প্রাথমিক সমাপনীতে জিপিএ-বন্যা শিক্ষার চিত্র বদলাল কি- মিলু শামস
দু’ হাজার তেরোর জানুয়ারি মাসে নিবন্ধিত ছাব্বিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারী করা, সঙ্গে এক লাখ তিন হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে আবারও জিপিএ ফাইভের ঢল নামাল প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার শিক্ষার্থীরা।
সারাদেশে চব্বিশ লাখ একাশি হাজার এক শ’ উনিশ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে চব্বিশ লাখ পনেরো হাজার তিন শ’ একচল্লিশ জন। জিপিএ ফাইভ পেয়েছে দু’ লাখ তিরিশ হাজার দু’শ’ বিশ জন। গত বছর এ হার ছিল এক লাখ পাঁচ হাজার ছ’শ’ তিয়াত্তর। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এবার দ্বিগুণেরও বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ পেয়েছে।এই লাফিয়ে চলা জিপিএ ফাইভের হার কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার সামগ্রিক চিত্র নয়, দু’শ’ বছরের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং তারও পরের সময়ে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় সত্যিকারের পরিবর্তন বা সংস্কার বলতে আসলে কিছুই হয়নি। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষা নিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল যার মধ্যে অন্যতম প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা জটিলতার আবর্তেই পাক খাচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার যে প্রস্তাব শিক্ষানীতিতে রাখা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। কারণ, এটা করতে হলে সরকারী-বেসরকারীসহ প্রায় আশি হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ এবং অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে হবে। দেশের দু’ হাজার দু’শ’টি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল চরম দুরবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। এ সংক্রান্ত যেসব প্রস্তাব এসেছে তা বাস্তবায়ন করতে যে টাকা ও অবকাঠামো সুবিধা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতেই নাকি ছ’ সাত বছর লাগবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির সম্ভাবনাও নাকি এতে রয়েছে। কারণ, ব্যবস্থাটা তখন দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। অর্থাৎ আবারও ঝুলে গেল। অথচ এ প্রস্তাব এসেছিল সেই ব্রিটিশ আমলে। ব্রিটিশ সরকারের সার্জেন্ট কমিশন উনিশ শ’ চুয়াল্লিশ সালে প্রস্তাব রেখেছিল চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার। এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছেন। গত শতকের ত্রিশের দশকে একজন প্রাথমিক শিক্ষক বেতন পেতেন সরকারী অফিসের পিওনের বেতনের চেয়েও কম। এঁদের বেশিরভাগই ছিলেন কৃষক পরিবার থেকে আগত এবং কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই প্রথম কি দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ঝরে যেত। এ চিত্রের খুব বেশি পরিবর্তন এখনও হয়নি। অথচ সেই চুয়ান্ন সাল থেকে শিক্ষা নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম কম হয়নি। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার গায়ে এসবের আঁচ প্রায় লাগেইনি। স্বাধীনতার পর প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) পাঁচ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরির কথা বলা হয়েছিল। দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে পুরোপুরি জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত থেকেই ওই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল; যা বাস্তবায়িত হলে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় হতো সরকারী প্রতিষ্ঠান। চুয়াত্তর সালে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রাথমিক শিক্ষাকে পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করার সুপারিশ করে এবং তিরাশি সালের মধ্যে একে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করার প্রস্তাব দেয়। সেই চুয়াল্লিশ সালের প্রস্তাব একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্য ফর্মে উপস্থাপিত হয়।
দুটো প্রতিশ্রুতি ছিল সরকারেরÑদু’ হাজার এগারো সালের মধ্যে স্কুলে যাওয়ার উপযোগী সব শিশুকে স্কুলে পাঠানো এবং ঝরে যাওয়া রোধ। এবং দু’ হাজার চৌদ্দ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে এখনও প্রায় সতেরো হাজার গ্রামে সরকারী-বেসরকারী কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। দু’ দশকের মধ্যে নতুন কোন স্কুল জাতীয়করণ হয়নি। শিক্ষকদের জীবনমান বা সামাজিক মর্যাদার কোন উন্নতি হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী বছরের শুরুতে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে নতুন বই পৌঁছে দিয়ে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। বঞ্চিতদের দেশে জিপি-এর বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে শহুরে শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সব প্রায় মহলের হাততালি কুড়িয়েছেন। কিন্তু এতে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান কতটা বাড়ছে তার খোঁজ কি রাখেন অভিভাবক কিংবা বাহবা দেয়া বুদ্ধিজীবীরা? শিক্ষা প্রতিযোগিতাকে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই বা কতটুকু? সারা পৃথিবীতে যেখানে পরীক্ষা পদ্ধতি কমিয়ে আনার জন্য নানান নিরীক্ষা চলছে সেখানে আমাদের দেশে পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়ে শৈশবকে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে। এর মানসিক ক্ষতির দিক নিতান্ত কম নয়। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার পর শিক্ষকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছেÑশতকরা পনেরো নম্বর পেলেও পাস করিয়ে দেয়ার। কোথাও কোথাও নাকি পরীক্ষায় অংশ নিলেই পাস নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এই পাস, এই জিপিএ ফাইভওয়ালা শিশুদের গন্তব্য আসলে কোথায়, তা শিক্ষামন্ত্রীই ভাল বলতে পারবেন।
শিক্ষামন্ত্রীর হাসিহাসি মুখ আর অভিভাবকদের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে এ তথ্যও আমাদের কাছে আসে যে, পলিটিক্যাল পাসের এই রমরমায়ও শতকরা বিশ ভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকে। আরেক জরিপে জানা যায়, প্রাথমিক স্তরের শতকরা আশি ভাগ শিক্ষার্থী মানসম্পন্ন শিক্ষা পায় না। অর্থাৎ শিক্ষা যাঁরা দিচ্ছেন সেই শিক্ষকদেরই পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব রয়েছে।
সম্প্রতি পাওয়া এক তথ্যে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশ উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নাম্বার পাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক নম্বরের বেঁধে দেয়া শর্ত পূরণ করতেও ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দু’ পরীক্ষায়ই এরা জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল।
সবচেয়ে অবহেলিত পেশা এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষকতা। নানা অভাব-অভিযোগ নিয়ে দু’ দশক ধরে শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। সব সরকারের কাছ থেকে তাঁরা শুধু প্রতিশ্রুতিই পান, সরকারের মেয়াদ ফুরালে আবার নামেন রাজপথে। এবারও প্রতিশ্রুতি এসেছে। দু’ হাজার তেরর জানুয়ারি আসছে একদিন পর। দেখা যাক, হয়ত এবার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের ভাগ্য বদল হবে।
No comments