বাংলাদেশের ৪১ বছর ॥ প্রত্যাশা ও অগ্রগতি
(পূর্ব প্রকাশের পর) বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মোট আকার ছিল ৪৪,৫৫০ মিলিয়ন টাকা এবং তা বেড়ে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দাঁড়িয়েছে ১৩৩,২৬,৭০০ মিলিয়ন টাকা।
স্বাধীনতার পর পর এদেশে মাত্র কয়েক শ’ কোটি টাকার বাজেট ছিল। এখন তা প্রায় ২ লক্ষ হাজার কোটিতে পৌঁছে যাচ্ছে। এখন অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে দ্বিগুণ হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার। এটা যে কোন মাপকাঠিতে খুব বড় একটি অর্জন।কিছু প্রতিবন্ধকতার জন্য আমাদের অর্থনীতি পূর্ণমাত্রায় গতিশীল হতে পারছে না। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল অবকাঠামোগত উন্নয়ন। দীর্ঘদিনের অবহেলা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা- ও দুর্নীতির ফলে পর্যাপ্ত গ্যাস, বিদ্যুত, পানি প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের কাজটি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনশক্তি তৈরির কোন পরিকল্পনা ও অবকাঠামো না থাকায় কঠিন হয়ে পড়েছে। উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলাও জরুরী। আমাদের অর্থনীতির গতিশীলতার আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আমলাতন্ত্রের দক্ষতার অভাবে প্রচুর অর্থব্যয় সত্ত্বেও দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ আশানুরূপভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে না। এমনকি বৈদেশিক সহায়তা যথাযথ ব্যবহারের অপারগতায় বিভিন্ন প্রকল্পের অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি ও বহু অর্থ অব্যবহৃত থেকে ফেরত যাচ্ছে। এ সকল প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও সবসময় আমাদের অর্থনীতিকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের খামখেয়ালীপনা, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা ও অস্থিরতা, বিশ্ববাজারে তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি আমাদের অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দেয়।কর্মসংস্থান বাংলাদেশে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর জন্য যে সুপ্রশস্ত কারিগরি ভিত প্রয়োজন তা বাংলাদেশে নেই। এজন্য বিশ্বের শ্রম বাজারে বাংলাদেশী শ্রমিকরা অদক্ষ বা অর্ধদক্ষ হিসেবে পরিচিত। তাদের মজুরি অতি নিম্ন পর্যায়ের এবং চাকরির নিশ্চয়তা কম। দেশে সরকারী বা বেসরকারীভাবে পরিচালিত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা অতি নগণ্য। কর্মসংস্থান উন্নয়নে আমরা নতুন একটি মডেল নিয়ে ভাবতে পারি। এটি পুরোপুরি সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের সংমিশ্রণে হবে। এটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপেও বাস্তবায়িত হতে পারে। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি ও পরিচালনা করা হবে যা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের বড় ভূমিকা পালন করবে। গতানুগতিক ধরনের প্রশিক্ষণকে পরিবর্তন করে দক্ষতাভিত্তিক আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এতে নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তি আহরণের মাধ্যমে সরকারী ও বেসরকারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে তৈরি করতে হবে।
মানব সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত মডেলটি নিম্নরূপ : প্রথমত প্রতিটি জেলায় বেসরকারীভাবে উন্নতমানের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা। এতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সমন্বয় করে এই উদ্যোগে কারিগরি ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করবে। বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এ কাজটির দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রশিক্ষণার্থীদের ও প্রশিক্ষকদের সকল সুবিধা বিশেষ করে বিশেষ বৃত্তি চালুর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। এই সরকারী বৃত্তি নিয়ে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। তবে সরকারকে মান-নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে কারিকুলাম, প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন আনুষঙ্গিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যায়ক্রমে কার্যক্রমটি সাফল্যের সাথে পরিচালিত হলে পরবর্তীতে এর পরিধি ব্যাপকতর করা যেতে পারে। এতে স্থানীয় যুবসমাজকে প্রশিক্ষণ লাভের জন্য দূরে কোথাও যেতে হবে না। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা থাকায় প্রশিক্ষণ লাভের জন্য তুলনামূলকভাবে কম অর্থব্যয় হবে। বিদেশে প্লেসমেন্টের জন্য কেন্দ্রটি বিএমইটির নিকট নিবন্ধিত হবে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ছাড়াই বিদেশে কর্মসংস্থান সম্ভব হবে। যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরেকটি মডেল হতে পারে আধুনিক কৃষি, মৎস্য ও পশু সম্পদ খাত। এ কাজটিতে স্বল্প-শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যুব কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শরিক করা সহজ হবে। উন্নত কৃষি, মৎস্য ও পশুপালন উপকরণ এবং যথোপযুক্ত বীজ ও সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে কর্মহীন যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে ব্যাংক বা অন্য কোন অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান থেকে কৃষি, মৎস্য ও পশুপালন উপকরণ সংগ্রহ করার জন্য ঋণ সহায়তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উৎপাদিত ফসল ন্যায্যমূল্যে বিপণনের জন্য গ্রহণ করা যেতে পারে।
তথ্য-প্রযুক্তি একটি ক্রমবর্ধনশীল খাত যাতে যুবসমাজের ব্যাপক হারে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা আছে। এক্ষেত্রেও পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় যৌথ বিনিয়োগের ব্যবস্থা নেয়া যায়। যুবসমাজের উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় একটি আইসিটি কেন্দ্র স্থাপন করা যায় ও তরুণ তরুণীদের আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা যায়। প্রয়োজন এবং চাহিদা বৃদ্ধি পেলে কেন্দ্রটিতে উচ্চতর কোর্স চালু করা যায়। এ কোর্স সমাপ্ত করলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা সহজেই আউট সোর্সিংয়ের কাজ, মোবাইল ফোন কোম্পানি বা উচ্চতর তথ্য-প্রযুক্তি খাতে কাজ বা চাকরি পেতে পারবে। বাংলাদেশের যুবসমাজকে যদি যথাযথ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া যায়, তবে তারা অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং এই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে সক্রিয় অবদান রাখতে পারবে। তাহলেই আমরা দেখব সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা। (সমাপ্ত)
ড. আহমদ আল কবির
No comments