ভারতকে বাংলাদেশের 'না'-কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে না আনোয়ারায়
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা বিষয়ক দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ-ভারত বৈঠকের প্রথম দিনে নিজেদের অবস্থান জানায় বাংলাদেশ।
ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে দৈনিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ১৫ সদস্যের বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসাইন এবং ২২ সদস্যের ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দেন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রিতা আচার্য।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসাইন জানান, 'আনোয়ারায় জমি অধিগ্রহণে জমির মালিকের বাধা রয়েছে। বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় এ ব্যাপারে আদালতই করণীয় নির্ধারণ করবেন। তাই এ বিষয়ে আলোচনার জন্য এটি আদর্শ সময় নয়।'
এর আগে আনোয়ারায় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা নিলেও চীনাপক্ষ প্রকল্পটির ৫১ শতাংশ মালিকানা দাবি করায় পিছিয়ে আসে বাংলাদেশ। চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি সরকার।
গতকালের বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের আরেকটি কয়লাভিত্তিক যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। ভারতীয় অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে। সরকার এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে তাগাদা দিলেও ভারত আরো দুই মাস সময় বেশি লাগবে বলে জানিয়েছে। তা ছাড়া এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুযায়ী এক মিলিলিটার জ্বালানি তেল লাগার কথা থাকলেও ভারতের প্রস্তাবে দুই মিলিলিটার জ্বালানি ব্যবহারের কথা বলায় বিষয়টি নিয়ে জটিলতা আরো বেড়েছে।
রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
বৈঠকের শেষ দিনে আজ বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন বিদ্যুৎসচিব মনোয়ার হোসেন এবং ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন দেশটির বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব উমা শঙ্কর রায়। বৈঠকে যৌথ প্রকল্পটির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা চুক্তির আওতায় বিদ্যুৎ খাতে চারটি যৌথ প্রকল্প রয়েছে।
সম্ভাব্যতা যাচাই ও অনুমতি ছাড়া আনোয়ারায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নয় : এদিকে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ১৫ মে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি ফরিদ আহম্মেদের হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ অভিমত দেন। রায়টির অবিকল সত্যায়িত নকল থেকে এ তথ্য জানান রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) আনোয়ারায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থবিষয়ক এই রিটটি করেছিল।
আদালতের অভিমতে সরকারকে কতগুলো শর্ত পূরণ করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, সম্ভাব্যতা যাচাই, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর অনুমতি ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না।
আদালতের পর্যবেক্ষণ : পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) জরিপের কথা উল্লেখ করে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আনোয়ারার রাঙ্গাদিয়া ও মাঝেরচর মৌজায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত পারকি বিচ, শাহ আমানত বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ ঘাঁটি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাইকার জরিপে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের কালো ধোঁয়ার কারণে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শাহ আমানত বিমানবন্দরের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে।
আদালত রায়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই সংঘটিত সভার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উপব্যবস্থাপকসহ (এস্টেট) বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে আপত্তির কথা উল্লেখ করা হয়।
হাইকোর্ট বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই এবং প্রজেক্ট প্রোফাইল ছাড়াই জমি অধিগ্রহণের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আদালত বলেন, 'আমরা সন্দিহান, আদৌ সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে কি না। বিবাদীদের কাগজপত্রে জানতে পেরেছি, জরিপদল স্থানীয় জনগণের আন্দোলনের মুখে জমি অধিগ্রহণ এলাকায় যেতে পারেনি।' আদালত আরো বলেন, এ ধরনের প্রক্রিয়ায় জমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রস্তাবিত প্রকল্প ও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াকে আদালত 'ঘোড়ার আগে গাড়ি' জুড়ে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আদালত বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের (চট্টগ্রাম অঞ্চল) অনুমতি চেয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন কেন্দ্র (পিডিবি) ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর আবেদন করে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর ও ৫ ডিসেম্বর দুই দফায় আরো কাগজপত্র দাখিল করতে বলে, যা পিডিবি আদৌ দাখিল করেনি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি আদৌ মিলেছে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন আদালত।
সিভিল এভিয়েশনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২৭৫ মিটার চিমনি ব্যবহারের পরিকল্পনার আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির বিদ্যুৎকেন্দ্র ছোট ছোট প্লান্টে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে আদালত বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই এবং ব্যয় বৃদ্ধির কথা বিবেচনা না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য নয়।
আদালত সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াকে আইনবহির্ভূত এবং নজিরবিহীন বলে আখ্যায়িত করেন। আদালত বলেন, 'ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা সম্পূর্ণ হয়েছিল কি না, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আমরা বিস্মিত হয়েছি যে,প্রজেক্ট প্রপোজাল ছাড়াই ভূমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে অতিরিক্ত আগ্রহ ও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।'
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের জবাবে বলেছে, সুবিধাজনক হলেই তবে আনোয়ারাকে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই বক্তব্যকে কটাক্ষ করে আদালত বলেন, সেই বিচার-বিবেচনা ছাড়া আগেই কেন ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে?
আদালত বলেন, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে প্রতিদিন ১০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে বছরে আনুমানিক ৮০০ জাহাজ বন্দরে নোঙর করবে। এতে বার্ষিক ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা কর্ণফুলী নদীর তীরে স্থাপিত জেটিতে খালাস করা হবে। ফলে নদীর পানি ভীষণভাবে দূষিত হবে এবং বন্দরে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও দূষিত পারদ নির্গমিত হবে, যা জনস্বাস্থ্য, জলজ প্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। আদালত বলেন, দূষিত পারদের কারণে স্নায়ুরোগ বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রসঙ্গে আদালত বলেন, 'শুধু সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যাচাই করলে হবে না, বরং জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা বিবেচনা করে তা করতে হবে।'
আদালত সরকারকে এই রায়ের নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ অনুসরণ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অগ্রসর হতে বলেছেন। আদালত বলেন, 'কারণ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু বেআইনি নয়, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের বিরুদ্ধে হুমকির কারণে আমরা উদ্বিগ্ন।' হাইকোর্ট সংবিধানের ১০২ ধারার ক্ষমতাবলে সরকারের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার রাখেন বলে উল্লেখ করেন, যদি ওই উন্নয়ন প্রকল্প জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি এবং আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, 'আমি আশা করি, সরকার উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে হাত দেবে।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল দায়ের করেনি। কাজেই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে এই রায় অনুসরণ করতে হবে।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ১৫ সদস্যের বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসাইন এবং ২২ সদস্যের ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দেন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রিতা আচার্য।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসাইন জানান, 'আনোয়ারায় জমি অধিগ্রহণে জমির মালিকের বাধা রয়েছে। বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় এ ব্যাপারে আদালতই করণীয় নির্ধারণ করবেন। তাই এ বিষয়ে আলোচনার জন্য এটি আদর্শ সময় নয়।'
এর আগে আনোয়ারায় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা নিলেও চীনাপক্ষ প্রকল্পটির ৫১ শতাংশ মালিকানা দাবি করায় পিছিয়ে আসে বাংলাদেশ। চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি সরকার।
গতকালের বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের আরেকটি কয়লাভিত্তিক যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। ভারতীয় অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে। সরকার এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে তাগাদা দিলেও ভারত আরো দুই মাস সময় বেশি লাগবে বলে জানিয়েছে। তা ছাড়া এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুযায়ী এক মিলিলিটার জ্বালানি তেল লাগার কথা থাকলেও ভারতের প্রস্তাবে দুই মিলিলিটার জ্বালানি ব্যবহারের কথা বলায় বিষয়টি নিয়ে জটিলতা আরো বেড়েছে।
রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
বৈঠকের শেষ দিনে আজ বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন বিদ্যুৎসচিব মনোয়ার হোসেন এবং ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন দেশটির বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব উমা শঙ্কর রায়। বৈঠকে যৌথ প্রকল্পটির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা চুক্তির আওতায় বিদ্যুৎ খাতে চারটি যৌথ প্রকল্প রয়েছে।
সম্ভাব্যতা যাচাই ও অনুমতি ছাড়া আনোয়ারায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নয় : এদিকে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ১৫ মে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি ফরিদ আহম্মেদের হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ অভিমত দেন। রায়টির অবিকল সত্যায়িত নকল থেকে এ তথ্য জানান রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) আনোয়ারায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থবিষয়ক এই রিটটি করেছিল।
আদালতের অভিমতে সরকারকে কতগুলো শর্ত পূরণ করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, সম্ভাব্যতা যাচাই, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর অনুমতি ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে না।
আদালতের পর্যবেক্ষণ : পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) জরিপের কথা উল্লেখ করে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আনোয়ারার রাঙ্গাদিয়া ও মাঝেরচর মৌজায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত পারকি বিচ, শাহ আমানত বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ ঘাঁটি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাইকার জরিপে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের কালো ধোঁয়ার কারণে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শাহ আমানত বিমানবন্দরের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে।
আদালত রায়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই সংঘটিত সভার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উপব্যবস্থাপকসহ (এস্টেট) বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে আপত্তির কথা উল্লেখ করা হয়।
হাইকোর্ট বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই এবং প্রজেক্ট প্রোফাইল ছাড়াই জমি অধিগ্রহণের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আদালত বলেন, 'আমরা সন্দিহান, আদৌ সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে কি না। বিবাদীদের কাগজপত্রে জানতে পেরেছি, জরিপদল স্থানীয় জনগণের আন্দোলনের মুখে জমি অধিগ্রহণ এলাকায় যেতে পারেনি।' আদালত আরো বলেন, এ ধরনের প্রক্রিয়ায় জমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রস্তাবিত প্রকল্প ও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াকে আদালত 'ঘোড়ার আগে গাড়ি' জুড়ে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আদালত বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের (চট্টগ্রাম অঞ্চল) অনুমতি চেয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন কেন্দ্র (পিডিবি) ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর আবেদন করে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর ও ৫ ডিসেম্বর দুই দফায় আরো কাগজপত্র দাখিল করতে বলে, যা পিডিবি আদৌ দাখিল করেনি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি আদৌ মিলেছে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন আদালত।
সিভিল এভিয়েশনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২৭৫ মিটার চিমনি ব্যবহারের পরিকল্পনার আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির বিদ্যুৎকেন্দ্র ছোট ছোট প্লান্টে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে আদালত বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই এবং ব্যয় বৃদ্ধির কথা বিবেচনা না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য নয়।
আদালত সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াকে আইনবহির্ভূত এবং নজিরবিহীন বলে আখ্যায়িত করেন। আদালত বলেন, 'ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা সম্পূর্ণ হয়েছিল কি না, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আমরা বিস্মিত হয়েছি যে,প্রজেক্ট প্রপোজাল ছাড়াই ভূমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে অতিরিক্ত আগ্রহ ও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।'
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের জবাবে বলেছে, সুবিধাজনক হলেই তবে আনোয়ারাকে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই বক্তব্যকে কটাক্ষ করে আদালত বলেন, সেই বিচার-বিবেচনা ছাড়া আগেই কেন ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে?
আদালত বলেন, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে প্রতিদিন ১০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে বছরে আনুমানিক ৮০০ জাহাজ বন্দরে নোঙর করবে। এতে বার্ষিক ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা কর্ণফুলী নদীর তীরে স্থাপিত জেটিতে খালাস করা হবে। ফলে নদীর পানি ভীষণভাবে দূষিত হবে এবং বন্দরে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও দূষিত পারদ নির্গমিত হবে, যা জনস্বাস্থ্য, জলজ প্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। আদালত বলেন, দূষিত পারদের কারণে স্নায়ুরোগ বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রসঙ্গে আদালত বলেন, 'শুধু সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যাচাই করলে হবে না, বরং জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা বিবেচনা করে তা করতে হবে।'
আদালত সরকারকে এই রায়ের নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ অনুসরণ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অগ্রসর হতে বলেছেন। আদালত বলেন, 'কারণ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু বেআইনি নয়, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের বিরুদ্ধে হুমকির কারণে আমরা উদ্বিগ্ন।' হাইকোর্ট সংবিধানের ১০২ ধারার ক্ষমতাবলে সরকারের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার রাখেন বলে উল্লেখ করেন, যদি ওই উন্নয়ন প্রকল্প জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি এবং আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, 'আমি আশা করি, সরকার উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে হাত দেবে।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল দায়ের করেনি। কাজেই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে এই রায় অনুসরণ করতে হবে।
No comments