বিনিয়োগ হচ্ছে না, উৎপাদনেও মন্দা by মনজুর আহমেদ
দেশে প্রথমবারের মতো পলিয়েস্টার চিপস তৈরির বড় ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল চার বছর আগে। পেট্রোলিয়াম উপজাত (বাই-প্রোডাক্ট) এমইজি ও পিটিএ থেকে পলিয়েস্টার চিপস তৈরি করার কথা ছিল কোম্পানির।
পলিয়েস্টার চিপস সিনথেটিক সুতা, কাপড় ও বিভিন্ন ধরনের পেট বোতল তৈরিতে মধ্যবর্তী পণ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়।
মালেক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিউ এশিয়া সিনথেটিকস নামে এই শিল্প স্থাপনের শেষ পর্যায়ে এসে আটকে যায় গ্যাস-সংযোগের অভাবে। ভেস্তে যায় প্রায় ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় ১০০ একর জমির ওপর পলিয়েস্টার চিপস তৈরির শিল্পটি স্থাপনের কথা ছিল। মালেক স্পিনিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ মতিন চৌধুরী জানান, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও গ্যাস-সংযোগ না পাওয়ায় শিল্পকারখানাটি স্থাপন করা যায়নি।
আবার তিন বছরেও গ্যাস না পেয়ে কারখানা বিক্রি করে দিচ্ছেন একজন প্রবাসী বাংলাদেশি, মোহাম্মদ আমিন। পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির জন্য ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে হাতিম ব্রিকসের গ্যাস-সংযোগ প্রদানের অনুমোদন দিয়েছিল তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন। এরপর ২০১১ সালে কয়লাভিত্তিক জ্বালানির ওপর নির্ভর করে উৎপাদনে যায় আশুলিয়ায় স্থাপিত এই কোম্পানি। কিন্তু এই পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কারখানা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মালিকপক্ষ হাতিম ব্রিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিন বলেন, ‘উচ্চ খরচে ব্যবসা টেকসই করা খুব কঠিন।’
গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প বিনিয়োগ থমকে পড়ার তথ্য অনেক দিন ধরেই ব্যবসায়ীরা বলে আসছেন। এর সঙ্গে আরও রয়েছে শিল্প স্থাপনের জমি না পাওয়াসহ অবকাঠামোগত অন্যান্য দুর্বলতা। আর নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে শিল্প ও বণিক সমিতিসমূহের ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, অবকাঠামো, সুদের হারসহ আগের অন্য সমস্যাগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। নতুন করে যুক্ত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগে ব্যবসায়ী সমাজ অবশ্যই একটু শঙ্কিত।
এদিকে, রিয়েল এস্টেট বা আবাসন খাতেও অনেক দিন ধরে মন্দা চলছে। নির্মিত ও অর্ধনির্মিত বহু ফ্ল্যাট অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়া এর প্রধান কারণ। আরেকটি কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি। এই আবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত অনেক শ্রমঘন শিল্প ও বিনিয়োগ। ফলে সেখানেও পড়ছে মন্দার প্রভাব।
বিনিয়োগ মন্দার পাশাপাশি শিল্প উৎপাদন কমার তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে এখন। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও একই চিত্র ছিল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অক্টোবরে কিছু বৃদ্ধি পাওয়ার পর নভেম্বর মাসে আবার রপ্তানি কমে যায়। ডিসেম্বর মাসে খানিকটা অগ্রগতি লক্ষ করা যায়।
সার্বিক বিষয় নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিনিয়োগ মন্দায় মানুষের সাধারণ চাহিদা কমে যাওয়ার দিকটি তুলে ধরে চারটি কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। কেননা, সেখানে চালের বিক্রয়মূল্য কমেছে। কিন্তু, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এতে দেশের ৬০-৭০ ভাগ মানুষ যে গ্রামে বাস করে, তাদের দিক থেকে চাহিদা কমে গেছে। অন্যদিকে শহরের মানুষের সম্পদের স্ফীতি কমে গেছে। জমি, ফ্ল্যাট বিক্রি আটকে পড়েছে, দামও পড়তির দিকে। শেয়ারবাজারের আয় তো নেই-ই, বিনিয়োগও আটকে আছে। আর বিনিয়োগ মন্দার চতুর্থ কারণ হিসেবে ঋণের সুদের হারকে দায়ী করেন আহসান মনসুর।
শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে: বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-অক্টোবর সময়ে সব ধরনের আমদানি ব্যয় ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ কমেছে। ঋণপত্রের (এলসি) নিষ্পত্তি (১১ দশমিক ০৪ শতাংশ) ও নতুন ঋণপত্র খোলার (১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ) পরিমাণও বেশ কমেছে।
একই সময়ে শিল্পের যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে। আবার নতুন এলসি খোলার পরিমাণও আগের বছরের চেয়ে কম। ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। নতুন এলসি খোলাতেও আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে, প্রায় ২ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া এবং নতুন এলসি কমে যাওয়ার তথ্য প্রমাণ করে যে দেশে বিনিয়োগ মন্দা চলছে। অন্যদিকে কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমার তথ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার স্বাক্ষর বহন করে। দেশের প্রধান প্রধান শিল্প খাত অর্থাৎ বস্ত্র, চামড়া, পাট, পোশাক, ওষুধ, প্যাকিং এবং অন্য সব ধরনের শিল্প খাতের যন্ত্রপাতি আমদানি গত চার মাসে কমে গেছে।
বিনিয়োগ মন্দায় মজুত বৃদ্ধি: আমদানি ব্যয় কমলেও রপ্তানিতে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ (জুলাই-অক্টোবর) প্রবৃদ্ধি রয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে প্রবাসী-আয়ে (রেমিট্যান্স) প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (মজুত)। এখন এই রিজার্ভ গিয়ে ঠেকেছে এক হাজার ৩০০ কোটি ডলারে।
মূলত দেশে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমে যাওয়ায় মজুতের বৃদ্ধি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ কারণে প্রতিনিয়ত ডলারের দাম পড়ে যাচ্ছে, টাকা শক্তিশালী হচ্ছে। এতে আশঙ্কা থাকে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স নিরুৎসাহিত হওয়ার। মজুত বৃদ্ধি কেবল বিদেশি মুদ্রায় নয়, দেশীয় মুদ্রার মজুতও বাড়ছে ব্যাংকগুলোতে। যে কারণে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে ধার করতে তেমন আগ্রহ নেই কারোর। কলমানির সুদের হার অনেক কমে গেছে।
মেয়াদি ঋণপ্রবাহ: ব্যাংকগুলোতে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মেয়াদি ঋণ বেড়েছে। বৃদ্ধির হার ৩০ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
তবে বিভিন্ন ব্যাংক সূত্র এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেয়াদি ঋণের একটা বড় অংশ এসেছে স্বল্পসময়ের জন্য দেওয়া বাণিজ্যিক অর্থায়ন-এলটিআর (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট) পুনঃ তফসিল করে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এই অর্থায়নগুলো একদল ব্যবসায়ী নিয়েছিলেন আমদানি করা নিত্যপণ্য বাজারজাত করতে সর্বোচ্চ তিন মাসের জন্য। কিন্তু বিশ্বাস ভঙ্গ করায় এই হাজার হাজার কোটি টাকা এখন মেয়াদি ঋণ হয়ে আটকে গেছে। মেয়াদি ঋণের অন্তত ২০ ভাগ এই অর্থায়ন থেকে পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
উৎপাদন কমছে: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) শিল্প উৎপাদনের পরিমাণ সূচক তৈরি করে। সর্বশেষ প্রস্তুত সেপ্টেম্বরভিত্তিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মধ্য ও বৃহৎ উৎপাদন খাতে নিম্নমুখী ধারা তৈরি হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম মাস অর্থাৎ জুলাই মাসে উৎপাদন খাতে সূচক ছিল ৬১০ দশমিক ৩৬, আগস্টে তা হয় ৫৮১ দশমিক ২৭ এবং সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে হয়েছে ৫৭১ দশমিক ৬৪।
৩ জানুয়ারি মধ্যরাতে সরকার জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলেছে, জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে দশমিক ২ শতাংশ থেকে দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত সরকারের জিডিপি কমবে। সিপিডির হিসাবে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উৎপাদনমুখী তৈরি পোশাক খাত। এ খাতের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত। এর প্রভাবে রপ্তানিও কমে যাবে দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত। অন্যদিকে আমদানি কমবে দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত।
আবার, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রপ্তানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং রপ্তানি কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে রপ্তানিকারকদের সমিতি ইএবি।
মালেক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিউ এশিয়া সিনথেটিকস নামে এই শিল্প স্থাপনের শেষ পর্যায়ে এসে আটকে যায় গ্যাস-সংযোগের অভাবে। ভেস্তে যায় প্রায় ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় ১০০ একর জমির ওপর পলিয়েস্টার চিপস তৈরির শিল্পটি স্থাপনের কথা ছিল। মালেক স্পিনিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ মতিন চৌধুরী জানান, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও গ্যাস-সংযোগ না পাওয়ায় শিল্পকারখানাটি স্থাপন করা যায়নি।
আবার তিন বছরেও গ্যাস না পেয়ে কারখানা বিক্রি করে দিচ্ছেন একজন প্রবাসী বাংলাদেশি, মোহাম্মদ আমিন। পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির জন্য ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে হাতিম ব্রিকসের গ্যাস-সংযোগ প্রদানের অনুমোদন দিয়েছিল তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন। এরপর ২০১১ সালে কয়লাভিত্তিক জ্বালানির ওপর নির্ভর করে উৎপাদনে যায় আশুলিয়ায় স্থাপিত এই কোম্পানি। কিন্তু এই পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কারখানা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মালিকপক্ষ হাতিম ব্রিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিন বলেন, ‘উচ্চ খরচে ব্যবসা টেকসই করা খুব কঠিন।’
গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প বিনিয়োগ থমকে পড়ার তথ্য অনেক দিন ধরেই ব্যবসায়ীরা বলে আসছেন। এর সঙ্গে আরও রয়েছে শিল্প স্থাপনের জমি না পাওয়াসহ অবকাঠামোগত অন্যান্য দুর্বলতা। আর নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে শিল্প ও বণিক সমিতিসমূহের ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, অবকাঠামো, সুদের হারসহ আগের অন্য সমস্যাগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। নতুন করে যুক্ত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগে ব্যবসায়ী সমাজ অবশ্যই একটু শঙ্কিত।
এদিকে, রিয়েল এস্টেট বা আবাসন খাতেও অনেক দিন ধরে মন্দা চলছে। নির্মিত ও অর্ধনির্মিত বহু ফ্ল্যাট অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়া এর প্রধান কারণ। আরেকটি কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি। এই আবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত অনেক শ্রমঘন শিল্প ও বিনিয়োগ। ফলে সেখানেও পড়ছে মন্দার প্রভাব।
বিনিয়োগ মন্দার পাশাপাশি শিল্প উৎপাদন কমার তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে এখন। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও একই চিত্র ছিল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অক্টোবরে কিছু বৃদ্ধি পাওয়ার পর নভেম্বর মাসে আবার রপ্তানি কমে যায়। ডিসেম্বর মাসে খানিকটা অগ্রগতি লক্ষ করা যায়।
সার্বিক বিষয় নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিনিয়োগ মন্দায় মানুষের সাধারণ চাহিদা কমে যাওয়ার দিকটি তুলে ধরে চারটি কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। কেননা, সেখানে চালের বিক্রয়মূল্য কমেছে। কিন্তু, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এতে দেশের ৬০-৭০ ভাগ মানুষ যে গ্রামে বাস করে, তাদের দিক থেকে চাহিদা কমে গেছে। অন্যদিকে শহরের মানুষের সম্পদের স্ফীতি কমে গেছে। জমি, ফ্ল্যাট বিক্রি আটকে পড়েছে, দামও পড়তির দিকে। শেয়ারবাজারের আয় তো নেই-ই, বিনিয়োগও আটকে আছে। আর বিনিয়োগ মন্দার চতুর্থ কারণ হিসেবে ঋণের সুদের হারকে দায়ী করেন আহসান মনসুর।
শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে: বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-অক্টোবর সময়ে সব ধরনের আমদানি ব্যয় ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ কমেছে। ঋণপত্রের (এলসি) নিষ্পত্তি (১১ দশমিক ০৪ শতাংশ) ও নতুন ঋণপত্র খোলার (১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ) পরিমাণও বেশ কমেছে।
একই সময়ে শিল্পের যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে। আবার নতুন এলসি খোলার পরিমাণও আগের বছরের চেয়ে কম। ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। নতুন এলসি খোলাতেও আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে, প্রায় ২ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া এবং নতুন এলসি কমে যাওয়ার তথ্য প্রমাণ করে যে দেশে বিনিয়োগ মন্দা চলছে। অন্যদিকে কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমার তথ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার স্বাক্ষর বহন করে। দেশের প্রধান প্রধান শিল্প খাত অর্থাৎ বস্ত্র, চামড়া, পাট, পোশাক, ওষুধ, প্যাকিং এবং অন্য সব ধরনের শিল্প খাতের যন্ত্রপাতি আমদানি গত চার মাসে কমে গেছে।
বিনিয়োগ মন্দায় মজুত বৃদ্ধি: আমদানি ব্যয় কমলেও রপ্তানিতে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ (জুলাই-অক্টোবর) প্রবৃদ্ধি রয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে প্রবাসী-আয়ে (রেমিট্যান্স) প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (মজুত)। এখন এই রিজার্ভ গিয়ে ঠেকেছে এক হাজার ৩০০ কোটি ডলারে।
মূলত দেশে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমে যাওয়ায় মজুতের বৃদ্ধি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ কারণে প্রতিনিয়ত ডলারের দাম পড়ে যাচ্ছে, টাকা শক্তিশালী হচ্ছে। এতে আশঙ্কা থাকে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স নিরুৎসাহিত হওয়ার। মজুত বৃদ্ধি কেবল বিদেশি মুদ্রায় নয়, দেশীয় মুদ্রার মজুতও বাড়ছে ব্যাংকগুলোতে। যে কারণে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে ধার করতে তেমন আগ্রহ নেই কারোর। কলমানির সুদের হার অনেক কমে গেছে।
মেয়াদি ঋণপ্রবাহ: ব্যাংকগুলোতে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মেয়াদি ঋণ বেড়েছে। বৃদ্ধির হার ৩০ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
তবে বিভিন্ন ব্যাংক সূত্র এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেয়াদি ঋণের একটা বড় অংশ এসেছে স্বল্পসময়ের জন্য দেওয়া বাণিজ্যিক অর্থায়ন-এলটিআর (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট) পুনঃ তফসিল করে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এই অর্থায়নগুলো একদল ব্যবসায়ী নিয়েছিলেন আমদানি করা নিত্যপণ্য বাজারজাত করতে সর্বোচ্চ তিন মাসের জন্য। কিন্তু বিশ্বাস ভঙ্গ করায় এই হাজার হাজার কোটি টাকা এখন মেয়াদি ঋণ হয়ে আটকে গেছে। মেয়াদি ঋণের অন্তত ২০ ভাগ এই অর্থায়ন থেকে পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
উৎপাদন কমছে: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) শিল্প উৎপাদনের পরিমাণ সূচক তৈরি করে। সর্বশেষ প্রস্তুত সেপ্টেম্বরভিত্তিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মধ্য ও বৃহৎ উৎপাদন খাতে নিম্নমুখী ধারা তৈরি হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরের প্রথম মাস অর্থাৎ জুলাই মাসে উৎপাদন খাতে সূচক ছিল ৬১০ দশমিক ৩৬, আগস্টে তা হয় ৫৮১ দশমিক ২৭ এবং সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে হয়েছে ৫৭১ দশমিক ৬৪।
৩ জানুয়ারি মধ্যরাতে সরকার জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলেছে, জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে দশমিক ২ শতাংশ থেকে দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত সরকারের জিডিপি কমবে। সিপিডির হিসাবে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে উৎপাদনমুখী তৈরি পোশাক খাত। এ খাতের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত। এর প্রভাবে রপ্তানিও কমে যাবে দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত। অন্যদিকে আমদানি কমবে দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত।
আবার, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রপ্তানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং রপ্তানি কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে রপ্তানিকারকদের সমিতি ইএবি।
No comments