স্মরণ-চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন by ফখরে আলম
ঘুষ-দুর্নীতি আছে, প্রতারণা আছে, ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা আছে, সবজিক্ষেতে পোকার আক্রমণ আছে, বাল্যবিয়ে, যৌতুক আছে, অফিস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা আছে; কিন্তু এসব নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখার সেই চারণ সাংবাদিক মোনজাতউদ্দিন নেই।
১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি এক দুর্ঘটনায় মারা যান। নৌপথের নির্দিষ্ট একটি এলাকায় কেন বারবার দুর্ঘটনা ঘটে- এ বিষয়টির অনুসন্ধান করতে গিয়ে কর্তব্যরত অবস্থায় ফেরি থেকে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়। কেউ কেউ মনে করেন, তাঁর মৃত্যু রহস্যজনক। মোনাজাতউদ্দিন দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক জনকণ্ঠে কাজ করেছেন। দীর্ঘ সময় সংবাদে কাজ করার কারণে তিনি সংবাদের মোনাজাতউদ্দিন হিসেবেই পরিচিত। গ্রামীণ জনপদ থেকে তিনি শত শত খবর লিখেছেন। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প হাজার হাজার পাঠককে শুনিয়েছেন। মফস্বলের সাংবাদিকতার খোলস ছিঁড়ে সততা, মেধা আর সৃজনশীলতায় জাতীয় সাংবাদিকের মুকুট পরেছেন। আর মফস্বল সাংবাদিকতাকে তিনি নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন। সংবাদ লেখার পাশাপাশি তিনি কবিতা, গল্প ও নাটক লিখেছেন। লিখেছেন ১০টি গ্রন্থ। পথ থেকে পথে, গ্রামীণ পর্যায় থেকে, পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ উল্লেখযোগ্য। পরিব্রাজকের মতো তিনি সারা দেশ ভ্রমণ করে খবর লিখেছেন। রাতে ঈশ্বরদী প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করে তিনি ভাসমান মানুষের কথা লিখেছেন। পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে কুমিল্লা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে খুব কাছ থেকে দেখে হাসপাতালের ওষুধ চুরি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছেন। বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদে মোনাজাতউদ্দিন সেখানকার নারীর জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। বাল্যবিয়ে, যৌতুক ও নারী নির্যাতনের ভয়াবহ গল্প শুনিয়েছেন। কর্মরত অবস্থায় মাসে ৩০ দিনই তাঁর খবর ছাপা হয়েছে। এর পাশাপাশি খবরের ফলোআপ তুলে ধরে তিনি পাঠকের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন। জীবন বাজি রেখে তিনি খবর সংগ্রহ করেছেন। সেই খবরের জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছেন। আশির দশকে আমার যখন সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি তখন মোনাজাতউদ্দিন পতিতালয়ের খবর সংগ্রহের জন্য যশোর এসেছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এরপর আমি তাঁর সব খবরই পড়েছি। গ্রামের খবর আমিও দু-চারটি লিখি। নাট্যকার মামুনুর রশীদ, গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানসহ আরো অনেকে বলেন, 'ফখরে আলম তুমি আরেকজন মোনাজাতউদ্দিন।' তখন আমার মাথা নিচু হয়। আমি অবনত হয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে মোনাজাতউদ্দিনকে স্মরণ করি। আমার কাছে বারবার মনে হয়, কাজের মধ্য দিয়ে মোনাজাতউদ্দিন একজন মোনাজাতউদ্দিন হয়েছেন। এখন কেউ বেশি কিছু হতে চাইলে তাঁকে মোনাজাতউদ্দিনই হতে হবে। এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।
ফখরে আলম
ফখরে আলম
No comments