চূড়া ছোঁয়ার স্বপ্ন by সুভাষ সাহা
ছুটছে তো ছুটছে_ এ ছোটার যেন বিরাম নেই। দেখা যায় না ক্লান্তির ছায়াও। কিসের নেশায় ওরা ছুটে চলেছে, কীই-বা হাসিল করতে চায় তারা? কোথায় তাদের স্বপ্ন বসতি আর কোথায় গিয়েই বা থামবে এই উড়ন্ত চলা? চীনের একটির পর একটি অর্থনৈতিক মিরাকলের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি,
শিল্প, এমনকি সাহিত্য-সংস্কৃতি পর্যন্ত একটির পর একটি মার্ক-পোস্ট পেরিয়ে যাওয়া দেখে যে কাউকে এমনতর ভাবনায় পেয়ে বসাটাই স্বাভাবিক। এই তো সেদিন তারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূরত্বের দ্রুতগতির বুলেট ট্রেন চালু করে দেখিয়ে দিয়েছে গতির দুনিয়ায় তারা সবাইকে টেক্কা দিয়ে চলতে পারে। চীনের নতুন ট্রেন সম্ভারে যুক্ত হওয়া এই বুলেট ট্রেন প্রাথমিকভাবে ৩শ' কিলোমিটার গতিতে ছুটছে। পরে সময়, সুযোগ ও অবকাঠামোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এর গতি আরও বৃদ্ধি করা চলবে। রাজধানী বেইজিং থেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় বাণিজ্য কেন্দ্র গুয়াংজু পর্যন্ত দুই হাজার ২৯৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে এই ট্রেনের ২৫টি স্থানে যাত্রাবিরতি করেও মাত্র ১০ ঘণ্টা লাগবে। আমাদের কাছে এটা স্বপ্নের মতো। কিন্তু চীনাদের কাছে এটা একেবারেই স্বাভাবিক। কারণ তারা এর চেয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখে। এভাবে চীনারা এগিয়ে যেতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেন চলাচলও তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। আমাদের প্রতিবেশী এশিয়ার আরেক জায়ান্ট ভারতের ট্রেন ব্যবস্থায় তো চীনা হাত লাগবে বলে। আসলে চীনারা এখন নেশার ঘোরে আছে। ওদের কাউকে প্রশ্ন করলে একটাই উত্তর পাওয়া যায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সবক্ষেত্রে পেছনে ফেলে পহেলা নম্বরের আসনখানি দখল করতে চায়। স্বপ্নচূড়া ছোঁয়ার একই গল্প কি আমাদের নিয়ে হতে পারে না। আমরা হয়তো চীনাদের মতো পারব না। তবে অনেককেই তো পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের আছে। দেশে এত রাজনৈতিক সংঘাত, বিশৃঙ্খলা, তারপরও অর্থনীতি কেমন তরতর করে উপরের দিকে উঠছে। একজন রিকশাওয়ালার উপার্জনও ঈর্ষা করার মতো ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা কমপক্ষে। গ্রামের গরিব পরিবারের মেয়েও আজকাল প্রসাধনী ব্যবহার করে। আর ১৬ কোটি মানুষের দেশে মোবাইল ব্যবহারের সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের ৮ কোটি। এতে দেশের মধ্যে মানুষে মানুষে যোগাযোগের গতিটা টের পাওয়া যায়। সামান্য কিছুতে সর্বত্র প্রতিক্রিয়া হওয়ার ধরন দেখেই তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের বয়ানকে গালগপ্পো মনে হয় না। নারীর ক্ষমতায়ন, জনস্বাস্থ্য ও গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতিটা কীভাবে হলো তা বিদেশি সংস্থাগুলোরও গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আসলে আমাদের সাধারণ মানুষের মধ্যে কর্মস্পৃহা, উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা, প্রতিযোগিতা করা ইত্যাদি গতির মানসিকতা বেশ জোরালো হয়েছে। ভেতো বাঙালি বলে চিরকালীন দুর্নামটা ঘোচানোর সময় মনে হয় সমাগত। জনগণের মধ্যে এই যে কর্মযোগের প্রকাশ তাকে কি আমরা সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে পারি না! আর এ কাজটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের, সরকারের। আমাদের সরকার এখনও পলিসি প্যারালাইসিসে পড়েনি। তবে তাদের মধ্যে আমার আমিকে ছেড়ে সর্বজনের মধ্যে আমাকে আবিষ্কারের সাধনায় মগ্ন হতে হবে। চীনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেভাবে তাদের মানুষকে একটি ঊর্ধ্বগতিমুখী দিকনির্দেশ দিয়েছেন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বও এ দেশের মানুষের চাহিদা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও নতুনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সামর্থ্য অনুযায়ী একটির পর একটি উন্নয়নের সিঁড়ি অতিক্রমের পথনির্দেশ দিতে পারেন। আর এটি দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবশ্যই রয়েছে। নিজেরাই জানেন না তারা কতটা অমিত শক্তি-তেজ ধারণ করেন। চীনারা ছয় দশকে জাপানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারে, আমরা কি স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও সব পশ্চাৎপদতাকে পেছনে ফেলে চূড়া ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে পারি না?
No comments