ভিন্নমত-আওয়ামী লীগের যত ভুল তত্ত্ব by আবু আহমেদ
আওয়ামী লীগ যেন এত দিন স্বপ্নের মধ্যে
বসবাস করছিল। তাদের নেতাদের ধারণা ছিল জনসাধারণের সমর্থন এখনো সঙ্গে আছে।
সেটি ছিল তাঁদের ভুল চিন্তা। তাঁদের ভুল চিন্তা এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে
তাঁরা কোনোদিন শুদ্ধ চিন্তার সময়ই পাননি।
এখনো তাঁরা
ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে চলেছেন যে তাঁদের প্রার্থীরা সিটি করপোরেশনের
নির্বাচনে হেরেছে প্রার্থী এবং কর্মীদের মধ্যে দূরত্বের কারণে। এখনো তাঁরা
ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে চলেছেন যে সরকারের অর্জনগুলো প্রার্থীরা সঠিকভাবে
জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেননি। এখনো তাঁরা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে চলেছেন
যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচারের জবাব প্রার্থীরা
সঠিকভাবে দিতে পারেননি। এখনো তাঁরা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে চলেছেন যে সিটি
করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মন-প্রাণ দিয়ে প্রার্থীদের
পক্ষে কাজ করেননি। এখনো তাঁরা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে চলেছেন যে দলের কর্মীরা
প্রার্থীর পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। এই ব্যাখ্যা কিছুটা শুদ্ধ হতো, যদি
পরাজয়ের অন্য কারণগুলো মুখ্য না হতো। যদি ভোটের ব্যবধান অত্যন্ত কম হতো।
আসলে বর্তমান আওয়ামী লীগে দূরদর্শী এবং সঠিক চিন্তার লোকের অভাব। তাঁরা
বিএনপি-জামায়াত কতটা পুলিশের পেটা খেল, কতটা এই দল বা জোট দুর্বল হলো ওই
নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। তাঁদের সম্পর্কে লোকে কী ভাবে, কী বলছে সেটা কান
পেতে শোনেন না। বরং উল্টোটা করতে তাঁদের সব শক্তি যেন নিয়োজিত করে।
গণতন্ত্রে ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা হলো একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে ভিন্নমত যেন অসত্য। দেশের মানুষের স্বাধীনভাবে মত
প্রকাশের অধিকারটুকু যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ভিন্ন মতের কাগজ বন্ধ করে দেওয়া
হচ্ছে। ভিন্ন মতের টিভি চ্যানেলেরও একই অবস্থা। কেউ জানে না দিগন্ত আর
ইসলামিক টিভি বন্ধ কেন। দেশে এত সব টিভি চ্যানেল চালু আছে, অথচ চালু নেই
দিগন্ত আর ইসলামিক টিভি। অথচ এই দুই টিভি চ্যানেলের দোষ কী সেটা সরকার
কোনোদিন ব্যাখ্যা করেনি। এখন দেশের প্রায় সংবাদমাধ্যম ও টিভি চ্যানেলই এক
ধরনের সরকারপন্থী। ফল হয়েছে এসব চ্যানেল যা কিছু বলে, লোকে ঠিক যেন
উল্টোটাই বোঝে। সেদিন এক মডারেট আওয়ামী লীগার এবং অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষ
অধ্যাপকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, দিগন্ত টিভি অনেক সতর্কতার সঙ্গে
সংবাদ প্রচার করত। কিন্তু কেন বন্ধ করা হলো তার কারণ তো বুঝলাম না।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬-২০০১- এই পাঁচ বছরও ক্ষমতায় ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তখনো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে অনেক পার্থক্য। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সবাইকে নিয়ে দেশ শাসন করেছে। শেষে ২০০১ সালের নির্বাচনে কয়েক শ ব্যুরোক্র্যাটকে OSD, অনেককে OSD থেকে অবসরে পাঠিয়েছে। শুরু হলো প্রশাসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ করার প্রতিযোগিতা। কিন্তু কাজটা কি ভালো হলো, ওই প্রশ্ন আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে কেউ তুলল না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর অসাম্প্রদায়িকতা এ দলের কিছু নেতা অহরহ উচ্চারণ করেন। তাঁদের এসব বক্তব্য ও ব্যাখ্যা জনগণ গ্রহণ করে কি না সেটা তাঁরা কোনোদিন ভেবে দেখেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো দেশকে বিভক্ত করার কোনো হাতিয়ার হতে পারে না। অথচ আওয়ামী লীগের পক্ষে জনগণের সহানুভূতি ছিল। অন্তত বৈরিতা ছিল না। এর ফলেই ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ যেন রুদ্রমূর্তি ধারণ করল। দেশকে বিভাজিত করার সব প্রকল্পই গ্রহণ করল। সিভিল ব্যুরোক্রেসির লোকদের মধ্যে কে দলীয়, কে অন্য দলের সেটা খুঁজতে শুরু করল। যাঁরা একটু ধর্মকর্ম করতেন, তাঁদের অন্য দলের সঙ্গে সহানুভূতিশীল হিসেবে চিহ্নিত করল। ব্যাখ্যাটা এমনভাবে দেওয়া হয়, যাতে করে দেশের মানুষের মধ্যে শুধু বিভাজনই বাড়ল। ভারত আমাদের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বটে। বলা হতো ভারতকে ট্রানজিট দিলে দেশের এত এত বিলিয়ন ডলার আয় হবে। এখন লোকে প্রশ্ন তোলে সেই সব বিলিয়ন ডলারের আয়ের কী হলো? তিন বছর আগে তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি করার কথা ছিল। আজও হয়নি, হয়তো হবে একদিন, তখন তিস্তায় বাংলাদেশের জন্য আর জল থাকবে না। কেন বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিতে পারে না? কোনো দল যদি মনে করে শুধু ভারতের সমর্থন কোনো দলকে ক্ষমতায় রাখবে অথবা ক্ষমতা এনে দেবে, সেই চিন্তা ভুল। বরং আজকে লোকে চিন্তা করতে শুরু করেছে, ভারত বাংলাদেশ থেকে শুধু নিচ্ছে, দিচ্ছে না কিছুই। আওয়ামী লীগের আরেক তত্ত্ব হলো নতুন প্রজন্মের ভোটাররা তাদের সঙ্গে আছে। যদি সেই তত্ত্বই সঠিক হয়, তাহলে চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ নতুন প্রজন্মের ভোটগুলো গেল কই? আওয়ামী লীগের আরেক তত্ত্ব হলো দেশের আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তথা হেফাজতের ১৩ দফাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিলে মহিলা ভোটাররা দলে দলে তাদের প্রার্থীকে ভোট দেবে। সেই তত্ত্বই যদি সঠিক হতো, তাহলে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় মহিলাদের ৫০ শতাংশ ভোট কোন বাক্সে পড়ল? আওয়ামী লীগ এখনো বলে চলেছে তারা ধর্মীয় ভাবাবেগের কাছে পরাজিত হয়েছে। তবে তাদের কথা হলো এই ভাবাবেগ থাকতে পারবে না। কিন্তু সত্য হলো মানুষের ধর্মবিশ্বাস থাকলে ধর্মীয় ভাবাবেগ থাকবে এবং ভোটের সময় সেই ভাবাবেগ কাজ করবে। হেফাজতের কর্মীদের ওপর গভীর রাতে জলকামান আর টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা কি ঠিক হয়েছে? যারা ওই গর্হিত কাজ করতে সরকারকে বুদ্ধি দিয়েছে, আজকে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য তাদেরই দায়ী করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীকে হেফাজতের ভেতরে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, সেটি অনুধাবন করতে অনুরোধ করব। আওয়ামী লীগের আরেক তত্ত্ব হলো সময়ে লোকে সব কিছু ভুলে যায়। হ্যাঁ, ভুলে যায় বটে। তবে কিছু কিছু বিষয় সহজে ভোলে না। না ভোলার একটি হলো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। যে চার সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ হাজার শেয়ার বিনিয়োগকারী ছিল, যারা তাদের অর্থের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হারিয়েছে। ভেবে দেখুন তাদের ভোটগুলো কোন বাক্সে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে একটি দ্বিখণ্ডিত জাতিকে শাসন করছে। আর নির্বাচনের আগে এমন একটা ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল যে তারা ক্ষমতায় গেলে সবাইকে নিয়ে দেশ শাসন করবে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, ভেবে দেখুন আপনি দেশের সব লোকের প্রধানমন্ত্রী, না যারা কাছ থেকে ভুল তথ্য দিয়ে আপনাকে প্রভাবিত করছে তাদের মতের প্রতিনিধিত্ব করছেন? কামরান-লিটন-খালেক কেউই অনুপযুক্ত প্রার্থী ছিলেন না। তাঁদের প্রচারও কম হয়নি। কিন্তু সত্য হলো তাঁরা শুধু আওয়ামী লীগের ভুল নীতির কারণেই পরাজিত হয়েছেন। অন্য কথা হলো, ওপরের কথাগুলো এবং অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের ভেতর থেকেই চিন্তাশীল ও প্রজ্ঞার অধিকারী লোকদের কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কেন শূন্যতা। কেউ যেন সাহস করছে না সত্য কথাগুলো দলীয় ফোরামে বলার জন্য। আর এখানেই দেশের স্বার্থ ও গণতন্ত্র মার খাচ্ছে। দেশে বহুমত থাকবে। শুধু একটা কোটারির মত সবার ওপর চাপিয়ে দিলে দেশের কোনো কল্যাণ হবে না। দেশ আগে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। কিন্তু সেই দুর্নীতির গভীরতা ও পরিধি এখন বেড়েছে, নাকি কমেছে? প্রধানমন্ত্রীকে আওয়ামী লীগের কিছু লোকের পরামর্শ হলো যেন এমন- যে যতটা পারেন বিরোধী দলকে দমন করুন। বিরোধী দলকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দিতে পারলে দেশ যেমন শান্তিতে থাকবে, তেমনি জনসমর্থনও অটুট থাকবে। এ জন্য পুলিশকে দলীয় নেতা-কর্মীর মতো ব্যবহার করুন। জল কামানের কাছে সব কিছুই পরাজিত হবে। এই তত্ত্বও যে মিথ্যা তা তো বর্তমানের নির্বাচনের ফলগুলো থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিরোধী দলকে দমন করতে হয় না। তাদের কথা শুনতে হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একজন বন্ধুবৎসল ও ভালো ব্যবহারের লোক। যাঁকে বলা যায় ভদ্রলোক। তাঁকে কেন বারবার জেলে নিতে হবে? এম কে আনোয়ার এবং নজরুল ইসলাম খানকে কেন নির্যাতনের শিকার হতে হবে। তাঁরাই যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে আর কারা বাদ যাবে? এসব প্রশ্ন জনগণ বারবার করছে। নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দেশে বিরাজ করা দরকার, সে পরিবেশকে তো ফিরিয়ে আনতে হবে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিয়ে। কিন্তু সে উদ্যোগ কি নেওয়া হচ্ছে?
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬-২০০১- এই পাঁচ বছরও ক্ষমতায় ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তখনো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে অনেক পার্থক্য। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সবাইকে নিয়ে দেশ শাসন করেছে। শেষে ২০০১ সালের নির্বাচনে কয়েক শ ব্যুরোক্র্যাটকে OSD, অনেককে OSD থেকে অবসরে পাঠিয়েছে। শুরু হলো প্রশাসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ করার প্রতিযোগিতা। কিন্তু কাজটা কি ভালো হলো, ওই প্রশ্ন আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে কেউ তুলল না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর অসাম্প্রদায়িকতা এ দলের কিছু নেতা অহরহ উচ্চারণ করেন। তাঁদের এসব বক্তব্য ও ব্যাখ্যা জনগণ গ্রহণ করে কি না সেটা তাঁরা কোনোদিন ভেবে দেখেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো দেশকে বিভক্ত করার কোনো হাতিয়ার হতে পারে না। অথচ আওয়ামী লীগের পক্ষে জনগণের সহানুভূতি ছিল। অন্তত বৈরিতা ছিল না। এর ফলেই ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ যেন রুদ্রমূর্তি ধারণ করল। দেশকে বিভাজিত করার সব প্রকল্পই গ্রহণ করল। সিভিল ব্যুরোক্রেসির লোকদের মধ্যে কে দলীয়, কে অন্য দলের সেটা খুঁজতে শুরু করল। যাঁরা একটু ধর্মকর্ম করতেন, তাঁদের অন্য দলের সঙ্গে সহানুভূতিশীল হিসেবে চিহ্নিত করল। ব্যাখ্যাটা এমনভাবে দেওয়া হয়, যাতে করে দেশের মানুষের মধ্যে শুধু বিভাজনই বাড়ল। ভারত আমাদের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বটে। বলা হতো ভারতকে ট্রানজিট দিলে দেশের এত এত বিলিয়ন ডলার আয় হবে। এখন লোকে প্রশ্ন তোলে সেই সব বিলিয়ন ডলারের আয়ের কী হলো? তিন বছর আগে তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি করার কথা ছিল। আজও হয়নি, হয়তো হবে একদিন, তখন তিস্তায় বাংলাদেশের জন্য আর জল থাকবে না। কেন বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিতে পারে না? কোনো দল যদি মনে করে শুধু ভারতের সমর্থন কোনো দলকে ক্ষমতায় রাখবে অথবা ক্ষমতা এনে দেবে, সেই চিন্তা ভুল। বরং আজকে লোকে চিন্তা করতে শুরু করেছে, ভারত বাংলাদেশ থেকে শুধু নিচ্ছে, দিচ্ছে না কিছুই। আওয়ামী লীগের আরেক তত্ত্ব হলো নতুন প্রজন্মের ভোটাররা তাদের সঙ্গে আছে। যদি সেই তত্ত্বই সঠিক হয়, তাহলে চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ নতুন প্রজন্মের ভোটগুলো গেল কই? আওয়ামী লীগের আরেক তত্ত্ব হলো দেশের আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তথা হেফাজতের ১৩ দফাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিলে মহিলা ভোটাররা দলে দলে তাদের প্রার্থীকে ভোট দেবে। সেই তত্ত্বই যদি সঠিক হতো, তাহলে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় মহিলাদের ৫০ শতাংশ ভোট কোন বাক্সে পড়ল? আওয়ামী লীগ এখনো বলে চলেছে তারা ধর্মীয় ভাবাবেগের কাছে পরাজিত হয়েছে। তবে তাদের কথা হলো এই ভাবাবেগ থাকতে পারবে না। কিন্তু সত্য হলো মানুষের ধর্মবিশ্বাস থাকলে ধর্মীয় ভাবাবেগ থাকবে এবং ভোটের সময় সেই ভাবাবেগ কাজ করবে। হেফাজতের কর্মীদের ওপর গভীর রাতে জলকামান আর টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা কি ঠিক হয়েছে? যারা ওই গর্হিত কাজ করতে সরকারকে বুদ্ধি দিয়েছে, আজকে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য তাদেরই দায়ী করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীকে হেফাজতের ভেতরে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, সেটি অনুধাবন করতে অনুরোধ করব। আওয়ামী লীগের আরেক তত্ত্ব হলো সময়ে লোকে সব কিছু ভুলে যায়। হ্যাঁ, ভুলে যায় বটে। তবে কিছু কিছু বিষয় সহজে ভোলে না। না ভোলার একটি হলো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। যে চার সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ হাজার শেয়ার বিনিয়োগকারী ছিল, যারা তাদের অর্থের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হারিয়েছে। ভেবে দেখুন তাদের ভোটগুলো কোন বাক্সে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে একটি দ্বিখণ্ডিত জাতিকে শাসন করছে। আর নির্বাচনের আগে এমন একটা ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল যে তারা ক্ষমতায় গেলে সবাইকে নিয়ে দেশ শাসন করবে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, ভেবে দেখুন আপনি দেশের সব লোকের প্রধানমন্ত্রী, না যারা কাছ থেকে ভুল তথ্য দিয়ে আপনাকে প্রভাবিত করছে তাদের মতের প্রতিনিধিত্ব করছেন? কামরান-লিটন-খালেক কেউই অনুপযুক্ত প্রার্থী ছিলেন না। তাঁদের প্রচারও কম হয়নি। কিন্তু সত্য হলো তাঁরা শুধু আওয়ামী লীগের ভুল নীতির কারণেই পরাজিত হয়েছেন। অন্য কথা হলো, ওপরের কথাগুলো এবং অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের ভেতর থেকেই চিন্তাশীল ও প্রজ্ঞার অধিকারী লোকদের কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কেন শূন্যতা। কেউ যেন সাহস করছে না সত্য কথাগুলো দলীয় ফোরামে বলার জন্য। আর এখানেই দেশের স্বার্থ ও গণতন্ত্র মার খাচ্ছে। দেশে বহুমত থাকবে। শুধু একটা কোটারির মত সবার ওপর চাপিয়ে দিলে দেশের কোনো কল্যাণ হবে না। দেশ আগে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। কিন্তু সেই দুর্নীতির গভীরতা ও পরিধি এখন বেড়েছে, নাকি কমেছে? প্রধানমন্ত্রীকে আওয়ামী লীগের কিছু লোকের পরামর্শ হলো যেন এমন- যে যতটা পারেন বিরোধী দলকে দমন করুন। বিরোধী দলকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দিতে পারলে দেশ যেমন শান্তিতে থাকবে, তেমনি জনসমর্থনও অটুট থাকবে। এ জন্য পুলিশকে দলীয় নেতা-কর্মীর মতো ব্যবহার করুন। জল কামানের কাছে সব কিছুই পরাজিত হবে। এই তত্ত্বও যে মিথ্যা তা তো বর্তমানের নির্বাচনের ফলগুলো থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিরোধী দলকে দমন করতে হয় না। তাদের কথা শুনতে হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একজন বন্ধুবৎসল ও ভালো ব্যবহারের লোক। যাঁকে বলা যায় ভদ্রলোক। তাঁকে কেন বারবার জেলে নিতে হবে? এম কে আনোয়ার এবং নজরুল ইসলাম খানকে কেন নির্যাতনের শিকার হতে হবে। তাঁরাই যদি নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে আর কারা বাদ যাবে? এসব প্রশ্ন জনগণ বারবার করছে। নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দেশে বিরাজ করা দরকার, সে পরিবেশকে তো ফিরিয়ে আনতে হবে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নিয়ে। কিন্তু সে উদ্যোগ কি নেওয়া হচ্ছে?
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments