সংসদ অধিবেশন চলাকালে মামলার কার্যক্রমে অংশ নেবেন না সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী

জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলাকালে ট্রাইব্যুনালে মামলার কার্যক্রমে অংশ নেবেন না সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সে জন্য তিনি তার পক্ষে নিযুক্ত সব (পাঁচজন)  আইনজীবীর নিয়োগ বা ওকালতনামা সাময়িকভাবে বাতিল করে ট্রাইব্যুনালে একটি আবেদন জমা দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনাল তার সে আবেদন মঞ্জুর করে তার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নতুন একজন আইনজীবী নিয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর অধীনে বন্দী বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সংসদ অধিবেশনে যোগদানের সুযোগ চেয়ে আবেদন করেছিলেন। গতকাল সকালে সে আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।

সংসদ অধিবেশন চলাকালে এবং অধিবেশন শেষ হওয়ার পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম মুলতবি রাখার জন্য  গতকাল আরেকটি আবেদন করেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সে আবেদনও খারিজ করেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অন্য একটি আবেদনও গতকাল খারিজ করা হয়। এর পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীরা মামলার কার্যক্রমে আর অংশগ্রহণ না করার কথা জানান ট্রাইব্যুনালে।

‘পার্লামেন্ট মেম্বারস প্রিভিলেজ অ্যাক্ট ১৯৬৫’-এর সেকশন ৭(১), ৭(২) ও ৭(৩) অনুযায়ী সংসদ অধিবেশন বসার সাত দিন আগে থেকে এবং অধিবেশন শেষ হওয়ার পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি কার্যক্রম চলতে পারে না। তাই সংসদ অধিবেশনকালীন এবং তার পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম মুলতবি রাখার আবেদন করা হয়। আবেদনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম।

গতকাল সকালে এ আবেদনটিসহ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে দেয়া তিনটি আবেদন খারিজ হওয়ার পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালকে জানান, আমরা আর আসামির পক্ষে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে অংশ নিতে চাই না। আমরা আমাদের কোনো কথা ট্রাইব্যুনালকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছি না। আমাদের কোর্ট ত্যাগ করার অনুমতি দেয়া হোক।

ট্রাইব্যুনাল তখন বলেন, যেতে হয় যান, কিন্তু আইন অনুযায়ী যান। কোর্ট ত্যাগ করা বিষয়ে রুলে কী আছে তা দেখেন। তখন রুল নম্বর ৪৫ (ডি) পড়ে শোনানো হয়। এতে বলা আছে, আইন অনুযায়ী একজন আইনজীবী তার মক্কেলকে সহায়তা করতে বাধ্য এবং কোর্টের অনুমতি ছাড়া তিনি কোর্ট ত্যাগ করতে পারবেন না।

এরপর ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনারা যদি চলে যেতে চান, তাহলে লিখিতভাবে দরখাস্ত দেন যে, আপনারা আর আসামির পক্ষে থাকতে চান না। কেন কার্যক্রমে অংশ নেবেন না, তা লিখে জানান।

এ সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা বলেন, আসামি লিখিত আকারে জানাবেন তিনি আর আমাদের তার আইনজীবী হিসেবে রাখবেন না।

ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এ পর্যায়ে বলেন, আপনারা মামলা চালাতে না চাইলে লিখিত আকারে দিতে হবে এবং আসামিকেও লিখিত আকারে বলতে হবে যে, তিনি আর আপনাদের রাখতে চান না।

এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, তাদের সব দখরাস্তই ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত এবং ট্রাইব্যুনালের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য। তারা এখন যেসব কথাবর্তা বলছেন তা আদালত অবমাননার (১১.৪ ধারা) পর্যায়ে পড়ে।

আহসানুল হক হেনা তখন রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবীকে লক্ষ্য করে বলেন, আপনি তো ১১.৪ ধারার মানেই বোঝেন না। আপনার সম্পর্কে স্কাইপ সংলাপে বলা আছে, আপনি কোনো আইনজীবীর মধ্যেই পড়েন না। আপনি গ্যাঞ্জাম করতে বেশ ভালো পারেন। তখন উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।

এ পর্যায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীরা অনুরোধ করেন তাদের কোর্ট ত্যাগ করা বিষয়ে আসামির সাথে পরামর্শের জন্য কোর্ট মুলতবি করা হোক। তখন ১৫ মিনিটের জন্য কোর্ট মুলতবি করা হয়। ঘড়িতে তখন দুপুর সোয়া ১২টা বাজে। দুপুর সাড়ে ১২টায় আবার কোর্ট বসলে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীর কাছে জানতে চান, আপনারা কী সিদ্ধান্ত নিলেন? আহসানুল হক হেনা বলেন, সংসদ চলা থেকে শুরু করে অধিবেশন শেষ হওয়ার পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত মামলার কার্যক্রমে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আসামি। ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি লিখিত আকারে উপস্থাপনের নির্দেশ দিলে কাঠগড়ায় বসে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী দরখাস্ত লেখা শুরু করেন। দরখাস্তে তিনি তার পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবীদের নিয়োগ বা ওকালতনামা বাতিল করেন। পার্লামেন্ট মেম্বারস প্রিভিলেজ অ্যাক্ট ১৯৬৫-এর ৭(১), ৭(২) ও ৭(৩) অনুযায়ী দরখাস্ত করে তিনি বলেন, সংসদ অধিবেশন বসার সাত দিন আগে থেকে এবং অধিবেশন শেষ হওয়ার পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি কার্যক্রম চলতে পারে না। তাই আমি এবং আমার পক্ষে কোন আইনজীবী আমার মামলার কার্যক্রমে অংশ নেব না। ওই সময় পর্যন্ত আমি আমার পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবীদের ওকালতনামা বাতিল করলাম।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় বসে যখন দরখাস্ত লিখছিলেন তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, এখন পূর্বনির্ধারিত ক্যামেরা ট্রায়াল শুরু হবে। তখন উভয় পক্ষের চারজন করে আইনজীবী ছাড়া সাংবাদিক এবং অন্যান্য লোক ট্রাইব্যুনাল কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। রুদ্ধদ্বার কক্ষে একজন মহিলা সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে। তিনি ১৭তম সাক্ষী। দেড়টা পর্যন্ত তার জবানবন্দী গ্রহণ শেষে কোর্ট মুলতবি করা হয়। কোর্টের বাইরে এসে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বলেন, ক্যামেরা ট্রায়ালের সময় আমরা চলে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ট্রাইব্যুনাল আমাদের অনুমতি দেননি; তাই আমরা বসেছিলাম।

দুপুরের বিরতির পর পৌনে ৩টার দিকে আবার ট্রাইব্যুনাল বসেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে তখন কোনো আইনজীবী কোর্টে ঢোকেননি। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির বলেন, মি. সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আপনার আইনজীবীদের খবর কী?

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী জবাবে বলেন, আমি তো দরখাস্ত দিয়ে বলেছি সংসদ চলাকালে এবং অধিবেশন শেষে পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত আমি বিচারকার্যক্রমে অংশ নেব না। ওই সময় পর্যন্ত আমি আমার আইনজীবীদের ওকালতনামাও বাতিল করেছি। সংসদ চলাকালে আমি বিচারকার্যক্রমে অংশ নিয়ে আমার অধিকারহরণকে স্বীকৃতি দিতে পারি না। আমার অধিকারহরণের কাছে মাথানত করতে পারি না। সংসদ অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে যদি আমার ফাঁসি না হয় তাহলে অধিবেশন শেষ হওয়ার সাত দিন পরে আমি আবার আমার আইনজীবীদের নিয়োগ দেবো এবং তারা আপনাদের সামনে হাজির হবেন ইনশাআল্লাহ।

তখন ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেন, আইনজীবীদের নিয়োগ বাতিল করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী যে আবেদন করেছেন তা মঞ্জুর করা  হলো। তার আইনজীবীদের নিয়োগ বাতিল বলে গণ্য হলো। আসামির পক্ষে আইনজীবী না থাকলে ট্রাইব্যুনাল আইনের সেকশন ১২ অনুযায়ী তার পক্ষে একজন রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সে অনুুযায়ী আমরা আজই তার পক্ষে একজন রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগ দেবো এবং আগামীকাল বৃহস্পতিবার তার মামলার কার্যক্রম শুরু হবে। সাক্ষীর জেরা হবে।

এর আগেও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে একজন রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার পর রাষ্ট্রীয় আইনজীবী প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পুনরায় তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিলে রাষ্ট্রীয় আইনজীবী বাতিল হয়ে যাবে নিয়ম অনুযায়ী।

ট্রাইব্যুনাল অধিবেশন শেষে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আমার অধিকার যদি রক্ষা করতে না পারি তাহলে আমি মানুষের অধিকার, আমাকে যারা ভোট দিয়েছে তাদের অধিকার কিভাবে রক্ষা করব? আমাকে ফাঁসি দিতে চায় দিক; কিন্তু একটা রেকর্ড থাকুক যে আমি আমার অধিকার সারেন্ডার করিনি। দ্রুত যাতে আমাকে ফাঁসি দিতে পারে সে সুযোগ করে দিলাম।

হাজতখানায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন গোলাম আযম

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম (৯০+) গতকাল ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। পরে তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন তার অবস্থা ভালো।

এর আগেও অধ্যাপক গোলাম আযম বেশ কয়েকবার ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। গতকাল অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষে প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় পরবর্তীতে তার মামলা গতকাল চলেনি। আজ তার মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
       


No comments

Powered by Blogger.