এক দুর্ঘটনায় গ্যাস বিপর্যয় সারা দেশে by আরিফুজ্জামান তুহিন
সিলেটের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে এক
দুর্ঘটনার পর গ্যাস সরবরাহে বিপর্যয় ঘটেছে। গ্যাসের চাপের পাশাপাশি বিদ্যুৎ
উৎপাদন কমে যাওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে অসংখ্য মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে।
প্রসেসিং
প্লান্টের একটি গ্যাসকেটে শনিবার সন্ধ্যায় ত্রুটি ধরা পড়লে দেশের অন্যতম
বৃহৎ এ গ্যাসক্ষেত্র তাৎক্ষণিক বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্লান্টের পাইপলাইন শেষ
পর্যন্ত মেরামত করা সম্ভব হলেও কম্প্রেসার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঠিক
করা যায়নি। ফলে গ্যাসের চাপ মারাত্মক কমে গেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বহুজাতিক কম্পানি শেভরন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রটি শনিবার বন্ধ হয়ে গেলে সাড়ে আট কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। গ্যাসের অভাবে তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমে গেছে দেড় হাজার মেগাওয়াট। কবে নাগাদ কম্প্রেসার ঠিক হবে তার কোনো ঠিক নেই। চাপ কমে যাওয়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বিদ্যুৎকেন্দ, শিল্প-কারখানা ও আবাসিক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। গতকাল রবিবার রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) জানিয়েছে, গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় কমপক্ষে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে দিনের বেলায় ও সন্ধ্যায় লোডশেডিং বেড়েছে। দেশে গড়ে উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর মধ্যে গ্যাস থেকে উৎপাদন হয় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো। জানা যায়, প্রসেসিং প্লান্টের একটি গ্যাসকেটে ত্রুটি ধরা পড়ার পর এ তথ্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়। তবে তিতাস গ্যাসসহ দেশের গ্যাস বিতরণ কম্পানিগুলো আগেভাগে এ তথ্য তাদের অঞ্চলের গ্রাহকদের না জানানোর ফলে কেউ আগাম প্রস্তুতি নিতে পারেনি। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ।
অন্যদিকে শেভরন তথ্য নিয়ে লুকোচুরি করছে- এমন অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ কম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রসেসিং প্লান্টের গ্যাসকেটে ত্রুটি দেখার পর সব কূপ বন্ধ করে দেওয়া হয় গত শনিবার সন্ধ্যায়। কূপ বন্ধের আগে পেট্রোবাংলাকে তারা জানিয়েছে। কিন্তু কূপ এলাকার লোকজনের ভাষ্য, শনিবার সন্ধ্যার দিকে তারা বিকট একটি শব্দ শুনতে পায়, যা সম্ভবত প্রসেসিং প্লান্টের পাইপলাইনে বিস্ফোরণ ঘটনার। কিন্তু এ তথ্যটি চেপে গেছে কম্পানি শেভরন।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আসল ঘটনা হলো বিবিয়ানার প্রসেসিং প্লান্টের পাইপে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এ বিস্ফোরণের তথ্য শেভরন পেট্রোবাংলাকে জানায়নি। ঠিকমতো অপারেট না করার কারণে এ বিস্ফোরণের সঙ্গে কম্প্রেসারটিও বিকল হয়ে গেছে। বছরখানেক আগে এ কম্প্রেসারটি বহু টাকা দিয়ে কেনা হয়। কম্প্রেসার দেখার দায়িত্বেও শেভরন রয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
জানা গেছে, বিবিয়ানার দুর্ঘটনার পর ঢাকায় ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম আসছে। এর আগেই এ অঞ্চলে ৩০০ মিলিয়ন গ্যাসের ঘাটতি ছিল। সব মিলিয়ে ঢাকায় গ্যাসের ঘাটতির পরিমাণ বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৪০০ মিলিয়ন। এই বিশাল ঘাটতি সামাল দিতে ঢাকায় তিতাস কর্তৃপক্ষ গ্যাস রেশনিং করছে।
সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের সবকটি কূপ বন্ধ করে দেওয়ার পর গতকাল সকালে চালু করতে গিয়ে দেখা যায়, গ্যাস কম্প্রেসারটিও বিকল হয়ে গেছে। এ যন্ত্রটি চালু না হওয়া পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। সংশ্লিষ্টরা আরো বলছেন, গ্যাস কম্প্রেসারের কাজ হোল সরবরাহ দ্রুত করা। গ্রাহকের কাছে গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি করা। তবে কম্প্রেসার সচল হওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তেই নেই। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ কাজে কম্প্রেসার প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে নতুন। ফলে কোনো ত্রুটি এতে ধরা পড়লে তা মেরামত করার মতো প্রকৌশলীও বাংলাদেশে নেই। এক বছরের মাথায় কম্প্রেসার নষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ভুল অপারেট করার কারণেই কম্প্রেসার নষ্ট হয়েছে বলে ওই সূত্র জানায়।
এদিকে গতকাল ঢাকায় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে রাত লেগে যেতে পারে। এতে মানুষকে আতঙ্কিত না হতে আহ্বান জানান তিনি।
শেভরন সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে উৎপাদিত গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করা হয়ে থাকে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে। এর পরিমাণ সাড়ে আট কোটি ঘনফুটের মতো। দেশে বর্তমানে মোট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে ২২২ কোটি ঘনফুটের মতো। গত শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটির উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হলে কোথাও কোথাও শনিবার মধ্যরাত থেকে, আরো অনেক স্থানে গতকাল সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। থেমে যায় শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদন। গ্যাসনির্ভর আবাসিক গ্রাহকদের একটি বড় অংশের বাড়িতে জ্বলেনি চুলা। সিএনজি স্ট্রেশনগুলোও ছিল বন্ধ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেভরনের পরিচালক (এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স) নাসের আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শনিবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের প্রসেসিং প্লান্টের একটি গ্যাসকেট কেটে যায়। এর ফলে প্রসেসিং প্লান্টের পাইপ থেকে গ্যাস বের হতে থাকে। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমরা বিবিয়ানার গ্যাসের কূপগুলো বন্ধ করে দিই। বিষয়টি আমরা সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানিয়েছি।' বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'গ্যাসকেটের ত্রুটি আজ (গতকাল রবিবার) সকাল সোয়া ৬টার দিকে মেরামত করা হয়েছে। এরপর আবার গ্যাস সঞ্চালন শুরু হয়েছে। তবে গ্যাস সরবরাহ দ্রুত করার যন্ত্র কম্প্রেসারটি কাজ না করায় সরবরাহ দ্রুত করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাস কম্প্রেসার মেরামতের কাজ চলছে।'
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্যাস ট্রান্সমিশন কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমরা কাজ করছি। আজ (রবিবার) রাতের মধ্যে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে।' গ্যাস কম্প্রেসারটি মেরামত হচ্ছে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, এখন কম্প্রেসার ছাড়াই গ্যাস পাইপলাইনে দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য গ্যাস দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছতে একটু সময় লাগছে।
এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে আমিনুর রহমান বলেন, 'বিবিয়ানার মতো বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্রে যদি বিপর্যয় ঘটে তাহলে বিপর্যয় সারিয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত কিছুই করার নেই। তবে ছোট ছোট যেসব গ্যাসক্ষেত্র আমাদের রয়েছে সেগুলোর কোনোটিতে বিপর্যয় দেখা দিলে তেমন সংকটে পড়তে হবে না।' তিনি আরো বলেন, 'বড় গ্যাসক্ষেত্রে যদি বিপর্যয় তাহলে সংকট সমাধানের কোনো বিকল্প রাস্তা আমাদের নেই। আমাদের জন্য সেটা সত্যিই খুব দুঃখজনক হবে।'
চুলা জ্বলেনি দিনভর : গত শনিবার মধ্যরাত থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এলাকার আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের চাপ কমে যায়। দিনের বেলায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, প্রেসক্লাব, সেগুনবাগিচা, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, হাতিরপুর, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ না থাকায় অনেক বাড়িতেই রান্না হয়নি বলে জানা যায়। একই কারণে অনেক হোটেলেও খাবার মেলেনি। গ্যাস না থাকায় সকাল থেকে গ্যাসচালিত বহু বাস ও সিএনজি চলাচল করতে পারেনি রাজধানী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের অনেক এলাকায়। প্রাইভেট কারেও গ্যাস (সিএনজি) নিতে পারেনি অনেকে। সকাল থেকে সিএনজি স্ট্রেশনগুলোতে লম্বা ভিড় দেখা গেলেও গ্যাস মেলেনি সন্ধ্যা পর্যন্ত। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে ঘুরে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকে ফোন করেও কালের কণ্ঠকে তাদের নানা ভোগান্তির কথা জানিয়েছে।
তিন বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ : এদিকে চট্টগ্রাম থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি শিমুল নজরুল জানিয়েছেন, সেখানেও গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। গ্যাস সংকটের কারণে চট্টগ্রামের গৃহস্থালির রান্নাবান্না থেকে শুরু বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শনিবার রাত থেকে গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় চট্টগ্রামের গ্যাসভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ ছিল। এ কারণে নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং চলে। একই কারণে নগরীর সব সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস বিক্রি বন্ধ থাকায় যানবাহন মালিকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। গতকাল রবিবার সকালে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে মাত্র ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)।
চট্টগ্রামে গ্যাসের সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী জামিল উদ্দিন আলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে গত শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় সঞ্চালন লাইন থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল। রবিবার সকাল থেকে আমরা (কেজিডিসিএল) গ্যাস পেয়েছি মাত্র ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট। তাই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। রবিবার রাতের মধ্যে গ্যাসের সরবরাহ আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।'
জানা গেছে, জাতীয় সঞ্চালন লাইন থেকে প্রতিদিন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি প্রায় ২২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পায়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবিকে দেওয়া হয় ৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু গতকাল কেজিডিসিএল পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় পিডিবিকে কোনো গ্যাস সরবরাহ করেনি বলে জানিয়েছেন রাউজান বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী স্বপন চক্রবর্তী। তাই গ্যাসভিত্তিক রাউজান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ ছিল। গতকাল চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল প্রায় ২০০ মেগাওয়াট।
এদিকে গতকাল সকাল থেকে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় নগরীর আন্দরকিল্লা, চকবাজার, লালখানবাজার, আসকার দীঘিরপাড়, মোমিন রোড, খুলশী, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের আবসিক গ্রাহকরা বিড়ম্বনায় পড়ে। নগরীর অনেক এলাকায় গ্যাসের অভাবে চুলা জ্বালাতে পারেনি বাসিন্দারা।
এ প্রসঙ্গে খুলশী আবাসিক এলাকার বাসিন্দা জিনিয়া আফরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্যাস সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়তে হয়েছে। কোনো উপায় না দেখে দুপুরের খাবার হোটেল থেকে কিনে খেয়েছি।'
বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও আবাসিক গ্রাহকের পাশাপাশি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প-কলকারখানা গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে শত কোটি টাকার ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে ব্যবসায়ীদের।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বহুজাতিক কম্পানি শেভরন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রটি শনিবার বন্ধ হয়ে গেলে সাড়ে আট কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। গ্যাসের অভাবে তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমে গেছে দেড় হাজার মেগাওয়াট। কবে নাগাদ কম্প্রেসার ঠিক হবে তার কোনো ঠিক নেই। চাপ কমে যাওয়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বিদ্যুৎকেন্দ, শিল্প-কারখানা ও আবাসিক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। গতকাল রবিবার রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) জানিয়েছে, গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় কমপক্ষে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে দিনের বেলায় ও সন্ধ্যায় লোডশেডিং বেড়েছে। দেশে গড়ে উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর মধ্যে গ্যাস থেকে উৎপাদন হয় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো। জানা যায়, প্রসেসিং প্লান্টের একটি গ্যাসকেটে ত্রুটি ধরা পড়ার পর এ তথ্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়। তবে তিতাস গ্যাসসহ দেশের গ্যাস বিতরণ কম্পানিগুলো আগেভাগে এ তথ্য তাদের অঞ্চলের গ্রাহকদের না জানানোর ফলে কেউ আগাম প্রস্তুতি নিতে পারেনি। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ।
অন্যদিকে শেভরন তথ্য নিয়ে লুকোচুরি করছে- এমন অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ কম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রসেসিং প্লান্টের গ্যাসকেটে ত্রুটি দেখার পর সব কূপ বন্ধ করে দেওয়া হয় গত শনিবার সন্ধ্যায়। কূপ বন্ধের আগে পেট্রোবাংলাকে তারা জানিয়েছে। কিন্তু কূপ এলাকার লোকজনের ভাষ্য, শনিবার সন্ধ্যার দিকে তারা বিকট একটি শব্দ শুনতে পায়, যা সম্ভবত প্রসেসিং প্লান্টের পাইপলাইনে বিস্ফোরণ ঘটনার। কিন্তু এ তথ্যটি চেপে গেছে কম্পানি শেভরন।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আসল ঘটনা হলো বিবিয়ানার প্রসেসিং প্লান্টের পাইপে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এ বিস্ফোরণের তথ্য শেভরন পেট্রোবাংলাকে জানায়নি। ঠিকমতো অপারেট না করার কারণে এ বিস্ফোরণের সঙ্গে কম্প্রেসারটিও বিকল হয়ে গেছে। বছরখানেক আগে এ কম্প্রেসারটি বহু টাকা দিয়ে কেনা হয়। কম্প্রেসার দেখার দায়িত্বেও শেভরন রয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
জানা গেছে, বিবিয়ানার দুর্ঘটনার পর ঢাকায় ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম আসছে। এর আগেই এ অঞ্চলে ৩০০ মিলিয়ন গ্যাসের ঘাটতি ছিল। সব মিলিয়ে ঢাকায় গ্যাসের ঘাটতির পরিমাণ বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৪০০ মিলিয়ন। এই বিশাল ঘাটতি সামাল দিতে ঢাকায় তিতাস কর্তৃপক্ষ গ্যাস রেশনিং করছে।
সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের সবকটি কূপ বন্ধ করে দেওয়ার পর গতকাল সকালে চালু করতে গিয়ে দেখা যায়, গ্যাস কম্প্রেসারটিও বিকল হয়ে গেছে। এ যন্ত্রটি চালু না হওয়া পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। সংশ্লিষ্টরা আরো বলছেন, গ্যাস কম্প্রেসারের কাজ হোল সরবরাহ দ্রুত করা। গ্রাহকের কাছে গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি করা। তবে কম্প্রেসার সচল হওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তেই নেই। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, গ্যাস সরবরাহ কাজে কম্প্রেসার প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে নতুন। ফলে কোনো ত্রুটি এতে ধরা পড়লে তা মেরামত করার মতো প্রকৌশলীও বাংলাদেশে নেই। এক বছরের মাথায় কম্প্রেসার নষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ভুল অপারেট করার কারণেই কম্প্রেসার নষ্ট হয়েছে বলে ওই সূত্র জানায়।
এদিকে গতকাল ঢাকায় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে রাত লেগে যেতে পারে। এতে মানুষকে আতঙ্কিত না হতে আহ্বান জানান তিনি।
শেভরন সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে উৎপাদিত গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করা হয়ে থাকে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে। এর পরিমাণ সাড়ে আট কোটি ঘনফুটের মতো। দেশে বর্তমানে মোট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে ২২২ কোটি ঘনফুটের মতো। গত শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটির উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হলে কোথাও কোথাও শনিবার মধ্যরাত থেকে, আরো অনেক স্থানে গতকাল সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। থেমে যায় শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদন। গ্যাসনির্ভর আবাসিক গ্রাহকদের একটি বড় অংশের বাড়িতে জ্বলেনি চুলা। সিএনজি স্ট্রেশনগুলোও ছিল বন্ধ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেভরনের পরিচালক (এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স) নাসের আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শনিবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের প্রসেসিং প্লান্টের একটি গ্যাসকেট কেটে যায়। এর ফলে প্রসেসিং প্লান্টের পাইপ থেকে গ্যাস বের হতে থাকে। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমরা বিবিয়ানার গ্যাসের কূপগুলো বন্ধ করে দিই। বিষয়টি আমরা সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানিয়েছি।' বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'গ্যাসকেটের ত্রুটি আজ (গতকাল রবিবার) সকাল সোয়া ৬টার দিকে মেরামত করা হয়েছে। এরপর আবার গ্যাস সঞ্চালন শুরু হয়েছে। তবে গ্যাস সরবরাহ দ্রুত করার যন্ত্র কম্প্রেসারটি কাজ না করায় সরবরাহ দ্রুত করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাস কম্প্রেসার মেরামতের কাজ চলছে।'
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্যাস ট্রান্সমিশন কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমরা কাজ করছি। আজ (রবিবার) রাতের মধ্যে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে।' গ্যাস কম্প্রেসারটি মেরামত হচ্ছে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, এখন কম্প্রেসার ছাড়াই গ্যাস পাইপলাইনে দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য গ্যাস দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছতে একটু সময় লাগছে।
এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে আমিনুর রহমান বলেন, 'বিবিয়ানার মতো বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্রে যদি বিপর্যয় ঘটে তাহলে বিপর্যয় সারিয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত কিছুই করার নেই। তবে ছোট ছোট যেসব গ্যাসক্ষেত্র আমাদের রয়েছে সেগুলোর কোনোটিতে বিপর্যয় দেখা দিলে তেমন সংকটে পড়তে হবে না।' তিনি আরো বলেন, 'বড় গ্যাসক্ষেত্রে যদি বিপর্যয় তাহলে সংকট সমাধানের কোনো বিকল্প রাস্তা আমাদের নেই। আমাদের জন্য সেটা সত্যিই খুব দুঃখজনক হবে।'
চুলা জ্বলেনি দিনভর : গত শনিবার মধ্যরাত থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এলাকার আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের চাপ কমে যায়। দিনের বেলায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, প্রেসক্লাব, সেগুনবাগিচা, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, হাতিরপুর, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ না থাকায় অনেক বাড়িতেই রান্না হয়নি বলে জানা যায়। একই কারণে অনেক হোটেলেও খাবার মেলেনি। গ্যাস না থাকায় সকাল থেকে গ্যাসচালিত বহু বাস ও সিএনজি চলাচল করতে পারেনি রাজধানী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের অনেক এলাকায়। প্রাইভেট কারেও গ্যাস (সিএনজি) নিতে পারেনি অনেকে। সকাল থেকে সিএনজি স্ট্রেশনগুলোতে লম্বা ভিড় দেখা গেলেও গ্যাস মেলেনি সন্ধ্যা পর্যন্ত। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে ঘুরে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকে ফোন করেও কালের কণ্ঠকে তাদের নানা ভোগান্তির কথা জানিয়েছে।
তিন বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ : এদিকে চট্টগ্রাম থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি শিমুল নজরুল জানিয়েছেন, সেখানেও গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। গ্যাস সংকটের কারণে চট্টগ্রামের গৃহস্থালির রান্নাবান্না থেকে শুরু বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শনিবার রাত থেকে গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় চট্টগ্রামের গ্যাসভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ ছিল। এ কারণে নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং চলে। একই কারণে নগরীর সব সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস বিক্রি বন্ধ থাকায় যানবাহন মালিকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। গতকাল রবিবার সকালে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে মাত্র ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)।
চট্টগ্রামে গ্যাসের সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী জামিল উদ্দিন আলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে গত শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় সঞ্চালন লাইন থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল। রবিবার সকাল থেকে আমরা (কেজিডিসিএল) গ্যাস পেয়েছি মাত্র ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট। তাই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। রবিবার রাতের মধ্যে গ্যাসের সরবরাহ আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।'
জানা গেছে, জাতীয় সঞ্চালন লাইন থেকে প্রতিদিন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি প্রায় ২২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পায়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবিকে দেওয়া হয় ৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু গতকাল কেজিডিসিএল পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ায় পিডিবিকে কোনো গ্যাস সরবরাহ করেনি বলে জানিয়েছেন রাউজান বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী স্বপন চক্রবর্তী। তাই গ্যাসভিত্তিক রাউজান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ ছিল। গতকাল চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল প্রায় ২০০ মেগাওয়াট।
এদিকে গতকাল সকাল থেকে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় নগরীর আন্দরকিল্লা, চকবাজার, লালখানবাজার, আসকার দীঘিরপাড়, মোমিন রোড, খুলশী, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের আবসিক গ্রাহকরা বিড়ম্বনায় পড়ে। নগরীর অনেক এলাকায় গ্যাসের অভাবে চুলা জ্বালাতে পারেনি বাসিন্দারা।
এ প্রসঙ্গে খুলশী আবাসিক এলাকার বাসিন্দা জিনিয়া আফরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্যাস সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়তে হয়েছে। কোনো উপায় না দেখে দুপুরের খাবার হোটেল থেকে কিনে খেয়েছি।'
বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও আবাসিক গ্রাহকের পাশাপাশি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প-কলকারখানা গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে শত কোটি টাকার ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে ব্যবসায়ীদের।
No comments