তাদের জন্য ভালোবাসা by আশরাফ উল্লাহ

নির্মমতা আর স্নেহের পরশ। মানুষের এপিঠ-ওপিঠ দেখল তিন ব্যাঘ্রশাবক ও বাঘিনী। একদল লোভাতুর দৃষ্টিতে আঘাত হেনেছে। আরেক দল চালাচ্ছে তাদের বাঁচানোর নিরন্তর সংগ্রাম। এই চার প্রাণীর বসবাস এখন কক্সবাজারের ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে।
১.এক পা নেই। তিন পায়ে চলে। লাফালাফি করলেই ক্ষত পায়ে ঝরে রক্ত। কিন্তু হুংকার, গর্জনে একেবারে বন্য। খাঁচার পাশে আগন্তুকের দেখা পেলেই তেড়ে আসে। থাবা বের করে ধরতে চায়। তর্জন-গর্জনে ভড়কে দেয়। পরক্ষণে আবার মিইয়ে যায়। শুয়ে পড়ে। তবে খাঁচার পাশের আগন্তুকের দিকে নজর রাখে ঠিকই। বলছিলাম তিন পায়ের সেই বাঘিনীর কথা। সাফারি পার্কে আমরা পৌঁছাই দুপুরের দিকে। চট্টগ্রাম শহর থেকে সকালে রওনা দিয়ে পার্কে পৌঁছাতেই বেলা গড়িয়ে গেল অর্ধেকে। তখন সূর্য মধ্য গগনে। উঁচু উঁচু গর্জনগাছের ফাঁক গলে ছিটকে পড়ছে রোদ। খোঁজ নিলাম তিন পায়ের বাঘিনীর। কেমন আছে বাঘিনী? পার্কের ভেতরের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে খাঁচার সামনে যেতেই হালুম। গর্জন দিয়ে তেড়ে এসে শুরু করে ছোটাছুটি। এ নিয়ে পার্কের দর্শনার্থীদের আগ্রহও বেশ। পার্কের বাঘের বেষ্টনীর কাছে গেলে গর্জন শুনে থমকে দাঁড়াচ্ছেন অনেকে। উৎসুক হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খোঁজেন গর্জনের কেন্দ্রস্থল। কেউ কেউ খাঁচার পাশে গিয়ে কাটিয়ে আসেন কিছু সময়।
কৌতূহলী ও আগ্রহী পাঠকের মনে থাকার কথা—এ বছরের ১৬ জানুয়ারি সুন্দরবনের কাছে খুলনার কয়রা উপজেলায় খাসিটানা গ্রামে লোকালয় থেকে উদ্ধার করা হয় এক বাঘিনীকে। মিঠা পানি আর খাবারের খোঁজে গ্রামে ঢুকে পড়েছিল সে। পায়ে শিকারির কোপের দগদগে ক্ষত, মুমূর্ষু অবস্থা। আশ্রয় নেয় একটি ঘরে। ঘরের লোকজন দরজা বন্ধ করে দিয়ে খবর দেয় বন বিভাগে। বাঘ পেলেই পিটিয়ে মারে লোকজন, এটাই জানা কথা। তবে এবার ছিল ব্যতিক্রম। মাংসের নেশায় নয়, নিতান্ত আশ্রয়ের জন্য এসেছিল। মানুষও তাই অন্য রকম, মারমুখী ছিল না। বাঘ তেড়ে আসেনি, লোকজনও ছিল শান্ত। এরপর কত কিছুই তো হয়ে গেল। ঢাকা হয়ে সাফারি পার্কে ঠাঁই হলো বাঘিনীর। এখন ভালোই কাটছে তার দিন। বনের বাঘ খাঁচাবন্দী হলেও তার স্বভাবসুলভ আচরণই করছে। হুংকার ছাড়ে, শিকার ধরতে চায়। সুন্দরবনের পরিবেশ নেই, তাতেও তার আস্ফাালন।
পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন জাহেদ মো. মালেকুর রহমান জানালেন, বাঘিনী আর হয়তো বনে ফিরতে পারবে না। এখানেই শেষ আশ্রয়। কারণ, শিকার ধরার মতো শক্তি তার নেই। পায়ের ক্ষতটি বেশ গভীর। শিকারি কোপটা এমনভাবে দিয়েছে, আর একটু হলে সে মারাই পড়ত। তা ছাড়া বাঘিনী এখনো প্রজনন না করলেও তাকে দিয়ে প্রজননও হয়তো করানো সম্ভব হবে না।
২.
সাফারি পার্কের হাসপাতালের বেষ্টনীতে খেলছে তিন ভাইবোন—জুঁই, জ্যোতি আর জয়। এই তিন ব্যাঘ্রশাবক পড়েছিল পাচারকারীর কবলে। এ অল্প বয়সে সইতে হয়েছে বিরাট ধকল। জন্মের পর মায়ের কোলছাড়া। বনের পরিবেশ ছেড়ে খাঁচাবন্দী হয়ে সুন্দরবন থেকে ঢাকার শ্যামলী। হয়তো কোনো এক ফাঁকে পাচারও হয়ে যেত। বাদ সাধল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গত ১১ জুন পাচারকারীর কবল মুক্ত হলো তিন ভাইবোন। কিন্তু তত দিনে খাঁচাবন্দী আর পরিচর্যার অভাবে প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে এল সাফারি পার্কে। পরম মমতায় তাদের সুস্থ করে তুলেছেন পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন জাহেদ মো. মালেকুর রহমান ও তাঁর দল। ব্যাঘ্রশাবকগুলো এখন পরিণত বাঘ। বয়স সাড়ে সাত মাস।
ভেটেরিনারি সার্জন জাহেদ বলেন, ‘বন্য প্রাণীরা আমাদের শত্রু নয়। তার পরও কিছু লোভী মানুষ থাবা ফেলে এদের ওপর। স্নেহ পেলে প্রাণীরা আপনজন ঠিকই চিনে নেয়। কাছে গেলে মমতার পরশ পেতে উন্মুখ হয়ে থাকে। আসুন, তাদের জন্য ভালোবাসার হাত বাড়াই।’

No comments

Powered by Blogger.