গ্যাস-সম্পদ- বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে by বদরুল ইমাম
বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত গ্যাস উৎপাদন পুরোটাই পেট্রোবাংলার অধীনে জাতীয় গ্যাস কোম্পানিগুলো কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসে। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাজ্যের কেয়ার্ন এনার্জি কোম্পানি সমুদ্রবক্ষে আবিষ্কৃত সাংগু গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন শুরু করলে দেশে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে বিদেশি তেল কোম্পানির কার্যক্রম শুরু হয়।
এর পর থেকে দেশে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহে ক্রমাগতভাবে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর অংশ বাড়তে থাকে এবং দেশি কোম্পানিগুলোর অংশ কমতে থাকে।
২০০৪ সালে যেখানে দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের ২৪ শতাংশ বিদেশি তেল কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত হয়, ২০০৮ সালে বিদেশি কোম্পানির অংশ বেড়ে গিয়ে ৪৫ শতাংশ এবং ২০১০ সালে তা ৫৩ শতাংশে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, পেট্রোবাংলার অধীনে দেশীয় কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত গ্যাস ২০০৪ সালে মোট উৎপাদনের ৭৬ শতাংশ থেকে কমে ২০০৮ সালে ৫৫ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৪৭ শতাংশ হয়। সর্বশেষ পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের প্রায় ৫৬ শতাংশ উৎপাদন করে বিদেশি কোম্পানি এবং বাকি ৪৪ শতাংশ উৎপাদন করে জাতীয় কোম্পানি। বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক গ্যাস উৎপাদনের অংশ নিকট ভবিষ্যতে বেড়ে চলবে বলে অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়। অনেকে আশঙ্কা করেন, এভাবে গ্যাস উৎপাদনে বিদেশি তেল কোম্পানির অংশ বাড়তে থাকলে এবং দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন কমতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহে দেশীয় কর্তৃত্ব খর্ব হবে এবং বিদেশি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, যা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ১৯টি এখন উৎপাদনে রয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ অনুযায়ী মাত্র ছয়টি গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনই গ্যাস সরবরাহের মূল নিয়ন্ত্রক। এই ছয়টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৮৫ শতাংশ উৎপাদন হয়, বাকি ১৫ শতাংশ গ্যাস আসে উৎপাদনরত বাকি ১৩টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে। গ্যাস সরবরাহের মূল নিয়ন্ত্রক এই ছয়টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে তিনটি গ্যাসক্ষেত্রই বিদেশি তেল কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত হয়, বাকি তিনটি দেশীয় কোম্পানি চালায়। সুতরাং, গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহে বিদেশি কোম্পানির তুলনায় দেশীয় কোম্পানির বর্তমান পশ্চাৎপদ অবস্থান শিগগির পরিবর্তিত হবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে যে তিনটি বিদেশি তেল কোম্পানি গ্যাস উৎপাদন করে থাকে, সেগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন ইনকরপোরেশন, ব্রিটেনের তাল্লো অয়েল ও অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস লিমিটেড। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শেভরনের কার্যক্রমই সর্ববৃহৎ বা এক অর্থে একচেটিয়া। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত গ্যাসের প্রায় ৫০ শতাংশ এককভাবে শেভরন উৎপাদন করে। শেভরনের হাতে যে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলো হলো বিবিয়ানা, জালালাবাদ ও মৌলভীবাজার। এগুলোর মধ্যে বিবিয়ানা সর্ববৃহৎ এবং এই গ্যাসক্ষেত্রই শেভরনের গ্যাস উৎপাদন কার্যক্রমের প্রধান কেন্দ্র। শেভরন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখন প্রতিদিন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ করে। সরকারি চাহিদার প্রেক্ষাপটে কোম্পানিটি আরও ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের জন্য এই গ্যাসক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কূপ খনন ও বিনিয়োগ করছে। এ কারণে কোম্পানিটির ওপর দেশের গ্যাস-নির্ভরতা শিগগির আরও বাড়বে।
সত্তরের দশকে বিশ্বখ্যাত লেখক অ্যান্থনি সিম্পসন তাঁর বেস্ট সেলার গ্রন্থে বিশ্বের সেরা ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর যে সাতটি তেল কোম্পানিকে ‘সেভেন সিসটারস’ নামে অভিহিত করেছিলেন, শেভরন তার একটি। অ্যান্থনি সিম্পসন তাঁর সেভেন সিসটারস বইতে দেখিয়েছিলেন, কী প্রতাপে এই সাতটি তেল কোম্পানি সারা বিশ্বে তেলের ব্যবসা করে, তাদের একেকটির বার্ষিক বাজেট বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বেশি এবং তারা কেবল আর্থিকভাবেই ক্ষমতাবান নয়, বরং প্রয়োজনে তাদের রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষমতা কোনো দেশের সরকার পতনের কারণ ঘটাতে পারে, যেমনটি পঞ্চাশের দশকে প্রমাণিত হয়েছিল ইরানের জনপ্রিয় নেতা মোসাদ্দেকের সামরিক উৎখাতের ঘটনায়। বিশ্বে এখন পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপট অতীত, পরবর্তী দশকগুলোয় রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ কেবল বড় বড় দেশেই ঘটেনি, বরং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যেও দেখা গেছে। কিন্তু ক্ষমতা ও আধিপত্যের বিকাশ কেবল সামরিক শক্তি প্রয়োগেই হয় না, বর্তমান যুগে অর্থনৈতিক কৌশল ও আধিপত্যের এক নতুন রূপ হিসেবে বিদ্যমান। আর অতীতের শেভরনরা এখন অর্থনৈতিক কৌশলকে ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী তাদের অবস্থান সুরক্ষা করে চলেছে বটে।
বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানির হাতে উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্র আছে পাঁচটি, আর জাতীয় কোম্পানির হাতে আছে ১৪টি। কিন্তু বিদেশি কোম্পানির মোট উৎপাদন জাতীয় কোম্পানিগুলোর মোট উৎপাদনের চেয়ে বেশি কেন? এর একটি প্রধান কারণ হলো, বিদেশি কোম্পানিগুলো অপেক্ষাকৃত ত্বরিতগতিতে গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন করে থাকে। যেমন ধরা যাক শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের কথা। এটি ১৯৯৮ সালে আবিষ্কৃত এবং গ্যাস উৎপাদন শুরু হয় ২০০৭ সালে। ২০১২ সাল নাগাদ অর্থাৎ উৎপাদন শুরুর পাঁচ বছরের মধ্যে এটিতে ১২টি উৎপাদন কূপ খনন করা হয়। তুলনামূলকভাবে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রটি উৎপাদনে আসে ১৯৬৮ সালে ও ২০১২ সাল নাগাদ, অর্থাৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার পর ৪৪ বছরে উৎপাদন কূপের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬টি। অথচ জাতীয় কোম্পানি পরিচালিত তিতাস গ্যাসক্ষেত্র শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের তুলনায় বড় ও গ্যাস উৎপাদনবান্ধব।
জাতীয় কোম্পানি কর্তৃক কম গ্যাস উৎপাদনের অন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, বিদেশি কোম্পানি প্রতি কূপে তুলনামূলকভাবে বেশি হারে গ্যাস উৎপাদন করে। উদাহরণস্বরূপ, শেভরন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের প্রতিটি কূপ থেকে দৈনিক ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস উৎপাদন করে। তুলনামূলকভাবে জাতীয় কোম্পানিগুলোর কোনো কূপেই দৈনিক ৩০ বা ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস উৎপাদিত হয় না। সম্প্রতি বাংলাদেশ কর্তৃক নিয়োজিত একটি বিদেশি পরামর্শক জাতীয় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কূপগুলোর ওপর জরিপ করে এই মত প্রকাশ করে যে এসব উৎপাদন কূপে প্রয়োজনীয় কিছু কারিগরি রদবদলের মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব। দেশের বর্তমান গ্যাস-সংকটের সময় ত্বরিতগতিতে এসব পরামর্শ ্বাস্তবায়ন করে গ্যাস-সংকট কমানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি দেশীয় গ্যাস কোম্পানি বাপেক্সের কার্যক্রম নিয়ে অনেকে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। একসময় বাপেক্সের প্রতি সরকারি অবহেলা প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতাকে বিপুলভাবে খর্ব করলেও সম্প্রতি এর কার্যক্রমে নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বাপেক্স কিছু নতুন গ্যাস আবিষ্কারে সক্ষম হয় এবং আরও অনুসন্ধানকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাপেক্স কর্তৃক পরিচালিত পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র—সবই ক্ষুদ্র আকারের এবং এগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদনের হারও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বাপেক্স দেশের দৈনিক মোট উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র প্রায় ৪ শতাংশ উৎপাদন ও সরবরাহ করে। বাপেক্সের প্রতি সরকারি সুনজর অব্যাহত থাকলে প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতে দেশে গ্যাস সরবরাহে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারবে, যদিও এই মুহূর্তে অন্য দুটি জাতীয় গ্যাস কোম্পানি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি ও সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির ওপরই দেশীয় গ্যাস উৎপাদন মূলত নির্ভরশীল।
ওপরের আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো ক্রমান্বয়ে দেশের গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। জাতীয় গ্যাস কোম্পানি কর্তৃক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ বিদেশি তেল কোম্পানির তুলনায় কম হওয়ার মূল কারণ হলো জাতীয় কোম্পানিগুলোর হাতে থাকা গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় ধীরগতিতে উন্নয়নকাজ পরিচালনা করা। তিতাস হবিগঞ্জ ও রশিদপুরের মতো বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রগুলো ত্বরিত ও বৃহৎ আকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে জাতীয় গ্যাস উৎপাদন বিদেশি কোম্পানির উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যথায়, বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকা গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় ত্বরিত উন্নয়নধারা শিগগিরই বাংলাদেশে গ্যাসের বাজারকে কুক্ষিগত করে ফেলবে। এ কারণে দেশের গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহে দেশীয় নিয়ন্ত্রণ লোপ পাবে এবং তা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।
ড. বদরুল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২০০৪ সালে যেখানে দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের ২৪ শতাংশ বিদেশি তেল কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত হয়, ২০০৮ সালে বিদেশি কোম্পানির অংশ বেড়ে গিয়ে ৪৫ শতাংশ এবং ২০১০ সালে তা ৫৩ শতাংশে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, পেট্রোবাংলার অধীনে দেশীয় কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত গ্যাস ২০০৪ সালে মোট উৎপাদনের ৭৬ শতাংশ থেকে কমে ২০০৮ সালে ৫৫ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৪৭ শতাংশ হয়। সর্বশেষ পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের প্রায় ৫৬ শতাংশ উৎপাদন করে বিদেশি কোম্পানি এবং বাকি ৪৪ শতাংশ উৎপাদন করে জাতীয় কোম্পানি। বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক গ্যাস উৎপাদনের অংশ নিকট ভবিষ্যতে বেড়ে চলবে বলে অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়। অনেকে আশঙ্কা করেন, এভাবে গ্যাস উৎপাদনে বিদেশি তেল কোম্পানির অংশ বাড়তে থাকলে এবং দেশীয় কোম্পানির উৎপাদন কমতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহে দেশীয় কর্তৃত্ব খর্ব হবে এবং বিদেশি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, যা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ১৯টি এখন উৎপাদনে রয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ অনুযায়ী মাত্র ছয়টি গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনই গ্যাস সরবরাহের মূল নিয়ন্ত্রক। এই ছয়টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৮৫ শতাংশ উৎপাদন হয়, বাকি ১৫ শতাংশ গ্যাস আসে উৎপাদনরত বাকি ১৩টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে। গ্যাস সরবরাহের মূল নিয়ন্ত্রক এই ছয়টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে তিনটি গ্যাসক্ষেত্রই বিদেশি তেল কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত হয়, বাকি তিনটি দেশীয় কোম্পানি চালায়। সুতরাং, গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহে বিদেশি কোম্পানির তুলনায় দেশীয় কোম্পানির বর্তমান পশ্চাৎপদ অবস্থান শিগগির পরিবর্তিত হবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে যে তিনটি বিদেশি তেল কোম্পানি গ্যাস উৎপাদন করে থাকে, সেগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন ইনকরপোরেশন, ব্রিটেনের তাল্লো অয়েল ও অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস লিমিটেড। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শেভরনের কার্যক্রমই সর্ববৃহৎ বা এক অর্থে একচেটিয়া। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত গ্যাসের প্রায় ৫০ শতাংশ এককভাবে শেভরন উৎপাদন করে। শেভরনের হাতে যে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলো হলো বিবিয়ানা, জালালাবাদ ও মৌলভীবাজার। এগুলোর মধ্যে বিবিয়ানা সর্ববৃহৎ এবং এই গ্যাসক্ষেত্রই শেভরনের গ্যাস উৎপাদন কার্যক্রমের প্রধান কেন্দ্র। শেভরন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখন প্রতিদিন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ করে। সরকারি চাহিদার প্রেক্ষাপটে কোম্পানিটি আরও ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের জন্য এই গ্যাসক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কূপ খনন ও বিনিয়োগ করছে। এ কারণে কোম্পানিটির ওপর দেশের গ্যাস-নির্ভরতা শিগগির আরও বাড়বে।
সত্তরের দশকে বিশ্বখ্যাত লেখক অ্যান্থনি সিম্পসন তাঁর বেস্ট সেলার গ্রন্থে বিশ্বের সেরা ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর যে সাতটি তেল কোম্পানিকে ‘সেভেন সিসটারস’ নামে অভিহিত করেছিলেন, শেভরন তার একটি। অ্যান্থনি সিম্পসন তাঁর সেভেন সিসটারস বইতে দেখিয়েছিলেন, কী প্রতাপে এই সাতটি তেল কোম্পানি সারা বিশ্বে তেলের ব্যবসা করে, তাদের একেকটির বার্ষিক বাজেট বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বেশি এবং তারা কেবল আর্থিকভাবেই ক্ষমতাবান নয়, বরং প্রয়োজনে তাদের রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষমতা কোনো দেশের সরকার পতনের কারণ ঘটাতে পারে, যেমনটি পঞ্চাশের দশকে প্রমাণিত হয়েছিল ইরানের জনপ্রিয় নেতা মোসাদ্দেকের সামরিক উৎখাতের ঘটনায়। বিশ্বে এখন পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপট অতীত, পরবর্তী দশকগুলোয় রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ কেবল বড় বড় দেশেই ঘটেনি, বরং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যেও দেখা গেছে। কিন্তু ক্ষমতা ও আধিপত্যের বিকাশ কেবল সামরিক শক্তি প্রয়োগেই হয় না, বর্তমান যুগে অর্থনৈতিক কৌশল ও আধিপত্যের এক নতুন রূপ হিসেবে বিদ্যমান। আর অতীতের শেভরনরা এখন অর্থনৈতিক কৌশলকে ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী তাদের অবস্থান সুরক্ষা করে চলেছে বটে।
বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানির হাতে উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্র আছে পাঁচটি, আর জাতীয় কোম্পানির হাতে আছে ১৪টি। কিন্তু বিদেশি কোম্পানির মোট উৎপাদন জাতীয় কোম্পানিগুলোর মোট উৎপাদনের চেয়ে বেশি কেন? এর একটি প্রধান কারণ হলো, বিদেশি কোম্পানিগুলো অপেক্ষাকৃত ত্বরিতগতিতে গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন করে থাকে। যেমন ধরা যাক শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের কথা। এটি ১৯৯৮ সালে আবিষ্কৃত এবং গ্যাস উৎপাদন শুরু হয় ২০০৭ সালে। ২০১২ সাল নাগাদ অর্থাৎ উৎপাদন শুরুর পাঁচ বছরের মধ্যে এটিতে ১২টি উৎপাদন কূপ খনন করা হয়। তুলনামূলকভাবে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রটি উৎপাদনে আসে ১৯৬৮ সালে ও ২০১২ সাল নাগাদ, অর্থাৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার পর ৪৪ বছরে উৎপাদন কূপের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬টি। অথচ জাতীয় কোম্পানি পরিচালিত তিতাস গ্যাসক্ষেত্র শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের তুলনায় বড় ও গ্যাস উৎপাদনবান্ধব।
জাতীয় কোম্পানি কর্তৃক কম গ্যাস উৎপাদনের অন্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, বিদেশি কোম্পানি প্রতি কূপে তুলনামূলকভাবে বেশি হারে গ্যাস উৎপাদন করে। উদাহরণস্বরূপ, শেভরন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের প্রতিটি কূপ থেকে দৈনিক ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস উৎপাদন করে। তুলনামূলকভাবে জাতীয় কোম্পানিগুলোর কোনো কূপেই দৈনিক ৩০ বা ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস উৎপাদিত হয় না। সম্প্রতি বাংলাদেশ কর্তৃক নিয়োজিত একটি বিদেশি পরামর্শক জাতীয় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কূপগুলোর ওপর জরিপ করে এই মত প্রকাশ করে যে এসব উৎপাদন কূপে প্রয়োজনীয় কিছু কারিগরি রদবদলের মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব। দেশের বর্তমান গ্যাস-সংকটের সময় ত্বরিতগতিতে এসব পরামর্শ ্বাস্তবায়ন করে গ্যাস-সংকট কমানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি দেশীয় গ্যাস কোম্পানি বাপেক্সের কার্যক্রম নিয়ে অনেকে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। একসময় বাপেক্সের প্রতি সরকারি অবহেলা প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতাকে বিপুলভাবে খর্ব করলেও সম্প্রতি এর কার্যক্রমে নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বাপেক্স কিছু নতুন গ্যাস আবিষ্কারে সক্ষম হয় এবং আরও অনুসন্ধানকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাপেক্স কর্তৃক পরিচালিত পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র—সবই ক্ষুদ্র আকারের এবং এগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদনের হারও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বাপেক্স দেশের দৈনিক মোট উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র প্রায় ৪ শতাংশ উৎপাদন ও সরবরাহ করে। বাপেক্সের প্রতি সরকারি সুনজর অব্যাহত থাকলে প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতে দেশে গ্যাস সরবরাহে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারবে, যদিও এই মুহূর্তে অন্য দুটি জাতীয় গ্যাস কোম্পানি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি ও সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির ওপরই দেশীয় গ্যাস উৎপাদন মূলত নির্ভরশীল।
ওপরের আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো ক্রমান্বয়ে দেশের গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। জাতীয় গ্যাস কোম্পানি কর্তৃক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ বিদেশি তেল কোম্পানির তুলনায় কম হওয়ার মূল কারণ হলো জাতীয় কোম্পানিগুলোর হাতে থাকা গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় ধীরগতিতে উন্নয়নকাজ পরিচালনা করা। তিতাস হবিগঞ্জ ও রশিদপুরের মতো বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রগুলো ত্বরিত ও বৃহৎ আকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে জাতীয় গ্যাস উৎপাদন বিদেশি কোম্পানির উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যথায়, বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকা গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় ত্বরিত উন্নয়নধারা শিগগিরই বাংলাদেশে গ্যাসের বাজারকে কুক্ষিগত করে ফেলবে। এ কারণে দেশের গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহে দেশীয় নিয়ন্ত্রণ লোপ পাবে এবং তা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।
ড. বদরুল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments