কথা সামান্যই-ঝরে গেলেন আরেক গুণীজন by ফজলুল আলম
কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমি খোন্দকার
আশরাফ হোসেনের চুলের কোথায় একটা সাদৃশ্য পেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি
করার সময় যখন তাঁকে কোনো কারণে মনে পড়ত, কিন্তু নাম মনে করতে পারতাম না,
তখন বলতাম, 'আরে, ওই যে ইংরেজি বিভাগের কবি নজরুলের চুলের মতো যাঁর চুল।'
অবশেষে
বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগের (২০০৩) বছরে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তাঁরই
সম্পাদনায় প্রকাশিত 'একবিংশ' লিটল ম্যাগাজিনের বিষয়ে। এ ম্যাগাজিনটা আমার
কাছে অনেকটা কলকাতার অনিল আচার্যের 'অনুষ্টুপ' নামের সুবিখ্যাত লিটল (আসলে
জায়ান্ট বলা উচিত) ম্যাগাজিনের মতো লাগত। তবে আমাদের দেশের মনেপ্রাণে
উৎসর্গকৃত কবি-লেখকের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ার জন্যই খোন্দকারের পত্রিকা অনিল
আচার্যের মতো ঢাউস হতো না। কিন্তু প্রবন্ধগুলো পড়তে গেলে এখানেও সম্পাদকের
তীক্ষ্ন দৃষ্টি ও সম্পাদনার স্বাদ পাওয়া যেত। প্রথম পরিচয়ে তিনি আমাকে
বলেছিলেন আমার গবেষণার বিষয় 'সংস্কৃতি' নিয়ে কিছু লিখতে, কিন্তু আমি সে সময়
পাঠভিত্তিক লেখা লেখার কথা ভাবতেও পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর
গল্প-উপন্যাস শুরু করলাম ২০০৪ সাল থেকে। প্রতিটি বই খোন্দকারের হাতে তুলে
দিয়েছি। প্রতিবারই তিনি 'সংস্কৃতি'র ওপর লেখার কথা মনে করিয়ে দিতেন। আমি
তাঁকে আমার টক শো কড়া আলাপে আহ্বান করতে পারলাম ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি
মাসে।
কবি হিসেবে খ্যাত খোন্দকারকে আমি প্রাবন্ধিক হিসেবে বেশি ভালো জানতাম। স্বীকার করতেই হবে যে নানা কথার মধ্যে বেরিয়ে এলো ইংরেজি সাহিত্যের এই অধ্যাপক 'বাংলা কবিতার আধুনিকতা' নিয়ে ডক্টরেট লেভেলে অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন। তার আগে তিনি ইংল্যান্ডের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'লিঙ্গুয়িস্টিক'-এ মাস্টার্স করেছিলেন। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল এখনো আমরা 'বাংলাদেশে ইংরেজি সাহিত্য' কেন পড়ব? খোন্দকারকে আগে জানাইনি যে তাঁকে আমি বেসামাল করে দেব ভেবে এই বিষয় নির্বাচন করেছিলাম। আমার বক্তব্য ছিল ইংরেজি ভাষা শিখতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা শেষেও ইংরেজি সাহিত্য কেন পড়তে হবে? খোন্দকার এতটুকু বিভ্রান্ত না হয়ে বললেন, "সত্যিই আমাদের দেশে নামে 'ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ' হলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা শেখানো হয় না।" আমার পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাহিত্য আমাদের পড়ানো হয় না কেন? খোন্দকার সাবলীলভাবে আমার সঙ্গে একমত হয়ে যা বললেন, তার পরে আমার আর তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো প্রশ্ন রইল না। তাঁর কথা থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হলো, খোন্দকার বিশ্বের প্রায় সব সমসাময়িক নতুন তত্ত্ব সম্পর্কে ও সেসবের বিশ্লেষণে অনেক জ্ঞান রাখেন। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে না হলেও আগামী ৩০-৪০ বছরের মধ্যে বর্তমানের ইংরেজি বিভাগে নামে এবং অধ্যয়ন বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা আছে। নতুন বিষয়ের মধ্যে 'ভাষাতত্ত্ব', 'জেন্ডার স্টাডিজ', 'কালচারাল স্টাডিজ' আসবেই। তারপর তিনি চলে গেলেন 'সাহিত্যতত্ত্বে'র সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কহীনতা সম্পর্কে। ইউরোপের (ব্রিটেন বাদে) অন্যান্য দেশের সাহিত্য তো থাকবেই, সেসব ছাড়াও আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান লিটারেচার ইত্যাদি থাকবে। তবে সেগুলো অতীত হয়ে যাওয়া কম্পারেটিভ লিটারেচারের গঠনে পড়ানো হবে না, তবে ছাত্রছাত্রীরা একটা বা দুটো দেশের সাহিত্য সম্পর্কে 'স্পেশালাইজেশন' করার সুযোগ পাবে। আমি তখন প্রশ্ন করলাম, সে সময় এ বিভাগেও বাংলা সাহিত্য পড়ানো যাবে কি? খোন্দকার বললেন, অবশ্যই যাবে। এ সময় আমার মনে হলো, খোন্দকারই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ইংরেজি বিভাগে বাংলাদেশের কবিতা বিষয়ে ডক্টরেট করেছেন। তাঁর সেই গবেষণা নিয়ে এর পরের আলোচনাটা হলো চমৎকার। সেসবের পূর্ণ বিবরণে না গিয়ে এখানে চুম্বকগুলো তুলে দিচ্ছি : পশ্চিমবঙ্গের কবিতা থেকে পূর্ববঙ্গের কবিতার পার্থক্য (যদিও প্রভাব থেকে যায়), ৪০ দশকের শেষে কলকাতার অনেক কবি ঢাকায় চলে আসেন, তাঁরা সঙ্গে আনেন 'মডার্নিজমে'র ধারা। সত্তরের দশকের মধ্যে বাংলা কবিতা নিজস্ব 'মডার্নিজম' শুরু করে, তারা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছেদ করতে সক্ষম হয় জীবনের প্রতি বেশি সম্পৃক্ত হয়ে ও আশাবাদী হয়ে। আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতা পোস্ট-মডার্ন হয়ে ওঠে।
২০০৭ সাল থেকে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কহীন 'সংস্কৃতি' বিষয়ে আমার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে- খোন্দকারকে সব কটিই দিয়েছিলাম। সে জন্যই তিনি আমাকে ২০১১ সালে 'উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রে'র জন্য 'সংস্কৃতি' বিষয়ে একটি প্রবন্ধ দিতে বললেন। তিনি তখন এই কেন্দ্রের পরিচালক। আমার কাছে তিনি প্রথম রচনা চেয়েছিলেন আট বছর আগে। এত দিন পরে সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি রচনা তাঁকে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করলাম- শিরোনাম ছিল 'সংস্কৃতি ও শ্রেণীসম্পর্ক'। ব্যতিক্রমী এই রচনাটি ১১ মে, ২০১১ সালে পঠিত হলো উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রে, আলোচক ছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম খান ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর। প্রবন্ধটির ওপর আলোচনা প্রাণবন্ত হয়ে উঠল শ্রোতা ও আলোচকদের কথার মধ্য দিয়ে। আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম আমার রচনা বিষয়ে এত আলোচনা শুনে। প্রায় একই সঙ্গে প্রবন্ধটি খোন্দকারের 'একবিংশ' ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো। খোন্দকারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ রয়েছি ও থাকব।
বিশাল প্রাণের, ব্যতিক্রমী ধ্যান-ধারণার অধিকারী ও নিজ ভাবনা প্রকাশে দক্ষ খোন্দকার আশরাফ হোসেন সহসাই চলে গেলেন। আমরা ইংরেজি বিভাগের একজন বাঙালিকে হারালাম।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
কবি হিসেবে খ্যাত খোন্দকারকে আমি প্রাবন্ধিক হিসেবে বেশি ভালো জানতাম। স্বীকার করতেই হবে যে নানা কথার মধ্যে বেরিয়ে এলো ইংরেজি সাহিত্যের এই অধ্যাপক 'বাংলা কবিতার আধুনিকতা' নিয়ে ডক্টরেট লেভেলে অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন। তার আগে তিনি ইংল্যান্ডের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'লিঙ্গুয়িস্টিক'-এ মাস্টার্স করেছিলেন। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল এখনো আমরা 'বাংলাদেশে ইংরেজি সাহিত্য' কেন পড়ব? খোন্দকারকে আগে জানাইনি যে তাঁকে আমি বেসামাল করে দেব ভেবে এই বিষয় নির্বাচন করেছিলাম। আমার বক্তব্য ছিল ইংরেজি ভাষা শিখতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা শেষেও ইংরেজি সাহিত্য কেন পড়তে হবে? খোন্দকার এতটুকু বিভ্রান্ত না হয়ে বললেন, "সত্যিই আমাদের দেশে নামে 'ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ' হলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা শেখানো হয় না।" আমার পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাহিত্য আমাদের পড়ানো হয় না কেন? খোন্দকার সাবলীলভাবে আমার সঙ্গে একমত হয়ে যা বললেন, তার পরে আমার আর তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো প্রশ্ন রইল না। তাঁর কথা থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হলো, খোন্দকার বিশ্বের প্রায় সব সমসাময়িক নতুন তত্ত্ব সম্পর্কে ও সেসবের বিশ্লেষণে অনেক জ্ঞান রাখেন। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে না হলেও আগামী ৩০-৪০ বছরের মধ্যে বর্তমানের ইংরেজি বিভাগে নামে এবং অধ্যয়ন বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা আছে। নতুন বিষয়ের মধ্যে 'ভাষাতত্ত্ব', 'জেন্ডার স্টাডিজ', 'কালচারাল স্টাডিজ' আসবেই। তারপর তিনি চলে গেলেন 'সাহিত্যতত্ত্বে'র সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কহীনতা সম্পর্কে। ইউরোপের (ব্রিটেন বাদে) অন্যান্য দেশের সাহিত্য তো থাকবেই, সেসব ছাড়াও আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান লিটারেচার ইত্যাদি থাকবে। তবে সেগুলো অতীত হয়ে যাওয়া কম্পারেটিভ লিটারেচারের গঠনে পড়ানো হবে না, তবে ছাত্রছাত্রীরা একটা বা দুটো দেশের সাহিত্য সম্পর্কে 'স্পেশালাইজেশন' করার সুযোগ পাবে। আমি তখন প্রশ্ন করলাম, সে সময় এ বিভাগেও বাংলা সাহিত্য পড়ানো যাবে কি? খোন্দকার বললেন, অবশ্যই যাবে। এ সময় আমার মনে হলো, খোন্দকারই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ইংরেজি বিভাগে বাংলাদেশের কবিতা বিষয়ে ডক্টরেট করেছেন। তাঁর সেই গবেষণা নিয়ে এর পরের আলোচনাটা হলো চমৎকার। সেসবের পূর্ণ বিবরণে না গিয়ে এখানে চুম্বকগুলো তুলে দিচ্ছি : পশ্চিমবঙ্গের কবিতা থেকে পূর্ববঙ্গের কবিতার পার্থক্য (যদিও প্রভাব থেকে যায়), ৪০ দশকের শেষে কলকাতার অনেক কবি ঢাকায় চলে আসেন, তাঁরা সঙ্গে আনেন 'মডার্নিজমে'র ধারা। সত্তরের দশকের মধ্যে বাংলা কবিতা নিজস্ব 'মডার্নিজম' শুরু করে, তারা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছেদ করতে সক্ষম হয় জীবনের প্রতি বেশি সম্পৃক্ত হয়ে ও আশাবাদী হয়ে। আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতা পোস্ট-মডার্ন হয়ে ওঠে।
২০০৭ সাল থেকে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কহীন 'সংস্কৃতি' বিষয়ে আমার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে- খোন্দকারকে সব কটিই দিয়েছিলাম। সে জন্যই তিনি আমাকে ২০১১ সালে 'উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রে'র জন্য 'সংস্কৃতি' বিষয়ে একটি প্রবন্ধ দিতে বললেন। তিনি তখন এই কেন্দ্রের পরিচালক। আমার কাছে তিনি প্রথম রচনা চেয়েছিলেন আট বছর আগে। এত দিন পরে সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি রচনা তাঁকে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করলাম- শিরোনাম ছিল 'সংস্কৃতি ও শ্রেণীসম্পর্ক'। ব্যতিক্রমী এই রচনাটি ১১ মে, ২০১১ সালে পঠিত হলো উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রে, আলোচক ছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম খান ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর। প্রবন্ধটির ওপর আলোচনা প্রাণবন্ত হয়ে উঠল শ্রোতা ও আলোচকদের কথার মধ্য দিয়ে। আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম আমার রচনা বিষয়ে এত আলোচনা শুনে। প্রায় একই সঙ্গে প্রবন্ধটি খোন্দকারের 'একবিংশ' ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো। খোন্দকারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ রয়েছি ও থাকব।
বিশাল প্রাণের, ব্যতিক্রমী ধ্যান-ধারণার অধিকারী ও নিজ ভাবনা প্রকাশে দক্ষ খোন্দকার আশরাফ হোসেন সহসাই চলে গেলেন। আমরা ইংরেজি বিভাগের একজন বাঙালিকে হারালাম।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
No comments