উৎপাদন বাড়লেও অবস্থা নাজুক by অরুণ কর্মকার
বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান সরকারের শাসন মেয়াদের প্রথম বছর গেছে পরিকল্পনা করতে। দ্বিতীয় বছরে প্রচুর চুক্তি সইয়ের পাশাপাশি কিছু উৎপাদন বেড়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ বছরেও চুক্তি সই অব্যাহত আছে। এই চার বছরে উৎপাদন বেড়েছে মোট প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট।
তবে এখন পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি কমেনি। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় সর্বোচ্চ চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি ছিল প্রায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। গত চার বছরে চাহিদা বেড়েছে দুই হাজার মেগাওয়াটের মতো।
গত চার বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন-মূল্য বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। দাম বাড়ানো হয়েছে পাঁচবার। আরও একবার বাড়ানো হবে। সব মিলিয়ে উৎপাদন ও দাম বাড়ার পরও সামগ্রিক বিদ্যুৎ পরিস্থিতি বেশ নাজুকই আছে, স্থিতি আসেনি। আসন্ন সেচ ও আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে লোডশেডিং যথেষ্টই থাকবে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছরের (২০১৩ সাল) শেষ নাগাদ ঘাটতি পরিস্থিতির নিরসন হওয়ার কথা। তবে ঝুঁকির দিক হচ্ছে, ওই সময়ের মধ্যে গ্যাস কিংবা কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর (বেইজ লোড প্ল্যান্ট) দুটির বেশি চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর বিপরীতে বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন কমবে।
এ অবস্থায় আরও অনেক দিন বিদ্যুৎ খাত নির্ভরশীল থাকবে মূলত ছোট ছোট ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক, বেসরকারি খাতের ক্ষুদ্র বিদ্যুৎকেন্দ্র (এসআইপিপি) এবং মাঝারি আকারের (১৫০ মেগাওয়াট) কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর।
এ ছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সংস্থান ও সরবরাহ, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যুৎ পাওয়া প্রভৃতি সরকারের সামনে এখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়েছে। অনিশ্চিত হয়ে আছে বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে স্থাপনের পরিকল্পিত এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও। অন্য কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও বর্তমান সরকারের শাসন মেয়াদে চালু হচ্ছে না।
চার বছরে প্রাপ্তি: আগামী ৫ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের চার বছর পূর্ণ হবে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন পাঁচ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। সে অঙ্গীকার পূরণ হয়েছে। প্রয়োজনীয় জ্বালানি পাওয়া সাপেক্ষে এখন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল তিন হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ছয় হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আগামী গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ চাহিদা হবে আট হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ ঘাটতি হবে এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের মতো।
উৎপাদন নির্ভরযোগ্য নয়: তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদি ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল, দ্রুত উৎপাদন বাড়িয়ে বিদ্যুৎ-সংকটের আশু সমাধান। পাশাপাশি ওই সময়ের মধ্যে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এনে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর অপসারণ শুরু করা। কিন্তু সেই অপসারণ এখন শুরুই করা যাচ্ছে না। কারণ বড় কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে দেরি হবে। এ কারণে, ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো জানায়, ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর নির্ভরতা হবে বিপজ্জনক। কারণ এগুলো থেকে নির্ভরযোগ্য উৎপাদন আশা করা যায় না। এখনই এগুলোর কোনো কোনোটিতে নির্ধারিত ক্ষমতার চেয়ে উৎপাদন কম হচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি খাতের কয়েকজন বিশ্লেষক বলেন, এসব কেন্দ্র থেকে পাওয়া বিদ্যুতের দামের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বড় কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসা এবং ছোট কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা প্রলম্বিত হলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন মূল্য সমন্বিত হয়ে কমে আসবে না। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। সরকারের বিদ্যুৎ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অনেকটা একমুখী চিন্তা ছিল যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে ভর্তুকির পরিমাণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয় ভেবে দেখা হয়নি।
সরকারের বিদ্যুৎ পরিকল্পনার কারিগরি যৌক্তিকতাও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। বড় কেন্দ্রগুলোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার প্রয়োজনীয় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রাক-প্রস্তুতির অভাব ও সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
বড় কেন্দ্রগুলোর অবস্থা: সরকারি খাতের গ্যাসভিত্তিক হরিপুর ৪৫০ ও বেসরকারি খাতের দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক ৩৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার মেঘনাঘাট-২ কেন্দ্রে আগামী বছর উৎপাদন শুরু হতে পারে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ-১৫০ এবং আরও দু-একটি কেন্দ্র চালুর প্রক্রিয়ায় আছে।
অপরদিকে ৪৫০ মেগাওয়াটের বিবিয়ানা-১, রামপালের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একই ক্ষমতার অরেকটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র এবং ১৫০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও কয়েকটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের কাজ পিছিয়ে আছে। এর একটিও বর্তমান সরকারের শাসন মেয়াদে উৎপাদনে আসছে না।
আমদানি প্রসঙ্গ: ভারতের সরকারি খাত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি বছর দেড়েক পিছিয়ে আগামী বছরের মধ্যভাগে আসার কথা। বেসরকারি খাত থেকে আরও ২৫০ মেগাওয়াট আনার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এখন অবশ্য সরকার ভারত-নেপাল ও ভুটান থেকে প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির কথা বলছে। তবে এগুলো এখন পর্যন্ত কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মিয়ানমার থেকেও আমদানির পরিকল্পনা সরকারের আছে।
জ্বালানির সমস্যা: বিদ্যুৎ উপাদনে জ্বালানির সংকট ও সরবরাহের সমস্যা অব্যাহত আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বাড়তে পারে বলে সরকারি সূত্রগুলো জানায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখনো ৪০০ থেকে ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে গ্যাসের স্বল্পতায়। এই স্বল্পতা শিগগির ঘুচবে এমন লক্ষণ নেই।
ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি তেল সরবরাহ একটি দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য নদী খনন, রেললাইন নির্মাণ ও সংস্কার, ডিপো স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় অনেক কাজ এখনো চাহিদা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়নি। ফলে এসব কেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহে সমস্যার কারণে উৎপাদন কম হতে পারে, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে।
কয়লাভিত্তিক যে কেন্দ্রগুলোর কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, তার একটিরও কয়লার উৎস নিশ্চিত নয়। এমনকি, দেশের কয়লা দিয়ে বড়পুকুরিয়ায় যে ২৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়ানোর কথা তা-ও বিলম্বিত হচ্ছে।
লোডশেডিংমুক্ত দেশ কবে: এই প্রেক্ষাপটে লোডশেডিংমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে বলা হয়েছিল ২০১১ সালের শেষেই দেশ লোডশেডিংমুক্ত হবে। এরপর বলা হয়, ২০১২ সালের কথা। কিন্তু এখন কবে নাগাদ ওই স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হতে পারে, তা নিশ্চিত নয়।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম, তামিম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ক্ষমতা, তাতে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হলে আগামী গ্রীষ্ম কোনোভাবে সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হবে দীর্ঘমেয়াদে।
ম তামিম বলেন, দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মতো কেন্দ্রগুলো যেমন স্থাপিত হয়নি, তেমনি এসব কেন্দ্রের জ্বালানির সংস্থানও করা যায়নি। ফলে পরিস্থিতি এমন হতে যাচ্ছে, যাতে বিদ্যুতের অভাবে অর্থনীতি মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়তে পারে।
গত চার বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন-মূল্য বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। দাম বাড়ানো হয়েছে পাঁচবার। আরও একবার বাড়ানো হবে। সব মিলিয়ে উৎপাদন ও দাম বাড়ার পরও সামগ্রিক বিদ্যুৎ পরিস্থিতি বেশ নাজুকই আছে, স্থিতি আসেনি। আসন্ন সেচ ও আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে লোডশেডিং যথেষ্টই থাকবে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছরের (২০১৩ সাল) শেষ নাগাদ ঘাটতি পরিস্থিতির নিরসন হওয়ার কথা। তবে ঝুঁকির দিক হচ্ছে, ওই সময়ের মধ্যে গ্যাস কিংবা কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর (বেইজ লোড প্ল্যান্ট) দুটির বেশি চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর বিপরীতে বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন কমবে।
এ অবস্থায় আরও অনেক দিন বিদ্যুৎ খাত নির্ভরশীল থাকবে মূলত ছোট ছোট ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক, বেসরকারি খাতের ক্ষুদ্র বিদ্যুৎকেন্দ্র (এসআইপিপি) এবং মাঝারি আকারের (১৫০ মেগাওয়াট) কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর।
এ ছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সংস্থান ও সরবরাহ, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যুৎ পাওয়া প্রভৃতি সরকারের সামনে এখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়েছে। অনিশ্চিত হয়ে আছে বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে স্থাপনের পরিকল্পিত এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও। অন্য কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও বর্তমান সরকারের শাসন মেয়াদে চালু হচ্ছে না।
চার বছরে প্রাপ্তি: আগামী ৫ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের চার বছর পূর্ণ হবে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন পাঁচ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। সে অঙ্গীকার পূরণ হয়েছে। প্রয়োজনীয় জ্বালানি পাওয়া সাপেক্ষে এখন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল তিন হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ছয় হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আগামী গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ চাহিদা হবে আট হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ ঘাটতি হবে এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের মতো।
উৎপাদন নির্ভরযোগ্য নয়: তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদি ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল, দ্রুত উৎপাদন বাড়িয়ে বিদ্যুৎ-সংকটের আশু সমাধান। পাশাপাশি ওই সময়ের মধ্যে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এনে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর অপসারণ শুরু করা। কিন্তু সেই অপসারণ এখন শুরুই করা যাচ্ছে না। কারণ বড় কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে দেরি হবে। এ কারণে, ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো জানায়, ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর নির্ভরতা হবে বিপজ্জনক। কারণ এগুলো থেকে নির্ভরযোগ্য উৎপাদন আশা করা যায় না। এখনই এগুলোর কোনো কোনোটিতে নির্ধারিত ক্ষমতার চেয়ে উৎপাদন কম হচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি খাতের কয়েকজন বিশ্লেষক বলেন, এসব কেন্দ্র থেকে পাওয়া বিদ্যুতের দামের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বড় কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসা এবং ছোট কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা প্রলম্বিত হলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন মূল্য সমন্বিত হয়ে কমে আসবে না। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। সরকারের বিদ্যুৎ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অনেকটা একমুখী চিন্তা ছিল যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে ভর্তুকির পরিমাণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয় ভেবে দেখা হয়নি।
সরকারের বিদ্যুৎ পরিকল্পনার কারিগরি যৌক্তিকতাও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। বড় কেন্দ্রগুলোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার প্রয়োজনীয় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রাক-প্রস্তুতির অভাব ও সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
বড় কেন্দ্রগুলোর অবস্থা: সরকারি খাতের গ্যাসভিত্তিক হরিপুর ৪৫০ ও বেসরকারি খাতের দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক ৩৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার মেঘনাঘাট-২ কেন্দ্রে আগামী বছর উৎপাদন শুরু হতে পারে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ-১৫০ এবং আরও দু-একটি কেন্দ্র চালুর প্রক্রিয়ায় আছে।
অপরদিকে ৪৫০ মেগাওয়াটের বিবিয়ানা-১, রামপালের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একই ক্ষমতার অরেকটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র এবং ১৫০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও কয়েকটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের কাজ পিছিয়ে আছে। এর একটিও বর্তমান সরকারের শাসন মেয়াদে উৎপাদনে আসছে না।
আমদানি প্রসঙ্গ: ভারতের সরকারি খাত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি বছর দেড়েক পিছিয়ে আগামী বছরের মধ্যভাগে আসার কথা। বেসরকারি খাত থেকে আরও ২৫০ মেগাওয়াট আনার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এখন অবশ্য সরকার ভারত-নেপাল ও ভুটান থেকে প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির কথা বলছে। তবে এগুলো এখন পর্যন্ত কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মিয়ানমার থেকেও আমদানির পরিকল্পনা সরকারের আছে।
জ্বালানির সমস্যা: বিদ্যুৎ উপাদনে জ্বালানির সংকট ও সরবরাহের সমস্যা অব্যাহত আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বাড়তে পারে বলে সরকারি সূত্রগুলো জানায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখনো ৪০০ থেকে ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে গ্যাসের স্বল্পতায়। এই স্বল্পতা শিগগির ঘুচবে এমন লক্ষণ নেই।
ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি তেল সরবরাহ একটি দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য নদী খনন, রেললাইন নির্মাণ ও সংস্কার, ডিপো স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় অনেক কাজ এখনো চাহিদা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়নি। ফলে এসব কেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহে সমস্যার কারণে উৎপাদন কম হতে পারে, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে।
কয়লাভিত্তিক যে কেন্দ্রগুলোর কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, তার একটিরও কয়লার উৎস নিশ্চিত নয়। এমনকি, দেশের কয়লা দিয়ে বড়পুকুরিয়ায় যে ২৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়ানোর কথা তা-ও বিলম্বিত হচ্ছে।
লোডশেডিংমুক্ত দেশ কবে: এই প্রেক্ষাপটে লোডশেডিংমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে বলা হয়েছিল ২০১১ সালের শেষেই দেশ লোডশেডিংমুক্ত হবে। এরপর বলা হয়, ২০১২ সালের কথা। কিন্তু এখন কবে নাগাদ ওই স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হতে পারে, তা নিশ্চিত নয়।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম, তামিম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ক্ষমতা, তাতে ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হলে আগামী গ্রীষ্ম কোনোভাবে সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হবে দীর্ঘমেয়াদে।
ম তামিম বলেন, দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মতো কেন্দ্রগুলো যেমন স্থাপিত হয়নি, তেমনি এসব কেন্দ্রের জ্বালানির সংস্থানও করা যায়নি। ফলে পরিস্থিতি এমন হতে যাচ্ছে, যাতে বিদ্যুতের অভাবে অর্থনীতি মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়তে পারে।
No comments