জনসংখ্যাধিক্য-ট্রাম্পকার্ড থেকে উদ্বেগে by একেএম নূর-উন-নবী

এক সময় যে সংখ্যাধিক্যতা আমাদের শক্তি জুগিয়েছিল, এখন তা সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সন্তান জন্মদানের যে বয়স, দলে দলে নারী-পুরুষ তাতে প্রবেশ করছে এবং তা হয়ে থাকছে উদ্বেগের কারণ। অনেকেই এখন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে লক্ষণ।
মূল সমস্যা হচ্ছে অগণিত মানুষ। তাদের জন্য খাদ্য ও জ্বালানির জোগান দিতে হবে। অন্যান্য পণ্য অব্যাহতভাবে সরবরাহ করতে হবে



বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পলিটিক্যাল ডেমোগ্রাফির অবদান শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমার বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছিল। আমরা সবাই জানি, পাকিস্তানের ২৩ বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব 'দেশে বাঙালি সংখ্যাধিক্য'_ এ বিষয়টির ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পরপরই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা শুরু হয়। তখন আমরা বলেছি, দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা। তাদের ওপর অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। উর্দু ভাষা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশেও ক্ষোভ ছিল। কিন্তু আমরা জনসংখ্যাগত সুবিধার কারণে যেভাবে ইস্যুটি সামনে আনতে পেরেছি এবং শুধু পাকিস্তানে নয়, বহির্বিশ্বেও সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছি, সেটা বেলুচিস্তান কিংবা সিল্পুব্দর জনগণ পারেনি। 'বাঙালিরা পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ'_ এ পরিসংখ্যান আমাদের বক্তব্যকে অনেক অনেক শক্তি জুগিয়েছে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ১৬৯টি। বঙ্গবল্পুব্দর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ১৬৭টি আসন লাভ করে এবং এককভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের জন্য তা পর্যাপ্ত ছিল। এভাবেই '৫৬ শতাংশ' আমাদের জন্য বিশেষ সুবিধা এনে দিয়েছিল।
পাকিস্তানের পূর্ব অংশে ৫৬ শতাংশ মানুষকে এক করার পেছনে অন্যতম প্রধান নিয়ামক ছিল ভাষা। যে কোনো গণআন্দোলনে অর্থনৈতিক ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ষাটের দশকে বাঙালি অর্থনীতিবিদরা পাকিস্তানের দুই অংশে বিদ্যমান বৈষম্যের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনীতিতে নানাভাবে পিছিয়ে পড়ছে, এখানের সম্পদ ব্যবহার করে উন্নতি ঘটানো হচ্ছে পিন্ডি-ইসলামাবাদ-করাচির_ এ বক্তব্য রাজনৈতিক অনুষ্ঠান এবং সংবাদপত্র ও সেমিনারে তুলে ধরা হতে থাকে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের ট্রাম্পকার্ড ছিল 'সংখ্যাগরিষ্ঠতা'। আর এ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে এক সূত্রে গেঁথে রেখেছিল ভাষা ও সংস্কৃতি। এটাই ছিল আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি। ভৌগোলিক দূরত্বও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুই অংশের মাঝে অন্য একটি দেশ ভারত_ এমন চিত্র শুধু কৃত্রিম নয়, হাস্যকরও মনে হতো। তবে সবকিছুর পরও বলতে হবে, ডেমোগ্রাফিক ফ্যাক্টর একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রধান নিয়ামক ছিল, এমনটি বিশ্বে ব্যতিক্রম।
স্বাধীনতার সময় আমাদের লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। দলে দলে মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। এমন কোনো গ্রাম-বন্দর-শহর ছিল না, যেখানে এ লড়াইয়ে শামিল হতে বিপুল সংখ্যায় সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষ এগিয়ে আসেনি। এত বিপুল সংখ্যায় স্বাধীনতার জন্য আত্মদানের ঘটনাও সমসাময়িক বিশ্বে বিরল।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার আধিক্য আমাদের শিল্প-কৃষি পণ্যের জন্য ভোক্তাও তৈরি করে। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী বিশ্বের অনেক দেশের মোট লোকসংখ্যার চেয়েও বেশি। আমাদের দেশে উৎপাদক শ্রেণী আছে, ভোক্তাও আছে। আবার অনেক দেশে ভোক্তা আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত উৎপাদক নেই। এ কারণে তাদের আমদানির মাধ্যমেই জরুরি পণ্যের চাহিদা মেটাতে হয়। আমাদের জনসম্পদ তাই উৎপাদক ও ভোক্তা হিসেবেও বড় সম্পদ। কিন্তু এই সম্পদ কীভাবে চার দশকে সংকট হয়ে উঠতে পারল? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আমাদের হাতে কাঁচামাল ছিল, কিন্তু তা থেকে ফিনিশড পণ্য তৈরি করতে পারা গেল না। এ কারণে এ সম্পদ যতটা না শক্তি, তার চেয়ে বেশি হয়ে উঠতে শুরু করেছে যা সেটা হচ্ছে বোঝা। আমাদের জনশক্তির দুটি অংশ রয়েছে। একটি অংশ তুলনামূলক শিক্ষিত ও দক্ষ, আধুনিক বিজ্ঞানপ্রযুক্তি সুবিধা তাদের আয়ত্তে। এদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেশে পর্যাপ্ত, আবার নানা দেশও তাদের পেতে আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেন, গোটা দুনিয়ায় আমাদের শ্রমসম্পদ ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু অন্য দেশগুলো তো কেবল যোগ্য-দক্ষ ও শিক্ষিতদের নেবে। বস্তিবাসীকে গ্রহণে কোনো আগ্রহ দেখাবে না। ক্রমে এই দক্ষ-যোগ্যরা যদি চলে যেতে থাকে তাহলে দেশে 'সংখ্যার বোঝা' আরও ভারী হয়ে উঠতে থাকবে। আমাদের জন্য পড়ে থাকবে এমন একদল অদক্ষ মানুষ, যারা ভোক্তা হিসেবে অনেক কিছু পেতে চাইবে; কিন্তু উৎপাদক হিসেবে অপেক্ষাকৃত কম কার্যকর। ভোক্তা হিসেবেও তাদের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ তাদের আয় তুলনামূলক কম এবং রুচিও সব ধরনের পণ্যের উপযোগী নয়। মানসম্পন্ন ও উচ্চমূল্যের পণ্য কেনার প্রতি এ অংশের ভোক্তাদের অনাগ্রহ সব দেশেই লক্ষণীয়। এ শ্রেণীর লোকসংখ্যা দেশে বেশি থাকায় বিদেশি বিনিয়োগও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসে না। চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনের তুলনায় বাংলাদেশের এখানেই পার্থক্য। আমাদের লোকসংখ্যা অনেক, কিন্তু কার্যকর বাজার সীমিত। অথচ চলি্লশের দশকের শেষ থেকে এসব দেশ স্বাধীন সত্তা হিসেবে প্রায় একসঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিল। আমাদের রাজধানী ঢাকায় জনবসতি ক্রমে বাড়ছে, কিন্তু বিশ্বে 'বসবাসের অযোগ্য' দ্বিতীয় বড় শহরের 'কলঙ্কতিলক' আমাদের ললাটে। কিন্তু আমাদের আশপাশেই দেখছি সমৃদ্ধির চিত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন সেখানে পাল্টে যাচ্ছে।
একসময় যে জনসংখ্যা শক্তি ছিল, তা নিয়ে আমাদের কত সমস্যা। উন্নয়নের পথে চলতে যে শক্তি আমরা কাজে লাগাতে পারতাম, তা এখন জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি বলে বিবেচিত হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সর্বত্র। ধান-গমের উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু চাহিদার সঙ্গে তা তাল মেলাতে পারছে না। পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না, এ কারণে রাজপথে নেমে আসছে হাজার হাজার মানুষ এবং তারা সৃষ্টি করছে 'দৌড় সালাউদ্দিন' চরিত্র। শেয়ারবাজারে সামান্য লাভের সম্ভাবনা দেখলেই লাখ লাখ মানুষ ছুটে যায় এবং 'বিনিয়োগকারীর' সংখ্যা স্বল্প সময়ের মধ্যেই ছাড়িয়ে যায় ত্রিশ লাখে। আড়িয়ল বিলে আধুনিক বিমানবন্দর স্থাপনের মহাপরিকল্পনা মুহূর্তেই অনেক মানুষকে শঙ্কিত করে তোলে। কারণ তাদের বসতভিটা ও শস্যের জমিতে টান পড়বে, এমন শঙ্কা সৃষ্টি হয়। এভাবে জনসংখ্যার আধিক্য এমনকি অতি তুচ্ছ কিংবা সাদামাটা ইস্যুকেও অনেক বড় করে তুলতে পারে। এটাও মনে রাখা দরকার যে, সমাজে কুচক্রী ও দুষ্ট লোক সর্বদাই থাকে, নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা যা খুশি তা-ই করতে পিছপা হয় না। তারা নদী দখল করে, কিন্তু সামনে রাখে অভাবী লোকদের। তারা বস্তিবাসীর একটি অংশকে সন্ত্রাসী হিসেবে গড়ে তোলে, তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে জনজীবন অশান্ত করে তোলে কিন্তু নিজেদের রাখে আড়ালে। আমাদের উপজেলায় উপজেলায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু যারা চিকিৎসা দেবেন, সেই চিকিৎসক পাওয়া যায় না। তাদের পোস্টিং দেওয়া হয় অনেক বাছবিচার করে নিয়োগদানের পর এবং কর্মস্থলে না থাকা অন্যায়। কিন্তু কী আকর্ষণে তারা সেখানে পড়ে থাকবে? রাষ্ট্র কি তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা সৃষ্টি করতে পেরেছে? প্রকৃতই গ্রামে গ্রামে উন্নত জীবন নিশ্চিত করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলছি। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হচ্ছে না। অথরিটির সঙ্গে অটোনমি দিতে রাজি নই। একটি অ্যাম্বুলেন্স খারাপ হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু তা মেরামত করার জন্য অর্থ বরাদ্দ পেতে চিকিৎসকদের ঢাকায় সচিবালয়ের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। তাদের সন্তানদের পড়ানোর মতো ভালো স্কুল গ্রামে মিলবে না।
বাংলাদেশে মানুষের চলাচল বেড়েছে। অনেক দেশেই এটাকে ইতিবাচক বলে গণ্য করা হয়। ভালো সুবিধা রয়েছে, এমন স্থানগুলোতে মানুষ যেতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ নিজের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে কেবল বেঁচে থাকার তাগিদ থেকে। তারা শহরে ছুটে আসে, বিশেষ করে আসে ঢাকা শহরে। কারণ আর্থ-সামাজিক যেটুকু সুবিধা গড়ে উঠছে, তা মূলত এখানেই। এক সময় জেলা স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে পারলেই মনে করা হতো সব পাওয়া হয়ে গেছে। এখন জেলা শহর সে চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। অনেক দেশে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আধুনিক নগর গড়ে ওঠে। কিন্তু ঢাকার মোটামুটি কাছের ময়মনসিংহের চিত্র দেখুন। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, মেয়েদের ক্যাডেট কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং আরও অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও আধুনিক নগরী হিসেবে সেটি গড়ে উঠতে পারছে না। কার্যত আমাদের সবকিছু কেন্দ্রীভূত ঢাকায়। আবার এখানেও নাগরিক সুবিধা সীমিত। এখানে অবকাঠামো সুবিধা সীমিত। যেটুকু গড়ে উঠছে, তাতেও অযত্ন-অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। মহাখালীতে ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে, কিন্তু যানজট কমাতে তার ভূমিকা তেমন নেই। গুলিস্তানের আন্ডারপাসে মানুষ চলাচল নেই, সেখানে ব্যবসা চলছে ইলেকট্রনিক পণ্যের।
এসব সমস্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ জনসংখ্যাধিক্যজনিত। কিন্তু তা নিয়ে ভাবা হয় তুলনামূলক কম। সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার বেড়েছে। প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুহার ক্রমাগত কমছে। মিলিয়ন ডেভেলপমেন্ট গোলের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এসব ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে রয়েছি। এর অন্যতম কারণ বেসরকারি খাতের উত্থান। যাদের সামান্য সচ্ছলতা রয়েছে, তারা আধুনিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সুবিধা গ্রহণ করছে। চিকিৎসকরা তাদের জন্য সিজারিয়ানের বিধান দিচ্ছেন। অ্যান্টিবায়োটিক সহজলভ্য। কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠী মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছে। এসব পরিবারে সন্তান বাড়ছে। আমাদের দরিদ্র পরিবারগুলোতে কিশোরীদের মধ্যে সন্তান ধারণের হার বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বেশি। বিয়ের বয়স আইনে যা রয়েছে, বাস্তবে তা অনেক পরিবার মানে না। আইন বলছে, বিয়ের নূ্যনতম বয়স ১৮ বছর। কিন্তু মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৫.৩ বছর। এক দশকে এ বয়স মাত্র এক বছর বেড়েছে। অল্প বয়সে বিয়ে, কিশোর বয়সে সন্তান এবং কয়েকটি সন্তান পরপর_ এটাই আমাদের বড় সমস্যা। আমরা যাদের শক্তিতে পরিণত করতে চাই তারা পরিণত হচ্ছে দুর্বলতায়।
বাংলাদেশে গড় আয়ু বাড়ছে এবং এটা সর্বত্র প্রশংসা পাচ্ছে। মোট লোকসংখ্যার ৬.২ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এদের অনেকের জীবনযাপনের চিত্র কিন্তু সুখের নয়। সামাজিক ও পারিবারিক নেটওয়ার্ক ভেঙে যাচ্ছে। তাদের নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে ক্রমে চাপ বাড়ছে। দরিদ্র পরিবারে নারীদের সমস্যা বিশেষভাবে প্রকট। প্রকৃতির নিয়মেই নারী তুলনামূলক বেশিদিন বাঁচে। কিন্তু বয়স্ক ও বিধবা ভাতা কতজনকে দেবেন? এ খাতে ব্যয় রাজস্ব বাজেটে চাপ বাড়াচ্ছে, যা কমিয়ে দিচ্ছে উৎপাদনমূলক খাতের ব্যয়।
এভাবে এক সময় যে সংখ্যাধিক্যতা আমাদের শক্তি জুগিয়েছিল, এখন তা সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সন্তান জন্মদানের যে বয়স, দলে দলে নারী-পুরুষ তাতে প্রবেশ করছে এবং তা হয়ে থাকছে উদ্বেগের কারণ। অনেকেই এখন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে লক্ষণ। মূল সমস্যা হচ্ছে অগণিত মানুষ। তাদের জন্য খাদ্য ও জ্বালানির জোগান দিতে হবে। অন্যান্য পণ্য অব্যাহতভাবে সরবরাহ করতে হবে। এখনই অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি যথেষ্ট। কিন্তু বিশ্ববাজার বলছে, সব পণ্যের অব্যাহত চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এমনকি অর্থ থাকলেও মিলবে না। তাহলে উপায়? বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আমরা কি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারব? কত লোক নিয়ে এ উৎসব আমরা পালন করব? আমাদের জনসংখ্যার কিছু সূচকে অগ্রগতি প্রশংসনীয়। কিন্তু অনেক সূচকে যে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তারা সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে নতুন এক দেশ দেখতে চাই। এ জন্য যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়েছি, কিন্তু এর ব্যবস্থাপনার কাজে নিদারুণ অবহেলা করেছি। আমাদের জনসংখ্যাকে কাজে লাগানো চাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য। আর এ প্রবৃদ্ধির মূল লক্ষ্য হতে হবে মানুষের কল্যাণ।
জনসংখ্যা সীমিত রাখার কাজের সঙ্গে বর্তমানে একটি মন্ত্রণালয় জড়িত, যার বাজেট কম এবং ক্ষমতা সীমিত। প্রকৃতপক্ষে এটা হতে হবে সরকারের বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়ের উদ্বেগের বিষয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সম্মিলিত চেষ্টা চালাতেই হবে। আমাদের শিক্ষিত ও সচ্ছল জনগোষ্ঠী তাদের রুচিবোধ ও আর্থিক ক্ষমতার কারণে পরিবারের আকার সীমিত রাখছে। জনগণের সব অংশের মধ্যে এ জীবনবোধ নিয়ে আসতে হবে। এ কাজ করতে পারলেই ফের বায়ান্ন ও একাত্তরের মতো জনসংখ্যা হয়ে উঠবে সম্পদ ও শক্তি হিসেবে। আমাদের পরিবার ও সমাজে আসবে প্রকৃত সুখের অনুভূতি।

একেএম নূর-উন-নবী : অধ্যাপক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
akmnnabi@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.