ডুমুরের ফুল অদৃশ্য নয়...
ডুমুরের ফুলকে নিয়ে কতই না কথা! ডুমুর গাছ ও ডুমুর সবজি নিয়ে তেমন কথা নেই। এগুলো দেখা যায়, কেবল দেখা যায় না (!) ডুমুরের ফুল। গ্রামাঞ্চলে পৌরাণিক উপাখ্যান নিয়ে গল্প আছে, বড় অমাবস্যার রাতে ডুমুরের ফুল ফোটে।
অতি ভাগ্যবানরা দেখতে পায় (!)। অবশ্য ঘোর অন্ধকারে এই ফুল দেখার জন্য কেউ রাতভর ডুমুরের গাছের নিচে টর্চ লাইট নিয়ে বসে অপেক্ষা করেছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। তবে ডুমুরের ফুলকে নিয়ে ব্যাকরণে বাগধারা আছে। কাউকে সহজে দেখা না গেলে, অ-নে-ক দিন পর স্বজন, পরিচিত জনের দেখা মিললে বলা হয় ‘কি বিষয় ডুমুরের ফুল হয়ে গেলে নাকি!’ ফুলের রাজ্যে ডুমুরই একমাত্র ফুল যাকে নিয়ে সৌন্দর্যের বদলে আছে রহস্য। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ডুমুরের ফুল মোটেও দুর্লভ নয়। ডুমুরের ভিতরেই ডুমুরের ফুল। হালে তার প্রমাণও মিলছে।দেশের গ্রামাঞ্চলে ডুমুরের গাছ দেখা যায়। গুল্মজাতীয় লম্বা এই গাছের কা- ভরে থোকায় থোকায় ছোট গোলাকৃতির অসংখ্য ডুমুর ঝুলে থাকে। প্রথমে সবুজ তারপর ক্রমেই লালচে বর্ণ ধারণ করে গাছ ডুমুরের আধার হয়ে থাকে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কে যেন পুরো গাছকেই মালা পরিয়ে দিয়েছে। গ্রাম গঞ্জে এত চেনা এই গাছ থাকার পরও কবে যে এর ফুলকে নিয়ে কোন ব্যক্তি কাব্যিক রসিকতা করেছেন তা কেউ বলতে পারে না। প্রকৃতি প্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশ সৌন্দর্যের প্রতীকী উপমায় নাটোরের বনলতা সেনকে টেনে এনেছেন। ডুমুরের ফুলের বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে ইতিহাস ও পৌরাণিক উপাখ্যান সাক্ষ্য দেয়, বৈদিক যুগেও পুজোর নৈবেদ্যে ডুমুরের ব্যবহার হতো। যে ধারা চিরন্তন হয়ে আছে। ডুমুরের অনেক প্রজাতির মধ্যে যজ্ঞডুমুরকেই শাস্ত্রিকগণ বেছে নিয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মী নিভা রানী সরকার পূর্ণিমা বললেন, প্রাচীনকালে পরিবেশের এতটা দূষণ ছিল না। তারপরও প্রকৃতিকে দূষণমুক্ত রাখতে ডুমুরের পাতায় তেল জাতীয় কিছু মিশিয়ে (কেউ ঘি মেশাত) আগুনে ফেলে দিলে যে ধোঁয়া হতো তা বায়ুতে মিশে গিয়ে পরিশোধন করত। অনেক প্রবীণ বলেন, একটা সময় গ্রামের মানুষ নিম ও ডুমুর গাছের নিচে অনেকটা সময় ধরে বসে থাকত। ধারণা করা হয়, এই গাছের নিচে বসলে যে বাতাস মেলে তা অনেক অসুখ দূর করে। প্রবীণদের এসব ভাবনা যে একবারে অমূলক নয় তার প্রমাণও আছে। প্রাচীন আমলে এই ডুমুরই ঔষধি বৃক্ষের মর্যাদা পেয়েছে। সে কালের হেকিম কবিরাজগণ হামানদিস্তায় ডুমুর বেটে তার সঙ্গে গাছগাছালির অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে অনেক জটিল রোগ নিরাময় করতেন। প্রাচীনের ধারাবাহিকতায় আজও আয়ুর্বেদীয় ও ইউনানী চিকিৎসায় ডুমুরের ঔষধি গুণাগুণকে কাজে লাগোনো হচ্ছে। অনেক এ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্রের ওষুধকে গ্রহণ করেন। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিগণ এখনও মনে করেন ডুমুরের ওষুধ টনিক হিসেবে কাজ করে। এই বিষয়ে একজন আয়ুর্বেদ চিকিৎসক বলেন, ডুমুরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি তো আছেই খনিজ লবণ, শর্করা ও আমিষ মেলে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও হজম শক্তি বৃদ্ধি সহ পেটের পীড়া নিরাময়ে ডুমুর ভাল কাজ করে। বর্তমান প্রজন্ম ডুমুরের ফুলের রহস্য নিয়ে যতটা উল্লসিত ডুমুরের গুণাগুণ সম্পর্কে ততটা নয়। অনেক তরুণ ডুমুর গাছ চেনেও না। পূর্বসূরিদের কাছে সেই যে শুনেছে এবং ব্যাকরণে পড়েছে ‘ডুমুরের ফুল’ সেই ধারণা নিয়েই বেড়ে উঠছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ডুমুর আসলে ফল না সবজি এর সরাসরি কোন ‘সলুশন’ নেই। একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী বলেন, ডুমুর এক ধরনের পু®পবিন্যাস। ওয়াইল্ড টাইপ অব প্লান্ট। এই কথার মধ্যেই প্রমাণ আছে অনেক পুষ্পের সমাহারেই ডুমুর। ফুলের একক কোন সত্তা নেই। ডুমুরের ভিতরেই আছে বহুমাত্রিক প্রলেপের ফুল। ডুমুরের গোলাকৃতির চারধারকে যদি প্রাচীর ধরা হয় তাহলে এর ভেতরে মেয়েদের চুলের বেণীর মতো পু®পাক্ষ থাকে। বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যার অধ্যাপক আব্দুল আজিজ বললেন, ডুমুরের ওপরে থাকে পুরুষ ফুল যা সংখ্যায় বেশি। নিচে থাকে স্ত্রী ফুল। স্বভাবতই এই সংখ্যা কম। ডুমুরের গোটার থাকে ছোট্ট ছিদ্র। এই পথেই পোকামাকর প্রবেশ করে। এরা প্রথমে পুরুষ ফুলের ওপর ঘুরে বেড়ায়। পুরুষ ফুলের পরাগরেণু গায়ে নিয়ে স্ত্রী ফুলের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়। পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের ওপর পরে। এ ভাবেই পরাগায়ন হয়ে একটা সময়ে বীজে পরিণত হয়। ডুমুর লাল রং ধারণ করে পেকে যাওয়ার সঙ্গে বীজেরও পরিপূর্ণতা আসে। পাখিদের প্রিয় খাবার পাকা ডুমুর। কখনও গাছ থেকে পাকা ডুমুর মাটিতে পড়ে, কখনও কৌতূহলী কেউ পাকা ডুমুর গাছ থেকে নিয়ে কোথাও ফেলে দিলে, আবার কখনও পাখিরা উড়ে এসে ডুমুর গাছে বসে ডুমুর খেয়ে উড়ে গিয়ে কোথাও বিষ্টা ফেললে সেখানেই ডুমুরের গাছ গজিয়ে ওঠে। এই গাছ অনাদরে অবহেলাভরেই দ্রুত বেড়ে ওঠে। এশিয়া অঞ্চলের ডুমুর গাছ ১৫ থেকে ২০ মিটার লম্বা হয়। বিদেশ বিভূঁইয়ে যে এই ফুলের দেখা মিলছে তা প্রযুক্তির অগ্রসরতায় গুগল সার্চ দিলেই দেখা যায়। কেনিয়ার নেইভাসা এলাকায় ডুমুরের খোলসের ভিতর থেকে বড় একটি ফুল প্রস্ফুটিত হয়েছে। এভাবেই যে ডুমুরের ফুল ফোটে তাও আজ দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্রামে লম্বা এই গাছ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। তারপরও যতটা টিকে আছে তাতেও হয়ত ফুল দেখা যায়। কেউ তা খেয়াল করে না। ওই যে বাগধারায় ডুমুরের ফুল নিয়ে যা বলা আছে মানুষ তাই-ই ভাবে।
No comments