'ভুতুড়ে বাড়ির' রিতা-মিতা-বগুড়ায় হোটেলের এক কক্ষে চার মাস by লিমন বাসার
ঢাকার মিরপুরের সেই 'ভুতুড়ে বাড়ির' দুই
বোন রিতা-মিতা আবারও সেই মর্মান্তিক দশায় জনসমক্ষে উঠে এসেছেন। এখন তাঁরা
বগুড়ায়। চার মাস হলো বগুড়ার একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করছিলেন তাঁরা।
সেখানে
অবস্থানকালেই দুই বোন আগের মতো অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েন। শেষের দিকে সারা দিন
হোটেল কক্ষের দরজা আটকে নিজেদের বন্দি করে রাখেন, নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে
দেন। হোটেলকর্মীরা জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জবাব দেন, 'দোজখি আজাব থেকে মুক্তি
পেতে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করছি। বিরক্ত করবেন না।' গভীর রাতে
তাঁদের কক্ষের ভেতর থেকে ভেসে আসত পবিত্র কোরআন তিলওয়াতের সুর। কখনো হাসির
শব্দ। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলে গতকাল রবিবার একজন মানবাধিকার আইনজীবীর
সহায়তায় পুলিশ দুই বোনকে হোটেল কক্ষ থেকে উদ্ধার করে। পরে তাঁদের বগুড়ার
সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিরাপত্তার
মধ্যে রাখা হয়েছে তাঁদের।
২০০৫ সালের ৮ জুলাই বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছিলেন এ দুই দুই বোন। একাকী, নিঃসঙ্গ জীবনযাপনরত অবস্থায় উচ্চশিক্ষিত ওই দুই বোনের তীব্র মানসিক অসুস্থতার খবর জেনে সারা দেশের মানুষ মর্মাহত হয়েছিল। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট এলিনা খান মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁদের সেই ভুতুড়ে বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন। দিনের পর দিন না খেয়ে হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। তখন চিকিৎসাকালে ডা. মোহিত কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রিতা ও মিতার সুস্থ হয়ে ওঠার পরও ধারাবাহিকভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। ওষুধ বন্ধ করে দিলে তাঁরা আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। যার প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দেবে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া।
বগুড়ায় তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে তেমনভাবে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রিতা-মিতা সদর থানায় এসে উপস্থিত হন। থানার সেকেন্ড অফিসার আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে একটি বাড়ি ঠিক করে দেওয়ার অনুরোধ জানান। তখন থানা থেকে তাঁদের বলা হয়, আর্থিক অবস্থা ভালো থাকলে তাঁরা কোনো আবাসিক হোটেলে উঠতে পারেন। এরপর পুলিশই তাঁদের থানাসংলগ্ন আকবরিয়া হোটেলের ২১ নম্বর কক্ষে তুলে দেয়। তখন তারা জানত না রিতা-মিতার আসল পরিচয়। তাঁরা পুলিশকে শুধু জানিয়েছিলেন, ঢাকা থেকে বগুড়ার সারিয়াকান্দি একটি কাজে আসার পর তাঁরা শহরে থাকতে চাচ্ছেন। আর তাঁদের আচরণে কোনো সন্দেহ না হওয়ায় পুলিশও তাঁদের আসার ও থাকতে চাওয়ার বিস্তারিত জানতে আগ্রহ দেখায়নি।
আকবরিয়া হোটেলে দুই বোনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম জুয়েল। তিনি জানান, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে এলে তাঁদের ২১ নম্বর কক্ষে থাকতে দেওয়া হয়। তাঁরা কয়দিন থাকবেন তা কিছু জানাননি। শুধু প্রতিদিন সকালে কক্ষের নির্ধারিত ৬০০ টাকা দিয়ে যেতেন বড় বোন আমিনুন নাহার। আর খাতায় পরিচয় হিসেবে বড় বোন লেখেন- আমিনুন নাহার (৪৯)। পিতা মৃত শরিফ উদ্দিন, পেশা ডাক্তার। আর ছোট বোন লেখেন- নুরুন নাহার, পেশা ইঞ্জিনিয়ার। ঠিকানা মণ্ডলগ্রাম, নাসিমনগর, বি. বাড়িয়া। জুয়েল জানান, চার মাসেরও বেশি সময় তাঁরা এখানে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। রিতা রাতে রাস্তায় বের হতেন। তিনি যে খাবার কিনে আনতেন, সেই খাবারই দুজনে খেতেন।
হোটেলের একজন বয় জানান, রাতে তাঁদের কক্ষ থেকে আল্লাহর নামে জিকির করার শব্দ হতো। আবার কখনো দুই বোনের হাসি শোনা যেত। তবে তাঁদের বিরক্ত না করার অনুরোধ করার কারণে কক্ষের আশপাশে কেউই যেত না। এ কারণে কক্ষে পরিত্যক্ত জিনিসপত্র, ফলমূলের খোসা দিয়ে জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। আর ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয় এক সপ্তাহ হলো। দুই বোনের কেউই এই সময়ে ঘর থেকে বের হননি। কোনো খাবার মুখে দেননি। এতে হোটেল কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। তারা অনেক ডাকাডাকি করলেও দরজা না খোলায় পুলিশের সহযোগিতা চায়।
আকবরিয়া হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান আলী আলাল বলেন, 'অজানা আশঙ্কায় আমরা পুলিশের হস্তক্ষেপ চাইলে রবিবার দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনের একজন কর্মী এসে তাঁদের কক্ষ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।' হোটেলের যে কক্ষে তাঁরা ছিলেন সেটি সব সময় তাঁরা অন্ধকার করে রাখতেন। কক্ষটিতে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন অপরিষ্কার থাকায় চারিদিকে দুর্গন্ধ। হোটেলের একজন কর্মকর্তা জানান, শেষের দিকে হোটেলে ভাড়া তাঁরা আর পরিশোধ করেননি।
গতকাল কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে রিতার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি পুরুষ কারো সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। শুধু বলেন, 'সবাই কাফের, দোজখে যাবে।' তবে এর পরও দুই বোনের আচরণ ও বেশভূষায় তেমন একটা অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছিল না।
রবিবার হোটেল কক্ষ থেকে উদ্ধার করার সময় তাঁরা বলেছিলেন, গায়েবি নির্দেশ ছাড়া তাঁরা ঘর থেকে বের হবেন না। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী শাহজাদী লায়লা আরজুমান বানু কৌশলে তাঁদের ঘর থেকে বের করেন। তবে তাঁরা বের হয়ে পুলিশ সদস্যদের দেখে রেগে যান। পরে তাঁদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে শহরতলির বারপুরে সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।
মানবাধিকারকর্মী লায়লা আরজুমান বানু জানান, তাঁদের কক্ষের সামনে দেখেই রিতা রাগে গজগজ করতে থাকেন। 'আল্লাহর গজব নাজিল হবে। শান্তিতে থাকতে দিতে চাও না। আবার সম্পত্তির লোভে আসছ? দলবল নিয়ে আসছ?' এ কথা বলেই আবার ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দেন। পরে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে দরজা খোলা হয়।
বগুড়া সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসনকেন্দ্রের শিক্ষক উম্মে শাহেদা জানান, রিতা-মিতাকে কখনো সুস্থ, কখনো অসুস্থ মনে হচ্ছে। সব কথাবার্তা স্বাভাবিক নয়। তবে তাঁরা বেশি কথা বলছেন না। নিরিবিলি থাকতে চাচ্ছেন। এ কারণে একজন পাহারাদার তাঁদের কক্ষের সামনে রাখা হয়েছে। দুজনের মধ্যে মিতা একটু অসুস্থ। না খেয়ে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে।
রিতা-মিতার ব্যাপারে কালের কণ্ঠ পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনুন নাহার রিতা সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। আর মিতা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিদেশে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। সাত বছর আগের তাঁদের মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধারের বেশ আগে থেকে তাঁদের মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনের ৯ নম্বর রোডের সি-ব্লকে ১ নম্বর বাড়িটি পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে 'ভুতুড়ে বাড়ি' পরিচিত হয়ে ওঠে। গভীর রাতে দুই বোন রাস্তায় পায়চারী করতেন। বাড়িটির চারদিক ছিল ঝোপঝাড়-জঙ্গলে ভরা। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস কোনোটিরই সংযোগ ছিল না। বিধ্বস্ত প্রায় বাড়িটিতে দুই বোন এক-আধাবেলা খেয়ে না-খেয়ে জীবন কাটাতেন। পৈতৃক ভিটার সামনের ফার্নিচারের দোকান ভাড়ার আয় দিয়ে চলছিল তাঁদের।
দুই বোনকে উদ্ধারের পর জানা যায়, তাঁরা জটিল মানসিক রোগ 'সিজোফ্রেনিয়ায়' আক্রান্ত। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, মনোরোগ চিকিৎসক ডা. মোহিত কামালের চিকিৎসা, পুরনো বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় নতুন এক জীবন ফিরে পান মিতা-রিতা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাহায্যে ভুতুড়ে বাড়িতে নতুন ঘর ওঠে। এর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগে ডা. রিতার মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে চাকরি হয়। এখন মিতা-রিতার মা ও বাবা কেউ বেঁচে নেই। বড় এক বোন থাকলেও তাঁকে বিশ্বাস করেন না তাঁরা। তাঁদের ধারণা, দুলাভাই তাঁদের বাড়ি দখল করবেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে রিতা-মিতার মা মারা যাওয়ার পর লাশ দাফনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই দুই বোনের আস্বাভাবিক জীবনযাপনের বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। ১৯৯৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তাঁরা পুরোপুরি লোকজন এড়িয়ে চলেছেন। ২০০৬ সালে চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলেও ২০০৮ সালে তাঁদের আচরণ আগের অবস্থায় চলে যায়। এরপর ২০১১ সালের ১৯ জুন 'ভূতের বাড়ি' থেকে রিতা-মিতাকে আবারও উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পর থেকে তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন।
২০০৫ সালের ৮ জুলাই বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছিলেন এ দুই দুই বোন। একাকী, নিঃসঙ্গ জীবনযাপনরত অবস্থায় উচ্চশিক্ষিত ওই দুই বোনের তীব্র মানসিক অসুস্থতার খবর জেনে সারা দেশের মানুষ মর্মাহত হয়েছিল। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট এলিনা খান মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁদের সেই ভুতুড়ে বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন। দিনের পর দিন না খেয়ে হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। তখন চিকিৎসাকালে ডা. মোহিত কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রিতা ও মিতার সুস্থ হয়ে ওঠার পরও ধারাবাহিকভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। ওষুধ বন্ধ করে দিলে তাঁরা আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। যার প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দেবে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া।
বগুড়ায় তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে তেমনভাবে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রিতা-মিতা সদর থানায় এসে উপস্থিত হন। থানার সেকেন্ড অফিসার আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে একটি বাড়ি ঠিক করে দেওয়ার অনুরোধ জানান। তখন থানা থেকে তাঁদের বলা হয়, আর্থিক অবস্থা ভালো থাকলে তাঁরা কোনো আবাসিক হোটেলে উঠতে পারেন। এরপর পুলিশই তাঁদের থানাসংলগ্ন আকবরিয়া হোটেলের ২১ নম্বর কক্ষে তুলে দেয়। তখন তারা জানত না রিতা-মিতার আসল পরিচয়। তাঁরা পুলিশকে শুধু জানিয়েছিলেন, ঢাকা থেকে বগুড়ার সারিয়াকান্দি একটি কাজে আসার পর তাঁরা শহরে থাকতে চাচ্ছেন। আর তাঁদের আচরণে কোনো সন্দেহ না হওয়ায় পুলিশও তাঁদের আসার ও থাকতে চাওয়ার বিস্তারিত জানতে আগ্রহ দেখায়নি।
আকবরিয়া হোটেলে দুই বোনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম জুয়েল। তিনি জানান, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে এলে তাঁদের ২১ নম্বর কক্ষে থাকতে দেওয়া হয়। তাঁরা কয়দিন থাকবেন তা কিছু জানাননি। শুধু প্রতিদিন সকালে কক্ষের নির্ধারিত ৬০০ টাকা দিয়ে যেতেন বড় বোন আমিনুন নাহার। আর খাতায় পরিচয় হিসেবে বড় বোন লেখেন- আমিনুন নাহার (৪৯)। পিতা মৃত শরিফ উদ্দিন, পেশা ডাক্তার। আর ছোট বোন লেখেন- নুরুন নাহার, পেশা ইঞ্জিনিয়ার। ঠিকানা মণ্ডলগ্রাম, নাসিমনগর, বি. বাড়িয়া। জুয়েল জানান, চার মাসেরও বেশি সময় তাঁরা এখানে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। রিতা রাতে রাস্তায় বের হতেন। তিনি যে খাবার কিনে আনতেন, সেই খাবারই দুজনে খেতেন।
হোটেলের একজন বয় জানান, রাতে তাঁদের কক্ষ থেকে আল্লাহর নামে জিকির করার শব্দ হতো। আবার কখনো দুই বোনের হাসি শোনা যেত। তবে তাঁদের বিরক্ত না করার অনুরোধ করার কারণে কক্ষের আশপাশে কেউই যেত না। এ কারণে কক্ষে পরিত্যক্ত জিনিসপত্র, ফলমূলের খোসা দিয়ে জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। আর ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয় এক সপ্তাহ হলো। দুই বোনের কেউই এই সময়ে ঘর থেকে বের হননি। কোনো খাবার মুখে দেননি। এতে হোটেল কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। তারা অনেক ডাকাডাকি করলেও দরজা না খোলায় পুলিশের সহযোগিতা চায়।
আকবরিয়া হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান আলী আলাল বলেন, 'অজানা আশঙ্কায় আমরা পুলিশের হস্তক্ষেপ চাইলে রবিবার দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনের একজন কর্মী এসে তাঁদের কক্ষ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।' হোটেলের যে কক্ষে তাঁরা ছিলেন সেটি সব সময় তাঁরা অন্ধকার করে রাখতেন। কক্ষটিতে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন অপরিষ্কার থাকায় চারিদিকে দুর্গন্ধ। হোটেলের একজন কর্মকর্তা জানান, শেষের দিকে হোটেলে ভাড়া তাঁরা আর পরিশোধ করেননি।
গতকাল কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে রিতার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি পুরুষ কারো সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। শুধু বলেন, 'সবাই কাফের, দোজখে যাবে।' তবে এর পরও দুই বোনের আচরণ ও বেশভূষায় তেমন একটা অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছিল না।
রবিবার হোটেল কক্ষ থেকে উদ্ধার করার সময় তাঁরা বলেছিলেন, গায়েবি নির্দেশ ছাড়া তাঁরা ঘর থেকে বের হবেন না। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী শাহজাদী লায়লা আরজুমান বানু কৌশলে তাঁদের ঘর থেকে বের করেন। তবে তাঁরা বের হয়ে পুলিশ সদস্যদের দেখে রেগে যান। পরে তাঁদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে শহরতলির বারপুরে সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।
মানবাধিকারকর্মী লায়লা আরজুমান বানু জানান, তাঁদের কক্ষের সামনে দেখেই রিতা রাগে গজগজ করতে থাকেন। 'আল্লাহর গজব নাজিল হবে। শান্তিতে থাকতে দিতে চাও না। আবার সম্পত্তির লোভে আসছ? দলবল নিয়ে আসছ?' এ কথা বলেই আবার ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দেন। পরে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে দরজা খোলা হয়।
বগুড়া সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসনকেন্দ্রের শিক্ষক উম্মে শাহেদা জানান, রিতা-মিতাকে কখনো সুস্থ, কখনো অসুস্থ মনে হচ্ছে। সব কথাবার্তা স্বাভাবিক নয়। তবে তাঁরা বেশি কথা বলছেন না। নিরিবিলি থাকতে চাচ্ছেন। এ কারণে একজন পাহারাদার তাঁদের কক্ষের সামনে রাখা হয়েছে। দুজনের মধ্যে মিতা একটু অসুস্থ। না খেয়ে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে।
রিতা-মিতার ব্যাপারে কালের কণ্ঠ পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনুন নাহার রিতা সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। আর মিতা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিদেশে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। সাত বছর আগের তাঁদের মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধারের বেশ আগে থেকে তাঁদের মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনের ৯ নম্বর রোডের সি-ব্লকে ১ নম্বর বাড়িটি পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে 'ভুতুড়ে বাড়ি' পরিচিত হয়ে ওঠে। গভীর রাতে দুই বোন রাস্তায় পায়চারী করতেন। বাড়িটির চারদিক ছিল ঝোপঝাড়-জঙ্গলে ভরা। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস কোনোটিরই সংযোগ ছিল না। বিধ্বস্ত প্রায় বাড়িটিতে দুই বোন এক-আধাবেলা খেয়ে না-খেয়ে জীবন কাটাতেন। পৈতৃক ভিটার সামনের ফার্নিচারের দোকান ভাড়ার আয় দিয়ে চলছিল তাঁদের।
দুই বোনকে উদ্ধারের পর জানা যায়, তাঁরা জটিল মানসিক রোগ 'সিজোফ্রেনিয়ায়' আক্রান্ত। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, মনোরোগ চিকিৎসক ডা. মোহিত কামালের চিকিৎসা, পুরনো বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় নতুন এক জীবন ফিরে পান মিতা-রিতা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাহায্যে ভুতুড়ে বাড়িতে নতুন ঘর ওঠে। এর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগে ডা. রিতার মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে চাকরি হয়। এখন মিতা-রিতার মা ও বাবা কেউ বেঁচে নেই। বড় এক বোন থাকলেও তাঁকে বিশ্বাস করেন না তাঁরা। তাঁদের ধারণা, দুলাভাই তাঁদের বাড়ি দখল করবেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে রিতা-মিতার মা মারা যাওয়ার পর লাশ দাফনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই দুই বোনের আস্বাভাবিক জীবনযাপনের বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। ১৯৯৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তাঁরা পুরোপুরি লোকজন এড়িয়ে চলেছেন। ২০০৬ সালে চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলেও ২০০৮ সালে তাঁদের আচরণ আগের অবস্থায় চলে যায়। এরপর ২০১১ সালের ১৯ জুন 'ভূতের বাড়ি' থেকে রিতা-মিতাকে আবারও উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পর থেকে তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন।
No comments