মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই-দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-স্প্লিন্টারের ব্যথায় আজও কাতরান আব্দুল মান্নান by এমরান হাসান সোহেল
পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে আলিপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের খেয়া। ওই খেয়া পাড়ি দিয়ে আঁকাবাঁকা প্রায় দুই কিলোমিটার মাটির পথ পেরিয়ে আলিপুর নদীর পশ্চিম পারে আব্দুল মান্নানের বাড়ি।
বাড়িতে চারটি ঘর, তিনটিই ঝকঝকে। একটি শুধু ভাঙা আর পোড়া টিনের তৈরি। পশ্চিম ভিটার ওই ঘরটি কোনো রকমে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওই ঘরেই থাকেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান বীরপ্রতীক।
ঘরের সামনে যেতেই শোনা গেল কারো কাতরানোর শব্দ। বারান্দায় চৌকিতে শুয়ে আছেন এক বয়স্ক লোক, তিনিই কাতরাচ্ছেন। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমিই আব্দুল মান্নান।' এলাকায় ছোট-বড় সবার কাছে তিনি 'মিলিটারি মান্নান' নামে পরিচিত। কিন্তু জীবনযুদ্ধে লড়ছেন ভুখানাঙ্গাদের কাতারে। অসুস্থ শরীর নিয়ে জীবনের শেষ বেলায় বাড়ির আঙিনায় শাকসবজি চাষ আর হাঁস-মুরগি পালন করে লড়াই করে যাচ্ছেন অভাবের বিরুদ্ধে।
১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনীর হাবিলদার পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর যে টাকা পেয়েছিলেন, তা ব্যয় হয়ে যায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের মামলায় আর নিজের চিকিৎসায়। শরীরে স্প্লিন্টার বয়ে বেড়ানো আব্দুল মান্নানের শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হয় ১০ বছর আগে।
আব্দুল মান্নান জানান, শরীরে স্প্লিন্টারের কারণে শীত এলেই রাতে ঘুমাতে পারেন না ব্যথায়। এ অবস্থা ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল থেকে। ১ নম্বর সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে সীতাকুণ্ডের টিবি হাসপাতালের পশ্চিম পাশের ব্রিজ অ্যামবুশ করে উড়িয়ে দেওয়ার পর শত্রুপক্ষের ছোড়া মর্টার শেলের স্প্লিন্টারে বাঁ হাত ও পা ক্ষতবিক্ষত হয়। তখন থেকেই স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন শরীরে। এ কারণে বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। এর পরও সংসারের প্রয়োজনে নিয়মিত সবজিবাগানে কাজ করতে হয় তাঁকে। মাটি কাটা, বাগান তৈরি করা, এমনকি গাছের পরিচর্যা_সবই করতে হয়। চিচিঙ্গা, শিম, করলা, লাউ, পেঁপে, বেগুনসহ নানা জাতের সবজি আবাদ করেন তিনি। তবে এর আয় থেকে সংসারের ব্যয় মেটানো কঠিন। মাঝেমধ্যে অভুক্তও থাকতে হয়। তবে না চাইলেও তাঁর অভাবের কথা এলাকার বেশির ভাগ লোকই জানে। সচ্ছল পরিবারের অনেকে মাঝেমধ্যে দু-চার কেজি চাল দিয়ে সহায়তাও করেন তাঁকে।
আব্দুল মান্নান জানান, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরে কম্পানি কমান্ডার সুবিদ আলী ভূঁইয়ার অধীনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও হালিশহর এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ৪ এপ্রিল সকালে আহত হওয়ার পর সন্দ্বীপ হাসপাতালে ২০ দিন চিকিৎসা নেন। এরপর চলে আসেন এলাকায়। কিন্তু বসে থাকেননি। স্থানীয় যুবকদের উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষণসহ অস্ত্র সংগ্রহ করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। শত্রুপক্ষ বিষয়টি জানার পর একাত্তরের অক্টোবরের মাঝামাঝি তাঁর বাড়িতে হানা দিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই পোড়া টিন দিয়ে ছোট করে একটি ঘর তোলেন। এখন ওই ঘরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ছে। বর্ষায় চালা দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। অর্থাভাবে ঘরের মেরামত হচ্ছে না। অথচ ১৯৭১ সালে কুমিরা যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি যে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন, এর স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ১৯৭৩ সালে 'বীরপ্রতীক' খেতাব দেওয়া হয়।
অর্থাভাবে বড় দুই মেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। তবে ছোট দুই সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন দশমিনা সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নুরে আলম সিদ্দিকী। একমাত্র ছেলে মো. হান্নান আলিম ও ছোট মেয়ে হালিমা বেগম দাখিল পাস করেছে ওই অধ্যক্ষের সার্বিক সহায়তায়। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর তাঁরা সংসারী হয়েছেন। ছোট মেয়েরও বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে; কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে শ্বশুরবাড়ি তুলে দিতে পারছেন না আব্দুল মান্নান।
উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি ও প্রতিবেশী মনির হোসেন হাওলাদার জানান, ২০১০ সালে আব্দুল মান্নানের ছেলে হান্নান পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হলেও পুলিশ রিপোর্টের জন্য ওই সময় দশমিনা থানার ওসিকে ১০ হাজার টাকা দিতে না পারায় চাকরিটা আর হয়নি। এ কথা এলাকার সবাই জানে।
আব্দুল মান্নান বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে পারলে মৃত্যুর আগে শান্তি পেতাম।'
পটুয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল বারেক বলেন, 'তাঁর (মান্নান) মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার এমন আর্থিক দুরবস্থা, এটা হতাশাজনক। তাঁর ছেলের চাকরির বিষয়েও আমরা হতাশ।'
ঘরের সামনে যেতেই শোনা গেল কারো কাতরানোর শব্দ। বারান্দায় চৌকিতে শুয়ে আছেন এক বয়স্ক লোক, তিনিই কাতরাচ্ছেন। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমিই আব্দুল মান্নান।' এলাকায় ছোট-বড় সবার কাছে তিনি 'মিলিটারি মান্নান' নামে পরিচিত। কিন্তু জীবনযুদ্ধে লড়ছেন ভুখানাঙ্গাদের কাতারে। অসুস্থ শরীর নিয়ে জীবনের শেষ বেলায় বাড়ির আঙিনায় শাকসবজি চাষ আর হাঁস-মুরগি পালন করে লড়াই করে যাচ্ছেন অভাবের বিরুদ্ধে।
১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনীর হাবিলদার পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর যে টাকা পেয়েছিলেন, তা ব্যয় হয়ে যায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের মামলায় আর নিজের চিকিৎসায়। শরীরে স্প্লিন্টার বয়ে বেড়ানো আব্দুল মান্নানের শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হয় ১০ বছর আগে।
আব্দুল মান্নান জানান, শরীরে স্প্লিন্টারের কারণে শীত এলেই রাতে ঘুমাতে পারেন না ব্যথায়। এ অবস্থা ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল থেকে। ১ নম্বর সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে সীতাকুণ্ডের টিবি হাসপাতালের পশ্চিম পাশের ব্রিজ অ্যামবুশ করে উড়িয়ে দেওয়ার পর শত্রুপক্ষের ছোড়া মর্টার শেলের স্প্লিন্টারে বাঁ হাত ও পা ক্ষতবিক্ষত হয়। তখন থেকেই স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন শরীরে। এ কারণে বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। এর পরও সংসারের প্রয়োজনে নিয়মিত সবজিবাগানে কাজ করতে হয় তাঁকে। মাটি কাটা, বাগান তৈরি করা, এমনকি গাছের পরিচর্যা_সবই করতে হয়। চিচিঙ্গা, শিম, করলা, লাউ, পেঁপে, বেগুনসহ নানা জাতের সবজি আবাদ করেন তিনি। তবে এর আয় থেকে সংসারের ব্যয় মেটানো কঠিন। মাঝেমধ্যে অভুক্তও থাকতে হয়। তবে না চাইলেও তাঁর অভাবের কথা এলাকার বেশির ভাগ লোকই জানে। সচ্ছল পরিবারের অনেকে মাঝেমধ্যে দু-চার কেজি চাল দিয়ে সহায়তাও করেন তাঁকে।
আব্দুল মান্নান জানান, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরে কম্পানি কমান্ডার সুবিদ আলী ভূঁইয়ার অধীনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও হালিশহর এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ৪ এপ্রিল সকালে আহত হওয়ার পর সন্দ্বীপ হাসপাতালে ২০ দিন চিকিৎসা নেন। এরপর চলে আসেন এলাকায়। কিন্তু বসে থাকেননি। স্থানীয় যুবকদের উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষণসহ অস্ত্র সংগ্রহ করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। শত্রুপক্ষ বিষয়টি জানার পর একাত্তরের অক্টোবরের মাঝামাঝি তাঁর বাড়িতে হানা দিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই পোড়া টিন দিয়ে ছোট করে একটি ঘর তোলেন। এখন ওই ঘরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ছে। বর্ষায় চালা দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। অর্থাভাবে ঘরের মেরামত হচ্ছে না। অথচ ১৯৭১ সালে কুমিরা যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি যে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন, এর স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ১৯৭৩ সালে 'বীরপ্রতীক' খেতাব দেওয়া হয়।
অর্থাভাবে বড় দুই মেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। তবে ছোট দুই সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন দশমিনা সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নুরে আলম সিদ্দিকী। একমাত্র ছেলে মো. হান্নান আলিম ও ছোট মেয়ে হালিমা বেগম দাখিল পাস করেছে ওই অধ্যক্ষের সার্বিক সহায়তায়। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর তাঁরা সংসারী হয়েছেন। ছোট মেয়েরও বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে; কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে শ্বশুরবাড়ি তুলে দিতে পারছেন না আব্দুল মান্নান।
উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি ও প্রতিবেশী মনির হোসেন হাওলাদার জানান, ২০১০ সালে আব্দুল মান্নানের ছেলে হান্নান পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হলেও পুলিশ রিপোর্টের জন্য ওই সময় দশমিনা থানার ওসিকে ১০ হাজার টাকা দিতে না পারায় চাকরিটা আর হয়নি। এ কথা এলাকার সবাই জানে।
আব্দুল মান্নান বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে পারলে মৃত্যুর আগে শান্তি পেতাম।'
পটুয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল বারেক বলেন, 'তাঁর (মান্নান) মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার এমন আর্থিক দুরবস্থা, এটা হতাশাজনক। তাঁর ছেলের চাকরির বিষয়েও আমরা হতাশ।'
No comments