রাষ্ট্র ও অর্থনীতি দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য by মইনুল ইসলাম
১৪ জুন পত্রিকায় প্রকাশিত দেশের জনগণের
দারিদ্র্য হ্রাসের প্রশংসনীয় সাফল্য-সম্পর্কিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি
সংস্থার (FAO) আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের খবরটি পরদিন অনুষ্ঠিত চারটি
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের ভরাডুবির খবরের ডামাডোলে প্রায়
হারিয়ে গেছে।
অথচ, ওই সাফল্যের স্বীকৃতি সারা দুনিয়ার
কাছে ‘চমকপ্রদ’ বিবেচিত হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। বিশ্বের ‘সর্বাধিক
জনসংখ্যার ঘনত্বের’ এই দেশটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্য হ্রাসের সংগ্রামে জাতিসংঘ
ঘোষিত আটটি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সবচেয়ে গুরুত্ববহ প্রথম
লক্ষ্যটিই নির্ধারিত সময়সীমা ২০১৫ সালের দুই বছর আগেভাগেই অর্জন করেছে—এ
খবরটি উন্নয়ন-চিন্তকদের কাছে নিঃসন্দেহে আনন্দের।
পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২০০০ সালের বার্ষিক অধিবেশনে ওই আটটি এমডিজি বা মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হয়েছিল, যার প্রথমটিতে ১৯৯০ সালের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী বাংলাদেশের ৫৮ শতাংশ জনসংখ্যাকে ২০১৫ সালে ২৯ শতাংশে হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছিল। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সঠিক পথে থাকা বিশ্বের মাত্র ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। তাই FAO ওই ২০টি দেশকে সাফল্যের ডিপ্লোমা প্রদানের জন্য যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ১৭ জুন ডিপ্লোমাটি গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালেই বাংলাদেশ যেহেতু ২৯ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ফেলেছে, তাই ২০১৫ সালে এ দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যা ২৫ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে আনা যাবে বলে আশা করা যায়।
অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি দারিদ্র্য সমস্যাকে সমাজব্যবস্থার বিদ্যমান উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টনব্যবস্থা (উৎপাদন সম্পর্কসমূহ) এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করি। আমার দৃঢ় অবস্থান হলো আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘সিস্টেম’ প্রতিনিয়ত সমাজে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে। মাঠপর্যায়ের গবেষণা ও তাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তিতে রচিত আমার বই The Poverty Discourse and Participatiory Action Reserch in Bangladesh গবেষণা সংস্থা রিসার্চ ইনশিয়েটিভ থেকে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে। মোট ১২টি প্রধান প্রক্রিয়ায় এ দেশে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি হচ্ছে বলে আমার গবেষণায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে প্রধান কয়েকটি প্রক্রিয়া ও ক্ষেত্র সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ দেশে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রধান ক্ষেত্র স্বাভাবিকভাবেই কৃষি খাত। কৃষি খাতের নিচের প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে তা প্রধানত ক্রিয়াশীল:
১. ভূমির মালিকানা খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার মাধ্যমে কৃষি জোতের আয়তন হ্রাস;
২. ভূমিহীনতার মারাত্মক প্রাদুর্ভাব;
৩. ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের নিঃস্বায়ন ও প্রান্তিকীকরণ প্রক্রিয়া;
৪. অনুপস্থিত ভূস্বামীদের হাতে ভূমি মালিকানার পুঞ্জীভবন এবং এর ফলে ভূমিস্বত্ব-ব্যবস্থায় বর্গাদারির ক্রমবর্ধমান বিস্তার;
৫. কৃষিজাত দ্রব্য বাজারজাতকরণে দালাল, ফড়িয়া, মহাজন, পাইকারদের মতো মধ্যস্বতভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে ব্যর্থতা;
৬. কৃষকের ঋণগ্রস্ততা ও মহাজনি ব্যবস্থার অব্যাহত দৌরাত্ম্য;
৭. বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, কালবৈশাখীর কারণে কৃষকের ঘরবাড়ি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, গৃহস্থালি দ্রব্যাদি ও কৃষি উৎপাদনের বিপর্যয়;
৮. কৃষি উপকরণের বাজারীকরণ বৃদ্ধির কারণে কৃষিকাজ না পোষানোর সমস্যা।
যথোপযুক্ত কৃষি সংস্কার ও ভূমি সংস্কার নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা রাজ্যের মতো এ দেশেও কৃষি খাতে দারিদ্র্য সৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে মোকাবিলা করা সময়ের দাবি হলেও কোনো সরকারই ব্যবস্থা নেয়নি। তবে বর্তমান সরকার কৃষি ও কৃষকবান্ধব বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করায় সাম্প্রতিক কালে দেশের কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছি আমরা। তরিতরকারি ও মাছ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক। খাদ্যশস্যের দাম মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গ্রামীণ জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এরই প্রতিফলন ঘটেছে গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়ার মাধ্যমে। এমনকি শহরাঞ্চলের শ্রমজীবী বিত্তহীন জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসনেও গতি সঞ্চার হয়েছে।
দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়ায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের ৮০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ এখন বিদেশে অভিবাসন করেছেন বলে ধারণা করা হয়। এসব প্রবাসী বাংলাদেশির ৯০-৯৫ শতাংশই স্বল্প শিক্ষিত, কম দক্ষ গ্রামীণ তরুণ জনগোষ্ঠী, যাঁরা বিদেশে নিম্ন মজুরির কাজে নিয়োজিত। কিন্তু, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মা-বাবা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে এবং পরিবারের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁদের নিম্ন আয়ের একটা বড় অনুপাত নিয়মিতভাবে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন নানা চ্যানেলে। গত অর্থবছরে বৈধ চ্যানেলসমূহের মাধ্যমে দেশে আসা রেমিট্যান্সের প্রবাহ ১৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এ বছর সেটা ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। এর বাইরে হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় আসা এবং দেশে আসা প্রবাসীদের সরাসরি বহন করা মালামাল ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের পরিমাণ আরও ছয় বিলিয়ন থেকে আট বিলিয়ন ডলার হতে পারে। অতএব, বৈধ-অবৈধ পথে প্রতিবছর অর্থনীতিতে বৈদেশিক রেমিট্যান্স যোগ হচ্ছে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পালে জোর হাওয়া লাগিয়ে চলেছে। দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কয়েক বিলিয়ন ডলার পুঁজি প্রতিবছর বিদেশে পাচার না করলে এবং অর্থনীতিতে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের প্রকোপ কিছুটা কমাতে পারলে দেশের জিডিপি এবং জিএনআইয়ের প্রবৃদ্ধির হার ইতিমধ্যে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। (জিএনআই হলো জিডিপি ও নিট রেমিট্যান্সের যোগফল। নিট রেমিট্যান্স হলো বিদেশ থেকে দেশে আসা রেমিট্যান্স এবং দেশ থেকে বিদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পার্থক্য।) দেশের জনগণের দারিদ্র্য হার হ্রাসের গতি ত্বরান্বিত হওয়ার পেছনে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কৃষি খাতের সাফল্যের প্রায় সমপর্যায়ের অবদান রাখছে।
এর কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার শিল্প খাতের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই অর্জিত হচ্ছে এই খাত থেকে। আবার এই খাতের জন্য মেশিনারি, ম্যাটেরিয়ালস ও এক্সেসরিজ আমদানিতে ব্যয় প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। তাই এ খাত থেকে বাংলাদেশের নিট রপ্তানি আয় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। (সে হিসাবে জনশক্তি রপ্তানি খাতই দেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের সূত্র।) তা সত্ত্বেও তৈরি পোশাকশিল্প প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে জনগণের দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়ায় বিশাল অবদান রেখে চলেছে। জনগণের সবচেয়ে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর নারী সমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এই খাতটি দেশে একটি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছে বলা চলে।
অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের যুগান্তকারী উদ্ভাবন ‘ক্ষুদ্রঋণ’ এ দেশের গ্রামীণ নারী সমাজের দারিদ্র্য নিরসনকে ত্বরান্বিতকরণের আরেকটি চলমান বিপ্লবের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ দেশের কয়েক হাজার এনজিওর বেশির ভাগই দুই দশক ধরে গ্রামীণ নিম্নবিত্ত জনগণের কাছে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই প্রধানত পালন করে চলেছে। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হারের তুলনায় বেশি এবং এ জন্য ক্ষুদ্রঋণের সমালোচকদের কাছে এটা একটা বহুল ব্যবহূত সমালোচনার অস্ত্র। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের সুদের হারকে তুলনা করা উচিত মহাজনি সুদের হারের সঙ্গে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হারের সঙ্গে নয়। ক্ষুদ্রঋণের নানা রকম ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, যেসব ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা ভোগে অপচয় করে না, তাদের প্রায় ২৮-৩০ শতাংশ উপার্জনশীল বিনিয়োগে ঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে নিজেদের পরিবারকে টেনে তুলতে সমর্থ হচ্ছে। তাই ক্ষুদ্রঋণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাটা স্রেফ মতলববাজি।
জনগণের একেবারে হতদরিদ্র অংশের জীবন ও জীবিকার কঠোর সংগ্রামে সহায়তা করার জন্য এ দেশের সরকারি ব্যয়ের একটা অংশ সামাজিক নিরাপত্তা জাল কর্মসূচিগুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়। এ ধরনের কর্মসূচির সংখ্যা প্রায় ৯০। সহায়তাপ্রাপ্ত জনগণের সংখ্যাও প্রায় আড়াই কোটি বলে সরকার দাবি করছে। এ কর্মসূচিগুলোর বেশির ভাগই দরিদ্র জনগণের জীবনকে কিছুটা সহনীয় করতে সামান্য অবদান রাখছে। এর মধ্যে আবার বেশ কয়েকটি উৎপাদনশীল ও আয় বর্ধনকারী কার্যক্রমকে উৎসাহিতও করে চলেছে, যা দারিদ্র্য মোকাবিলায় ইতিবাচক ভূমিকা
পালন করে চলেছে। এতৎসত্ত্বেও বলা প্রয়োজন, সামাজিক নিরাপত্তা জাল কর্মসূচিকে মূল্যায়ন ও গবেষণার মাধ্যমে আরও কার্যকর করা সময়ের দাবি।
দারিদ্র্য নিরসনে অর্জিত এ দেশের জনগণের সাফল্যের পেছনে যেসব বিষয় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি সমান গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই প্রধান প্রধান দারিদ্র্য সৃষ্টিকারী বিষয়কে। দারিদ্র্যের যমজ ভাই বলা হয় আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে। যে সমাজে বৈষম্য বাড়ানোর আয়োজনগুলো শক্তিশালী করা হয়, ওই সমাজে দারিদ্র্য নিরসন কঠিন হওয়াই স্বাভাবিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় মাথাপিছু জিডিপি ৪৮ হাজার ডলার হওয়া সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের কারণে ১৭ শতাংশ মার্কিন জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। ২০০৭ সালে এই অনুপাত ছিল ১১ শতাংশ। কিন্তু চলমান মন্দা এবং আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বৃদ্ধির শিকার হয়ে গত ছয় বছরে আরও ৬ শতাংশ মার্কিন নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছে বলে দাবি করেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
শুধু আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্যের কারণেই লাতিন আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পদশালী দেশ ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, পেরু, নিকারাগুয়া ও ইকুয়েডরের জনগণের বিশাল অংশ কিছুদিন আগেও দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে ছিল! ওই সব দেশের নির্বাচিত বামপন্থী সরকারগুলো জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’ অর্জনের কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়াকে গত এক দশকে নাটকীয়ভাবে শক্তিশালী করতে সমর্থ হয়েছে। ভেনেজুয়েলার হুগো চাভেজ, ব্রাজিলের লুলা ডি সিলভা, নিকারাগুয়ার ওরতেগা, বলিভিয়ার মোরালেস—এসব নাম এখন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফল রাষ্ট্রনায়কদের তালিকায়। তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেশের জনগণের দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে দুর্বল করে দিয়ে দেশের সম্পদকে দেশের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে নিয়োজিত করতে সমর্থ হয়েছে।
উল্লেখিত প্রক্রিয়াগুলো এ দেশেও বৈষম্য এবং দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে। তালিকাটা দেখুন:
১. শিক্ষা খাতে বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার লালন,
২. স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাজারীকরণ ও বৈষম্যমূলক চিকিৎসাব্যবস্থার বিস্তার;
৩. ব্যাংকিং-ব্যবস্থাকে ধনাঢ্য গোষ্ঠীর একচেটিয়া দখলে রাখা;
৪. সরকারি রাজস্ব ও ব্যয়ব্যবস্থার গণবিরোধী চারিত্র বহাল রাখা;
৫. রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির তাণ্ডব; এবং
৬. বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য নিয়ে দুর্নীতির মচ্ছব। সে জন্যই বলছি, এ দেশের জন্যও ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’ কৌশল গ্রহণ দারিদ্র্য নিরসনকে ত্বরান্বিত করার জন্য আশু প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২০০০ সালের বার্ষিক অধিবেশনে ওই আটটি এমডিজি বা মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হয়েছিল, যার প্রথমটিতে ১৯৯০ সালের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী বাংলাদেশের ৫৮ শতাংশ জনসংখ্যাকে ২০১৫ সালে ২৯ শতাংশে হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছিল। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সঠিক পথে থাকা বিশ্বের মাত্র ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। তাই FAO ওই ২০টি দেশকে সাফল্যের ডিপ্লোমা প্রদানের জন্য যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ১৭ জুন ডিপ্লোমাটি গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালেই বাংলাদেশ যেহেতু ২৯ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ফেলেছে, তাই ২০১৫ সালে এ দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যা ২৫ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে আনা যাবে বলে আশা করা যায়।
অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি দারিদ্র্য সমস্যাকে সমাজব্যবস্থার বিদ্যমান উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টনব্যবস্থা (উৎপাদন সম্পর্কসমূহ) এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করি। আমার দৃঢ় অবস্থান হলো আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘সিস্টেম’ প্রতিনিয়ত সমাজে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে। মাঠপর্যায়ের গবেষণা ও তাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তিতে রচিত আমার বই The Poverty Discourse and Participatiory Action Reserch in Bangladesh গবেষণা সংস্থা রিসার্চ ইনশিয়েটিভ থেকে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে। মোট ১২টি প্রধান প্রক্রিয়ায় এ দেশে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি হচ্ছে বলে আমার গবেষণায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে প্রধান কয়েকটি প্রক্রিয়া ও ক্ষেত্র সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ দেশে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রধান ক্ষেত্র স্বাভাবিকভাবেই কৃষি খাত। কৃষি খাতের নিচের প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে তা প্রধানত ক্রিয়াশীল:
১. ভূমির মালিকানা খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার মাধ্যমে কৃষি জোতের আয়তন হ্রাস;
২. ভূমিহীনতার মারাত্মক প্রাদুর্ভাব;
৩. ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের নিঃস্বায়ন ও প্রান্তিকীকরণ প্রক্রিয়া;
৪. অনুপস্থিত ভূস্বামীদের হাতে ভূমি মালিকানার পুঞ্জীভবন এবং এর ফলে ভূমিস্বত্ব-ব্যবস্থায় বর্গাদারির ক্রমবর্ধমান বিস্তার;
৫. কৃষিজাত দ্রব্য বাজারজাতকরণে দালাল, ফড়িয়া, মহাজন, পাইকারদের মতো মধ্যস্বতভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে ব্যর্থতা;
৬. কৃষকের ঋণগ্রস্ততা ও মহাজনি ব্যবস্থার অব্যাহত দৌরাত্ম্য;
৭. বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, কালবৈশাখীর কারণে কৃষকের ঘরবাড়ি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, গৃহস্থালি দ্রব্যাদি ও কৃষি উৎপাদনের বিপর্যয়;
৮. কৃষি উপকরণের বাজারীকরণ বৃদ্ধির কারণে কৃষিকাজ না পোষানোর সমস্যা।
যথোপযুক্ত কৃষি সংস্কার ও ভূমি সংস্কার নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা রাজ্যের মতো এ দেশেও কৃষি খাতে দারিদ্র্য সৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে মোকাবিলা করা সময়ের দাবি হলেও কোনো সরকারই ব্যবস্থা নেয়নি। তবে বর্তমান সরকার কৃষি ও কৃষকবান্ধব বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করায় সাম্প্রতিক কালে দেশের কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছি আমরা। তরিতরকারি ও মাছ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক। খাদ্যশস্যের দাম মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গ্রামীণ জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। এরই প্রতিফলন ঘটেছে গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়ার মাধ্যমে। এমনকি শহরাঞ্চলের শ্রমজীবী বিত্তহীন জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসনেও গতি সঞ্চার হয়েছে।
দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়ায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের ৮০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ এখন বিদেশে অভিবাসন করেছেন বলে ধারণা করা হয়। এসব প্রবাসী বাংলাদেশির ৯০-৯৫ শতাংশই স্বল্প শিক্ষিত, কম দক্ষ গ্রামীণ তরুণ জনগোষ্ঠী, যাঁরা বিদেশে নিম্ন মজুরির কাজে নিয়োজিত। কিন্তু, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মা-বাবা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে এবং পরিবারের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁদের নিম্ন আয়ের একটা বড় অনুপাত নিয়মিতভাবে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন নানা চ্যানেলে। গত অর্থবছরে বৈধ চ্যানেলসমূহের মাধ্যমে দেশে আসা রেমিট্যান্সের প্রবাহ ১৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এ বছর সেটা ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। এর বাইরে হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় আসা এবং দেশে আসা প্রবাসীদের সরাসরি বহন করা মালামাল ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের পরিমাণ আরও ছয় বিলিয়ন থেকে আট বিলিয়ন ডলার হতে পারে। অতএব, বৈধ-অবৈধ পথে প্রতিবছর অর্থনীতিতে বৈদেশিক রেমিট্যান্স যোগ হচ্ছে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পালে জোর হাওয়া লাগিয়ে চলেছে। দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কয়েক বিলিয়ন ডলার পুঁজি প্রতিবছর বিদেশে পাচার না করলে এবং অর্থনীতিতে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের প্রকোপ কিছুটা কমাতে পারলে দেশের জিডিপি এবং জিএনআইয়ের প্রবৃদ্ধির হার ইতিমধ্যে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। (জিএনআই হলো জিডিপি ও নিট রেমিট্যান্সের যোগফল। নিট রেমিট্যান্স হলো বিদেশ থেকে দেশে আসা রেমিট্যান্স এবং দেশ থেকে বিদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পার্থক্য।) দেশের জনগণের দারিদ্র্য হার হ্রাসের গতি ত্বরান্বিত হওয়ার পেছনে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কৃষি খাতের সাফল্যের প্রায় সমপর্যায়ের অবদান রাখছে।
এর কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার শিল্প খাতের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশই অর্জিত হচ্ছে এই খাত থেকে। আবার এই খাতের জন্য মেশিনারি, ম্যাটেরিয়ালস ও এক্সেসরিজ আমদানিতে ব্যয় প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। তাই এ খাত থেকে বাংলাদেশের নিট রপ্তানি আয় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। (সে হিসাবে জনশক্তি রপ্তানি খাতই দেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের সূত্র।) তা সত্ত্বেও তৈরি পোশাকশিল্প প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে জনগণের দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়ায় বিশাল অবদান রেখে চলেছে। জনগণের সবচেয়ে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর নারী সমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এই খাতটি দেশে একটি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছে বলা চলে।
অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের যুগান্তকারী উদ্ভাবন ‘ক্ষুদ্রঋণ’ এ দেশের গ্রামীণ নারী সমাজের দারিদ্র্য নিরসনকে ত্বরান্বিতকরণের আরেকটি চলমান বিপ্লবের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ দেশের কয়েক হাজার এনজিওর বেশির ভাগই দুই দশক ধরে গ্রামীণ নিম্নবিত্ত জনগণের কাছে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই প্রধানত পালন করে চলেছে। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হারের তুলনায় বেশি এবং এ জন্য ক্ষুদ্রঋণের সমালোচকদের কাছে এটা একটা বহুল ব্যবহূত সমালোচনার অস্ত্র। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের সুদের হারকে তুলনা করা উচিত মহাজনি সুদের হারের সঙ্গে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হারের সঙ্গে নয়। ক্ষুদ্রঋণের নানা রকম ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, যেসব ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা ভোগে অপচয় করে না, তাদের প্রায় ২৮-৩০ শতাংশ উপার্জনশীল বিনিয়োগে ঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে নিজেদের পরিবারকে টেনে তুলতে সমর্থ হচ্ছে। তাই ক্ষুদ্রঋণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাটা স্রেফ মতলববাজি।
জনগণের একেবারে হতদরিদ্র অংশের জীবন ও জীবিকার কঠোর সংগ্রামে সহায়তা করার জন্য এ দেশের সরকারি ব্যয়ের একটা অংশ সামাজিক নিরাপত্তা জাল কর্মসূচিগুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়। এ ধরনের কর্মসূচির সংখ্যা প্রায় ৯০। সহায়তাপ্রাপ্ত জনগণের সংখ্যাও প্রায় আড়াই কোটি বলে সরকার দাবি করছে। এ কর্মসূচিগুলোর বেশির ভাগই দরিদ্র জনগণের জীবনকে কিছুটা সহনীয় করতে সামান্য অবদান রাখছে। এর মধ্যে আবার বেশ কয়েকটি উৎপাদনশীল ও আয় বর্ধনকারী কার্যক্রমকে উৎসাহিতও করে চলেছে, যা দারিদ্র্য মোকাবিলায় ইতিবাচক ভূমিকা
পালন করে চলেছে। এতৎসত্ত্বেও বলা প্রয়োজন, সামাজিক নিরাপত্তা জাল কর্মসূচিকে মূল্যায়ন ও গবেষণার মাধ্যমে আরও কার্যকর করা সময়ের দাবি।
দারিদ্র্য নিরসনে অর্জিত এ দেশের জনগণের সাফল্যের পেছনে যেসব বিষয় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি সমান গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই প্রধান প্রধান দারিদ্র্য সৃষ্টিকারী বিষয়কে। দারিদ্র্যের যমজ ভাই বলা হয় আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে। যে সমাজে বৈষম্য বাড়ানোর আয়োজনগুলো শক্তিশালী করা হয়, ওই সমাজে দারিদ্র্য নিরসন কঠিন হওয়াই স্বাভাবিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় মাথাপিছু জিডিপি ৪৮ হাজার ডলার হওয়া সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের কারণে ১৭ শতাংশ মার্কিন জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। ২০০৭ সালে এই অনুপাত ছিল ১১ শতাংশ। কিন্তু চলমান মন্দা এবং আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বৃদ্ধির শিকার হয়ে গত ছয় বছরে আরও ৬ শতাংশ মার্কিন নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছে বলে দাবি করেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
শুধু আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্যের কারণেই লাতিন আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পদশালী দেশ ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, পেরু, নিকারাগুয়া ও ইকুয়েডরের জনগণের বিশাল অংশ কিছুদিন আগেও দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে ছিল! ওই সব দেশের নির্বাচিত বামপন্থী সরকারগুলো জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’ অর্জনের কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়াকে গত এক দশকে নাটকীয়ভাবে শক্তিশালী করতে সমর্থ হয়েছে। ভেনেজুয়েলার হুগো চাভেজ, ব্রাজিলের লুলা ডি সিলভা, নিকারাগুয়ার ওরতেগা, বলিভিয়ার মোরালেস—এসব নাম এখন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফল রাষ্ট্রনায়কদের তালিকায়। তাঁদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেশের জনগণের দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে দুর্বল করে দিয়ে দেশের সম্পদকে দেশের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে নিয়োজিত করতে সমর্থ হয়েছে।
উল্লেখিত প্রক্রিয়াগুলো এ দেশেও বৈষম্য এবং দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে। তালিকাটা দেখুন:
১. শিক্ষা খাতে বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার লালন,
২. স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাজারীকরণ ও বৈষম্যমূলক চিকিৎসাব্যবস্থার বিস্তার;
৩. ব্যাংকিং-ব্যবস্থাকে ধনাঢ্য গোষ্ঠীর একচেটিয়া দখলে রাখা;
৪. সরকারি রাজস্ব ও ব্যয়ব্যবস্থার গণবিরোধী চারিত্র বহাল রাখা;
৫. রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির তাণ্ডব; এবং
৬. বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য নিয়ে দুর্নীতির মচ্ছব। সে জন্যই বলছি, এ দেশের জন্যও ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’ কৌশল গ্রহণ দারিদ্র্য নিরসনকে ত্বরান্বিত করার জন্য আশু প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
No comments