শবেবরাতের তাৎপর্য by ড. মোহা. আশরাফ উজ জামান

পবিত্র ও মহিমান্বিত রাতগুলোর মধ্যে শবেবরাত অন্যতম। এ রাতের সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহতায়ালা পৃথিবীসংলগ্ন আকাশে তাঁর রহমত, মাগফিরাত ও দানের অগণিত ভাণ্ডার নিয়ে আগমন করেন এবং রহমত বর্ষণ করতে থাকেন।
আমরা মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সেরা জীব। তাঁর অগণিত কৃপা ও দয়ায় আমরা বেষ্টিত। কিন্তু অনেক সময় আমরা তাঁকে ভুলে যাই। আমরা যাতে আমাদের সব অপরাধ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি- এ জন্য মহান আল্লাহ কিছু কিছু রাতকে ক্ষমার রজনী হিসেবে নির্ধারণ করে রেখেছেন।
'শব' ফার্সি শব্দ, অর্থ রাত। আর বারাত আরবি শব্দ, অর্থ মুক্তি। সুতরাং শবেবরাত অর্থ মুক্তির রাত্রি বা মুক্তির রজনী। আরবি ভাষায় শবেবরাতকে লাইলাতুল বারাত বলা হয়। হাদিসে এ রাত্রিকে লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান নামে উল্লেখ করা হয়েছে। শাবান মাসের ১৫তম রাত্রিকে বলা হয় লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান। তবে উপমহাদেশে এ রাত্রিটি শবেবরাত নামেই অধিক পরিচিত। শবেবরাতের রাত শুধু মুসলিম জাতির জন্য নয় বরং সমগ্র মানব জাতির জন্য অত্যন্ত পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে মুসলিম জাতির জন্য শবেবরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। হিজরি বর্ষের অষ্টম মাসের নাম শাবান। আর এ মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত মহিমান্বিত রজনীটি সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে আমাদের মাঝে আগমন করে। এ ছাড়া শাবান মাস পবিত্র রমজান মাসের পূর্বাভাস ঘোষণা করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, 'ইন্না আনজালনাহু ফি লাইলাতিম মুবারাকাতিন। ইন্না কুন্না মুনজিরিন' অর্থাৎ 'আমি কোরআনকে বরকতময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি এবং আমি ভয় প্রদর্শনকারী।' (সুরা আদ-দুখান, আয়াত-৩)। বিশিষ্ট তাবিই 'ইকরামা (রহ.)সহ অনেক মুফাসসির বলেন, এ আয়াত শবেবরাত অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তাফসিরের কিতাবগুলোয় আরো বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন, 'এ রাতে এক শাবান থেকে অপর শাবান পর্যন্ত প্রতিটি বস্তুর সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তখন এরূপ হয়- এক ব্যক্তির বিয়ে হলো এবং তার সন্তান জম্ম নিল, পরে মৃতের মধ্যে তার নাম তালিকাভুক্ত হলো।' একদা শাবান মাসের ১৫তম রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, 'হে আয়েশা তুমি কি জানো আজ কোন রাত? 'আয়েশা (রা.) উত্তরে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।' তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'এটি হচ্ছে শাবান মাসের ১৫তম রাত্রি। এ রাতটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এ রাতে আল্লাহতায়ালা বান্দার ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন।'
শবেবরাতকে ভাগ্যরজনী বলে অভিহিত করা হয়। অনেক পণ্ডিত ও ইসলামবিশারদের মতে, এ রজনীতে আগামী এক বছরের রিজিক নির্ধারণ করা হয়। আগামী এক বছরের মধ্যে যারা মারা যাবে, যেসব শিশু জন্মলাভ করবে, তাদের নামের তালিকা এ রাতে নির্দিষ্ট ফেরেশতাদের হাতে সোপর্দ করা হয়। আবার কারো কারো মতে, এ রাতে এসব কিছু লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়, যার পরিসমাপ্তি ঘটে রমজানের ২৭তম রাত শবে কদরে। শবেবরাতের রাতে আল্লাহপাক অপরাধী বান্দাদের নাজাত দান করেন। তবে এ নাজাত লাভের জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাত আসবে, তখন তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবে এবং দিনে রোজা পালন করবে। কেননা এদিন সূর্য অস্ত যাওয়ার পরই আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। এরপর তিনি বলেন, 'কে আছো ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কে আছো রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দান করব। কে আছো বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে বিপদমুক্ত করব। ফজর হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরূপ বলতে থাকেন।' এভাবে বিভিন্ন বিপদ-আপদে নিমজ্জিত বান্দাদের আল্লাহপাক এ রাতে মুক্তি দান করেন। মহানবী (সা.)-এর ওই হাদিসটি বড়ই তাৎপর্যমণ্ডিত। আল্লাহতায়ালা স্বীয় বান্দাদের প্রতি সর্বদা সুপ্রসন্ন ও দয়াশীল। তাঁর দয়া লাভের জন্য আমাদের প্রার্থনা জানাতে হবে। আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে ধন্য হতে হলে এ রাতে যেমন ইবাদত-বন্দেগি করতে হবে, অনুরূপভাবে এর আগে এবং পরেও আল্লাহর অনুগত হতে হবে এবং রাসুলের প্রদর্শিত পথে চলতে হবে।
এ মহিমান্বিত রজনীতেও কিছু কিছু লোক আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়। এরা বড়ই হতভাগা। তারা হলো জাদুকর, মুশরিক, জেনাকারী, ঈর্ষাপরায়ণ, পরস্পর শত্রুতাভাব পোষণকারী, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, অন্যায়ভাবে হত্যাকারী ইত্যাদি।
তাফসিরে কাশশাফে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি এ রাতে ১০০ রাকাত নামাজ আদায় করবে, আল্লাহতায়ালা তাঁর কাছে ১০০ ফিরিশতা পাঠাবেন। এর মধ্যে ৩০ জন তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করবেন। ৩০ জন তাঁকে দোজখের আজাব থেকে নিরাপত্তার সংবাদ জানাবেন। ৩০ জন তাঁকে দুনিয়ার বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবেন এবং ১০ জন তাঁকে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচাবেন। অপর হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'এ রাতে আল্লাহতায়ালা বনু কালব গোত্রের ছাগল পালের পশমের সংখ্যানুপাতে আমার উম্মতকে ক্ষমা করবেন। অর্থাৎ অসংখ্য উম্মতে মুহাম্মদীকে ক্ষমা করা হবে।'
শবেবরাতে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) এ রাতে ১০০ রাকাত নফল নামাজ আদায়ের উপদেশ দিয়েছেন। হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, 'আমাকে প্রায় ৩০ জন সাহাবি জানিয়েছেন, যাঁরা এ রাতে নফল নামাজ আদায় করেন, আল্লাহতায়ালা তাঁদের প্রতি ৭০ বার রহমতের দৃষ্টি দান করেন। শবেবরাত অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ রজনী। নফল ইবাদত-বন্দেগির দ্বারা আল্লাহ ও রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে এ পবিত্র রাতটির উসিলায় গোনাহগার বান্দার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে থাকে। কাজেই আমাদের প্রয়োজন ফজিলতপূর্ণ রাত্রিতে অত্যন্ত আদব ও ভক্তিসহকারে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থেকে নিজেদের মুক্তি তথা ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার জন্য কান্নাকাটি করা। নফল ইবাদতের মধ্যে কোরআন শরিফ তিলাওয়াত উত্তম ইবাদত। এ রাতে বেশি বেশি করে কোরআন পাঠ করা যায়। কোরআনের একটি অক্ষর পাঠ করলে ১০টি নেকি পাওয়া যায়।' এ রাতে একটি দোয়া পাঠ করা উত্তম। তা হলো : 'আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়ুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি' অর্থাৎ 'হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে পছন্দ করো, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দাও।'
শবেবরাতের রাতে দান-সদকা করা উত্তম। এ রাতে দান করার ফজিলত অনেক। এ রাতে আরো করণীয় হলো কোনো বিশেষ ব্যবস্থা বা আয়োজন না করে সাধারণভাবে কবরস্থানে যাওয়া এবং মৃত ব্যক্তিদের জন্য দরুদ-ইস্তেগফার পাঠ করে দোয়া করা। এ রজনীতে আমাদের প্রিয়নবী (সা.) মদিনার কবরস্থান জান্নাতুল বাকিতে গমন করে গভীর রাতে উম্মতের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। তিনি ওই রাতে আমাদের সুসংবাদ দিয়ে বলেছেন, 'আল্লাহ তাঁর অগণিত বান্দাদের এ রাতে ক্ষমা করেন। এ থেকেও বোঝা যায়, এ রাতের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ বরকতে পরিপূর্ণ। শবেবরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আমলের বর্ণনা দিয়ে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেছেন, 'নবীজি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন হে আয়েশা! তুমি কি জানো আজ কোন রাত্রি? আমি আরজ করলাম, এ সম্পর্কে আল্লাহর রাসুলই (সা.) অধিক জ্ঞাত। নবীজি (সা.) ইরশাদ করলেন, আজ শাবান মাসের মধ্যরাত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি দান করেন। আজ কি তুমি আমাকে ইবাদত করার অনুমতি দেবে? আমি বললাম জি্ব। এরপর নবী (সা.) সুরা ফাতিহা ও ছোট একটি সুরা পাঠ করে প্রথম রাকাতে সিজদায় অবনত হয়ে অর্ধরাত অতিবাহিত করে দিলেন। দ্বিতীয় রাকাতে সিজদায় বাকি অর্ধরাতও কাটিয়ে দিলেন। তিনি এমনভাবে সিজদায় পড়ে রইলেন যে আমার মনে হলো আল্লাহ তাঁর পবিত্র আত্মা কবজ করে দিয়েছেন।' এ হাদিস থেকে বোঝা যায় যে শবেবরাতের নামাজে রাকাত সংখ্যা বাড়ানোর মধ্যে বরকত নেই বরং একাগ্রচিত্ত ও আন্তরিকতা সহকারে অল্পসংখ্যক নামাজই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যথেষ্ট। তা ছাড়া যেকোনো নামাজে সুরা ফাতিহা ছাড়া অন্য সুরা নির্দিষ্ট নেই, যার কাছে যেভাবে সহজ মনে হবে সেভাবে নামাজ আদায় করা যাবে।
বরকতময় এ রজনীতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে নিমগ্ন থাকাই মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য। অথচ কিছু সংখ্যক লোক এ রাতে এমন কিছু কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, যেগুলো ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, যেমন- আতশবাজি, পটকাবাজি, বোমা ফোটানো, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা, হালুয়া-রুটি ও পোলাও-বিরিয়ানি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া ইত্যাদি। এ ছাড়া এ রাতে কবরে ফুল দেওয়া, বাতি জ্বালানোও গোনাহের কাজ। তাই এসব অবশ্যই বর্জন করতে হবে। মুক্তির বার্তা নিয়ে আগত পবিত্র শবেবরাতে আমাদের উচিত ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে এ রাতের যাবতীয় ফজিলত অর্জনে প্রয়াসী হওয়া।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.