কারসাজির কবলে বিড়ি সিগারেটের রাজস্ by ফারজানা লাবনী
বিড়ি-সিগারেট খাতে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে এই খাতে এবার রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই বিপুল ঘাটতির কারণ চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে আদায় বাড়াতে এনবিআরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্র এ তথ্য জানায়। রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে বিড়ি-সিগারেট খাতের কিছু ব্যবসায়ীর জড়িত থাকার কথা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও স্বীকার করেছেন।
এনবিআরের তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে বিড়ি-সিগারেট খাতের প্রবৃদ্ধি তার আগের বছরের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেশি ছিল। গত অর্থবছরে সিগারেট খাত থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়। একই সময়ে বিড়ি খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয় প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বিড়ি-সিগারেট খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম অর্ধে অর্থাৎ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খাত থেকে ছয় হাজার ১০৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার অর্ধেকও হয়নি। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায়ের পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা কম। পৃথক হিসাবে চলতি অর্থবছরে বিড়ি খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মোট ৩০০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা আদায়ের কথা থাকলেও ওই পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৮৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
সিগারেট খাত : রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (মূসক শাখা) বা এলটিইউ (ভ্যাট) শাখা থেকে সিগারেট খাতের রাজস্ব কমার কারণ অনুসন্ধান করে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এলটিইউ (ভ্যাট) শাখার অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুসারে, সিগারেট খাতের বর্তমান জনবল রয়েছে ১৭ হাজার। আটটি বড় মাপের প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই খাতে। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো লিমিটেডের মোট বাজার অংশীদারত্ব ৯৭ শতাংশ। বৃহৎ এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে সিগারেটের চারটি মূল্যস্তর কার্যকর রয়েছে। প্রতিটি মূল্যস্তরের জন্য ভ্যাটের পরিমাণ ১৫ শতাংশ নির্দিষ্ট রয়েছে। মূল্যস্তর ভেদে সম্পূরক শুল্ক ভিন্ন। সম্পূরক শুল্ক প্রথম স্তরে ৩৯ শতাংশ, দ্বিতীয় স্তরে ৫৬ শতাংশ, তৃতীয় স্তরে ৫৯ শতাংশ এবং চতুর্থ স্তরে ৬১ শতাংশ। মূল্য ভিত্তি প্রথম স্তরে ১২ দশমিক ১০ টাকা থেকে ১২ দশমিক ৩০ টাকা, দ্বিতীয় স্তরে ২৪ দশমিক ৭৫ থেকে ২৫ দশমিক ২৫ টাকা, তৃতীয় স্তরে ৩৫ দশমিক ২০ থেকে ৩৯ দশমিক ৫০ টাকা এবং চতুর্থ স্তরে ৬৬ টাকা থেকে তার ওপরে।
মূলত উৎপাদন খরচের তারতম্যের ভিত্তিতে সিগারেটের মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক স্তর নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত সিগারেটে তামাকের পরিমাণ কম-বেশি দেওয়ায় এ উৎপাদন খরচে বড় ধরনের তারতম্য ঘটে। এ ক্ষেত্রে সিগারেট উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান তামাকের ব্যবহারসহ উৎপাদন খরচের ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এই কারসাজিতে উচ্চমূল্য স্তরের সিগারেট এনবিআরের কাছে নিম্ন ধাপের বলা হলেও বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়। এনবিআরের একশ্রেণীর কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কিছু ব্যক্তি মিলে এই কারসাজি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের সর্বশেষ হিসাবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সিগারেট উৎপাদন গড়ে ২৫০ শতাংশ বেড়েছে।
বিড়ি খাত : গত অক্টোবর থেকে এনবিআরের টোব্যাকো সাকসেশন সেল বিড়ি খাতের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় কাজ শুরু করে। কয়েকটি ধাপে এ কাজ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে বিড়ি খাতে শুল্ক ফাঁকির কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিড়ির বাজার পরিস্থিতি, কারখানার পরিবেশ, শ্রমিকের মজুরি ও শারীরিক অবস্থা, বর্তমান নির্ধারিত রাজস্ব এবং ভবিষ্যতে এ খাতের জন্য সহনীয় শুল্ক আরোপের বিষয়টি আনা হয়। সর্বশেষ এ খাতের শ্রমিকদের জন্য বিকল্প পুনর্বাসনের খাতগুলো চিহ্নিত করতে কাজ চলছে।
বিড়িশিল্পে পাঁচ বছর আগে কারখানার সংখ্যা ছিল প্রায় চার শ। কিন্তু বর্তমানে শ্রমিক সংকটসহ অন্যান্য কারণে কারখানার সংখ্যা কমে ১৮১টি হয়েছে। পাঁচ বছর আগে শ্রমিকের সংখ্যা ২১ লাখ থাকলেও বর্তমানে তা সাত লাখ। বিড়ি খাতে রয়েছে আকিজ বিড়ি, কারিকর বিড়ি, নাসির গ্রুপ, রংপুর বিড়িসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান।
টোব্যাকো সাকসেশন সেলের প্রতিবেদন অনুসারে, বিড়ি খাতে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয় মূলত ব্যান্ড রোল বা স্ট্যাম্প পুনঃব্যবহার, নকল স্ট্যাম্প বা নকল ব্যান্ড রোল ব্যবহারের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বিড়ির প্যাকেটে কাগজের যে পাতলা আবরণ ফিতার মতো জড়ানো থাকে, তা অসাধু ব্যবসায়ীরা একবার ব্যবহারের সরকারি নির্দেশ না মেনে একাধিকবার ব্যবহার করে। আবার বিড়ি খাতের অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নকল ব্যান্ড রোল ব্যবহার করে থাকে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এনবিআরের লোকবল সংকটের কারণে বিভিন্ন দোকানে ঘুরে প্রকৃত ব্যান্ড রোল ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা যাচাই করা সম্ভব হয় না। ব্যান্ড রোল পুনঃব্যবহারের তুলনায় নকল ব্যান্ড রোলের ব্যবহার বেশি হয়।
অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ বিড়ি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং কারিকর বিড়ি ফ্যাক্টরি লিমিটেডের পরিচালক ভানু লাল দেব। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ভালো-মন্দ সবখানেই আছে। বিড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেকেই শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে। তার মানে এই নয় যে সবাই ফাঁকি দিচ্ছে। ব্যান্ড রোল ও স্ট্যাম্প পুনঃব্যবহার, নকল স্ট্যাম্প ও নকল ব্যান্ড রোল ব্যবহারের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। অনেকে রাজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে বলেও জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।
তিনি আরো বলেন, নিম্নমানের সিগারেট বাজারে আসায় বিড়ির বাজার কমছে। এ খাতের শ্রমিকদের বর্তমান মজুরি প্রতি হাজার শলাকায় ৩৬ টাকা। এ ব্যবসায় শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও এ খাতে শ্রমিকসংখ্যা ২০ লাখের বেশি ছিল। বর্তমানে তা ১০ লাখেরও কম।
এনবিআরের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানায় বা বাড়িতে বসেই অনেকে বিড়ি তৈরির কাজ করে। সাধারণত একই পরিবারের সদস্যরা পর্যায়ক্রমে এ খাতের শ্রমিক হিসেবে থাকে। দীর্ঘদিন এ কাজে জড়িতদের মারাত্মক স্বাস্থ্যহানি ঘটে। এক পর্যায়ে এসব শ্রমিক অন্য কোনো খাতে কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অথচ বিড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিও দেয় না।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিড়ি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর- এই কারণ উল্লেখ করে প্রতিবছরই এ খাতকে নিরুৎসাহিত করতে বাজেটে সম্পূরক শুল্ক ও ভিত্তিমূল্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে রাজস্ব আদায়কারী সরকারি এই সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিড়ি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেন। তাঁরা বিড়ি শ্রমিকের দোহাই দিয়ে নানা আন্দোলন সংগ্রামে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে থাকেন। বিভিন্নভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এসব ব্যক্তিকে বিড়ি কারখানার শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে বিড়িশিল্পে মূসক (মূল্য সংযোজন কর) বা ভ্যাট ১৫ শতাংশ। সম্পূরক শুল্ক ফিল্টারযুক্ত বিড়িতে ২৫ শতাংশ এবং ফিল্টার ছাড়া ২০ শতাংশ। ট্যারিফ ভ্যালু আট শলাকার প্যাকেটে ১.০১ টাকা, ১২ শলাকার প্যাকেটে ১.৫১ টাকা এবং ২৫ শলাকার প্যাকেটে ৩.১৫ টাকা।
এনবিআরের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাতের মধ্যে অন্যতম বিড়ি ও সিগারেট খাত। এসব খাতে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। অসাধু উদ্যোক্তাদের নানা রকম অপকৌশল আছে এই রাজস্ব ফাঁকিতে। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এনবিআরের কোনো অসাধু কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনবিআরের তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে বিড়ি-সিগারেট খাতের প্রবৃদ্ধি তার আগের বছরের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেশি ছিল। গত অর্থবছরে সিগারেট খাত থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়। একই সময়ে বিড়ি খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয় প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বিড়ি-সিগারেট খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম অর্ধে অর্থাৎ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খাত থেকে ছয় হাজার ১০৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার অর্ধেকও হয়নি। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায়ের পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা কম। পৃথক হিসাবে চলতি অর্থবছরে বিড়ি খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মোট ৩০০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা আদায়ের কথা থাকলেও ওই পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৮৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
সিগারেট খাত : রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (মূসক শাখা) বা এলটিইউ (ভ্যাট) শাখা থেকে সিগারেট খাতের রাজস্ব কমার কারণ অনুসন্ধান করে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এলটিইউ (ভ্যাট) শাখার অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুসারে, সিগারেট খাতের বর্তমান জনবল রয়েছে ১৭ হাজার। আটটি বড় মাপের প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই খাতে। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো লিমিটেডের মোট বাজার অংশীদারত্ব ৯৭ শতাংশ। বৃহৎ এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে সিগারেটের চারটি মূল্যস্তর কার্যকর রয়েছে। প্রতিটি মূল্যস্তরের জন্য ভ্যাটের পরিমাণ ১৫ শতাংশ নির্দিষ্ট রয়েছে। মূল্যস্তর ভেদে সম্পূরক শুল্ক ভিন্ন। সম্পূরক শুল্ক প্রথম স্তরে ৩৯ শতাংশ, দ্বিতীয় স্তরে ৫৬ শতাংশ, তৃতীয় স্তরে ৫৯ শতাংশ এবং চতুর্থ স্তরে ৬১ শতাংশ। মূল্য ভিত্তি প্রথম স্তরে ১২ দশমিক ১০ টাকা থেকে ১২ দশমিক ৩০ টাকা, দ্বিতীয় স্তরে ২৪ দশমিক ৭৫ থেকে ২৫ দশমিক ২৫ টাকা, তৃতীয় স্তরে ৩৫ দশমিক ২০ থেকে ৩৯ দশমিক ৫০ টাকা এবং চতুর্থ স্তরে ৬৬ টাকা থেকে তার ওপরে।
মূলত উৎপাদন খরচের তারতম্যের ভিত্তিতে সিগারেটের মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক স্তর নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত সিগারেটে তামাকের পরিমাণ কম-বেশি দেওয়ায় এ উৎপাদন খরচে বড় ধরনের তারতম্য ঘটে। এ ক্ষেত্রে সিগারেট উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান তামাকের ব্যবহারসহ উৎপাদন খরচের ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এই কারসাজিতে উচ্চমূল্য স্তরের সিগারেট এনবিআরের কাছে নিম্ন ধাপের বলা হলেও বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়। এনবিআরের একশ্রেণীর কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কিছু ব্যক্তি মিলে এই কারসাজি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের সর্বশেষ হিসাবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সিগারেট উৎপাদন গড়ে ২৫০ শতাংশ বেড়েছে।
বিড়ি খাত : গত অক্টোবর থেকে এনবিআরের টোব্যাকো সাকসেশন সেল বিড়ি খাতের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় কাজ শুরু করে। কয়েকটি ধাপে এ কাজ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে বিড়ি খাতে শুল্ক ফাঁকির কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিড়ির বাজার পরিস্থিতি, কারখানার পরিবেশ, শ্রমিকের মজুরি ও শারীরিক অবস্থা, বর্তমান নির্ধারিত রাজস্ব এবং ভবিষ্যতে এ খাতের জন্য সহনীয় শুল্ক আরোপের বিষয়টি আনা হয়। সর্বশেষ এ খাতের শ্রমিকদের জন্য বিকল্প পুনর্বাসনের খাতগুলো চিহ্নিত করতে কাজ চলছে।
বিড়িশিল্পে পাঁচ বছর আগে কারখানার সংখ্যা ছিল প্রায় চার শ। কিন্তু বর্তমানে শ্রমিক সংকটসহ অন্যান্য কারণে কারখানার সংখ্যা কমে ১৮১টি হয়েছে। পাঁচ বছর আগে শ্রমিকের সংখ্যা ২১ লাখ থাকলেও বর্তমানে তা সাত লাখ। বিড়ি খাতে রয়েছে আকিজ বিড়ি, কারিকর বিড়ি, নাসির গ্রুপ, রংপুর বিড়িসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান।
টোব্যাকো সাকসেশন সেলের প্রতিবেদন অনুসারে, বিড়ি খাতে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয় মূলত ব্যান্ড রোল বা স্ট্যাম্প পুনঃব্যবহার, নকল স্ট্যাম্প বা নকল ব্যান্ড রোল ব্যবহারের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বিড়ির প্যাকেটে কাগজের যে পাতলা আবরণ ফিতার মতো জড়ানো থাকে, তা অসাধু ব্যবসায়ীরা একবার ব্যবহারের সরকারি নির্দেশ না মেনে একাধিকবার ব্যবহার করে। আবার বিড়ি খাতের অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নকল ব্যান্ড রোল ব্যবহার করে থাকে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এনবিআরের লোকবল সংকটের কারণে বিভিন্ন দোকানে ঘুরে প্রকৃত ব্যান্ড রোল ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা যাচাই করা সম্ভব হয় না। ব্যান্ড রোল পুনঃব্যবহারের তুলনায় নকল ব্যান্ড রোলের ব্যবহার বেশি হয়।
অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ বিড়ি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং কারিকর বিড়ি ফ্যাক্টরি লিমিটেডের পরিচালক ভানু লাল দেব। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ভালো-মন্দ সবখানেই আছে। বিড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেকেই শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে। তার মানে এই নয় যে সবাই ফাঁকি দিচ্ছে। ব্যান্ড রোল ও স্ট্যাম্প পুনঃব্যবহার, নকল স্ট্যাম্প ও নকল ব্যান্ড রোল ব্যবহারের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। অনেকে রাজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে বলেও জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।
তিনি আরো বলেন, নিম্নমানের সিগারেট বাজারে আসায় বিড়ির বাজার কমছে। এ খাতের শ্রমিকদের বর্তমান মজুরি প্রতি হাজার শলাকায় ৩৬ টাকা। এ ব্যবসায় শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও এ খাতে শ্রমিকসংখ্যা ২০ লাখের বেশি ছিল। বর্তমানে তা ১০ লাখেরও কম।
এনবিআরের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানায় বা বাড়িতে বসেই অনেকে বিড়ি তৈরির কাজ করে। সাধারণত একই পরিবারের সদস্যরা পর্যায়ক্রমে এ খাতের শ্রমিক হিসেবে থাকে। দীর্ঘদিন এ কাজে জড়িতদের মারাত্মক স্বাস্থ্যহানি ঘটে। এক পর্যায়ে এসব শ্রমিক অন্য কোনো খাতে কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অথচ বিড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিও দেয় না।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিড়ি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর- এই কারণ উল্লেখ করে প্রতিবছরই এ খাতকে নিরুৎসাহিত করতে বাজেটে সম্পূরক শুল্ক ও ভিত্তিমূল্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে রাজস্ব আদায়কারী সরকারি এই সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিড়ি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেন। তাঁরা বিড়ি শ্রমিকের দোহাই দিয়ে নানা আন্দোলন সংগ্রামে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে থাকেন। বিভিন্নভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এসব ব্যক্তিকে বিড়ি কারখানার শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে বিড়িশিল্পে মূসক (মূল্য সংযোজন কর) বা ভ্যাট ১৫ শতাংশ। সম্পূরক শুল্ক ফিল্টারযুক্ত বিড়িতে ২৫ শতাংশ এবং ফিল্টার ছাড়া ২০ শতাংশ। ট্যারিফ ভ্যালু আট শলাকার প্যাকেটে ১.০১ টাকা, ১২ শলাকার প্যাকেটে ১.৫১ টাকা এবং ২৫ শলাকার প্যাকেটে ৩.১৫ টাকা।
এনবিআরের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খাতের মধ্যে অন্যতম বিড়ি ও সিগারেট খাত। এসব খাতে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। অসাধু উদ্যোক্তাদের নানা রকম অপকৌশল আছে এই রাজস্ব ফাঁকিতে। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এনবিআরের কোনো অসাধু কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
No comments