শিক্ষা-অদ্ভুত উটের পিঠে উচ্চশিক্ষা by সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
একচলি্লশ বছরে শিক্ষায় আমাদের সংখ্যাতাত্তি্বক অর্জন তো অকিঞ্চিৎকর নয়। জনসংখ্যা বাড়ার হারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে না হোক, চলমান সময়ের ধারার অনিবার্য ফসল হিসেবে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থী দুই-ই বেড়েছে। গত শতকের নব্বই দশকের সূচনায় উচ্চশিক্ষার দিগন্ত সম্প্রসারিত হলো_ সরকারি শিক্ষার পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষাও এলো। অর্থাৎ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবুজ সংকেত সরকারিভাবেই দেওয়া হলো। আশা ছিল, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমবে এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। কোনো আশাই পূরণ হয়নি। ভর্তিচ্ছুদের পছন্দের তালিকায় এখনও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ওপরে অবস্থান নেয়। অবশ্য এমন পছন্দের কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের চেয়ে আর্থিক বিবেচনা। বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা উচ্চশিক্ষা বাংলাদেশে পাওয়া যায়। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা-বাণিজ্যের একটি সম্ভাবনাময় খাত হওয়ার কারণে সেখানে পড়তে যাওয়ার মানেই হলো, 'ফেল কড়ি, মাখ তেল।'
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগুলোও বিস্ময়কর এবং যা উদ্যোক্তাদের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অজ্ঞতার সূচক। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে রহঃবৎহধঃরড়হধষ বা ড়িৎষফ থাকা বেমানান ও অনভিপ্রেত। কারণ ইংরেজি ঁহরাবৎংরঃু শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ঁহরাবৎংরঃধং থেকে, যার নিহিতার্থ হলো, এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে বিশ্বমানের জ্ঞানচর্চা হয়। আর বাংলা প্রতিশব্দ 'বিশ্ববিদ্যালয়' তো আরও প্রত্যক্ষভাবে অর্থবহ। আর তাই মাঝে মধ্যে আমি বলে থাকি, আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব ঢ়ড়ষধৎ বা মেরুসম প্রতিষ্ঠান_ ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন দিকদিগন্ত নিয়ে তাদের নাম। সম্প্রতি একটি বিস্ময়কর নামের সঙ্গে পরিচিত হলাম_ ঊঁৎড়ঢ়বধহ টহরাবৎংরঃু ড়ভ ইধহমষধফবংয. ইংল্যান্ডের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এবং অর্ধডজন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপকের যৎসামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে এমন সব নাম আমার বোধগম্য হয় না। ধর্মের নামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ও হতে পারে না। কারণ, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে ধর্ম-অধর্ম সবকিছুরই চর্চা হয়। মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথ তার স্বপ্নসাধের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছিলেন বিশ্বভারতী। তিনি ছিলেন বিশ্বত্বের সাধক। বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশ্বত্ব চর্চার প্রতিষ্ঠান। কাজেই প্রতিষ্ঠানটির ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকীকরণ বা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক নামকরণ অযৌক্তিক ও অবাঞ্ছিত।
এটা স্বীকার্য, আমাদের উচ্চশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক আকার-অবয়ব ও সংখ্যা স্টম্ফীতিও প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু গুণে-মানে কি এ স্টম্ফীতি ও প্রসারতা অর্থবহ? উত্তর তো বহুমাত্রিক এবং যা দিতে গেলে জীবনানন্দ দাশ থেকে পঙ্ক্তি ধার করে বলতে হয়, 'কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?' কিন্তু বেদনা তো সইতে হবে, নইলে সামনে এগোনোর পথ পাব কী করে? আমাদের উচ্চশিক্ষার মান মূল্যায়ন করতে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হতে হবে। ১৮৭৭ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে সেই সময়ে প্রচলিত শিক্ষা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, 'বঙ্গদেশে এখন এমনি সৃষ্টি ছাড়া শিক্ষাপ্রণালি প্রচলিত রহিয়াছে যে, তাহাতে শিক্ষিতেরা বিজ্ঞান দর্শনের কতকগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সন ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলি মুখস্থ করিতে পারিয়াছেন বটে; কিন্তু তাহাতে তাহাদের রুচিরও উন্নতি করিতে পারেন নাই বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও শিখেন নাই।' অন্যত্র তিনি বলেছিলেন, 'বিদ্যা সহজ, শিক্ষা কঠিন। বিদ্যা আহরণের, শিক্ষা আচরণের।' এ দুটি মন্তব্য যদি আমাদের উচ্চশিক্ষায় যাদের অলোকন তাদের ওপর প্রয়োগ করি, তাহলে উপসংহার রবীন্দ্রনাথ-অনুরূপ হতে বাধ্য। তার কারণ শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা নয়, যথার্থ শিক্ষকের ঘাটতি। অর্থাৎ ভালো শিক্ষক অপ্রতুল, অযোগ্য শিক্ষক প্রচুর। রবীন্দ্রনাথ তার সময়ের নিচের ক্লাসের শিক্ষক সম্পর্কে যা বলেছিলেন তা আজও আমাদের সর্বস্তরের সিংহভাগ শিক্ষকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য: 'তাহারা না জানে ভালো বাংলা, না জানে ভালো ইংরেজি।' একজন শিক্ষকের এতসব বৈশিষ্ট্যের পাটাতন তার পঠন-অনুরাগ ও পাঠ্যাভ্যাস। এ সংক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-প্রাসঙ্গিক একটি তথ্য হাজির করছি। ১৯৮৭ সালে মোট ৯৫২ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৮৮ জনের লাইব্রেরি কার্ড ছিল। যাদের কার্ড ছিল না তাদের মধ্যে ছিলেন সেসব বরেণ্য শিক্ষক, যারা শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় এরাই ছিলেন দিকনির্দেশক। আবার এদের অনেকেরই কোনো গবেষণা প্রকাশনা ছিল না। এখন শিক্ষকের সংখ্যা তো দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে; কিন্তু লাইব্রেরি কার্ডধারী শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে কি-না সে তথ্য আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই। শিক্ষক যদি পাঠকুণ্ঠ হন, তাহলে শিক্ষার্থীরা যে পাঠবিমুখ হবে তা অবধারিত, হয়েছেও তাই।
পড়াশোনাহীন শিক্ষার্থীর সিংহভাগ পরীক্ষার বৈতরণী পার হয় ফটোকপি নোট দিয়ে। ফলে একই উত্তর একাধিক খাতায় পাওয়া যায়। তাদেরও ভাষাজ্ঞান শিক্ষকদের অনুরূপ হতে বাধ্য।
আমাদের উচ্চ শিক্ষাঙ্গন কেন এত বেদনাবিধুর? স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি আমলে '৬১ সালের কালাকানুন বদলে বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতন্ত্রের ধনে ধনী করার লক্ষ্যে '৭৩-এর অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছিল। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অধ্যাদেশ চালু নেই। '৬১-এর কালাকানুন ছিল এক বীঃৎবসব, '৭৩-এর অধ্যাদেশ অন্য বীঃৎবসব_ কোনো কানুনই বিশ্ববিদ্যালয় উপযোগী নয়। বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই স্বায়ত্তশাসিত হবে; কিন্তু তা তো গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতির বাইরে হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্তচিন্তার অবাধ প্রাঙ্গণ। কিন্তু প্রশাসন হবে দায়বদ্ধ ও স্বচ্ছ, যা গণতন্ত্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু '৭৩-এর অধ্যাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার ব্যবস্থা রাখেনি। ফলে তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের বর্মের আড়ালে অনেক প্রশ্নবিদ্ধ কাজ হয়। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায় এবং তা মেধাকে উপেক্ষা করেই।
উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতিকরণ একটি কারণ, যা শিক্ষার পরিবেশকে বিঘি্নত করেছে এবং যার অন্যতম সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিকারী হিসেবে '৭৩-এর অধ্যাদেশকে চিহ্নিত করা যায়। প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নির্বাহী এবং অনুষদগুলোর ডিনের পদগুলোকে নির্বাচনভিত্তিক করার ফলে মেধাভিত্তিক যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য ও সংযোগ প্রাধান্য পায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভাবমূর্তি বিপন্ন হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রায় অর্ধশতাব্দী ভারতে কংগ্রেসের লাগাতার নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্চ কমিটির মাধ্যমে যোগ্যতম শিক্ষাবিদকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো, যাদের খুব কমসংখ্যকই ছিলেন কংগ্রেস অনুসারী। কিন্তু তাতে সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। এমনকি উপনিবেশ আমলেও যোগ্যতম শিক্ষাবিদকেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হতো। ফলে আশুতোষ মুখার্জি পরপর তিনবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। তৃতীয়বার তিনি প্রত্যাখ্যান করলে তাকে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল যে, তার চেয়ে যোগ্য প্রার্থী নেই বলে তাকেই উপাচার্য হতে হবে। আশুতোষ মুখার্জি কিছু শর্ত দিয়েছিলেন; যা মেনে নিয়েই তার নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছিল। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান-মনীষার লালনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়োগ দিয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী স্যার সি ভি রমন ও দার্শনিক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানকে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার পিজে হার্ট'গ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রভাষক রমেশচন্দ্র মজুমদারকে সরাসরি অধ্যাপক করে নিয়ে এসেছিলেন। কারণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ছাড়তে চায়নি। তাহলে কি স্বাধীন বাংলাদেশ উপনিবেশ ভারতেরও পেছনে চলে গেল?
যে কোনো ক্ষমতাসীন সরকার তাদের রাজনীতির বিস্তৃত অঙ্গন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবেচনা করে, আর এতেই যত সব ব্যত্যয়_ বিচ্যুতি ও বিপন্নতা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-মনীষার লালনক্ষেত্র, অপরাজনীতির চারণভূমি নয়। বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্তে মেধাই হওয়া উচিত প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কেউ সর্বোত্তম মেধার অধিকারী হলেও সে বিবেচ্য হবে না। কারণ, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধার; এ মাটিতে রাজাকারের স্থান নেই।
এবার শিক্ষক রাজনীতির প্রসঙ্গে আসা যাক। শিক্ষকের জীবন ও কর্মে রাজনীতির স্পর্শ থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। সমাজের সবচেয়ে আলোকিত মানুষ শিক্ষক রাজনীতি করবেন না তো কে করবে?
তবে শিক্ষকের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদের রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। শিক্ষকের রাজনীতি চেতনার ও নৈতিক অবস্থানের এবং যার ধারাবাহিকতায় সক্রিয় কর্মকাণ্ডেরও। কিন্তু এমন রাজনীতি অন্ধ দলবাজির রাজনীতি হতে পারে না। কারণ, শিক্ষকতার নৈতিক দিকটির কথা বাদ দিলেও দলীয়ভাবে চিহ্নিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারান। জনান্তিকে শ্রুত, ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমাদের পরিচিতি নাকি 'বল্গু স্যার/বল্গু ম্যাডাম' অথবা 'হোয়াইট স্যার/হোয়াইট ম্যাডাম' হিসেবে, যা আসলে আমাদের পেশাগত পরিচয়কে ক্ষুণ্ন করে। তবে শিক্ষক রাজনীতিতে শিক্ষক বা রাজনীতি কোনোটিই নেই; যা আছে তা হলো, ফন্দি-ফিকির, যার শিকড় '৭৩-এর অধ্যাদেশে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অভিন্ন মঞ্চ থাকবে এবং যাতে একাট্টা অবস্থান নিয়ে তারা দেশ ও মানুষের বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করবেন। স্মর্তব্য, '৭১-পূর্ব দিনগুলোতে তাদের এমন অবস্থান ও ভূমিকার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের বৌদ্ধিক পাটাতনের নির্মাণ হয়েছিল।
মনে হয়, শিক্ষক রাজনীতি উচ্চশিক্ষাকে এ পর্যন্ত কী দিয়েছে তার একটি বস্তুনিষ্ঠ স্থিতিপত্র তৈরি করা দরকার। মোটা দাগে বলা যায়, শিক্ষক রাজনীতি_
১. অযোগ্য ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক করেছে;
২. অযোগ্য শিক্ষককে পদ-পদবি প্রাপ্তিতে সহায়ক হয়েছে;
৩. শিক্ষা কার্যক্রম বিঘি্নত করেছে এবং
৪. সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিপন্ন করেছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই আমার অন্তর্জ্বালা। বিশ্ববিদ্যালয়টির অতীত ও বর্তমান ভাবমূর্তির মধ্যে অবস্থানগত দূরত্ব যোজন যোজনব্যাপী।
তবে এমন সব তির্যক বক্তব্যের নিহিতার্থ এ নয় যে, আশার আলোর বিন্দুটি হারিয়ে গেছে। আলোর বিন্দু অবশ্যই আছে; একে বৃত্তে পরিণত করতে হবে এবং বৃত্ত থেকে অনেক বড় পরিসরে। কাজটি দুরূহ হলেও অসম্ভব নয়। কাজটি করবে যাকে বলা যেতে পারে ত্রিপক্ষীয় মৈত্রী_ ছাত্র, শিক্ষক ও সরকার। স্মর্তব্য, এমন ত্রিপক্ষীয় মৈত্রীর মাধ্যমে স্বাধীনতা-পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছিল।
ত্রিপক্ষীয় মৈত্রী নির্মাণে রাজনীতির সংশ্লেষ আছে এমন ছাত্র-শিক্ষককে বাইরে রাখতে হবে। অন্যদিকে সরকারের দিক থেকে এমন ব্যক্তিরাই দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন, যাদের আছে মেধা-মননের সমঝদার হওয়ার যোগ্যতা এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা। প্রস্তাবিত ত্রিপক্ষীয় পর্ষদের সদস্য নির্বাচনের মাপকাঠি কী হবে তার দিকনির্দেশ হাজির করার জন্য আবার রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করছি :'ও ফড় হড়ঃ যধাব ধহু ভধরঃয রহ ধহু হব িরহংঃরঃঁঃরড়হ, নঁঃ রহ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব যিড় ঃযরহশ ঢ়ৎড়ঢ়বৎষু, ভববষ হড়নষু ধহফ ধপঃ ৎরমযঃষু.' কথাগুলো তিনি লিখেছিলেন তার স্কটিশ স্থপতি বন্ধু স্যার প্যাট্রিক গেডেসকে। সৃষ্টিশীল কোনো দায়িত্ব এমন মানুষের ওপর ন্যস্ত হওয়া উচিত, যাদের আছে রবীন্দ্রনাথ নির্দেশিত তিনটি মানবীয় গুণ। তিন পক্ষের সম্মিলিত ও ঐকান্তিক উদ্যোগে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের দিনবদলের রোডম্যাপ তৈরি হোক এমন আশা থাকছে। তবে আপাতত কিছু বিনীত প্রস্তাব থাকছে :
১. '৭৩-এর অধ্যাদেশকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে পরিবর্তন/পরিবর্ধন করতে হবে;
২. উচ্চ শিক্ষাঙ্গনকে অপরাজনীতিমুক্ত করতে হবে;
৩. উপাচার্য/প্রো-উপাচার্য/কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ মঞ্জুরি কমিশনের ব্যবস্থাপনায় সার্চ কমিটির মাধ্যমে হবে;
৪. শিক্ষক নিয়োগ সম্পূর্ণ মেধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে হবে;
৫. বছরে অন্তত একটি গবেষণা প্রকাশনা না থাকলে শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি হবে না;
৬. পদ পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কোনো দায়িত্বের কৃতিত্ব বিবেচনায় নেওয়া যাবে না;
৭. গবেষণা ডিগ্রি/প্রকাশনাহীন, কোনো শিক্ষককে উঁচু পদে পদায়ন করা যাবে না;
৮. ঢাকাসহ অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক/অধ্যাপক পদে নির্বাচনী কমিটিতে দু'জন বিদেশি বিষয়-বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২০০২ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ব্যবস্থা ছিল; অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সময়েই তা ছিল না। এ দুটি পদের নির্বাচনী কমিটিতে বিদেশি বিশেষজ্ঞ না থাকার কারণে পদ দুটির মান যে ক্ষুণ্ন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সব সদস্য দেশি হওয়াতে তদবির করার সুবিধা যে হয় তা মানতে হবে;
৯. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম হবে ইংরেজি। কিন্তু সব অনুষদ/বিভাগে বাংলা ভাষা/সাহিত্যের একটি সমন্বিত কোর্স চালু থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : 'এই বঙ্গদেশে শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ে ইংরেজি ও বাংলা গঙ্গা-যমুনার মিলিত ধারায় প্রবাহিত হইবে।' তার আরও কথা, 'আমার অর্জিত বিদ্যা বিশ্বের বাজারে যাচাই না করা গেলে সেই বিদ্যায় কাজ নাই।' বাংলা মাধ্যমে প্রায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর কী হাল হয় তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ইতিমধ্যেই বলেছি। রবীন্দ্রনাথই তো বলেছিলেন, 'মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম।' কিন্তু তিনি উপর্যুক্ত মন্তব্যগুলোও করেছিলেন। আসলে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-দর্শন সম্পর্কে সঠিক পাঠ থাকলে আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা এখন যে ঘেরাটোপে আবদ্ধ তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত এবং
১০.ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতির পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। বর্তমান পদ্ধতি নিরপেক্ষ হলেও তা বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং কীভাবে তা বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে তা একটি কমিটির মাধ্যমে বিবেচিত হতে পারে।
উচ্চশিক্ষার সাম্প্রতিক চালচিত্রের যথার্থ বর্ণনা দিতে হলে কবি শামসুর রাহমানের পঙ্ক্তি একটু বদলিয়ে বলতে হবে, 'অদ্ভুত এক উটের পিঠে চলেছে উচ্চশিক্ষা।' প্রয়োজন উচ্চশিক্ষাকে এই অদ্ভুত উটের পিঠ থেকে নামিয়ে একটি তেজি ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দেওয়া। এ লক্ষ্যে আরও প্রয়োজন 'শিক্ষা বাঁচাও' নামের সুসংহত ও সঠিক নেতৃত্বে এক নাগরিক আন্দোলন। আর প্রয়োজন উচ্চশিক্ষা তথা গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টানোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাহলেই দেশ বদলাবে, অন্য কিছুতে নয়।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : প্রফেসর ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এটা স্বীকার্য, আমাদের উচ্চশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক আকার-অবয়ব ও সংখ্যা স্টম্ফীতিও প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু গুণে-মানে কি এ স্টম্ফীতি ও প্রসারতা অর্থবহ? উত্তর তো বহুমাত্রিক এবং যা দিতে গেলে জীবনানন্দ দাশ থেকে পঙ্ক্তি ধার করে বলতে হয়, 'কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?' কিন্তু বেদনা তো সইতে হবে, নইলে সামনে এগোনোর পথ পাব কী করে? আমাদের উচ্চশিক্ষার মান মূল্যায়ন করতে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হতে হবে। ১৮৭৭ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে সেই সময়ে প্রচলিত শিক্ষা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, 'বঙ্গদেশে এখন এমনি সৃষ্টি ছাড়া শিক্ষাপ্রণালি প্রচলিত রহিয়াছে যে, তাহাতে শিক্ষিতেরা বিজ্ঞান দর্শনের কতকগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সন ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলি মুখস্থ করিতে পারিয়াছেন বটে; কিন্তু তাহাতে তাহাদের রুচিরও উন্নতি করিতে পারেন নাই বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও শিখেন নাই।' অন্যত্র তিনি বলেছিলেন, 'বিদ্যা সহজ, শিক্ষা কঠিন। বিদ্যা আহরণের, শিক্ষা আচরণের।' এ দুটি মন্তব্য যদি আমাদের উচ্চশিক্ষায় যাদের অলোকন তাদের ওপর প্রয়োগ করি, তাহলে উপসংহার রবীন্দ্রনাথ-অনুরূপ হতে বাধ্য। তার কারণ শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা নয়, যথার্থ শিক্ষকের ঘাটতি। অর্থাৎ ভালো শিক্ষক অপ্রতুল, অযোগ্য শিক্ষক প্রচুর। রবীন্দ্রনাথ তার সময়ের নিচের ক্লাসের শিক্ষক সম্পর্কে যা বলেছিলেন তা আজও আমাদের সর্বস্তরের সিংহভাগ শিক্ষকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য: 'তাহারা না জানে ভালো বাংলা, না জানে ভালো ইংরেজি।' একজন শিক্ষকের এতসব বৈশিষ্ট্যের পাটাতন তার পঠন-অনুরাগ ও পাঠ্যাভ্যাস। এ সংক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-প্রাসঙ্গিক একটি তথ্য হাজির করছি। ১৯৮৭ সালে মোট ৯৫২ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৮৮ জনের লাইব্রেরি কার্ড ছিল। যাদের কার্ড ছিল না তাদের মধ্যে ছিলেন সেসব বরেণ্য শিক্ষক, যারা শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় এরাই ছিলেন দিকনির্দেশক। আবার এদের অনেকেরই কোনো গবেষণা প্রকাশনা ছিল না। এখন শিক্ষকের সংখ্যা তো দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে; কিন্তু লাইব্রেরি কার্ডধারী শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে কি-না সে তথ্য আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই। শিক্ষক যদি পাঠকুণ্ঠ হন, তাহলে শিক্ষার্থীরা যে পাঠবিমুখ হবে তা অবধারিত, হয়েছেও তাই।
পড়াশোনাহীন শিক্ষার্থীর সিংহভাগ পরীক্ষার বৈতরণী পার হয় ফটোকপি নোট দিয়ে। ফলে একই উত্তর একাধিক খাতায় পাওয়া যায়। তাদেরও ভাষাজ্ঞান শিক্ষকদের অনুরূপ হতে বাধ্য।
আমাদের উচ্চ শিক্ষাঙ্গন কেন এত বেদনাবিধুর? স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি আমলে '৬১ সালের কালাকানুন বদলে বিশ্ববিদ্যালয়কে গণতন্ত্রের ধনে ধনী করার লক্ষ্যে '৭৩-এর অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছিল। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অধ্যাদেশ চালু নেই। '৬১-এর কালাকানুন ছিল এক বীঃৎবসব, '৭৩-এর অধ্যাদেশ অন্য বীঃৎবসব_ কোনো কানুনই বিশ্ববিদ্যালয় উপযোগী নয়। বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই স্বায়ত্তশাসিত হবে; কিন্তু তা তো গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতির বাইরে হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্তচিন্তার অবাধ প্রাঙ্গণ। কিন্তু প্রশাসন হবে দায়বদ্ধ ও স্বচ্ছ, যা গণতন্ত্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু '৭৩-এর অধ্যাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার ব্যবস্থা রাখেনি। ফলে তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের বর্মের আড়ালে অনেক প্রশ্নবিদ্ধ কাজ হয়। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায় এবং তা মেধাকে উপেক্ষা করেই।
উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতিকরণ একটি কারণ, যা শিক্ষার পরিবেশকে বিঘি্নত করেছে এবং যার অন্যতম সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিকারী হিসেবে '৭৩-এর অধ্যাদেশকে চিহ্নিত করা যায়। প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নির্বাহী এবং অনুষদগুলোর ডিনের পদগুলোকে নির্বাচনভিত্তিক করার ফলে মেধাভিত্তিক যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য ও সংযোগ প্রাধান্য পায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভাবমূর্তি বিপন্ন হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রায় অর্ধশতাব্দী ভারতে কংগ্রেসের লাগাতার নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্চ কমিটির মাধ্যমে যোগ্যতম শিক্ষাবিদকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো, যাদের খুব কমসংখ্যকই ছিলেন কংগ্রেস অনুসারী। কিন্তু তাতে সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। এমনকি উপনিবেশ আমলেও যোগ্যতম শিক্ষাবিদকেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হতো। ফলে আশুতোষ মুখার্জি পরপর তিনবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। তৃতীয়বার তিনি প্রত্যাখ্যান করলে তাকে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল যে, তার চেয়ে যোগ্য প্রার্থী নেই বলে তাকেই উপাচার্য হতে হবে। আশুতোষ মুখার্জি কিছু শর্ত দিয়েছিলেন; যা মেনে নিয়েই তার নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছিল। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান-মনীষার লালনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়োগ দিয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী স্যার সি ভি রমন ও দার্শনিক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানকে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার পিজে হার্ট'গ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রভাষক রমেশচন্দ্র মজুমদারকে সরাসরি অধ্যাপক করে নিয়ে এসেছিলেন। কারণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ছাড়তে চায়নি। তাহলে কি স্বাধীন বাংলাদেশ উপনিবেশ ভারতেরও পেছনে চলে গেল?
যে কোনো ক্ষমতাসীন সরকার তাদের রাজনীতির বিস্তৃত অঙ্গন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবেচনা করে, আর এতেই যত সব ব্যত্যয়_ বিচ্যুতি ও বিপন্নতা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-মনীষার লালনক্ষেত্র, অপরাজনীতির চারণভূমি নয়। বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্তে মেধাই হওয়া উচিত প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কেউ সর্বোত্তম মেধার অধিকারী হলেও সে বিবেচ্য হবে না। কারণ, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধার; এ মাটিতে রাজাকারের স্থান নেই।
এবার শিক্ষক রাজনীতির প্রসঙ্গে আসা যাক। শিক্ষকের জীবন ও কর্মে রাজনীতির স্পর্শ থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। সমাজের সবচেয়ে আলোকিত মানুষ শিক্ষক রাজনীতি করবেন না তো কে করবে?
তবে শিক্ষকের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদের রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। শিক্ষকের রাজনীতি চেতনার ও নৈতিক অবস্থানের এবং যার ধারাবাহিকতায় সক্রিয় কর্মকাণ্ডেরও। কিন্তু এমন রাজনীতি অন্ধ দলবাজির রাজনীতি হতে পারে না। কারণ, শিক্ষকতার নৈতিক দিকটির কথা বাদ দিলেও দলীয়ভাবে চিহ্নিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারান। জনান্তিকে শ্রুত, ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমাদের পরিচিতি নাকি 'বল্গু স্যার/বল্গু ম্যাডাম' অথবা 'হোয়াইট স্যার/হোয়াইট ম্যাডাম' হিসেবে, যা আসলে আমাদের পেশাগত পরিচয়কে ক্ষুণ্ন করে। তবে শিক্ষক রাজনীতিতে শিক্ষক বা রাজনীতি কোনোটিই নেই; যা আছে তা হলো, ফন্দি-ফিকির, যার শিকড় '৭৩-এর অধ্যাদেশে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অভিন্ন মঞ্চ থাকবে এবং যাতে একাট্টা অবস্থান নিয়ে তারা দেশ ও মানুষের বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করবেন। স্মর্তব্য, '৭১-পূর্ব দিনগুলোতে তাদের এমন অবস্থান ও ভূমিকার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের বৌদ্ধিক পাটাতনের নির্মাণ হয়েছিল।
মনে হয়, শিক্ষক রাজনীতি উচ্চশিক্ষাকে এ পর্যন্ত কী দিয়েছে তার একটি বস্তুনিষ্ঠ স্থিতিপত্র তৈরি করা দরকার। মোটা দাগে বলা যায়, শিক্ষক রাজনীতি_
১. অযোগ্য ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক করেছে;
২. অযোগ্য শিক্ষককে পদ-পদবি প্রাপ্তিতে সহায়ক হয়েছে;
৩. শিক্ষা কার্যক্রম বিঘি্নত করেছে এবং
৪. সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিপন্ন করেছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই আমার অন্তর্জ্বালা। বিশ্ববিদ্যালয়টির অতীত ও বর্তমান ভাবমূর্তির মধ্যে অবস্থানগত দূরত্ব যোজন যোজনব্যাপী।
তবে এমন সব তির্যক বক্তব্যের নিহিতার্থ এ নয় যে, আশার আলোর বিন্দুটি হারিয়ে গেছে। আলোর বিন্দু অবশ্যই আছে; একে বৃত্তে পরিণত করতে হবে এবং বৃত্ত থেকে অনেক বড় পরিসরে। কাজটি দুরূহ হলেও অসম্ভব নয়। কাজটি করবে যাকে বলা যেতে পারে ত্রিপক্ষীয় মৈত্রী_ ছাত্র, শিক্ষক ও সরকার। স্মর্তব্য, এমন ত্রিপক্ষীয় মৈত্রীর মাধ্যমে স্বাধীনতা-পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছিল।
ত্রিপক্ষীয় মৈত্রী নির্মাণে রাজনীতির সংশ্লেষ আছে এমন ছাত্র-শিক্ষককে বাইরে রাখতে হবে। অন্যদিকে সরকারের দিক থেকে এমন ব্যক্তিরাই দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন, যাদের আছে মেধা-মননের সমঝদার হওয়ার যোগ্যতা এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা। প্রস্তাবিত ত্রিপক্ষীয় পর্ষদের সদস্য নির্বাচনের মাপকাঠি কী হবে তার দিকনির্দেশ হাজির করার জন্য আবার রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করছি :'ও ফড় হড়ঃ যধাব ধহু ভধরঃয রহ ধহু হব িরহংঃরঃঁঃরড়হ, নঁঃ রহ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব যিড় ঃযরহশ ঢ়ৎড়ঢ়বৎষু, ভববষ হড়নষু ধহফ ধপঃ ৎরমযঃষু.' কথাগুলো তিনি লিখেছিলেন তার স্কটিশ স্থপতি বন্ধু স্যার প্যাট্রিক গেডেসকে। সৃষ্টিশীল কোনো দায়িত্ব এমন মানুষের ওপর ন্যস্ত হওয়া উচিত, যাদের আছে রবীন্দ্রনাথ নির্দেশিত তিনটি মানবীয় গুণ। তিন পক্ষের সম্মিলিত ও ঐকান্তিক উদ্যোগে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের দিনবদলের রোডম্যাপ তৈরি হোক এমন আশা থাকছে। তবে আপাতত কিছু বিনীত প্রস্তাব থাকছে :
১. '৭৩-এর অধ্যাদেশকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে পরিবর্তন/পরিবর্ধন করতে হবে;
২. উচ্চ শিক্ষাঙ্গনকে অপরাজনীতিমুক্ত করতে হবে;
৩. উপাচার্য/প্রো-উপাচার্য/কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ মঞ্জুরি কমিশনের ব্যবস্থাপনায় সার্চ কমিটির মাধ্যমে হবে;
৪. শিক্ষক নিয়োগ সম্পূর্ণ মেধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে হবে;
৫. বছরে অন্তত একটি গবেষণা প্রকাশনা না থাকলে শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি হবে না;
৬. পদ পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কোনো দায়িত্বের কৃতিত্ব বিবেচনায় নেওয়া যাবে না;
৭. গবেষণা ডিগ্রি/প্রকাশনাহীন, কোনো শিক্ষককে উঁচু পদে পদায়ন করা যাবে না;
৮. ঢাকাসহ অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক/অধ্যাপক পদে নির্বাচনী কমিটিতে দু'জন বিদেশি বিষয়-বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২০০২ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ব্যবস্থা ছিল; অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সময়েই তা ছিল না। এ দুটি পদের নির্বাচনী কমিটিতে বিদেশি বিশেষজ্ঞ না থাকার কারণে পদ দুটির মান যে ক্ষুণ্ন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সব সদস্য দেশি হওয়াতে তদবির করার সুবিধা যে হয় তা মানতে হবে;
৯. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম হবে ইংরেজি। কিন্তু সব অনুষদ/বিভাগে বাংলা ভাষা/সাহিত্যের একটি সমন্বিত কোর্স চালু থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : 'এই বঙ্গদেশে শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ে ইংরেজি ও বাংলা গঙ্গা-যমুনার মিলিত ধারায় প্রবাহিত হইবে।' তার আরও কথা, 'আমার অর্জিত বিদ্যা বিশ্বের বাজারে যাচাই না করা গেলে সেই বিদ্যায় কাজ নাই।' বাংলা মাধ্যমে প্রায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর কী হাল হয় তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ইতিমধ্যেই বলেছি। রবীন্দ্রনাথই তো বলেছিলেন, 'মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম।' কিন্তু তিনি উপর্যুক্ত মন্তব্যগুলোও করেছিলেন। আসলে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-দর্শন সম্পর্কে সঠিক পাঠ থাকলে আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা এখন যে ঘেরাটোপে আবদ্ধ তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারত এবং
১০.ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতির পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। বর্তমান পদ্ধতি নিরপেক্ষ হলেও তা বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং কীভাবে তা বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে তা একটি কমিটির মাধ্যমে বিবেচিত হতে পারে।
উচ্চশিক্ষার সাম্প্রতিক চালচিত্রের যথার্থ বর্ণনা দিতে হলে কবি শামসুর রাহমানের পঙ্ক্তি একটু বদলিয়ে বলতে হবে, 'অদ্ভুত এক উটের পিঠে চলেছে উচ্চশিক্ষা।' প্রয়োজন উচ্চশিক্ষাকে এই অদ্ভুত উটের পিঠ থেকে নামিয়ে একটি তেজি ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দেওয়া। এ লক্ষ্যে আরও প্রয়োজন 'শিক্ষা বাঁচাও' নামের সুসংহত ও সঠিক নেতৃত্বে এক নাগরিক আন্দোলন। আর প্রয়োজন উচ্চশিক্ষা তথা গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টানোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাহলেই দেশ বদলাবে, অন্য কিছুতে নয়।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : প্রফেসর ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments