নিত্যজাতম্-হায় বিকেন্দ্রীকরণ! by মহসীন হাবিব

আমাদের নিজেদেরই লজ্জা করে টেলিভিশনে অথবা পত্রিকার পাতায় শাসক শ্রেণীর মুখ দেখে। গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, এই শাসক শ্রেণী নিজেদের ভালোমন্দ, ক্ষমতায় টিকে থাকা, না-থাকা এসব ছাড়া কোনো কালেও ৬৮ হাজার গ্রামের মানুষের কথা, সত্যিকার উন্নয়নের কথা ভাবেনি, এখনো ভাবে না।
সম্ভবত তাদের মেন্টাল সেটআপটাই এই রকম যে রাজধানীর বাইরে তথা গ্রামেগঞ্জে যারা বসবাস করে তারা এ দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর কাছে তাঁরা যাবেন, কয়েক হাজার লোক জড়ো হবে, ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে সেই রোদে পোড়া মানুষগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেবেন এবং চলে আসবেন। অথবা জনতা লাইন ধরে দাঁড়াবে, নেতা অথবা আমলারা একটি করে কাপড় বা লুঙ্গি হাতে তুলে দিয়ে 'গণতান্ত্রিক' দায়িত্ব পালন করে চলে আসবেন। তাদের থাকবে না কোনো সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা, থাকবে না ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে সরকারের কোনো সেবা গ্রহণের সুযোগ, থাকবে না সরকারি দপ্তরের কাজটি সেরে ফেলার সুযোগ। কিডনি বা লিভারে একটু সমস্যা দেখা দিলে সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ পকেটে পুরে দৌড়ে আসতে হবে দেশের একমাত্র ভরসাস্থল ঢাকায়। একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর চাকরিজনিত কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাঁকে ছুটি নিয়ে এসে পড়ে থাকতে হবে ঢাকায় কোনো এক দপ্তরের সামনে! এর কারণ, ঢাকা শহরে রাজধানীর সুবিধাভোগকারী ধনাঢ্য শ্রেণী আর সরকারের কিছু মানুষ ছাড়া বাদবাকি সব মানুষ এক জটিল ষড়যন্ত্রের শিকার। দেশের শাসকগোষ্ঠীই এই ষড়যন্ত্র অলিখিতভাবে অব্যাহত রেখেছে। আর সেই ষড়যন্ত্রের মূলমন্ত্র হলো সব ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখা, তথা কোনোক্রমেই বিকেন্দ্রীকরণ না হতে দেওয়া।
কেন এই ষড়যন্ত্র? এই দেশ স্বাধীন হয়েছে চার দশকের অধিক সময় পার হয়ে গেছে। অথচ কোনো সরকারপ্রধান, কোনো গুরুত্বপূর্ণ আমলা (চাকরিতে থাকা অবস্থায়) প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের ব্যাপারে সামান্য প্রচেষ্টা চালাননি। অথচ বাংলাদেশে শাসকদের অন্যতম অপরিহার্য কাজ ছিল প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ। শুধু প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ হলে বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতিচর্চা, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক গুণগত মানসহ সব ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারত। এসব সবাই বোঝেন। কিন্তু অতি সংকীর্ণ স্বার্থে মুখ ফিরিয়ে রাখেন। বাধ্য হয়েই এই শাসকদের কাছে বিনয়ের সঙ্গে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে : ব্রিটিশ ভারতের শাসক লর্ড কার্জন বিশ্বাস করতেন, ভারতীয়রা অর্থাৎ উপমহাদেশের জনগণ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই তিনি স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র পরিসরেও জনগণের হাতে ক্ষমতা দেখতে চাননি। ফলে লর্ড রিপন যে স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছিলেন, তিনি সেটা রোধ করেন এবং প্রশাসনের কেন্দ্রীভূতকরণে মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন। আমরা কি ধরে নেব যে স্বাধীন বাংলাদেশে, এই বাংলায় জন্ম নেওয়া শাসকরা লর্ড কার্জনের সেই মানসিকতাকে ধারণ করে আছেন? অবশ্য কার্জনের ওই সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক ও অযৌক্তিক দেখে পরবর্তীকালে লর্ড মর্লি রয়্যাল কমিশন অব ডিসেন্ট্রালাইজেশন গঠন করেছিলেন। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, ব্রিটিশ ভারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বড় লাটরা একেকজন একেক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, আমাদের সব শাসকের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন।
আমরা সত্যিই এক স্বৈরাচারী গণতন্ত্রে বসবাস করছি বহুকাল ধরেই। স্বৈরাচার এখানে একক কোনো ব্যক্তি নয়, স্বৈরাচার সব দলের রাজনৈতিক ইশতেহার, সব রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গি। কোনো সরকারের ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে কোনো পরিকল্পনার কথা শোনা যায় না। বিকেন্দ্রীকরণের জন্য বাজেটে কোনো সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকে না। অথচ তাঁরা সবাই জানেন প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ সারা বিশ্বে কিভাবে হয়েছে এবং হচ্ছে। তাঁরা সবাই জানেন, বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া সত্যিকার উন্নয়ন এবং জনগণের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয় (নাকি জানেন না?)। এই যে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যাপারে অনীহা, এর অনেক কারণ আছে। ক্ষমতা ছুটে যাওয়ার ভয় এবং এক হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার স্বার্থে আমলাদের পরামর্শে রাজনৈতিক নেতারা মধ্যযুগীয় ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনায় আগ্রহী। তা না হলে কেন বিকেন্দ্রীকরণ করবে না। সত্য বলতে দ্বিধা নেই, স্বৈরাচারই বলা হোক আর যা-ই বলা হোক, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কোনো এক অজানা কারণে বিকেন্দ্রীকরণে কিছুটা হাত দিয়েছিলেন। তাঁর নিজেরই মনে আছে কি না জানা নেই, তিনি এক মিটিংয়ে বলেছিলেন, বিআইডাব্লিউটিএর ঢাকায় কী কাজ? এ অফিস হবে নদীমাতৃক কোনো এলাকায়। সেই অনুসারে তিনি বিআইডাব্লিউটিএর প্রধান অফিস বরিশালে ট্রান্সফার করার প্রক্রিয়া করেছিলেন। একজন বড় আমলা এবং কয়েকজন মাঝারি আমলাকে ঢাকা ছেড়ে থাকতে হবে বিধায় এরশাদের সে পরিকল্পনাই ভেস্তে গেছে। এরশাদ উপজেলায় সাধারণ মানুষের ঘরের কোণে আদালত পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু 'অ-স্বৈরাচারী' শাসকরা তা সহ্য করতে পারেননি। ক্ষমতার বা প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ তো দূরের কথা, আমরা বহুদিন ধরে প্রস্তাব রেখেছি জেলা প্রশাসক পদে কমপক্ষে যুগ্ম সচিবদের দায়িত্ব দিতে। এ জন্য মাত্র একটি নির্বাহী আদেশই যথেষ্ট। কিন্তু তা না করে একটি টেবিল, একটি চেয়ার দিয়ে যুগ্ম সচিবদের ঢাকায় বসিয়ে রেখে উপসচিব দিয়ে জেলা প্রশাসনের মতো ভারী দায়িত্ব চালানো হয়। এটি ষড়যন্ত্রেরই অংশ বলে ধরে নেওয়া যায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও এটা চেয়ে শেষ পর্যন্ত পারেননি। বিস্ময়ের ব্যাপার, বড় বড় কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে চাকরি করতে চান না। সরকারি কর্মচারী হিসেবে এটি কত বড় ঔদ্ধত্য তা তাঁরা বোঝেন না। অফিস-আদালতে জেলা-উপজেলায় পোস্টিংকে বলা হয় 'বাইরে' পোস্টিং! কী ধৃষ্টতা!
যা হোক, বিকেন্দ্রীকরণ প্রশ্নে আসি। ফরাসি লেখক ও বুদ্ধিজীবী আলেক্সি দ্য তকিভিলে লিখেছিলেন, ফরাসি বিপ্লবই নাকি শুরু হয়েছিল বিকেন্দ্রীকরণের দাবিতে। ক্ষমতা তখন এতটাই কেন্দ্রীভূত ছিল, যা জনসাধারণকে চরম নিপীড়িত অবস্থার মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। এটাই প্রমাণ করে যে ক্ষমতা যত কেন্দ্রীভূত হয়, জনগণের ওপর নিপীড়ন ততই শক্ত হতে থাকে। এ ধারাই বাংলাদেশে অব্যাহত আছে, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভালো হওয়া সত্ত্বেও আমরা কেন শান্তিতে নেই? এর একমাত্র কারণ, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সব ক্ষমতার আধার ঢাকা শহরের কয়েকটি রাস্তায়।
বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলন শিল্পায়নের জোয়ারে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্ত সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
বিশ্বের সব দেশে আমরা যখন স্থানীয় প্রশাসনকে শক্তিশালী করার সর্বাত্মক চেষ্টা দেখতে পাচ্ছি, তখন বাংলাদেশের স্থানীয় প্রশাসনকে সংকুচিত করে ঢাকামুখী করার প্রবণতা দেখে মনে হয়, কোনো মধ্যযুগের শাসনের অধীন আমরা। যদি বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মানুষের প্রতি ভালোবাসা কোনো নেতা-নেত্রীর থাকে তাহলে অনুরোধ জানাব, এখনই প্রশাসন, অবকাঠামো ও স্থানীয় প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণে হাত দিন। এতে দিন দিন নিজের দলের লাভ-লোকসান দেখা যাবে না, কিন্তু দেশে যোগাযোগ, শিক্ষা, যানজট নিরসন, কৃষি তথা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হবে।

mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.