপত্তিটা সেখানেই। বিশেষ করে যেসব দেশে আইন প্রায়ই ক্ষমতাসীন ও বিত্তবানদের প্রতি পক্ষপাত করে থাকে।
কামাল আহমেদ: বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
স্নোডেনের কাছ থেকেই জানা গেল বিশ্বব্যাপী টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের আড়িপাতা কার্যক্রম কতটা বিস্তৃত ছিল। তিনি আরও জানালেন যে যোগাযোগ খাতের বিভিন্ন বহুজাতিক এবং বৈশ্বিক কোম্পানি গ্রাহকদের অজ্ঞাতসারেই তাদের সম্পর্কে তথ্যভান্ডার যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে কীভাবে খুলে দিয়েছিল। যদিও গুগল, ফেসবুক, ইয়াহুর মতো কোম্পানিগুলো প্রিজম নামের প্রকল্পে তাদের কোনো ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছে। এসব নজরদারি যে শুধু নিজেদের নাগরিকদের মধ্যেই সীমিত ছিল তা নয়, অনেক বন্ধুরাষ্ট্রের নাগরিকেরাও এ তৎপরতার লক্ষ্য ছিলেন। সরকারিভাবে বরং বলা হচ্ছে যে তারা তাদের নাগরিকদের ক্ষেত্রে আইনের বাইরে কিছুই করেনি। অর্থাৎ, নিজেদের কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রে সন্দেহ হলে তারা আইনসম্মত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ওই নজরদারির কাজটি করেছে। কিন্তু তাদের সীমানার বাইরে যেসব বিশ্বনাগরিক, তাদের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি এনএসএর কাছে বিবেচ্য নয়, অথবা তাদের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ সে রকম নির্দেশনাই তাদের দিয়েছে।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান শুক্রবার ২১ জুন এডওয়ার্ড স্নোডেনের বরাতে আরও বড় আকারে নজরদারির আরেকটি তথ্য প্রকাশ করেছে। এবারের অভিযোগটির কেন্দ্রে রয়েছে ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান জিসিএইচকিউ। তারা ব্রিটেনে উচ্চক্ষমতার ইন্টারনেট সংযোগের অবকাঠামো ফাইবার অপটিকস সংযোগের প্রায় ২০০টি স্থানে হস্তক্ষেপ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে হওয়া সব ধরনের তথ্য আদান-প্রদান এবং টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড হস্তগত করে সেগুলো যুক্তরাজ্যের এনএসএর সঙ্গে ভাগাভাগি করেছে। গার্ডিয়ান জানায়, এভাবে তারা দৈনিক বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি এ ধরনের তথ্যপ্রবাহের রেকর্ড সংগ্রহ করেছে। ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার বা এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ছবি, মন্তব্য বা স্ট্যাটাস কোনো কিছুই এ নজরদারি পেতে রাখা জাল থেকে বাদ যায় না। এ বিশাল তথ্যভান্ডার বাছাইয়ের দক্ষযজ্ঞ পরিচালনায় তাদের যে সময় প্রয়োজন, সেই সময়টা পাওয়ার জন্য এসব সংগৃহীত তথ্য তারা ৩০ দিন পর্যন্ত মজুত রাখে তাদের বিশেষ মজুতাগারে।গার্ডিয়ান বলছে, টেম্পোরা নামের এ কার্যক্রম চলছে ১৮ মাস ধরে।
জিসিএইচকিউ সাধারণ নিরীহ মানুষের ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা তথ্য আদান-প্রদানে আড়ি পেতে যেসব তথ্য হস্তগত করছে তা আইনসম্মত না বেআইনি, সে বিষয় নিয়ে একধরনের অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। ফলে এ বিষয়ে বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে সোচ্চার একটি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী বিগ ব্রাদার ওয়াচের নিক পিকলস প্রশ্ন তুলেছেন, কারও কারও ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহের জন্য আদালত অথবা আইনগত ক্ষমতার অধিকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি আবশ্যক বলে যে যুক্তি দেওয়া হয়, সেটা যদি সত্য হয় তাহলে অগণিত নিরীহ মানুষের কথোপকথন বা তথ্য আদান-প্রদানে এ ধরনের নজরদারি বা জাল ফেলার প্রয়োজন হবে কেন?
অপর আরেকটি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী লিবার্টির প্রধান শমি চক্রবর্তী বিবিসির রেডিও ফোরের টুডে অনুষ্ঠানে বলেছেন, কারও বাসার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কেউ বইপত্র চুরি করে নিয়ে গিয়ে বস্তায় ভরে ফেলে রাখলেই বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাঁর মতে, চুরি করা বইপত্র চোর কোনো কাজে না লাগালেও যাঁর বইপত্র চুরি হয়েছে, তাতে যে তিনি কম লাঞ্ছিত বোধ করবেন, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র, উভয় দেশের রাজনীতিকেরাই নিজেদের নাগরিকদের এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন যে তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বেআইনিভাবে লঙ্ঘন করা হয়নি এবং এসব গোয়েন্দা কার্যক্রম রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাজ্যে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা আইনপ্রণেতাদের সামনে হাজির হয়ে দাবি করেছেন, এসব গোপন নজরদারির মাধ্যমে তাঁরা অনেক সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা নস্যাৎ করে দিতে পেরেছেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও গার্ডিয়ান-এ তাঁদের নজরদারির গভীরতা ও বিস্মৃতির তথ্য প্রকাশ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই জানিয়েছেন যে এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কারণেই নাকি তাঁরা অলিম্পিকের সময় সন্ত্রাসী হামলার একাধিক পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে পেরেছেন।
ইন্টারনেটের ওপর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের এই যে বৈশ্বিক আধিপত্য, তাতে তাদের নাগরিকদের অধিকার তেমন একটা লঙ্ঘিত না হলেও বাকি দুনিয়ার নিরীহ নাগরিকদের ব্যক্তিগত, গোপনীয়তা এবং স্বাধীনতার অনেকটাই ইতিমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। অন্য দেশগুলোরও সার্বভৌমত্বের পরিধি, অন্তত নিজেদের নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্র অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তবু কিছুটা খোলামেলাভাবে তাদের অস্বস্তির কথা প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্যের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে তাদের এ তৎপরতার বিস্তারিত।
বৃহৎ শক্তির প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ও দাপটের মুখে নিজেদের আবরু হারানোর বিষয়টা বুঝে ওঠার আগেই বাংলাদেশে আসছে আরেকটি নজরদারির ব্যবস্থা। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যাতে ক্ষতিকর বা উসকানিমূলক ছবি এবং তথ্যের প্রচার বন্ধ করা যায়, সে জন্য সরকার ছাঁকনি (ফিল্টার) বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ৩১ মের নিউ এজ পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিটিআরসি) এ ফিল্টার বসানোর জন্য ইতিমধ্যে ছয়টি কোম্পানিকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করেছে। সুতরাং, বাংলাদেশের ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি ব্যবহারকারীদের অচিরেই আন্তর্জাতিক নজরদারির পর আবার দেশীয় পাহারাদারদের খবরদারির কবলে পড়তে হবে। আর এর ফলে সরকারের রাজনৈতিক চরিত্র বদলের সঙ্গে নিজেদের সুর বদলে না নিলে কার কপালে কী ঘটবে বলা মুশকিল।
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীরা ফেসবুক বা টুইটার ব্যবহারে কতটা আগ্রহী এবং সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমকে কে কীভাবে কাজে লাগাচ্ছেন তা জানার জন্য বছর কয়েক আগে আমি একবার উদ্যোগী হয়েছিলাম। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই বছর চারেক ধরে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার একটি করে টুইটার অ্যাকাউন্টের অনুসারী। অবশ্য এগুলো যে তাঁদেরই অর্থাৎ তাঁরা নিজেরা অথবা তাঁদের অনুমোদিত কেউ এগুলো পরিচালনা করেন—সেটা আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। ফেসবুকেও তাঁদের নামে অ্যাকাউন্ট আছে, কিন্তু সেগুলো তাঁরা পরিচালনা করেন অথবা তাতে কী প্রকাশিত হচ্ছে সেগুলোর খোঁজখবর রাখেন, এমনটা আমার মনে হয় না।
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে আমি দুই দিন (১৮ ও ২২ জুন) তাঁদের নামের অ্যাকাউন্টগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে দেখলাম। আমার এ আগ্রহের কারণ অবশ্য সংসদে পাস হওয়া নতুন সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) বিল, ২০১৩, যাতে এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত সন্দেহজনক উসকানিমূলক মন্তব্য, ছবি, প্রচারণা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাক্ষ্য বা প্রমাণ হিসেবে আদালতে বিবেচ্য হবে। বিষয়টিতে পুলিশ এবং তদন্তকারীর হাতে যে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েই অনেকে রীতিমতো আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। আমার কৌতূহলও সেখানেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেল টুইটারে প্রধানমন্ত্রীর নামে ছয়টি অ্যাকাউন্ট আছে, যার চারটিতে তাঁর ছবিও ব্যবহূত হয়েছে। টুইটারে ‘অ্যাট দ্য রেট চিহ্নসহ শেখ হাসিনা’ নামে যে অ্যাকাউন্ট আছে, তাতে তাঁকে অনুসরণ করেন ছয় হাজার ৫৮৮ জন। এ অ্যাকাউন্ট ২০০৯ থেকে চালু আছে। এই নামে যেসব টুইট আছে তার মধ্যে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখের একটি টুইটে লেখা আছে, ‘ওয়ান বাই ওয়ান উই উইল গো আফটার ইচ অ্যান্ড এভরিওয়ান অব দেম’ (আমরা এক এক করে তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করব)। এ রকম আরেকটি অ্যাকাউন্ট ‘অ্যাট দ্য রেট চিহ্ন শেখ হাসিনা বিডি’। এ অ্যাকাউন্টে তাঁকে অনুসরণ করেন ৭৩ জন। সেখানে ২৮ জানুয়ারির একটি টুইটে লেখা আছে, ‘উই উইল ডেফিনিটলি গেট অল দ্য রাজাকারস, কিল দেম অ্যান্ড মেক আ ওয়ান্ডারফুল কান্ট্রি উইথ হোপ অ্যান্ড ড্রিম’ (আমরা অবশ্যই সব রাজাকারকে ধরব, তাদের হত্যা করব এবং আশা ও স্বপ্নময় এক চমৎকার দেশ গড়ে তুলব)। আবার ফেসবুকে তাঁর একটি অ্যাকাউন্টে {দেশরত্ন ২০০৯ (আইডি)} সবার আগে চোখে পড়ে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচিতি। তাঁর নামের অন্য কয়েকটি অ্যাকাউন্টে অন্যদের এমন সব মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো তিনি অথবা তাঁর পক্ষে দায়িত্বশীল কেউ দেখভাল করলে প্রকাশিত হতো বলে মনে হয় না।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার নামে অবশ্য ফেসবুক ও টুইটারে একটি করে অ্যাকাউন্টই পাওয়া গেছে। তবে এসব অ্যাকাউন্টেও এমন তথ্য বা প্রচারসামগ্রী আছে, যা সরকারের বিবেচনায় আপত্তিকর বলে গণ্য হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে এখানে ৫ মের কিছু ভিডিওর কথা উল্লেখ করা যায়।
ফেসবুকের বন্ধুদের কাছ থেকে হরহামেশাই অভিযোগ শুনি যে অনাকাঙ্ক্ষিত ছবি, ভিডিও, মন্তব্য ইত্যাদি ট্যাগিংয়ের জ্বালায় তাঁরা চরমভাবে বিরক্ত। নিজের টাইমলাইন বা ওয়ালে কী থাকবে বা থাকবে না, সেটার ওপর অনেকেরই সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিপত্তিটা সেখানেই। বিশেষ করে যেসব দেশে আইন প্রায়ই ক্ষমতাসীন ও বিত্তবানদের প্রতি পক্ষপাত করে থাকে।
কামাল আহমেদ: বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
No comments