সাংসদেরা এলাকামুখী, কোরাম নিয়ে হিমশিম সংসদীয় কমিটির
নবম জাতীয় সংসদে সংসদীয় কমিটিগুলো যে গতিতে কাজ শুরু করেছিল, সেই গতি এখন আর নেই। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় বেশির ভাগ সাংসদ এখন এলাকামুখী। কমে যাচ্ছে বৈঠকে উপস্থিতির হার। কোরাম মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রায়ই। বৈঠক বাতিলের ঘটনাও ঘটছে।
গত ছয় মাসের হিসাব নিয়ে দেখা গেছে, আট থেকে ১৫ সদস্যের কমিটিতে ইদানীং বেশির ভাগ বৈঠকে তিন-চারজনের বেশি উপস্থিত থাকছেন না। ডিসেম্বরের হিসাবে দেখা গেছে, এ মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত বিভিন্ন কমিটি মোট ১৮টি বৈঠক করেছে। বৈঠকে উপস্থিতির হার গড়ে সাড়ে চারজন। নভেম্বরে বৈঠক হয়েছে ৩১টি। সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল সাড়ে পাঁচজনের কিছু বেশি। অক্টোবরে বৈঠক হয়েছে মাত্র ১৯টি। সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছয়জন। অথচ তার আগের ছয় মাসে গড়ে ৪৬টি করে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল আটজনের বেশি। ইদানীং মন্ত্রীরাও বৈঠকে কম আসেন। ডিসেম্বরে অন্তত ছয়টি বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী অনুপস্থিত ছিলেন।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, গত তিন মাসে বেশ কয়েকবার বৈঠকের জন্য কমিটির সভাপতিদের কোরাম মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য, মহিলা ও শিশু, মুক্তিযুদ্ধ, তথ্য ও যোগাযোগ, আইন, প্রতিশ্রুতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়বিষয়ক কমিটির বৈঠকে সদস্যদের উপস্থিতি ছিল তিন থেকে চারজন। সরকারি হিসাবে কমিটির সদস্যসংখ্যা ১৫ হলেও ২৩ ডিসেম্বরের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাত্র পাঁচজন।
২৬ নভেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) বিল পরীক্ষার জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কমিটিকে কোরাম সংকটে পড়তে হয়েছিল। কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভূঁইয়া এবং সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম (জ্যাকব) ছাড়া আর কোনো সদস্য ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ২৮ নভেম্বর বৈঠক ডেকে বিল পরীক্ষা করতে হয়েছে।
আবার গত অধিবেশনে কমিটি পুনর্গঠনের পর থেকে বস্ত্র ও পাট, পররাষ্ট্র ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদও খালি রয়েছে।
সর্বাধিক বৈঠক: তার পরও বৈঠকের ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ অতীতের যেকোনো সংসদকে ছাড়িয়ে গেছে। সবগুলো কমিটি এখন পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি বৈঠক করেছে। যদিও কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী মাত্র পাঁচটি কমিটি নিয়মিত বৈঠক করতে পেরেছে।
সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সংসদের সর্বশেষ ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৭ মাসে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ-সম্পর্কিত ৪৩টি কমিটি এক হাজার ৫০০টির মতো বৈঠক করেছে। সংসদবিষয়ক কমিটিগুলোর বৈঠক হয়েছে ৫৯টি।
বর্তমান সংসদের যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। বেশির ভাগ কমিটি গঠন হয়েছিল এক মাসের মধ্যেই। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২৪৮ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মাসে অন্ততপক্ষে একটি বৈঠক করবে। এই হিসাবে নিয়মিত বৈঠকে করেছে সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত কমিটি ১০৩টি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি ৭১টি, আইন মন্ত্রণালয় ৬০টি, অর্থ মন্ত্রণালয় ৫১টি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় -সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ৫২টি। অন্যদিকে সবচেয়ে কম বৈঠক করেছে পররাষ্ট্র ১৪টি এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি ১৮টি।
বিশেষ কমিটির মধ্যে পিটিশন, বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত ও কার্যপ্রণালি বিধি-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি ৪৭ মাসে একটি বৈঠকও করেনি। তিনটি কমিটিরই সভাপতি পদাধিকারবলে সংসদের স্পিকার।
এর আগে অষ্টম সংসদ যাত্রা শুরু করেছিল ২০০১ সালের ২৫ অক্টোবর। কমিটি গঠন হয়েছিল ১৮ মাস পরে ২০০৩ সালের মে মাসে সপ্তম অধিবেশনে। তখন সব মিলিয়ে কমিটির বৈঠক হয়েছিল এক হাজার ২৪২টি। সর্বোচ্চ ৪৬টি বৈঠক করেছিল আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি।
মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিভাগ-সম্পর্কিত কমিটিগুলো এবার আনুমানিক সাত হাজারের বেশি সুপারিশ করেছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের মতে, সুপারিশ বাস্তবায়নের হার ৪০ শতাংশের বেশি। সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রথম তিন বছর কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কমিটির বিরোধ দেখা দিয়েছিল। এ নিয়ে কমিটির সভাপতিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছেও নালিশ করেছিলেন। বর্তমানে কমিটির সভাপতিরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রহমত আলী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারকে সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করার জন্য সংবিধানে আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে। নির্বাহী বিভাগ নিজেদের স্বার্থে আইনটি করেনি। যত দিন না এ আইন হবে তত দিন কমিটির কথা সরকার শুনবে না। সুপারিশ আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শওকত মোমেন শাহজাহান বলেন, মন্ত্রণালয় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে থাকে।
বিতর্কিত সুপারিশ ও বিধি পরিপন্থী সদস্য: কার্যপ্রণালি বিধির ১৮৮ ধারা মোতাবেক কোনো কমিটিতে সাংসদের আর্থিক, প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচিত হতে পারে, এমন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো সাংসদকে ওই কমিটির সদস্য করা যাবে না। ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে আবাসন ব্যবসায়ী সাংসদ নসরুল হামিদ ও এনামুল হককে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবহন খাতের ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় শেখ মুজিবুর রহমানকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তবে এখনো বেশ কয়েকজন সাংসদ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কমিটিতে সভাপতি অথবা সদস্য আছেন। পারিবারিকভাবে নৌপরিবহন ব্যবসা থাকলেও নূর-ই-আলম চৌধুরী নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি। লঞ্চমালিক গোলাম কিবরিয়া একই কমিটির সদস্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির সদস্য নাজমুল হাসান আগে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। একই কমিটির সদস্য আমান উল্লাহ হূদেরাগ হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। ওই হাসপাতালের কেনাকাটায় অনিয়ম তদন্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ছাড় দিয়ে প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগ রয়েছে।
আকিজ গ্রুপের অংশীদার শেখ আফিল উদ্দিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় -সম্পর্কিত কমিটির সদস্য। সংসদীয় কমিটিতে ভারত থেকে পুরোনো ট্রাক আমদানির প্রস্তাব করে কমিটির বৈঠকেই তিনি তীব্র সমালোচিত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য হয়েও আবদুল মতিন খসরু, ফজলে রাব্বি মিয়া, ফজলে নূর (তাপস), ফজিলাতুন নেসা ও নুরুল ইসলাম আইন পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে সাংসদদের জন্য কোটা রাখার সুপারিশ করে সমালোচিত হয়। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তা বাতিল হয়।
ইতিবাচক দিক: কমিটিগুলো বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক সুপারিশও করেছে। কয়েকটি কমিটি বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য প্রথমবারের মতো নাগরিক সমাজের লোকজনকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানায়। সরকারি হিসাব কমিটির অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির সুপারিশের মাধ্যমে সরকারের প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এই কমিটি প্রায় ১৮ বছর পর নির্বাহী বিভাগের কাছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের হিসাবও তলব করেছে।
আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির প্রচেষ্টায় হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইনে পরিণত হয়েছে। আমলাদের ছাড় দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনের বিল আনার পর এই কমিটির আপত্তিতে তা থেমে যায়। সংসদীয় কমিটির কাছে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদ মেনে খসড়া আইন প্রণীত হলেও মন্ত্রীদের বিরোধিতায় তা আইনে পরিণত হয়নি। মানসম্মত ওষুধ তৈরি করে না, এমন ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি।
জানতে চাইলে স্পিকার আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সংসদীয় রীতিতে মন্ত্রণালয়ের কাছে কমিটির সুপারিশ ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যে কারণে কমিটিগুলো আক্ষরিক অর্থে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, বিদ্যমান আইনে সংসদীয় কমিটিকে কার্যকর করার জন্য সরকার কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে। কমিটির পরামর্শ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সভা এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠকে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সচিবরা যেভাবে বুঝিয়ে থাকেন, মন্ত্রীরা সে অনুযায়ী কাজ করে থাকেন।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, গত তিন মাসে বেশ কয়েকবার বৈঠকের জন্য কমিটির সভাপতিদের কোরাম মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য, মহিলা ও শিশু, মুক্তিযুদ্ধ, তথ্য ও যোগাযোগ, আইন, প্রতিশ্রুতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়বিষয়ক কমিটির বৈঠকে সদস্যদের উপস্থিতি ছিল তিন থেকে চারজন। সরকারি হিসাবে কমিটির সদস্যসংখ্যা ১৫ হলেও ২৩ ডিসেম্বরের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাত্র পাঁচজন।
২৬ নভেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) বিল পরীক্ষার জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কমিটিকে কোরাম সংকটে পড়তে হয়েছিল। কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভূঁইয়া এবং সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম (জ্যাকব) ছাড়া আর কোনো সদস্য ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ২৮ নভেম্বর বৈঠক ডেকে বিল পরীক্ষা করতে হয়েছে।
আবার গত অধিবেশনে কমিটি পুনর্গঠনের পর থেকে বস্ত্র ও পাট, পররাষ্ট্র ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদও খালি রয়েছে।
সর্বাধিক বৈঠক: তার পরও বৈঠকের ক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ অতীতের যেকোনো সংসদকে ছাড়িয়ে গেছে। সবগুলো কমিটি এখন পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি বৈঠক করেছে। যদিও কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী মাত্র পাঁচটি কমিটি নিয়মিত বৈঠক করতে পেরেছে।
সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সংসদের সর্বশেষ ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৭ মাসে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ-সম্পর্কিত ৪৩টি কমিটি এক হাজার ৫০০টির মতো বৈঠক করেছে। সংসদবিষয়ক কমিটিগুলোর বৈঠক হয়েছে ৫৯টি।
বর্তমান সংসদের যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি। বেশির ভাগ কমিটি গঠন হয়েছিল এক মাসের মধ্যেই। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২৪৮ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মাসে অন্ততপক্ষে একটি বৈঠক করবে। এই হিসাবে নিয়মিত বৈঠকে করেছে সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত কমিটি ১০৩টি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি ৭১টি, আইন মন্ত্রণালয় ৬০টি, অর্থ মন্ত্রণালয় ৫১টি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় -সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ৫২টি। অন্যদিকে সবচেয়ে কম বৈঠক করেছে পররাষ্ট্র ১৪টি এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি ১৮টি।
বিশেষ কমিটির মধ্যে পিটিশন, বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত ও কার্যপ্রণালি বিধি-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি ৪৭ মাসে একটি বৈঠকও করেনি। তিনটি কমিটিরই সভাপতি পদাধিকারবলে সংসদের স্পিকার।
এর আগে অষ্টম সংসদ যাত্রা শুরু করেছিল ২০০১ সালের ২৫ অক্টোবর। কমিটি গঠন হয়েছিল ১৮ মাস পরে ২০০৩ সালের মে মাসে সপ্তম অধিবেশনে। তখন সব মিলিয়ে কমিটির বৈঠক হয়েছিল এক হাজার ২৪২টি। সর্বোচ্চ ৪৬টি বৈঠক করেছিল আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি।
মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিভাগ-সম্পর্কিত কমিটিগুলো এবার আনুমানিক সাত হাজারের বেশি সুপারিশ করেছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের মতে, সুপারিশ বাস্তবায়নের হার ৪০ শতাংশের বেশি। সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রথম তিন বছর কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কমিটির বিরোধ দেখা দিয়েছিল। এ নিয়ে কমিটির সভাপতিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছেও নালিশ করেছিলেন। বর্তমানে কমিটির সভাপতিরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রহমত আলী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারকে সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করার জন্য সংবিধানে আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে। নির্বাহী বিভাগ নিজেদের স্বার্থে আইনটি করেনি। যত দিন না এ আইন হবে তত দিন কমিটির কথা সরকার শুনবে না। সুপারিশ আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শওকত মোমেন শাহজাহান বলেন, মন্ত্রণালয় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে থাকে।
বিতর্কিত সুপারিশ ও বিধি পরিপন্থী সদস্য: কার্যপ্রণালি বিধির ১৮৮ ধারা মোতাবেক কোনো কমিটিতে সাংসদের আর্থিক, প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচিত হতে পারে, এমন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো সাংসদকে ওই কমিটির সদস্য করা যাবে না। ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে আবাসন ব্যবসায়ী সাংসদ নসরুল হামিদ ও এনামুল হককে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবহন খাতের ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় শেখ মুজিবুর রহমানকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তবে এখনো বেশ কয়েকজন সাংসদ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কমিটিতে সভাপতি অথবা সদস্য আছেন। পারিবারিকভাবে নৌপরিবহন ব্যবসা থাকলেও নূর-ই-আলম চৌধুরী নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি। লঞ্চমালিক গোলাম কিবরিয়া একই কমিটির সদস্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির সদস্য নাজমুল হাসান আগে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। একই কমিটির সদস্য আমান উল্লাহ হূদেরাগ হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। ওই হাসপাতালের কেনাকাটায় অনিয়ম তদন্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ছাড় দিয়ে প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগ রয়েছে।
আকিজ গ্রুপের অংশীদার শেখ আফিল উদ্দিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় -সম্পর্কিত কমিটির সদস্য। সংসদীয় কমিটিতে ভারত থেকে পুরোনো ট্রাক আমদানির প্রস্তাব করে কমিটির বৈঠকেই তিনি তীব্র সমালোচিত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য হয়েও আবদুল মতিন খসরু, ফজলে রাব্বি মিয়া, ফজলে নূর (তাপস), ফজিলাতুন নেসা ও নুরুল ইসলাম আইন পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে সাংসদদের জন্য কোটা রাখার সুপারিশ করে সমালোচিত হয়। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তা বাতিল হয়।
ইতিবাচক দিক: কমিটিগুলো বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক সুপারিশও করেছে। কয়েকটি কমিটি বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য প্রথমবারের মতো নাগরিক সমাজের লোকজনকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানায়। সরকারি হিসাব কমিটির অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির সুপারিশের মাধ্যমে সরকারের প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এই কমিটি প্রায় ১৮ বছর পর নির্বাহী বিভাগের কাছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের হিসাবও তলব করেছে।
আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির প্রচেষ্টায় হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইনে পরিণত হয়েছে। আমলাদের ছাড় দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন সংশোধনের বিল আনার পর এই কমিটির আপত্তিতে তা থেমে যায়। সংসদীয় কমিটির কাছে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদ মেনে খসড়া আইন প্রণীত হলেও মন্ত্রীদের বিরোধিতায় তা আইনে পরিণত হয়নি। মানসম্মত ওষুধ তৈরি করে না, এমন ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটি।
জানতে চাইলে স্পিকার আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সংসদীয় রীতিতে মন্ত্রণালয়ের কাছে কমিটির সুপারিশ ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যে কারণে কমিটিগুলো আক্ষরিক অর্থে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, বিদ্যমান আইনে সংসদীয় কমিটিকে কার্যকর করার জন্য সরকার কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে। কমিটির পরামর্শ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সভা এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠকে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সচিবরা যেভাবে বুঝিয়ে থাকেন, মন্ত্রীরা সে অনুযায়ী কাজ করে থাকেন।
No comments