সরকারের 'মামলাকলে' মহাজোটের এরশাদ by মোশতাক আহমদ
সরকারের শেষ সময়ে এসে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামে দায়ের করা মামলাগুলো হঠাৎ করে চাঙ্গা করা হচ্ছে।
মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর হত্যা মামলা এবং বিমানবাহিনীর জন্য রাডার ক্রয় দুর্নীতি মামলায় নিয়মিত হাজিরা আর শুনানিতে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে তাঁকে। অথচ ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে পতনের পর তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা অথবা চার্জশিটে আসামি করা এসব মামলা এত বছর চালুই করা হয়নি।
গত ১০ জানুয়ারি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মঞ্জুর হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়, যেখানে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয় এরশাদকে। এ মামলার পরবর্তী তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিনও তাঁকে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে বলে জানা গেছে। তার আগে ৭ ফেব্রুয়ারি রাডার ক্রয় দুর্নীতি মামলায় তাঁকে হাজিরা দিতে হবে আদালতে। এ মামলাটি দায়ের করে সাবেক দুর্নীতি দমন ব্যুরো। মামলাটি এখন চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরশাদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা আছে হলিডে ইন নামে প্রস্তাবিত পাঁচ তারকাবিশিষ্ট সরকারি হোটেল-সংক্রান্ত দুর্নীতির। এ মামলা এখন হাইকোর্টে স্থগিত অবস্থায় আছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেশ কিছু দিন ধরে ক্ষমতাসীন মূল দল আওয়ামী লীগের নানা কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনায় মুখর হয়েছেন এবং নিজ দলের শক্তি-সামর্থ্য জাহির করে বেড়াচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এরশাদের মুখ বন্ধ করে তাঁকে চাপে রাখার জন্যই আওয়ামী লীগ তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো চাঙ্গা করার কৌশল নিয়েছে।
গত ১২ জানুয়ারি নীলফামারীতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শওকত চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এরশাদ বলেন, 'শিগগিরই আমরা মহাজোট থেকে বেরিয়ে আসব।' ওই দিন সন্ধ্যায় নীলফামারীর সৈয়দপুরে শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণকালে এরশাদ আরো বলেন, 'অনেকে মনে করে, জাতীয় পার্টি বহু বিভক্ত একটি রাজনৈতিক দল। এটা ঠিক নয়। আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এরই মধ্যে আমরা ২০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছি। শিগগিরই সব আসনে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হবে।'
গত ৮ নভেম্বর দুপুরে সিলেট সার্কিট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিশ্বাস নেই উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, 'জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটি ফ্যাক্টর। নির্বাচনে গেলে জাতীয় পার্টি জিতবে।' এরশাদ আরো বলেন, 'যেভাবেই নির্বাচন হোক না কেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। জাতীয় পার্টি এখনো মহাজোটে আছে। সময় হলেই জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে একক নির্বাচন করবে।'
৪ নভেম্বর দুপুরে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শেখ শিমুল ঈদগাহ মাঠে এক নির্বাচনী জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এরশাদ বলেন, 'বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে দেশের মানুষ হতাশ হয়ে পড়েছে। দেশে কোনো উন্নয়ন হয়নি। শুধু খুন ও গুমের ঘটনা ঘটছে। তাই দেশের মানুষ এখন পরিবর্তন চায়।' এরশাদ বলেন, ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা থাকলেও সরকার তা করতে পারেনি। এ দেশে চাকরি হয় টাকা ও মন্ত্রীদের সুপারিশে। এ অবস্থার পরিবর্তন চায় দেশের মানুষ; চায় নতুন সরকার। জাতীয় পার্টি ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব হবে না বলেও তিনি দাবি করেন।
বেঁকে বসা এরশাদকে বাগে রাখতে কম-বেশি দুই দশক পর এই প্রকাশ্য মামলা-থেরাপি এবং জাতীয় পার্টির নেতাদের এ ব্যাপারে স্পষ্ট অভিযোগ থাকলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা যথারীতি অস্বীকার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, এরশাদের মামলা নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো আগ্রহ নেই। তাই এ বিষয়ে চাপের প্রশ্নই আসে না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার এ বিষয়ে কিছু জানা নেই, তাই কোনো মন্তব্য করতে চাই না।'
রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার কমিটির সভাপতি আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী সরকার অনেকের দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করেছিল। কিন্তু দুদক কারো দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহার করেনি।
সরকারের শেষ সময়ে এসে হঠাৎ এরশাদের মামলা চাঙ্গা করার ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসও কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয়। অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেন, 'এরশাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন। এ নিয়ে এখন কোনো মন্তব্য করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের নিষেধ আছে।'
জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ অভিযোগ করে বলেছেন, এরশাদের বিরুদ্ধের মামলাগুলো তাঁরা আরো আগেই নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকারপক্ষ অহেতুক বিলম্ব করেছে। এখন সরকারের শেষ সময়ে এসে সেগুলো চাঙ্গা করায় তাঁরা শঙ্কিত।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুস সবুর আসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মহাজোট সরকারের চার বছর পার হয়ে গেছে। আমরা আর সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। আমাদের মনে হয়, সরকার মামলাগুলো ঝুলিয়ে রেখে ফায়দা লুটতে চায়। আমি আওয়ামী লীগকে বলে দিতে চাই, ভয় দেখিয়ে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। আর এক পক্ষের আগ্রহেও কখনো বন্ধুত্ব টিকে থাকতে পারে না। এরশাদের নামে দায়ের করা মামলাগুলো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। আমি আশা করি, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।'
এ অভিযোগের জবাবে আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'কারো মামলা চাঙ্গা হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা আমার জানা নেই। তবে সব মামলাই আইনের স্বাভাবিক গতিতে চলবে।'
দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এরশাদের মামলা প্রত্যাহারে দুদকের কোনো সুযোগ নেই। এটা আদালতের বিষয়। আদালত চাইলে যে কারো মামলা প্রত্যাহার করতে পারেন।
জাতীয় পার্টি সূত্র জানায়, মহাজোট গঠনের সময় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা হয়। সেখানে এরশাদের নামের মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয়টিও ছিল। জাতীয় পার্টি সূত্রের আরো দাবি, মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বারবার এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের আশ্বাস দেওয়া হয়। তার পরও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। এ জন্য এরশাদ নিজেও দুইবার লিখিত আবেদন করেন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে আন্তরিক সাড়া পাননি।
তবে জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এ সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি মামলা নিয়ে ভীত নন। মামলা আইনের স্বাভাবিক গতিতে চলবে। তিনি বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে মামলাগুলো চাঙ্গা হলে তাতে কী? আমি সব সময়ই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি মনে করি, মামলাগুলো আইনিভাবেই সমাধান হবে।' জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, নৈতিক কারণে এরশাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা উচিত। কারণ এরশাদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক। পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, 'এরশাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মামলা করা হয়েছিল। আমি অবিলম্বে এসব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।'
জাপা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন বাবলু কালের কণ্ঠকে বলেন, এরশাদের বিরুদ্ধে যত মামলা দায়ের হয়েছে, এর সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক। এ ছাড়া তিনি এ পর্যন্ত অনেক মামলায় খালাস পেয়েছেন। সেগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, সব মামলাই ছিল মিথ্যা অভিযোগে ও হয়রানির উদ্দেশ্যে। জানা গেছে, মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৭ মে প্রথম দফায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন এরশাদ। ওই আবেদনে এরশাদ মঞ্জুর হত্যা, রাডার ক্রয় ও বিটিভির কেব্ল্ ক্রয় দুর্নীতি মামলাসহ পাঁচটি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। কোনো অগ্রগতি না হলে ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় তিনি স্বরাষ্ট্রসচিব বরাবর মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন।
তাতেও কাজ না হলে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ সরকার আমলে নেতা-কর্মীরা কয়েক দফা আন্দোলন করে। এমনকি জাতীয় সংসদ থেকে ওয়াক আউটের ঘোষণাও দেন তাঁরা। তবে ওয়াক আউট না করলেও কয়েক দফা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে জাপা নেতা-কর্মীরা।
এরশাদের জেল খাটা : জানা গেছে, জাপানি নৌযান ক্রয়-সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় এরশাদ সাজা ভোগ করেছেন। তবে তাঁকে এ মামলায় আর সাজা ভোগ করতে হবে না। ১৯৯৫ সালের ৬ জুলাই ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে চার মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু এর আগেই এরশাদ সাজা ভোগ করায় আদালত ওই সাজাকে এ রায় থেকে কর্তন করেন। ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে সাজা খাটা শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পার হওয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দূর হয় এরশাদের।
উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান না করে ৫২০টি নৌযান ও ১০টি পানি পরিশোধন যন্ত্র ক্রয় করার ক্ষেত্রে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ প্রভাব খাটিয়ে ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ আনা হয়। ১৯৯১ সালের ২২ জুলাই তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর উপপরিচালক এ কে এম হোসেন রমনা থানায় এ বিষয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এরশাদের নামে যত মামলা : জাপা সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হলে তাঁর নামে মোট ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ২০০৬ সালে বিএনপির সঙ্গে এরশাদের জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে পাঁচটি মামলা প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি। অন্য ২২টি মামলার মধ্যে ১৮টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। বিচারাধীন মঞ্জুর হত্যা মামলা, রাডার ক্রয় দুর্নীতি ও হলিডে ইন দুর্নীতি মামলা। এগুলোর মধ্যে মঞ্জুর হত্যা মামলা নিয়ে এরশাদ বেশি চিন্তিত বলে জাপা সূত্র জানিয়েছে।
রাডার ক্রয় দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকার ২০১১ সালে সুপারিশ করলেও এতে বাদ সাধে দুদক। দুদক বলেছে, উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তারা মামলা দায়ের করেছে। এ কারণে সরকার সুপারিশ করলেই তারা মামলা প্রত্যাহার করবে না।
এরশাদের আইনজীবী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম বলেন, নেতার বিরুদ্ধে ঠিক কতটি মামলা দায়ের হয়েছিল আর কতটি মামলা রয়েছে এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। কাগজ না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, মহাজোটগতভাবে গত নির্বাচনে জাপা ২৯টি আসনে জয়লাভ করে। উপনির্বাচনে একটি আসনে পরাজিত হলে জাপার এমপির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮। সংরক্ষিত আসনে তিনজন নারী এমপিসহ বর্তমান সংসদে জাপার প্রতিনিধি মোট ৩১ জন।
গত ১০ জানুয়ারি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মঞ্জুর হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়, যেখানে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয় এরশাদকে। এ মামলার পরবর্তী তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিনও তাঁকে আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে বলে জানা গেছে। তার আগে ৭ ফেব্রুয়ারি রাডার ক্রয় দুর্নীতি মামলায় তাঁকে হাজিরা দিতে হবে আদালতে। এ মামলাটি দায়ের করে সাবেক দুর্নীতি দমন ব্যুরো। মামলাটি এখন চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরশাদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা আছে হলিডে ইন নামে প্রস্তাবিত পাঁচ তারকাবিশিষ্ট সরকারি হোটেল-সংক্রান্ত দুর্নীতির। এ মামলা এখন হাইকোর্টে স্থগিত অবস্থায় আছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেশ কিছু দিন ধরে ক্ষমতাসীন মূল দল আওয়ামী লীগের নানা কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনায় মুখর হয়েছেন এবং নিজ দলের শক্তি-সামর্থ্য জাহির করে বেড়াচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এরশাদের মুখ বন্ধ করে তাঁকে চাপে রাখার জন্যই আওয়ামী লীগ তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো চাঙ্গা করার কৌশল নিয়েছে।
গত ১২ জানুয়ারি নীলফামারীতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শওকত চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এরশাদ বলেন, 'শিগগিরই আমরা মহাজোট থেকে বেরিয়ে আসব।' ওই দিন সন্ধ্যায় নীলফামারীর সৈয়দপুরে শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণকালে এরশাদ আরো বলেন, 'অনেকে মনে করে, জাতীয় পার্টি বহু বিভক্ত একটি রাজনৈতিক দল। এটা ঠিক নয়। আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এরই মধ্যে আমরা ২০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছি। শিগগিরই সব আসনে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হবে।'
গত ৮ নভেম্বর দুপুরে সিলেট সার্কিট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিশ্বাস নেই উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, 'জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটি ফ্যাক্টর। নির্বাচনে গেলে জাতীয় পার্টি জিতবে।' এরশাদ আরো বলেন, 'যেভাবেই নির্বাচন হোক না কেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। জাতীয় পার্টি এখনো মহাজোটে আছে। সময় হলেই জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে একক নির্বাচন করবে।'
৪ নভেম্বর দুপুরে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শেখ শিমুল ঈদগাহ মাঠে এক নির্বাচনী জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এরশাদ বলেন, 'বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে দেশের মানুষ হতাশ হয়ে পড়েছে। দেশে কোনো উন্নয়ন হয়নি। শুধু খুন ও গুমের ঘটনা ঘটছে। তাই দেশের মানুষ এখন পরিবর্তন চায়।' এরশাদ বলেন, ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা থাকলেও সরকার তা করতে পারেনি। এ দেশে চাকরি হয় টাকা ও মন্ত্রীদের সুপারিশে। এ অবস্থার পরিবর্তন চায় দেশের মানুষ; চায় নতুন সরকার। জাতীয় পার্টি ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব হবে না বলেও তিনি দাবি করেন।
বেঁকে বসা এরশাদকে বাগে রাখতে কম-বেশি দুই দশক পর এই প্রকাশ্য মামলা-থেরাপি এবং জাতীয় পার্টির নেতাদের এ ব্যাপারে স্পষ্ট অভিযোগ থাকলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা যথারীতি অস্বীকার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, এরশাদের মামলা নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো আগ্রহ নেই। তাই এ বিষয়ে চাপের প্রশ্নই আসে না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার এ বিষয়ে কিছু জানা নেই, তাই কোনো মন্তব্য করতে চাই না।'
রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার কমিটির সভাপতি আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী সরকার অনেকের দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করেছিল। কিন্তু দুদক কারো দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহার করেনি।
সরকারের শেষ সময়ে এসে হঠাৎ এরশাদের মামলা চাঙ্গা করার ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসও কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয়। অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেন, 'এরশাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন। এ নিয়ে এখন কোনো মন্তব্য করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের নিষেধ আছে।'
জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ অভিযোগ করে বলেছেন, এরশাদের বিরুদ্ধের মামলাগুলো তাঁরা আরো আগেই নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকারপক্ষ অহেতুক বিলম্ব করেছে। এখন সরকারের শেষ সময়ে এসে সেগুলো চাঙ্গা করায় তাঁরা শঙ্কিত।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুস সবুর আসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মহাজোট সরকারের চার বছর পার হয়ে গেছে। আমরা আর সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। আমাদের মনে হয়, সরকার মামলাগুলো ঝুলিয়ে রেখে ফায়দা লুটতে চায়। আমি আওয়ামী লীগকে বলে দিতে চাই, ভয় দেখিয়ে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। আর এক পক্ষের আগ্রহেও কখনো বন্ধুত্ব টিকে থাকতে পারে না। এরশাদের নামে দায়ের করা মামলাগুলো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। আমি আশা করি, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।'
এ অভিযোগের জবাবে আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'কারো মামলা চাঙ্গা হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা আমার জানা নেই। তবে সব মামলাই আইনের স্বাভাবিক গতিতে চলবে।'
দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এরশাদের মামলা প্রত্যাহারে দুদকের কোনো সুযোগ নেই। এটা আদালতের বিষয়। আদালত চাইলে যে কারো মামলা প্রত্যাহার করতে পারেন।
জাতীয় পার্টি সূত্র জানায়, মহাজোট গঠনের সময় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা হয়। সেখানে এরশাদের নামের মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয়টিও ছিল। জাতীয় পার্টি সূত্রের আরো দাবি, মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বারবার এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের আশ্বাস দেওয়া হয়। তার পরও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। এ জন্য এরশাদ নিজেও দুইবার লিখিত আবেদন করেন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে আন্তরিক সাড়া পাননি।
তবে জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এ সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি মামলা নিয়ে ভীত নন। মামলা আইনের স্বাভাবিক গতিতে চলবে। তিনি বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে মামলাগুলো চাঙ্গা হলে তাতে কী? আমি সব সময়ই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি মনে করি, মামলাগুলো আইনিভাবেই সমাধান হবে।' জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, নৈতিক কারণে এরশাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা উচিত। কারণ এরশাদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক। পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, 'এরশাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মামলা করা হয়েছিল। আমি অবিলম্বে এসব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।'
জাপা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন বাবলু কালের কণ্ঠকে বলেন, এরশাদের বিরুদ্ধে যত মামলা দায়ের হয়েছে, এর সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক। এ ছাড়া তিনি এ পর্যন্ত অনেক মামলায় খালাস পেয়েছেন। সেগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, সব মামলাই ছিল মিথ্যা অভিযোগে ও হয়রানির উদ্দেশ্যে। জানা গেছে, মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৭ মে প্রথম দফায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন এরশাদ। ওই আবেদনে এরশাদ মঞ্জুর হত্যা, রাডার ক্রয় ও বিটিভির কেব্ল্ ক্রয় দুর্নীতি মামলাসহ পাঁচটি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। কোনো অগ্রগতি না হলে ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় তিনি স্বরাষ্ট্রসচিব বরাবর মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন।
তাতেও কাজ না হলে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ সরকার আমলে নেতা-কর্মীরা কয়েক দফা আন্দোলন করে। এমনকি জাতীয় সংসদ থেকে ওয়াক আউটের ঘোষণাও দেন তাঁরা। তবে ওয়াক আউট না করলেও কয়েক দফা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে জাপা নেতা-কর্মীরা।
এরশাদের জেল খাটা : জানা গেছে, জাপানি নৌযান ক্রয়-সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় এরশাদ সাজা ভোগ করেছেন। তবে তাঁকে এ মামলায় আর সাজা ভোগ করতে হবে না। ১৯৯৫ সালের ৬ জুলাই ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে চার মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু এর আগেই এরশাদ সাজা ভোগ করায় আদালত ওই সাজাকে এ রায় থেকে কর্তন করেন। ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে সাজা খাটা শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পার হওয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দূর হয় এরশাদের।
উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান না করে ৫২০টি নৌযান ও ১০টি পানি পরিশোধন যন্ত্র ক্রয় করার ক্ষেত্রে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ প্রভাব খাটিয়ে ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ আনা হয়। ১৯৯১ সালের ২২ জুলাই তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর উপপরিচালক এ কে এম হোসেন রমনা থানায় এ বিষয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এরশাদের নামে যত মামলা : জাপা সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হলে তাঁর নামে মোট ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ২০০৬ সালে বিএনপির সঙ্গে এরশাদের জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে পাঁচটি মামলা প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি। অন্য ২২টি মামলার মধ্যে ১৮টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। বিচারাধীন মঞ্জুর হত্যা মামলা, রাডার ক্রয় দুর্নীতি ও হলিডে ইন দুর্নীতি মামলা। এগুলোর মধ্যে মঞ্জুর হত্যা মামলা নিয়ে এরশাদ বেশি চিন্তিত বলে জাপা সূত্র জানিয়েছে।
রাডার ক্রয় দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকার ২০১১ সালে সুপারিশ করলেও এতে বাদ সাধে দুদক। দুদক বলেছে, উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তারা মামলা দায়ের করেছে। এ কারণে সরকার সুপারিশ করলেই তারা মামলা প্রত্যাহার করবে না।
এরশাদের আইনজীবী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম বলেন, নেতার বিরুদ্ধে ঠিক কতটি মামলা দায়ের হয়েছিল আর কতটি মামলা রয়েছে এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। কাগজ না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, মহাজোটগতভাবে গত নির্বাচনে জাপা ২৯টি আসনে জয়লাভ করে। উপনির্বাচনে একটি আসনে পরাজিত হলে জাপার এমপির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮। সংরক্ষিত আসনে তিনজন নারী এমপিসহ বর্তমান সংসদে জাপার প্রতিনিধি মোট ৩১ জন।
No comments