সমসময়-লিবিয়ায় অস্থিরতা বাংলাদেশেরও পরীক্ষা by আতাউস সামাদ
লিবিয়া পরিস্থিতি বাংলাদেশ সরকার, জনশক্তি রফতানিকারক ও সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিদের জন্য এক মহাপরীক্ষা হিসেবে দেখা দিয়েছে। লিবিয়ায় তাড়াতাড়ি স্বাভাবিকতা ও শান্তি ফিরে আসা-না আসার ওপর নির্ভর করছে কম কষ্ট ও ক্ষতির মধ্য দিয়ে এ পরীক্ষা পার হওয়া
মধ্যপ্রাচ্যের ও উত্তর আফ্রিকার দেশে দেশে জনগণ নাগরিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অর্থনীতিতে সবার অংশ থাকা এবং দুর্নীতি উৎখাত করার জন্য যে আন্দোলন চালাচ্ছে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষরা তাতে সানন্দে সমর্থন জানাচ্ছে ও জানাতে থাকবে। তার কারণ অনেক বছর ধরে ঘাড়ে চেপে বসা স্বৈরশাসকরা ওইসব দেশে যে অসহনীয় দুরবস্থার সৃষ্টি করেছে, বাংলাদেশে আমরা ১৯৭১-এ স্বাধীনতা পাওয়ার আগে ও পরে বহু বছর সে রকম পরিস্থিতিতে বসবাস করেছি। এখানে একেক স্বৈরশাসক একেক লেবাস ধরে এসেছেন। তাদের কেউ এক বিপ্লব, কেউবা দুই বিপ্লব, আবার অন্য কেউ নতুন দেশ গড়ার বিপ্লবের কথা শুনিয়েছেন। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে এখন গণআন্দোলনের জোয়ার চলছে, সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতির মূল পার্থক্য হচ্ছে এই যে, সেখানকার স্বৈরশাসকদের অনেকেই বিপ্লব করার নামে ক্ষমতা দখল করে একেকজন ৩০-৪০ বছর ধরে গদি আঁকড়ে থেকেছেন; কিন্তু বাংলাদেশে কেউ ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে অতটা লম্বা সময় পাড়ি দিতে পারেননি।
দ্বিতীয় তফাৎটা হচ্ছে, ওই দেশগুলো নানাভাবে আমাদের চেয়ে ধনী। তাদের মধ্যে মিসরে হতদরিদ্র আছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো বিপুল সংখ্যায় নয়। তৃতীয় পার্থক্য হচ্ছে, ওই দেশগুলোর শাসকরা কয়েক দশক ধরে ক্ষমতায় থেকে তারা নিজেরা, তাদের আত্মীয়স্বজন ও কাছের লোকেরা এতই বড় অঙ্কের রাষ্ট্রীয় টাকা-পয়সা ও সম্পত্তি দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের দখলে নিয়েছে, যা আমাদের মতো গরিবদের জন্য ধারণা করতেও কষ্ট হয়। আর চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের বহু লোক ওই দেশগুলোতে প্রবাসী কর্মজীবী হিসেবে কাজ করেন; কিন্তু ওই দেশগুলোর তেমন কেউ এ দেশে কাজের খোঁজে আসেন না।
উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি দমনের দাবি আমরা খুশিমনে সমর্থন করলেও একই সঙ্গে আমাদের আকাঙ্ক্ষা হবে সেখানে যাতে গৃহযুদ্ধ না বাধে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় ও সহিংস হয়ে না ওঠে বা যেন এমন চরম বিশৃঙ্খলা দেখা না দেয়, যার দরুন সেই দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। কারণ সে রকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হলে আমাদের প্রবাসী পেশাজীবী ও শ্রমিকরা জীবন যাওয়ার মতো হুমকির মধ্যে পড়বেন। আর দেশগুলো যদি দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে, তবে আমাদের প্রবাসী কর্মীদের কাজ ছেড়ে বা বেকার হয়ে দেশে ফেরত আসতে হতে পারে। অতীতেও একবার বাংলাদেশকে এ রকম জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল, যখন ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করেছিলেন। তখন কুয়েতে কর্মরত হাজার হাজার বাংলাদেশিকে প্রাণ হাতে নিয়ে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছিল। পথে বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিলেন। লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময়ও সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা খুবই বিপদে পড়েছিলেন। এবার লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের মহাসমস্যা দেখা দিয়েছে এবং সে দেশে এক লাখের কাছাকাছি বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করতেন বিধায় আমাদের দুশ্চিন্তা গভীরতর হয়েছে।
তাছাড়া লিবিয়ায় এবার পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল। কর্নেল গাদ্দাফি যদি ক্ষমতা না ছাড়েন তাহলে দেশটিতে তার সৈন্য ও মিলিশিয়াদের সঙ্গে গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীদের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই গাদ্দাফির সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে দুই হাজারের বেশি লোক মারা গেছে বলে জাতিসংঘের সূত্ররা জানিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে আরও কতজনের প্রাণ যাবে কে জানে? তাই শান্তিকামী একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত হবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে লিবিয়ার রাজনৈতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য কাজ করা। সামরিকভাবে শক্তিশালী পশ্চিমা দেশগুলো প্রয়োজনে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করার যে পরিকল্পনা করছে ও উদ্যোগ নিচ্ছে, সেগুলোকে বাংলাদেশ কতদূর সমর্থন করবে তা-ও এখনই ভেবে রাখতে হবে। লিবিয়ায় শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন ও জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনই বাংলাদেশের কাম্য হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে নৈতিক অবস্থান ও নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান, দুই বিষয়ই গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। লিবিয়া পরিস্থিতির দ্রুত সমাধানের জন্য বাংলাদেশের বেশ জোরেশোরে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কাজ করে যাওয়া প্রয়োজন আরও এ কারণে যে, লিবিয়া থেকে জ্বালানি তেল রফতানি বেশিদিন বন্ধ থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়বেই এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। এমনকি তার ফলে এ দেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে গাদ্দাফি ও তার পারিষদরা যদি আর অশান্তি না সৃষ্টি করে বিদায় নেন।
এখন এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, গাদ্দাফি শুধু পেশিশক্তির সহায়তায় ক্ষমতা দখলে রেখে ক্ষান্ত হননি, তিনি একজন নিষ্ঠুর শাসক এবং খুবই দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি। তার ও পরিবারের অন্য সদস্যদের হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে গচ্ছিত থাকার এবং কোনো কোনো দেশে সেই অর্থ বাজেয়াপ্ত করার খবর প্রকাশিত হয়েছে। তার নিজের দেশের লোককে বেকার রেখেও গাদ্দাফি ও তার পরিবার এ পাপটি করেছেন। তবে এখানে অবশ্যই একটা প্রশ্ন জাগে, পশ্চিমা দেশগুলো এত বছর ধরে গাদ্দাফির দুর্নীতির ধন গচ্ছিত রেখেছিল কীভাবে ও কেন? সেজন্য সন্দেহ হয়, গাদ্দাফি যদি ক্ষমতা ছেড়েও দেন তারপরও ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ায় সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে দেবে কি-না এবং দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালনা মেনে নেবে কি-না। হয়তো দেখা যাবে, লিবিয়াতেও মিসর ও তিউনিসিয়ার মতো দেশ পরিচালনার পদ্ধতি দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তথা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।
লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশিদের খুব দ্রুত সেখান থেকে বের করে আনা এখনও কঠিন কাজ। প্রথমত, বাংলাদেশিরা কোথায় কোথায় আছেন, তার সব খবর ত্রিপোলিতে আমাদের দূতাবাসের কাছে আছে কি-না তা এক প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, দূতাবাসের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য থাকলেও আমাদের কূটনীতিকরা বর্তমান পরিস্থিতিতে সব বাংলাদেশির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন কি-না। কারণ লিবিয়ার ভেতরে এখন যানবাহন নিয়ে চলাচল করা নিরাপদ নয়, হয়তো বা কোনো কোনো জায়গায় ত্রিপোলি থেকে যাওয়াই সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশিদের সরিয়ে আনতে তাদের সংগঠিত করা ও তাদের নিরাপদ যাত্রা (সেফ প্যাসেজের) ব্যবস্থা করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। তাছাড়াও লিবিয়ায় কর্মরত বহু বাংলাদেশি হয়তো চাইবেন যে, পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এলে তারা যেন আগের কাজে ফেরত যেতে পারেন। সে নিশ্চয়তা যদি তারা না পান তাহলে তারা চাইবেন প্রথমত, লিবিয়ার ভেতরেই কোনো নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে অথবা লিবিয়ার আশপাশে কোনো দেশে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিতে। কিন্তু মিসর বা তিউনিসিয়া বর্তমানে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ক্রান্তিকালীন জটিলতা ও অর্থনৈতিক অসুবিধার জন্য এবং নতুন কোনো সামাজিক অস্থিরতা যাতে না হয়, সেজন্য নিজেদের কাঁধে কোনো বড় শরণার্থী সমস্যা তুলে নিতে চাইবে না। তাই বাংলাদেশকে জাতিসংঘ, ইসলামী সম্মেলন, রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট, আইএমও (আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা) ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংক্রান্ত হাইকমিশনের মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে, প্রথমত, লিবিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য এবং তাদের কাছে খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা পেঁৗছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। মিসর ও তিউনিসিয়ার সঙ্গেও ওই প্রতিষ্ঠানগুলো মারফত বা সরাসরি আলোচনা করতে হবে, যাতে তারা তাদের মাটিতে লিবিয়া থেকে সরে আসা ভিনদেশিদের বিশেষ ব্যবস্থায় সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়। এজন্য তাদের সীমান্ত অতিক্রম করতে দেওয়ার কাজটি যাতে বিনা বাধায় বা কড়াকড়ি ছাড়া করা যায়, মিসর ও তিউনিসিয়াকে সে ব্যাপারে প্রয়োজনে বারবার অনুরোধ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে প্রত্যাগত কয়েকজনের কাছ থেকে ও বিদেশি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের খবর থেকে আমরা জেনেছি, যারা লিবিয়ায় তাদের কর্মস্থল থেকে মিসর বা তিউনিসিয়া সীমান্তে এসে পেঁৗছাচ্ছেন, তাদের অনেকেই ক্ষুধা ও পথের ক্লান্তিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন।
ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, কিছু বিদেশি কোম্পানি যারা বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশ থেকে শ্রমিক এনে লিবিয়ায় কাজ করছিল, তারাও স্ব-উদ্যোগে এই কর্মীদের লিবিয়া থেকে বের করে আনছে। বাংলাদেশ সরকার ও এখানকার জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে লিবিয়ায় যাওয়া কর্মীদের নিয়োগদানকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা।
লিবিয়া পরিস্থিতি বাংলাদেশ সরকার, জনশক্তি রফতানিকারক ও সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিদের জন্য এক মহাপরীক্ষা হিসেবে দেখা দিয়েছে। লিবিয়ায় তাড়াতাড়ি স্বাভাবিকতা ও শান্তি ফিরে আসা-না আসার ওপর নির্ভর করছে কম কষ্ট ও ক্ষতির মধ্য দিয়ে এ পরীক্ষা পার হওয়া।
২-৩-২০১১
আতাউস সামাদ : সাংবাদিক
দ্বিতীয় তফাৎটা হচ্ছে, ওই দেশগুলো নানাভাবে আমাদের চেয়ে ধনী। তাদের মধ্যে মিসরে হতদরিদ্র আছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো বিপুল সংখ্যায় নয়। তৃতীয় পার্থক্য হচ্ছে, ওই দেশগুলোর শাসকরা কয়েক দশক ধরে ক্ষমতায় থেকে তারা নিজেরা, তাদের আত্মীয়স্বজন ও কাছের লোকেরা এতই বড় অঙ্কের রাষ্ট্রীয় টাকা-পয়সা ও সম্পত্তি দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের দখলে নিয়েছে, যা আমাদের মতো গরিবদের জন্য ধারণা করতেও কষ্ট হয়। আর চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের বহু লোক ওই দেশগুলোতে প্রবাসী কর্মজীবী হিসেবে কাজ করেন; কিন্তু ওই দেশগুলোর তেমন কেউ এ দেশে কাজের খোঁজে আসেন না।
উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি দমনের দাবি আমরা খুশিমনে সমর্থন করলেও একই সঙ্গে আমাদের আকাঙ্ক্ষা হবে সেখানে যাতে গৃহযুদ্ধ না বাধে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় ও সহিংস হয়ে না ওঠে বা যেন এমন চরম বিশৃঙ্খলা দেখা না দেয়, যার দরুন সেই দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। কারণ সে রকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হলে আমাদের প্রবাসী পেশাজীবী ও শ্রমিকরা জীবন যাওয়ার মতো হুমকির মধ্যে পড়বেন। আর দেশগুলো যদি দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে, তবে আমাদের প্রবাসী কর্মীদের কাজ ছেড়ে বা বেকার হয়ে দেশে ফেরত আসতে হতে পারে। অতীতেও একবার বাংলাদেশকে এ রকম জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল, যখন ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করেছিলেন। তখন কুয়েতে কর্মরত হাজার হাজার বাংলাদেশিকে প্রাণ হাতে নিয়ে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছিল। পথে বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিলেন। লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময়ও সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা খুবই বিপদে পড়েছিলেন। এবার লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের মহাসমস্যা দেখা দিয়েছে এবং সে দেশে এক লাখের কাছাকাছি বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করতেন বিধায় আমাদের দুশ্চিন্তা গভীরতর হয়েছে।
তাছাড়া লিবিয়ায় এবার পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল। কর্নেল গাদ্দাফি যদি ক্ষমতা না ছাড়েন তাহলে দেশটিতে তার সৈন্য ও মিলিশিয়াদের সঙ্গে গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীদের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই গাদ্দাফির সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে দুই হাজারের বেশি লোক মারা গেছে বলে জাতিসংঘের সূত্ররা জানিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে আরও কতজনের প্রাণ যাবে কে জানে? তাই শান্তিকামী একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত হবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে লিবিয়ার রাজনৈতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য কাজ করা। সামরিকভাবে শক্তিশালী পশ্চিমা দেশগুলো প্রয়োজনে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করার যে পরিকল্পনা করছে ও উদ্যোগ নিচ্ছে, সেগুলোকে বাংলাদেশ কতদূর সমর্থন করবে তা-ও এখনই ভেবে রাখতে হবে। লিবিয়ায় শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন ও জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনই বাংলাদেশের কাম্য হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে নৈতিক অবস্থান ও নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান, দুই বিষয়ই গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। লিবিয়া পরিস্থিতির দ্রুত সমাধানের জন্য বাংলাদেশের বেশ জোরেশোরে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কাজ করে যাওয়া প্রয়োজন আরও এ কারণে যে, লিবিয়া থেকে জ্বালানি তেল রফতানি বেশিদিন বন্ধ থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়বেই এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। এমনকি তার ফলে এ দেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে গাদ্দাফি ও তার পারিষদরা যদি আর অশান্তি না সৃষ্টি করে বিদায় নেন।
এখন এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, গাদ্দাফি শুধু পেশিশক্তির সহায়তায় ক্ষমতা দখলে রেখে ক্ষান্ত হননি, তিনি একজন নিষ্ঠুর শাসক এবং খুবই দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি। তার ও পরিবারের অন্য সদস্যদের হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে গচ্ছিত থাকার এবং কোনো কোনো দেশে সেই অর্থ বাজেয়াপ্ত করার খবর প্রকাশিত হয়েছে। তার নিজের দেশের লোককে বেকার রেখেও গাদ্দাফি ও তার পরিবার এ পাপটি করেছেন। তবে এখানে অবশ্যই একটা প্রশ্ন জাগে, পশ্চিমা দেশগুলো এত বছর ধরে গাদ্দাফির দুর্নীতির ধন গচ্ছিত রেখেছিল কীভাবে ও কেন? সেজন্য সন্দেহ হয়, গাদ্দাফি যদি ক্ষমতা ছেড়েও দেন তারপরও ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ায় সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে দেবে কি-না এবং দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালনা মেনে নেবে কি-না। হয়তো দেখা যাবে, লিবিয়াতেও মিসর ও তিউনিসিয়ার মতো দেশ পরিচালনার পদ্ধতি দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তথা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।
লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশিদের খুব দ্রুত সেখান থেকে বের করে আনা এখনও কঠিন কাজ। প্রথমত, বাংলাদেশিরা কোথায় কোথায় আছেন, তার সব খবর ত্রিপোলিতে আমাদের দূতাবাসের কাছে আছে কি-না তা এক প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, দূতাবাসের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য থাকলেও আমাদের কূটনীতিকরা বর্তমান পরিস্থিতিতে সব বাংলাদেশির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন কি-না। কারণ লিবিয়ার ভেতরে এখন যানবাহন নিয়ে চলাচল করা নিরাপদ নয়, হয়তো বা কোনো কোনো জায়গায় ত্রিপোলি থেকে যাওয়াই সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশিদের সরিয়ে আনতে তাদের সংগঠিত করা ও তাদের নিরাপদ যাত্রা (সেফ প্যাসেজের) ব্যবস্থা করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। তাছাড়াও লিবিয়ায় কর্মরত বহু বাংলাদেশি হয়তো চাইবেন যে, পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এলে তারা যেন আগের কাজে ফেরত যেতে পারেন। সে নিশ্চয়তা যদি তারা না পান তাহলে তারা চাইবেন প্রথমত, লিবিয়ার ভেতরেই কোনো নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে অথবা লিবিয়ার আশপাশে কোনো দেশে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিতে। কিন্তু মিসর বা তিউনিসিয়া বর্তমানে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ক্রান্তিকালীন জটিলতা ও অর্থনৈতিক অসুবিধার জন্য এবং নতুন কোনো সামাজিক অস্থিরতা যাতে না হয়, সেজন্য নিজেদের কাঁধে কোনো বড় শরণার্থী সমস্যা তুলে নিতে চাইবে না। তাই বাংলাদেশকে জাতিসংঘ, ইসলামী সম্মেলন, রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট, আইএমও (আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা) ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংক্রান্ত হাইকমিশনের মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে, প্রথমত, লিবিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য এবং তাদের কাছে খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা পেঁৗছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। মিসর ও তিউনিসিয়ার সঙ্গেও ওই প্রতিষ্ঠানগুলো মারফত বা সরাসরি আলোচনা করতে হবে, যাতে তারা তাদের মাটিতে লিবিয়া থেকে সরে আসা ভিনদেশিদের বিশেষ ব্যবস্থায় সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়। এজন্য তাদের সীমান্ত অতিক্রম করতে দেওয়ার কাজটি যাতে বিনা বাধায় বা কড়াকড়ি ছাড়া করা যায়, মিসর ও তিউনিসিয়াকে সে ব্যাপারে প্রয়োজনে বারবার অনুরোধ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে প্রত্যাগত কয়েকজনের কাছ থেকে ও বিদেশি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের খবর থেকে আমরা জেনেছি, যারা লিবিয়ায় তাদের কর্মস্থল থেকে মিসর বা তিউনিসিয়া সীমান্তে এসে পেঁৗছাচ্ছেন, তাদের অনেকেই ক্ষুধা ও পথের ক্লান্তিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন।
ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, কিছু বিদেশি কোম্পানি যারা বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশ থেকে শ্রমিক এনে লিবিয়ায় কাজ করছিল, তারাও স্ব-উদ্যোগে এই কর্মীদের লিবিয়া থেকে বের করে আনছে। বাংলাদেশ সরকার ও এখানকার জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে লিবিয়ায় যাওয়া কর্মীদের নিয়োগদানকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা।
লিবিয়া পরিস্থিতি বাংলাদেশ সরকার, জনশক্তি রফতানিকারক ও সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিদের জন্য এক মহাপরীক্ষা হিসেবে দেখা দিয়েছে। লিবিয়ায় তাড়াতাড়ি স্বাভাবিকতা ও শান্তি ফিরে আসা-না আসার ওপর নির্ভর করছে কম কষ্ট ও ক্ষতির মধ্য দিয়ে এ পরীক্ষা পার হওয়া।
২-৩-২০১১
আতাউস সামাদ : সাংবাদিক
No comments