পাকিস্তান-মৌলবাদ নাকি সংস্কারপন্থি, কে জয়ী হবে? by সুভাষ সাহা

 বৃহত্তর ক্যানভাসে পরিকল্পিত ও এখানে উলি্লখিত সংস্কার করতে পারলে পাকিস্তান এক দশকের মধ্যেই হয়ে উঠতে পারে একটি অগ্রসরমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
কাজটি সহজ না হলেও অসাধ্য নয় কোন পথ ধরবে পাকিস্তান? মিসরের মতো পাকিস্তানেও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের হাতছানি দেখতে পান বেনজির ভুট্টোর ভাতিজি লেখিকা ফাতিমা ভুট্টো। পাকিস্তান-আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট আহমেদ রশিদ অবশ্য ভিন্ন বার্তা দিয়েছেন। তার মতে, পাকিস্তানে এখন ইসলামী চরমপন্থি গ্রুপগুলোর রমরমা অবস্থা আর এখন পাকিস্তানে বিপ্লব হলে সেটি হবে একান্তই ইসলামী বিপ্লব। সুতরাং পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্বে বড় বড় মাথাওয়ালাদের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। গণবিস্ফোরণ হলে পারমাণবিক শক্তিধর ও বিশাল জনসংখ্যার মুসলিম দেশটি শেষ পর্যন্ত তালেবানি জঙ্গিদের হাতে পড়ে কি-না_ এ নিয়ে শঙ্কা জাগাটা স্বাভাবিক।
মিসরের মতো গণতান্ত্রিক সংস্কারকামী অভ্যুত্থানের উপাদান পাকিস্তানি সমাজে এখন পশ্চাদপসরমান। বরং তালেবানি জোশ সাধারণ পাকিস্তানিদের অনেকাংশকেই গ্রাস করেছে। সে কারণে পাকিস্তানের সমাজে এখন আধুনিক সমাজের মতো নীতিনৈতিকতার বালাই নেই। পাকিস্তানি ক্রিকেটার সালমান বাটরা তাই ক্রিকেট ব্যাটিং বা ফিক্সিংয়ের মধ্যে কোনো অন্যায় দেখতে পান না। ভাবখানা এই যে, রাঘববোয়ালরা যখন রাষ্ট্রীয় ও অন্যের সম্পদ নয়ছয় করে দিব্যি উচ্চাসনে বসে ছড়ি ঘোরাতে পারছে, তাহলে আমাদের যদু-মধুদের ব্যাটিং, ফিক্সিংয়ে দোষ হবে কেন!
সামাজিক অসাম্য ও চরম দারিদ্র্যের কারণে এখন ইসলামের নামে মোল্লাতান্ত্রিক আইন ও রাষ্ট্রব্যবস্থাই অধিক কাম্য হয়ে উঠছে সাধারণের কাছে। এ সামাজিক অসাম্য আবার একটি দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা অধোগতির কারণ বলে রবার্ট শিলার থেকে পল ক্রুগম্যান পর্যন্ত অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক মত প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলের ব্যর্থতার পাশাপাশি সামাজিক অসাম্যের অবদান কম নয়। এখানে সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ ও মহাজনি পুঁজি এখনও ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল। প্রয়োজনীয় ভূমি সংস্কার পাকিস্তানে হয়নি। তার ওপর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমতা বিধানের কোনো সামাজিক যোগসূত্রও আবিষ্কৃত হয়নি, এবং কোনো ভিশনারি রাজনীতিবিদ এ কাজে হাত দিয়েছিলেন, তেমন প্রমাণও নেই।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে সেনাবাহিনী প্রচণ্ড আস্থা সংকটে ছিল। এ অবস্থাকে ইতিবাচকভাবে পাকিস্তানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের কাজে লাগাতে পারতেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। কারণ তিনি তখন পাকিস্তানিদের কাছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কেবল সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে সেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেই গণতান্ত্রিক সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে বলে বগল বাজাতে শুরু করেন। তার দলের বিঘোষিত নীতি-আদর্শের সঙ্গে নিজেই বেইমানি করে তিনি পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তার এ ঐতিহাসিক ভুলের খেসারত তিনি শূলে চড়ে জীবন দিয়ে দেন। এখন গোটা পাকিস্তান তার বিষে জর্জরিত হচ্ছে। ভুট্টোর ইসলামী ঝাণ্ডা একজন কট্টর ইসলামপন্থি জেনারেলের হাতেই শোভা পায়। জেনারেল জিয়াউল হক ভেকধারী নেতাকে চিরতরে সরিয়ে দিয়ে গোটা দেশকে তালেবানিকরণের মিশনে লেগে পড়েন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবদান কম নয়। তাদের স্বার্থগত কারণেই পাকিস্তানি সমাজের এভাবে নিরন্তর নিম্নগামী হওয়া ঠেকানোর কোনো বন্দোবস্ত হয়নি। বারকয়েক নির্বাচিত সরকার এনে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্র্যাকটিস করতে গিয়ে পাকিস্তান তার জনগণের কাছে গণতন্ত্র সম্পর্কেই ভুল সংকেত দেয়। সুশাসন ও সামাজিক সংস্কারবিহীন গণতন্ত্র সোনার পাথরবাটির মতো। ফলে অর্থনৈতিক অসাম্য দগদগে ঘায়ের মতো মানুষের মনে বিষাক্ত প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। নিরন্ন ও গরিব মানুষ এক সময় তাই ইসলামের নামে জঙ্গি শাসনে সমতাবিধানের জন্য একেকজন পদাতিক জঙ্গি সৈনিক বনে যায়। পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থার জন্য তাই অদৃষ্টকে দুষে লাভ নেই। এর দায়দায়িত্ব একান্তই পাকিস্তানি সুবিধাভোগী অধিপতি শ্রেণীর এবং জানি দোস্ত যুক্তরাষ্ট্রের।
এখনও পাকিস্তানিদের সম্বিত ফিরেছে বলে মনে হয় না। জারদারি-গিলানির ভঙ্গুর জোট সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের হুকুমে নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় জোটকে পর্যন্ত পেলা দিতে হচ্ছে। সরকার না পারছে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটের সুরাহা করতে, অথবা নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে ফর্মুলা বাতলাতে। তারা প্রেসিডেন্টের হাত থেকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা এনেই বড় একখানা কাজ করে ফেলেছেন বলে মনে করছেন। আরে ভাই, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এতে ঠেকে না। যদি বেসামরিক প্রশাসন দেশ পরিচালনায় সম্পূর্ণ অযোগ্যতার পরিচয় দেয় এবং তারা যদি সাধারণ মানুষের সামান্য আস্থাটুকুও ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইসলামী বিপ্লব ঠেকানোর জন্য সামরিক বাহিনীকে আবার ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান নিয়ে রাস্তায় দেখা যেতে পারে। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিচের স্তরে যথেষ্ট তালেবানি ইনডক্ট্রিনেশন হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত থাকার কারণে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়াকেও ওয়াশিংটন বা ব্রাসেলস কেউ নিরাপদ ভাববে না, ভারত তো নয়ই। সম্ভবত এ কারণেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা সীমাহীন দুর্নীতি ও অযোগ্যতা প্রদর্শনের পরও তাদের প্রতি ওয়াশিংটন ও সেনাবাহিনী উভয় পক্ষেরই সমর্থন বজায় রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার যেভাবে ইসলামী চরমপন্থিদের সঙ্গে আপস করছে এবং বিরোধী দল বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল মুসলিম লীগের নেতা ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তালেবানদের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা জোগাচ্ছেন তাতে এই স্থিতাবস্থা কতদিন বজায় থাকবে বলা মুশকিল। তাই সময় থাকতে, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদেরই গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে হাত দেওয়া উচিত নয় কি?
পাকিস্তানে এ মুহূর্তে বিপ্লব মানেই ইসলামী বিপ্লব। কারণ এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোও তালেবানি আদর্শকে দৃঢ়ভাবে মোকাবেলায় প্রস্তুত নয়। সম্প্রতি পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তার প্রমাণ। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনাকারী গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়েও তিনি যখন ব্লাসফেমি আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন খ্রিস্টান মহিলাকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমা করে দেওয়া এবং এ মধ্যযুগীয় আইনটি সংশোধনের পক্ষে কড়া অবস্থান গ্রহণ করেন, তখন তার পক্ষে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তথা জারদারি বা গিলানি কেউই অবস্থান নেননি। ফলে মৌলবাদী জঙ্গি গ্রুপগুলো তাকে হত্যা করার প্রকাশ্য ফতোয়া দিতে সাহস পায়। এখানেই ঘটনার শেষ নয়, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ নেতাকে হত্যায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, তার দলের পাঞ্জাবে ক্ষমতাসীন হওয়ার পেছনে জঙ্গিগোষ্ঠীর সমর্থন ছিল।
পাকিস্তানে বিরোধী দল ও সরকারি দল তথা রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টের দ্রুত মৌলবাদী জঙ্গি গ্রুপগুলোর কাছে প্রকাশ্য বা গোপনে আত্মসমর্পণ দেশটিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাসির হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে শুকরিয়া মিছিল ও মৌলবাদী আস্ফালন দেখে যে কোনো বিবেকবান সুস্থ মানসিকতার মানুষই আতঙ্ক বোধ করবেন। অথচ পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের আপসকামী মানসিকতা প্রদর্শন ছাড়া এ অপশক্তিকে মোকাবেলা করার হিম্মত প্রদর্শন করতে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অংশও এখন এ মৌলবাদী ধ্যানধারণায় আচ্ছন্ন।
মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর প্রকাশ্য আস্ফালনের কারণে শাসকশ্রেণী তাদের ক্ষমতা ও সম্পদ হারানোর ভয়ে এখন যারপরনাই ভীতসন্ত্রস্ত হতে পারে। পাকিস্তানে এখন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। এ অবস্থায় একটি শক্তিশালী ও আপসহীন নেতৃত্বে (জারদারি-গিলানির মতো মাজাভাঙা নয়, আবার শাহবাজ শরিফের মতো জঙ্গিদের সহায়তাকারীও নয়) পরিচালিত সংস্কারকামী বৃহত্তর রাজনৈতিক কোয়ালিশন সরকারের প্রয়োজন পড়তে পারে। ওই সরকারের নেতারা জঙ্গিগোষ্ঠীর হুমকির কাছে মাথা নত না করে সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিক পাকিস্তান গড়ার ১০ বছর মেয়াদি মিশন শুরু করতে পারেন। সরকার যদি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা হলেও রোধ করে, বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়, শিক্ষাব্যবস্থার যুগোপযোগী সংস্কার করে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং ব্লাসফেমি আইনের মতো মানবাধিকারবিরোধী আইন সংশোধন করে এবং সুশাসনের ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারে, তাহলে পাকিস্তানিদের আগামী দিন সত্যিই সুন্দর হবে এবং দক্ষিণ এশিয়া তখন তার হারানো জুয়েল ফিরে পেয়ে বিশ্বের বুকে গর্বের সঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়াবে। পাকিস্তস্নানে ইতিবাচক পরিবর্তন গোটা দক্ষিণ এশিয়া, এমনকি মধ্য এশিয়াতেও শান্তি-স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। অথচ দেখুন এখনকার পাকিস্তানে হরেকরকমের তালেবান ইসলামী হুকুমত অথবা কল্পিত খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ইহকাল ও পরকালের হেফাজত করার দায়িত্বটা নিয়ে নিচ্ছে। মানুষের সামনে গণতন্ত্রের নামে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা বা সামরিক শাসন কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিশা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন তালেবানি আদর্শই মানুষের কাছে বেঁচে থাকার অবলম্বন বলে বোধ হচ্ছে। এ ধরনের মানসিকতার বিস্তার মূলত একটি সমাজের পশ্চাৎগামিতাকেই নির্দেশ করে।
আর বৃহত্তর ক্যানভাসে পরিকল্পিত ও এখানে উলি্লখিত সংস্কার করতে পারলে পাকিস্তান এক দশকের মধ্যেই হয়ে উঠতে পারে একটি অগ্রসরমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কাজটি সহজ না হলেও অসাধ্য নয়। কোন পথ ধরে এগোবে পাকিস্তান তার জবাব নিজের কাছেই খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে ওয়াশিংটন দিশারির ভূমিকা পালন করে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তার অতীত ভূমিকার দায় শোধ করতে পারে।

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.