গল্প- অসমাপ্ত by ফিহির হোসাইন
কণ্ঠ শুনে মনেই পড়ছে না মেয়েটির সাথে আগে কথা হয়েছে। তার মাঝে মেয়েটির অদ্ভুত আচরণে কল কেটে দেয়াও নিজের কাছে অমানবিক মনে হলো।
প্রতিদিন
রাত ১২টা হলেই কল দিয়ে বসত। কোনো কথা না বলে শুরু হতো তার অদ্ভুত আচরণ।
তারপর কল কেটে দিত। একটা রহস্য যেমন কাজ করছিল, অন্য দিকে ভয়ও হচ্ছিল।
আবার কোনো জিন-ভূতের পাল্লায় পড়লাম না তো! দিনে কল দেয়ার ইচ্ছে থাকা
সত্ত্বেও কল দেয়া হতো না। রাত হলে মনে হতো তাকে আজ কল দেয়ার কথা ছিল।
রহস্য কাজ করত বলেই প্রতি রাতে তার কল ধরতাম। কানে দিয়ে রেখে কখন যে গভীর
নিদে হারিয়ে যেতাম মনেই হতো না। এর মাঝে সাপ্তাহখানেক পার। যেদিন মেয়েটি
প্রথম কথা বলল, সেদিন আর কাঁদেনি। কল দিয়েই আমায় জবাব দিলোÑ ‘একদম সরি’।
মেয়েটির সরি বলার দিকে আমার কোনো খেয়াল নেই। একটি প্রশ্নের ছায়ায় সব
ভাবনা কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। যথারীতি আমি আমার প্রশ্ন রাখলাম। আপনি কল
দিয়ে কিছু না বলে কান্না শুরু করতেন কেন? আপনি কি আমায় চেনেন? আমার
নাম্বারই বা পেলেন কোথায়?
বলল, আমায় একটু সাহায্য করুন।
আগে আপনার পরিচয় দিন।
দেবো। কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল, আমার মনে হয় আপনি এখনো পড়াশোনা করছেন?
কেন বলুন তো?
আচ্ছা, আপনি এমন কেনর পেছনে পড়ে আছেন কেন?
অ্যাটলিস্ট এটা বলুনÑ আপনার নাম্বারটা সেভ করব কী নামে? নাকি ‘কান্না করা একটি মেয়ে’ এই নামে সেভ করে রাখব?
হয়তো আমার কথা শুনে কিংবা অন্য কোনো কারণে বেশ শব্দ করেই মেয়েটি হেসে উঠে বলল, আজ অনেক দিন পর হাসলাম।
রাত অনেক হয়েছেÑ এত রাতে এভাবে হাসছেন আপনার মা জেগে যাবে না?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, আমি আলাদা রুমে থাকি। আচ্ছা আপনার তো নাম জানা হলো না।
ইমু। পুরো নাম ইমরান হোসাইন। পড়ছি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। কাস শুরু হলো আজ বারো দিন। আপনি?
মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন কোথাও অভিনয় করছেন। আই লাইক ইট, থ্যাংস। আমি মনিহা। যাত্রাবাড়ী আইডিয়ালে পড়ছি। সামনের বছর এসএসসি দেবো। মা-বাবার একমাত্র সন্তান আমি। বাবা ব্যবসা করছেন আর মা আমার স্কুলেই শিক্ষিকা হিসেবে আছেন। ছোট্ট একটি পরিবার… মেয়েটির বাক রুদ্ধ হয়ে আসে। মিনিট দুয়েক চুপ থাকার পর শুনতে পাচ্ছিলাম সে কান্না করছে।
কী হলো মনিহা! কান্না করছো কেন? কোনো সমস্যা?
না, ঠিক আছে। আজ তাহলে রাখি? কাল কল দেবো।
কী হলো বলবে তো?
কোনো কথা না বলেই মনিহা কল কেটে দেয়। আমিও আর কল ব্যাক করার প্রয়োজন বোধ করলাম না। ইচ্ছে করে যে তার পারসোনাল বিষয় বলতে চাইছে না, তাকে জোর করার কোনো অর্থই হয় না। চোখটা প্রায় লেগে আসছিল, এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। কল রিসিভ করতেই বলল, ‘আজ তোমায় সত্য কিছু কথা বলি। আমার জীবনের খুব পারসোনাল কথা। তোমায় কেন বলছি জানি না। মন চাইলো, তোমার সাথে কথা বলে একটা বিশ্বাস জন্মাল, তাই বলছি। কথাগুলো শোনার পর তোমার সাথে আমার আর কথা হবে কি না জানি না। তবুও বলছিÑ ‘আমরা ছোট্ট একটি পরিবার। বাবা-মায়ের বেশ আদরের সন্তান আমি। কেমন আদরের জানো? Ñআমার যাতে চলাফেরায় কোনো কষ্ট না হয়, তাই বাবা আমাকে একটি গাড়িও কিনে দিয়েছে। এত সুখের মাঝে থেকেও একটি বেদনার তীরের যন্ত্রণায় বেশ কাতর হয়ে পড়ছি। অনেক সুখের একটি পরিবার ছিল আমাদের। কত হাসি-আনন্দ-উল্লাসে আমার বিকেলগুলো কেটেছে, তার হিসাব শেষ হওয়ার নয়। তখন আমি কাস সেভেনে পড়ছি। বেশ রাত হলো। বাবা তখনো বাসায় ফিরে আসেননি। মা জেগে আছেন। আমায় খাইয়ে দিয়ে বললেন ঘুমিয়ে পড়তে। মা তখনো খায়নি। বাবার সাথে খাবে তাই বসে আছে। জীবনের এই প্রথম রাত বাবাকে ছাড়া খাওয়া হলো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে আমায় ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তখন রাত ২টা পেড়িয়ে। বাবা বাসায় এলেন। অন্য দিনের চেয়ে আজ তার শরীরটা ভালো নেই বোঝা যাচ্ছিল। কেমন যেন হেলে-দুলে চলছেন। ফ্রেশ হওয়ারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। অমনি বিছানায় শুয়ে পড়েন। মা কত বললেন, কে শোনে কার কথা। উল্টো ধমক দিয়ে মাকে থামিয়ে দিলেন। বুঝ হওয়ার পর থেকে আজই প্রথম মায়ের সাথে এমন ব্যবহার চোখে পড়ল। তারপর থেকে প্রতিদিন অনেক রাত করে বাসায় ফিরতেন। প্রতিদিন মায়ের সাথে ঝগড়া হতো। সকালে-রাতে। প্রতিদিন। হঠাৎ বাবার এই পরিবর্তন, নেশা করা, রাত করে বাসায় ফেরা আর মায়ের চোখে পানি দেখে সহ্য হচ্ছিল না। নিজের অজান্তেই রাতে চোখ গড়িয়ে পানি পড়ত। ইচ্ছে করত চিৎকার করে কান্না করি। বান্ধবীরা কেউ জানত না আমার এই বিষয়গুলো। তাদের সাথে শেয়ার করার প্রয়োজনও মনে হলো না। শুধু শুধু তাদের কাছে ছোট হয়ে থাকার চেয়ে না বলাই শ্রেয় মনে করলাম।
মনিহার কথা শোনার পর থেকে তার প্রতি অজানা এক মায়া কাজ করতে শুরু করে। মনে হলো যদি একটি মানুষ আমায় কল দিয়ে খানেক ভালো থাকেÑ তাহলে ক্ষতি কোথায়! এরপর থেকে আমি বন্ধু হিসেবেই তার পাশে থাকার চেষ্টা করি। কোনো প্রশ্নহীন তার কথাগুলো শুনতাম। একদিন নিজ থেকেই সে বলল আমার সাথে দেখা করবে। তখন কলেজের কাসের সময়টা ছয় মাস পেড়িয়ে গেছে। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। কেন হচ্ছিলাম না জানা নেই। তবে রাজি না হয়ে থাকার উপায়ও ছিল না। কথা দিলাম একদিন কাস শেষে তার সাথে দেখা করব। সময় দেয়া হয়, কিন্তু দেখা করা হয় না। পঞ্চম তারিখের দিন সে বলল, আজ যদি তুমি আমার সাথে দেখা না করো, তাহলে আজকের পর থেকে আর কোনো দিন তোমাকে কল দেবো না। কাস শেষ করে সোজা চলে এলাম তার এখানে। তার সাথে প্রথম দেখা হয় অলিম্পিক ভবনের সামনে। গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমার জন্য। পরনের স্কুলড্রেস দেখে মনে হলো সে কাস শেষ করে এসেছে। দেখা হতেই বলল, চলো, গাড়িতে ওঠ। একটা ভয় কাজ করছিল মনের ভেতর। মেয়েটি আবার আমায় ব্লাকমেইল করছে না তো! উঠতে দেরি দেখে বলল, এখানে আমার জন্য নিরাপদ নয়। চলো অন্য কোথাও গিয়ে বসি। ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠলাম। টিকাটুলি হয়ে আইডিয়াল স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার বান্ধবীরাও ছিল ওখানে বসা। গিয়ে একসাথে বসলাম। ২ ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। আমার জীবনে দেখা এই প্রথম একটি মেয়েÑ যার রূপলাবণ্য সত্যিই বর্ণনাহীন। মেয়েরা এত সুন্দর হতে পারে তাকে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই হতো না। লাল গোলাপি ঠোঁট, মায়া কাড়া চোখের দৃষ্টি, গোলাপি গণ্ডদ্বয়, সরু নাকের গঠন আর মিষ্টি হাসির ঝলক দেখে নিজেকে বিশ্বাস হলো না। মেয়েটি যেন রূপের স্বর্গ নিয়ে জন্মেছে। কথায় কথায় একদিন বড় আপুর সাথে বিষয়টি বলা হয়ে যায়। এর ফাঁকে মনিহা আপুর সাথে কথা বলবে তাই নাম্বারও চেয়ে নেয়। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তাকে আপুর নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। কলেজ থেকে ফিরে যাওয়ার পর শুনলাম সে আপুর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছে। আপুও তার কণ্ঠ শুনে আসক্ত হয়ে পড়ে। দেখতে চাইলো তাকে। কথা দিলাম। মনিহাকেও বললাম। সেও রাজি হলো।
এর দু’দিন পরই কলেজ থেকে ফেরার পথে মনিহা কল দিলো। কল দিয়ে কান্না শুরু করে। জিজ্ঞেস করতেই বলল, তার বয়ফ্রেন্ড চলে যাচ্ছে। আমেরিকান ডিভি ভিসা পেয়েছে। তাই সে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বললাম, কান্নার কী আছেÑ ডিজিটাল যুগ, স্কাইপে কথা বলবে। তাহলেই তো হলো! বলল, তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেই চলে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে, কোনো কারণ নেই। তার সাথে সে আর সম্পর্ক রাখবে নাÑ এটাই শেষ বলে দিয়েছে। তোমার তো কোনো দোষ নেই? না, না। তাহলে বিশ্বাস রাখো, হয়তো একদিন ফিরে আসবে।
সত্যি এ বিষয়ে আমারও কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি, সুখের দিনগুলো মানুষের কাছে যেমন স্থায়ী নয়, ঠিক তেমনি দুঃখের দিনগুলো। একদিন দেখবে তোমার জীবনের সব দুঃখ মুছে আবার সুখের ছায়া ফিরে এসেছে।
এর সাপ্তাহখানেক পরেই একদিন বিকেল বেলায় কল দিয়ে বলল, ইমু তুমি কোথায়? বাসায়। কেন বলো তো? আমি তোমার এখানে এসেছি, একটু নিচে নামবে? আপু বেশ অসুস্থ, এখন নামতে পারছি না। হয়তো হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। কী হয়েছে আপুর? মামা হতে যাচ্ছি। ও আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে একটা কাজ করবে? সুযোগ হলে আমার ফোনে ১০০ টাকা দিয়ো, একটা কল দিতে হবে জরুরি। হাতেও টাকা নেই, মোবাইলেও নেই।
বাসার নিচের মোবাইল দোকানদার পরিচিত ছিল। কল দিয়ে তাকে মনিহার নাম্বার দিয়ে বললাম ১০০ টাকা পাঠিয়ে দিতে। ভাগিনা হওয়ার পর মনিহার সাথে আর একদিন দেখা হয়েছিল। বসুন্ধরা সিটিতে। শপিং করবে, তাই আমায় বেশ জোর করল। দাবি দেয়ায় না করা হলো না। পুরো বিকেল সময়টা, রাতের খানিক সময়ও আছে দুপুরের খাবারও খাওয়া হলো একসাথে। যাওয়ার মিনিট বিশেক আগে দু’জনেই বসা ছিলাম আটতলার একটি খাবারের টেবিলে। কাঁটা চামচে নুডলস নিতে নিতে বললÑ ইমু, তোমায় আজ আরেকটি সত্য কথা বলি, জানি না বিশ্বাস করবে কি না, তবে এটাই সত্য কথাÑ ‘আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি’। আকাশ থেকে পড়েছি তা বলব না, তবে তার কথা শুনে যে প্রচণ্ড শখড হয়েছিÑ এটা সেও বুঝতে পেরেছিল। আমাদের সম্পর্ক যেমন আছে তেমন থাকলেই ভালো হতো না? আমরা ভালো বন্ধু হয়েছি, তাই থাকি। খানিক চুপ থেকে মনিহা চলে গেল। কিছুই বলল না। খাবারও শেষ করা হলো না। শুধু এতটুকু বলল, রাতে কল দেবো। রাত পার হলো, দিনের সূর্য উঠে এলো। কিন্তু আমার হৃদয়ের সূর্যটি আর কোনো দিন উদিত হলো না। সে রাতের পর থেকে তার সাথে আর কোনো দিন কথা হয়নি। নাম্বারও খোলা পেলাম না। আজো না।
fihir44@gmail.com
বলল, আমায় একটু সাহায্য করুন।
আগে আপনার পরিচয় দিন।
দেবো। কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল, আমার মনে হয় আপনি এখনো পড়াশোনা করছেন?
কেন বলুন তো?
আচ্ছা, আপনি এমন কেনর পেছনে পড়ে আছেন কেন?
অ্যাটলিস্ট এটা বলুনÑ আপনার নাম্বারটা সেভ করব কী নামে? নাকি ‘কান্না করা একটি মেয়ে’ এই নামে সেভ করে রাখব?
হয়তো আমার কথা শুনে কিংবা অন্য কোনো কারণে বেশ শব্দ করেই মেয়েটি হেসে উঠে বলল, আজ অনেক দিন পর হাসলাম।
রাত অনেক হয়েছেÑ এত রাতে এভাবে হাসছেন আপনার মা জেগে যাবে না?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, আমি আলাদা রুমে থাকি। আচ্ছা আপনার তো নাম জানা হলো না।
ইমু। পুরো নাম ইমরান হোসাইন। পড়ছি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। কাস শুরু হলো আজ বারো দিন। আপনি?
মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন কোথাও অভিনয় করছেন। আই লাইক ইট, থ্যাংস। আমি মনিহা। যাত্রাবাড়ী আইডিয়ালে পড়ছি। সামনের বছর এসএসসি দেবো। মা-বাবার একমাত্র সন্তান আমি। বাবা ব্যবসা করছেন আর মা আমার স্কুলেই শিক্ষিকা হিসেবে আছেন। ছোট্ট একটি পরিবার… মেয়েটির বাক রুদ্ধ হয়ে আসে। মিনিট দুয়েক চুপ থাকার পর শুনতে পাচ্ছিলাম সে কান্না করছে।
কী হলো মনিহা! কান্না করছো কেন? কোনো সমস্যা?
না, ঠিক আছে। আজ তাহলে রাখি? কাল কল দেবো।
কী হলো বলবে তো?
কোনো কথা না বলেই মনিহা কল কেটে দেয়। আমিও আর কল ব্যাক করার প্রয়োজন বোধ করলাম না। ইচ্ছে করে যে তার পারসোনাল বিষয় বলতে চাইছে না, তাকে জোর করার কোনো অর্থই হয় না। চোখটা প্রায় লেগে আসছিল, এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। কল রিসিভ করতেই বলল, ‘আজ তোমায় সত্য কিছু কথা বলি। আমার জীবনের খুব পারসোনাল কথা। তোমায় কেন বলছি জানি না। মন চাইলো, তোমার সাথে কথা বলে একটা বিশ্বাস জন্মাল, তাই বলছি। কথাগুলো শোনার পর তোমার সাথে আমার আর কথা হবে কি না জানি না। তবুও বলছিÑ ‘আমরা ছোট্ট একটি পরিবার। বাবা-মায়ের বেশ আদরের সন্তান আমি। কেমন আদরের জানো? Ñআমার যাতে চলাফেরায় কোনো কষ্ট না হয়, তাই বাবা আমাকে একটি গাড়িও কিনে দিয়েছে। এত সুখের মাঝে থেকেও একটি বেদনার তীরের যন্ত্রণায় বেশ কাতর হয়ে পড়ছি। অনেক সুখের একটি পরিবার ছিল আমাদের। কত হাসি-আনন্দ-উল্লাসে আমার বিকেলগুলো কেটেছে, তার হিসাব শেষ হওয়ার নয়। তখন আমি কাস সেভেনে পড়ছি। বেশ রাত হলো। বাবা তখনো বাসায় ফিরে আসেননি। মা জেগে আছেন। আমায় খাইয়ে দিয়ে বললেন ঘুমিয়ে পড়তে। মা তখনো খায়নি। বাবার সাথে খাবে তাই বসে আছে। জীবনের এই প্রথম রাত বাবাকে ছাড়া খাওয়া হলো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে আমায় ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তখন রাত ২টা পেড়িয়ে। বাবা বাসায় এলেন। অন্য দিনের চেয়ে আজ তার শরীরটা ভালো নেই বোঝা যাচ্ছিল। কেমন যেন হেলে-দুলে চলছেন। ফ্রেশ হওয়ারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। অমনি বিছানায় শুয়ে পড়েন। মা কত বললেন, কে শোনে কার কথা। উল্টো ধমক দিয়ে মাকে থামিয়ে দিলেন। বুঝ হওয়ার পর থেকে আজই প্রথম মায়ের সাথে এমন ব্যবহার চোখে পড়ল। তারপর থেকে প্রতিদিন অনেক রাত করে বাসায় ফিরতেন। প্রতিদিন মায়ের সাথে ঝগড়া হতো। সকালে-রাতে। প্রতিদিন। হঠাৎ বাবার এই পরিবর্তন, নেশা করা, রাত করে বাসায় ফেরা আর মায়ের চোখে পানি দেখে সহ্য হচ্ছিল না। নিজের অজান্তেই রাতে চোখ গড়িয়ে পানি পড়ত। ইচ্ছে করত চিৎকার করে কান্না করি। বান্ধবীরা কেউ জানত না আমার এই বিষয়গুলো। তাদের সাথে শেয়ার করার প্রয়োজনও মনে হলো না। শুধু শুধু তাদের কাছে ছোট হয়ে থাকার চেয়ে না বলাই শ্রেয় মনে করলাম।
মনিহার কথা শোনার পর থেকে তার প্রতি অজানা এক মায়া কাজ করতে শুরু করে। মনে হলো যদি একটি মানুষ আমায় কল দিয়ে খানেক ভালো থাকেÑ তাহলে ক্ষতি কোথায়! এরপর থেকে আমি বন্ধু হিসেবেই তার পাশে থাকার চেষ্টা করি। কোনো প্রশ্নহীন তার কথাগুলো শুনতাম। একদিন নিজ থেকেই সে বলল আমার সাথে দেখা করবে। তখন কলেজের কাসের সময়টা ছয় মাস পেড়িয়ে গেছে। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। কেন হচ্ছিলাম না জানা নেই। তবে রাজি না হয়ে থাকার উপায়ও ছিল না। কথা দিলাম একদিন কাস শেষে তার সাথে দেখা করব। সময় দেয়া হয়, কিন্তু দেখা করা হয় না। পঞ্চম তারিখের দিন সে বলল, আজ যদি তুমি আমার সাথে দেখা না করো, তাহলে আজকের পর থেকে আর কোনো দিন তোমাকে কল দেবো না। কাস শেষ করে সোজা চলে এলাম তার এখানে। তার সাথে প্রথম দেখা হয় অলিম্পিক ভবনের সামনে। গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমার জন্য। পরনের স্কুলড্রেস দেখে মনে হলো সে কাস শেষ করে এসেছে। দেখা হতেই বলল, চলো, গাড়িতে ওঠ। একটা ভয় কাজ করছিল মনের ভেতর। মেয়েটি আবার আমায় ব্লাকমেইল করছে না তো! উঠতে দেরি দেখে বলল, এখানে আমার জন্য নিরাপদ নয়। চলো অন্য কোথাও গিয়ে বসি। ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠলাম। টিকাটুলি হয়ে আইডিয়াল স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার বান্ধবীরাও ছিল ওখানে বসা। গিয়ে একসাথে বসলাম। ২ ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। আমার জীবনে দেখা এই প্রথম একটি মেয়েÑ যার রূপলাবণ্য সত্যিই বর্ণনাহীন। মেয়েরা এত সুন্দর হতে পারে তাকে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই হতো না। লাল গোলাপি ঠোঁট, মায়া কাড়া চোখের দৃষ্টি, গোলাপি গণ্ডদ্বয়, সরু নাকের গঠন আর মিষ্টি হাসির ঝলক দেখে নিজেকে বিশ্বাস হলো না। মেয়েটি যেন রূপের স্বর্গ নিয়ে জন্মেছে। কথায় কথায় একদিন বড় আপুর সাথে বিষয়টি বলা হয়ে যায়। এর ফাঁকে মনিহা আপুর সাথে কথা বলবে তাই নাম্বারও চেয়ে নেয়। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তাকে আপুর নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। কলেজ থেকে ফিরে যাওয়ার পর শুনলাম সে আপুর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছে। আপুও তার কণ্ঠ শুনে আসক্ত হয়ে পড়ে। দেখতে চাইলো তাকে। কথা দিলাম। মনিহাকেও বললাম। সেও রাজি হলো।
এর দু’দিন পরই কলেজ থেকে ফেরার পথে মনিহা কল দিলো। কল দিয়ে কান্না শুরু করে। জিজ্ঞেস করতেই বলল, তার বয়ফ্রেন্ড চলে যাচ্ছে। আমেরিকান ডিভি ভিসা পেয়েছে। তাই সে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বললাম, কান্নার কী আছেÑ ডিজিটাল যুগ, স্কাইপে কথা বলবে। তাহলেই তো হলো! বলল, তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেই চলে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে, কোনো কারণ নেই। তার সাথে সে আর সম্পর্ক রাখবে নাÑ এটাই শেষ বলে দিয়েছে। তোমার তো কোনো দোষ নেই? না, না। তাহলে বিশ্বাস রাখো, হয়তো একদিন ফিরে আসবে।
সত্যি এ বিষয়ে আমারও কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি, সুখের দিনগুলো মানুষের কাছে যেমন স্থায়ী নয়, ঠিক তেমনি দুঃখের দিনগুলো। একদিন দেখবে তোমার জীবনের সব দুঃখ মুছে আবার সুখের ছায়া ফিরে এসেছে।
এর সাপ্তাহখানেক পরেই একদিন বিকেল বেলায় কল দিয়ে বলল, ইমু তুমি কোথায়? বাসায়। কেন বলো তো? আমি তোমার এখানে এসেছি, একটু নিচে নামবে? আপু বেশ অসুস্থ, এখন নামতে পারছি না। হয়তো হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। কী হয়েছে আপুর? মামা হতে যাচ্ছি। ও আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে একটা কাজ করবে? সুযোগ হলে আমার ফোনে ১০০ টাকা দিয়ো, একটা কল দিতে হবে জরুরি। হাতেও টাকা নেই, মোবাইলেও নেই।
বাসার নিচের মোবাইল দোকানদার পরিচিত ছিল। কল দিয়ে তাকে মনিহার নাম্বার দিয়ে বললাম ১০০ টাকা পাঠিয়ে দিতে। ভাগিনা হওয়ার পর মনিহার সাথে আর একদিন দেখা হয়েছিল। বসুন্ধরা সিটিতে। শপিং করবে, তাই আমায় বেশ জোর করল। দাবি দেয়ায় না করা হলো না। পুরো বিকেল সময়টা, রাতের খানিক সময়ও আছে দুপুরের খাবারও খাওয়া হলো একসাথে। যাওয়ার মিনিট বিশেক আগে দু’জনেই বসা ছিলাম আটতলার একটি খাবারের টেবিলে। কাঁটা চামচে নুডলস নিতে নিতে বললÑ ইমু, তোমায় আজ আরেকটি সত্য কথা বলি, জানি না বিশ্বাস করবে কি না, তবে এটাই সত্য কথাÑ ‘আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি’। আকাশ থেকে পড়েছি তা বলব না, তবে তার কথা শুনে যে প্রচণ্ড শখড হয়েছিÑ এটা সেও বুঝতে পেরেছিল। আমাদের সম্পর্ক যেমন আছে তেমন থাকলেই ভালো হতো না? আমরা ভালো বন্ধু হয়েছি, তাই থাকি। খানিক চুপ থেকে মনিহা চলে গেল। কিছুই বলল না। খাবারও শেষ করা হলো না। শুধু এতটুকু বলল, রাতে কল দেবো। রাত পার হলো, দিনের সূর্য উঠে এলো। কিন্তু আমার হৃদয়ের সূর্যটি আর কোনো দিন উদিত হলো না। সে রাতের পর থেকে তার সাথে আর কোনো দিন কথা হয়নি। নাম্বারও খোলা পেলাম না। আজো না।
fihir44@gmail.com
No comments