পরমাণু শক্তি কেন্দ্র- রূপপুর: আর কত দূর? by আবদুল মতিন
আজ থেকে ৫০ বছর আগে রূপপুর পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে কাজ করব বলে আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধু পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশনে যোগ দিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা এবং আমি অনেক আগেই অবসর নিয়েছি। অবসরপ্রাপ্ত অনেক বন্ধুই আজ বেঁচে নেই।
যাঁরা বেঁচে আছি, তাঁদের মনে প্রশ্ন: রূপপুর প্রকল্প আর কত দূর?
২০০৯ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুরে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের জন্য একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরে রাশিয়ার সঙ্গে আরও কয়েকটি চুক্তি হয় এবং রাশিয়া রূপপুরে ১০০০ মেগাওয়াট (MW) শক্তিসম্পন্ন দুটি পরমাণু চুল্লি স্থাপনের জন্য কারিগরি এবং অর্থনৈতিক সাহায্য দেবে বলে জানা গেছে। সরকারি সূত্রমতে, দুটি চুল্লির প্রতিটির মূল্য ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা বলে অনুমিত হয়। ইতিমধ্যে রাশিয়া বাংলাদেশকে একটি সমীক্ষা পরিচালনা, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং পরমাণু চুল্লির নকশা প্রণয়নের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (চার হাজার কোটি টাকা) ঋণ দেবে বলে জানা গেছে। আগামী জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের সময় এই ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা আছে। খবরে আরও প্রকাশ যে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের পর প্রথম ১০ বছর রুশ কারিগরেরা কেন্দ্রটি চালনা করবেন এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি কারিগরেরা চালনার দায়িত্ব নেবেন।
আমি বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে পরমাণু চুল্লি স্থাপনের বিষয়ে বিভিন্ন চুক্তি এবং খবরগুলো অতি আগ্রহের সঙ্গে পর্যালোচনা করেছি। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দুই দেশের আলাপ-আলোচনার ধরন দেখে খুবই হতাশ হয়েছি। হতাশার কারণগুলো নিচে আলোচনা করছি। এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও আলোচনা ও চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
মানবসম্পদ: ১৯৬০-এর দশকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সব পরমাণু প্রকৌশলী অবসরে গেছেন। পরে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন সুদক্ষ পরমাণু প্রকৌশলীর দল গঠন করেনি। বর্তমানে কমিশন প্রায় পরমাণু প্রকৌশলীশূন্য। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য যে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পরমাণু প্রকৌশলী দরকার, তারও অভাব রয়েছে। দীর্ঘ ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে পারি, পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণের আগেই দক্ষ মানবসম্পদ গড়া প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় দক্ষ মানবসম্পদ না গড়ে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা বা কোনো চুক্তি সম্পাদন করা সমীচীন হবে না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, গত তিন বছরে পরমাণু চুল্লির ব্যাপারে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় কোনো বাংলাদেশি দক্ষ পরমাণু প্রকৌশলী জড়িত ছিলেন না। পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ বিল গত মে মাসে সংসদে পাস হয়েছে কিন্তু এখনো পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ অথরিটি গঠন করা হয়নি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অথরিটি গঠন করা প্রয়োজন।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা: রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের নির্ধারিত স্থানটি প্রায় ৬০ বছর আগে ৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট (MW) শক্তিসম্পন্ন চুল্লির জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। বর্তমানে ১০০০ মেগাওয়াট (MW) শক্তিসম্পন্ন দুটি চুল্লি স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ভারতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে গঙ্গার পানিপ্রবাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে। ভারী যন্ত্রপাতি বহনের জন্য গঙ্গার নাব্যতাও হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে রূপপুরের আশপাশের জনসংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। রূপপুর এলাকায় ভূমিকম্পের প্রবণতাও অনেক বেশি। এ অবস্থায় রূপপুর প্রকল্পের জন্য একটি নতুন কারিগরি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত, এই সমীক্ষা গত তিন বছরেও শেষ করা হয়নি।
সাধারণত, এই সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে চুল্লি নির্মাতা একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেন। চুল্লির গ্রাহক এই প্রকল্প প্রস্তাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে এবং আলোচনার মাধ্যমে চুল্লির মূল্য ও চুক্তির শর্তাবলি নির্ধারণ করে। সম্ভাব্যতা যাচাই, প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা এবং চুক্তির শর্তাবলি নির্ধারণ করতে দুই থেকে আড়াই বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। দুর্ভাগ্যবশত, দক্ষতা এবং পেশাদারির অভাবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গত তিন বছরে এই কাজগুলো সমাধা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, প্রকল্প প্রস্তাব, পর্যালোচনা এবং খসড়া চুক্তি নিয়ে আলোচনা ছাড়া আমরা কীভাবে রূপপুর প্রকল্পের চূড়ান্ত চুক্তির কাছাকাছি এসে গেলাম? এটা কি সম্ভব? প্রাথমিক সমীক্ষা ও পর্যালোচনা ছাড়া কোনো চুক্তি সম্পাদন করলে তার পরিণাম চেরনোবিল কিংবা ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
প্রকল্প খরচ: রূপপুরের ১০০০ মেগাওয়াট (MW) শক্তিসম্পন্ন একটি চুল্লির মূল্য ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা অনুমিত হয়েছে। এই মূল্য কতটুকু বাস্তবসম্মত? ভিয়েতনাম একই শক্তিসম্পন্ন দুটি চুল্লি রাশিয়ার কাছ থেকে কিনতে সম্মত হয়েছে এবং একেকটি চুল্লির মূল্য ৩৬ হাজার কোটি টাকা। বেলারুশ ও তুরস্ক অনুরূপ মূল্যে রাশিয়া থেকে দুটি পরমাণু শক্তি কেন্দ্র কিনবে বলে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে। পশ্চিমা দেশে তৈরি পরমাণু চুল্লির মূল্য আরও বেশি। এমন অবস্থায় আমরা কী করে আশা করতে পারি, রাশিয়া বাজারমূল্য থেকে অর্ধেকেরও কম মূল্যে পরমাণু চুল্লি সরবরাহ করবে? রূপপুর প্রকল্পের প্রতিটি চুল্লির মূল্য ৩২ হাজার কোটি টাকার কম হবে না। এ সত্যটি প্রকাশ করতে সরকারের এত অনীহা কেন?
পরমাণু চুল্লির চালক: দেশে দক্ষ পরমাণু প্রকৌশলী না থাকায় রাশিয়া থেকে কারিগর এনে প্রথম ১০ বছর রূপপুর পরমাণু চুল্লি চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবটিও খুব বাস্তবসম্মত নয়। কোনো কারণে যদি দেশে বা রূপপুর এলাকায় আইনশৃঙ্খলার কোনো ধরনের অবনতি ঘটে এবং রুশ কারিগরেরা একসঙ্গে বাংলাদেশ পরিত্যাগ করেন, তবে রূপপুর চুল্লি চালানোর দায়িত্ব কে নেবেন? তখন কোনো ধরনের পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়িত্ব কে বহন করবে? বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উচিত ছিল, ২০০৯ সালেই ৩০-৪০ জন মেধাবী প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়া এবং সাভার পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া। সেটা না করে কমিশন মানবসম্পদ গড়ার কাজে খুবই অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এবং রুশ কারিগর দিয়ে রূপপুরে পরমাণু চুল্লি চালানোর পথ সুগম করেছে।
৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ: আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রূপপুর প্রকল্পের সমীক্ষা, নকশা প্রণয়ন এবং প্রশিক্ষণের খরচ বাবদ বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই এখনো শেষ হয়নি, সেই প্রকল্পের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ কেন গ্রহণ করব? সমীক্ষার জন্য বড়জোর ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হতে পারে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে এত টাকা খরচের পর যদি কোনো কারণে প্রকল্প বাস্তবায়িত না হয়, তখন এই ঋণের দায়ভার কে বহন করবে?
পরমাণু চুল্লির নিরাপত্তা: ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল এবং ২০১১ সালে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর পরমাণু চুল্লির নিরাপত্তার বিষয়টি সারা বিশ্বে আলোচনায় এসেছে। যাদের পরমাণু চুল্লি চালু আছে, তারা সবাই নিরাপত্তার বিষয়টি পুনরায় পর্যালোচনা করছে। ইউরোপের কোনো কোনো দেশ এবং জাপান পর্যায়ক্রমে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছে। খবরে প্রকাশ, রুশ পর্যালোচনায় তাদের চুল্লিতে নিরাপত্তাজনিত বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েছে। আমরা সেই ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সম্পর্কে অবহিত আছি কি এবং এগুলো সন্তোষজনকভাবে সমাধান করা হয়েছে কি? অনিচ্ছাকৃত কারণে রূপপুরে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে এবং ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ নিয়ে নিরাপত্তাবলয় গড়া হয়। তবে প্রায় ৩০ লাখ লোককে অল্প সময়ে অন্যত্র স্থানান্তর করে দীর্ঘদিনের জন্য তাদের বাসস্থান, আহার, স্বাস্থ্যসেবা ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও অবকাঠামো আছে কি? কাজেই রূপপুর প্রকল্পের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
পরমাণু শক্তি করপোরেশন গঠন, জনবল নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে কিন্তু একটু দেরি হলেও করপোরেশনের মাধ্যমেই পরমাণু চুল্লি নির্মাণ এবং পরিচালনার কাজ অধিক দক্ষতা ও পেশাদারি সহকারে পরিচালিত হবে। পরমাণু চুল্লি নির্মাণে এবং পরিচালনায় দক্ষতা ও পেশাদারির কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প পথে চললে ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা আছে। সেই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ক্ষমতা ও দক্ষতা বাংলাদেশের নেই। বলা হয়ে থাকে, চেরনোবিল দুর্ঘটনার কারণে বিশ্বের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ছিল এবং ফুকুশিমা দুর্ঘটনার কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপান বর্তমানে হিমশিম খাচ্ছে। এ কথাগুলো স্মরণ রেখে আমাদের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে।
আবদুল মতিন: বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এবং রূপপুর অ্যান্ড দ্য পাওয়ার ক্রাইসিস বইয়ের লেখক।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুরে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের জন্য একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরে রাশিয়ার সঙ্গে আরও কয়েকটি চুক্তি হয় এবং রাশিয়া রূপপুরে ১০০০ মেগাওয়াট (MW) শক্তিসম্পন্ন দুটি পরমাণু চুল্লি স্থাপনের জন্য কারিগরি এবং অর্থনৈতিক সাহায্য দেবে বলে জানা গেছে। সরকারি সূত্রমতে, দুটি চুল্লির প্রতিটির মূল্য ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা বলে অনুমিত হয়। ইতিমধ্যে রাশিয়া বাংলাদেশকে একটি সমীক্ষা পরিচালনা, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং পরমাণু চুল্লির নকশা প্রণয়নের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (চার হাজার কোটি টাকা) ঋণ দেবে বলে জানা গেছে। আগামী জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের সময় এই ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা আছে। খবরে আরও প্রকাশ যে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের পর প্রথম ১০ বছর রুশ কারিগরেরা কেন্দ্রটি চালনা করবেন এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি কারিগরেরা চালনার দায়িত্ব নেবেন।
আমি বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে পরমাণু চুল্লি স্থাপনের বিষয়ে বিভিন্ন চুক্তি এবং খবরগুলো অতি আগ্রহের সঙ্গে পর্যালোচনা করেছি। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দুই দেশের আলাপ-আলোচনার ধরন দেখে খুবই হতাশ হয়েছি। হতাশার কারণগুলো নিচে আলোচনা করছি। এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও আলোচনা ও চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
মানবসম্পদ: ১৯৬০-এর দশকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সব পরমাণু প্রকৌশলী অবসরে গেছেন। পরে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন সুদক্ষ পরমাণু প্রকৌশলীর দল গঠন করেনি। বর্তমানে কমিশন প্রায় পরমাণু প্রকৌশলীশূন্য। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য যে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পরমাণু প্রকৌশলী দরকার, তারও অভাব রয়েছে। দীর্ঘ ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে পারি, পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণের আগেই দক্ষ মানবসম্পদ গড়া প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় দক্ষ মানবসম্পদ না গড়ে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা বা কোনো চুক্তি সম্পাদন করা সমীচীন হবে না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, গত তিন বছরে পরমাণু চুল্লির ব্যাপারে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় কোনো বাংলাদেশি দক্ষ পরমাণু প্রকৌশলী জড়িত ছিলেন না। পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ বিল গত মে মাসে সংসদে পাস হয়েছে কিন্তু এখনো পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ অথরিটি গঠন করা হয়নি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অথরিটি গঠন করা প্রয়োজন।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা: রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের নির্ধারিত স্থানটি প্রায় ৬০ বছর আগে ৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট (MW) শক্তিসম্পন্ন চুল্লির জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। বর্তমানে ১০০০ মেগাওয়াট (MW) শক্তিসম্পন্ন দুটি চুল্লি স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ভারতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে গঙ্গার পানিপ্রবাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে। ভারী যন্ত্রপাতি বহনের জন্য গঙ্গার নাব্যতাও হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে রূপপুরের আশপাশের জনসংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। রূপপুর এলাকায় ভূমিকম্পের প্রবণতাও অনেক বেশি। এ অবস্থায় রূপপুর প্রকল্পের জন্য একটি নতুন কারিগরি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত, এই সমীক্ষা গত তিন বছরেও শেষ করা হয়নি।
সাধারণত, এই সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে চুল্লি নির্মাতা একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেন। চুল্লির গ্রাহক এই প্রকল্প প্রস্তাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে এবং আলোচনার মাধ্যমে চুল্লির মূল্য ও চুক্তির শর্তাবলি নির্ধারণ করে। সম্ভাব্যতা যাচাই, প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা এবং চুক্তির শর্তাবলি নির্ধারণ করতে দুই থেকে আড়াই বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। দুর্ভাগ্যবশত, দক্ষতা এবং পেশাদারির অভাবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গত তিন বছরে এই কাজগুলো সমাধা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, প্রকল্প প্রস্তাব, পর্যালোচনা এবং খসড়া চুক্তি নিয়ে আলোচনা ছাড়া আমরা কীভাবে রূপপুর প্রকল্পের চূড়ান্ত চুক্তির কাছাকাছি এসে গেলাম? এটা কি সম্ভব? প্রাথমিক সমীক্ষা ও পর্যালোচনা ছাড়া কোনো চুক্তি সম্পাদন করলে তার পরিণাম চেরনোবিল কিংবা ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
প্রকল্প খরচ: রূপপুরের ১০০০ মেগাওয়াট (MW) শক্তিসম্পন্ন একটি চুল্লির মূল্য ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা অনুমিত হয়েছে। এই মূল্য কতটুকু বাস্তবসম্মত? ভিয়েতনাম একই শক্তিসম্পন্ন দুটি চুল্লি রাশিয়ার কাছ থেকে কিনতে সম্মত হয়েছে এবং একেকটি চুল্লির মূল্য ৩৬ হাজার কোটি টাকা। বেলারুশ ও তুরস্ক অনুরূপ মূল্যে রাশিয়া থেকে দুটি পরমাণু শক্তি কেন্দ্র কিনবে বলে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে। পশ্চিমা দেশে তৈরি পরমাণু চুল্লির মূল্য আরও বেশি। এমন অবস্থায় আমরা কী করে আশা করতে পারি, রাশিয়া বাজারমূল্য থেকে অর্ধেকেরও কম মূল্যে পরমাণু চুল্লি সরবরাহ করবে? রূপপুর প্রকল্পের প্রতিটি চুল্লির মূল্য ৩২ হাজার কোটি টাকার কম হবে না। এ সত্যটি প্রকাশ করতে সরকারের এত অনীহা কেন?
পরমাণু চুল্লির চালক: দেশে দক্ষ পরমাণু প্রকৌশলী না থাকায় রাশিয়া থেকে কারিগর এনে প্রথম ১০ বছর রূপপুর পরমাণু চুল্লি চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবটিও খুব বাস্তবসম্মত নয়। কোনো কারণে যদি দেশে বা রূপপুর এলাকায় আইনশৃঙ্খলার কোনো ধরনের অবনতি ঘটে এবং রুশ কারিগরেরা একসঙ্গে বাংলাদেশ পরিত্যাগ করেন, তবে রূপপুর চুল্লি চালানোর দায়িত্ব কে নেবেন? তখন কোনো ধরনের পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়িত্ব কে বহন করবে? বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের উচিত ছিল, ২০০৯ সালেই ৩০-৪০ জন মেধাবী প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়া এবং সাভার পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া। সেটা না করে কমিশন মানবসম্পদ গড়ার কাজে খুবই অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এবং রুশ কারিগর দিয়ে রূপপুরে পরমাণু চুল্লি চালানোর পথ সুগম করেছে।
৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ: আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রূপপুর প্রকল্পের সমীক্ষা, নকশা প্রণয়ন এবং প্রশিক্ষণের খরচ বাবদ বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই এখনো শেষ হয়নি, সেই প্রকল্পের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ কেন গ্রহণ করব? সমীক্ষার জন্য বড়জোর ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হতে পারে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে এত টাকা খরচের পর যদি কোনো কারণে প্রকল্প বাস্তবায়িত না হয়, তখন এই ঋণের দায়ভার কে বহন করবে?
পরমাণু চুল্লির নিরাপত্তা: ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল এবং ২০১১ সালে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর পরমাণু চুল্লির নিরাপত্তার বিষয়টি সারা বিশ্বে আলোচনায় এসেছে। যাদের পরমাণু চুল্লি চালু আছে, তারা সবাই নিরাপত্তার বিষয়টি পুনরায় পর্যালোচনা করছে। ইউরোপের কোনো কোনো দেশ এবং জাপান পর্যায়ক্রমে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছে। খবরে প্রকাশ, রুশ পর্যালোচনায় তাদের চুল্লিতে নিরাপত্তাজনিত বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েছে। আমরা সেই ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সম্পর্কে অবহিত আছি কি এবং এগুলো সন্তোষজনকভাবে সমাধান করা হয়েছে কি? অনিচ্ছাকৃত কারণে রূপপুরে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে এবং ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ নিয়ে নিরাপত্তাবলয় গড়া হয়। তবে প্রায় ৩০ লাখ লোককে অল্প সময়ে অন্যত্র স্থানান্তর করে দীর্ঘদিনের জন্য তাদের বাসস্থান, আহার, স্বাস্থ্যসেবা ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও অবকাঠামো আছে কি? কাজেই রূপপুর প্রকল্পের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
পরমাণু শক্তি করপোরেশন গঠন, জনবল নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে কিন্তু একটু দেরি হলেও করপোরেশনের মাধ্যমেই পরমাণু চুল্লি নির্মাণ এবং পরিচালনার কাজ অধিক দক্ষতা ও পেশাদারি সহকারে পরিচালিত হবে। পরমাণু চুল্লি নির্মাণে এবং পরিচালনায় দক্ষতা ও পেশাদারির কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প পথে চললে ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা আছে। সেই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ক্ষমতা ও দক্ষতা বাংলাদেশের নেই। বলা হয়ে থাকে, চেরনোবিল দুর্ঘটনার কারণে বিশ্বের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ছিল এবং ফুকুশিমা দুর্ঘটনার কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপান বর্তমানে হিমশিম খাচ্ছে। এ কথাগুলো স্মরণ রেখে আমাদের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে।
আবদুল মতিন: বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এবং রূপপুর অ্যান্ড দ্য পাওয়ার ক্রাইসিস বইয়ের লেখক।
No comments