বাড়ছে বেকারত্ব, অপচয় হচ্ছে শ্রমশক্তি by মোঃ আরিফুর রহমান
বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে শ্রমশক্তি। কিন্তু দুভার্গ্যর বিষয় হচ্ছে শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে আমরা তেমন ভাবে পারছি না। জনসংখ্যাকে আমরা জনসম্পদে পরিণত করতে পারছি না।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম, উন্নয়নশীল অনেক দেশ যেখানে নিজদের জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে অর্থাৎ মানব সম্পদে পরিণত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। যদিও প্রশিক্ষণসহ নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করার মাধ্যেমে সরকার দক্ষমানব সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে কিন্তু তা জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। তাছাড়া মানবসম্পদে পরিণত করার আগে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা বা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়া অনেক জরুরী। এটা করা গেলে এরপর এই শ্রমশক্তিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে জনগণের কর্মসংস্থানের রয়েছে বিশাল ঘাটতি। আর এর ফলে বিশাল জনগোষ্ঠী জনসম্পদে পরিণত না হয়ে বরং বোঝা হিসেবে দেশ ও সমাজের কাছে আর্বিভূত হচ্ছে। আমাদের যে বিশাল শ্রমশক্তি রয়েছে তা যদি যথাযথ কাজে লাগানো যেত তবে আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হতো। কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা দেখি শ্রমশক্তির বিপুল অপচয়। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ঠিকমতো করতে না পারার ব্যর্থতাই মূলত শ্রমশক্তির অপচয়ের অন্যতম কারণ। যেই হারে প্রতিনিয়ত আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে সেই হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না। ফলে এক বিশাল জনগোষ্ঠী বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। প্রতিবছর ২০ লাখ লোক কাজের খোঁজে মাঠে নামছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজ খুঁজে পাচ্ছে না তারা। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিপুলসংখ্যক মানুষ নিজেদের কর্মসংস্থান করতে ব্যর্থ হচ্ছে । এর ফলে একদিকে তারা মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে আর অন্যদিকে বেড়ে চলছে অপরাধপ্রবণতা। সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অন্যতম কারণ এই বেকারত্ব। সরকারীভাবে বলা হয়, মানুষের আয় বাড়ছে আর দারিদ্র্যের হার কমছে কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন কথা বলে।কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ উৎপাদন খাতে স্থবিরতা। গ্যাস-বিদ্যুত সঙ্কটের কারণে দেশে শিল্প বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। তার ওপর ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ উদ্যোক্তাদের শিল্প খাতে বিনিয়োগের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবাহ কমিয়ে দেয়ার জন্য যে মুদ্রানীতি করেছে এর ফলে বিনিয়োগকারীরা ঋণ সুবিধা নিতে পারছেন না। আবার সরকার যে ঋণ নিচ্ছে তার বেশিরভাগই ব্যবহার করছে অনুৎপাদনশীল খাতে। ফলে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের অস্থিরতা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে কয়েক বছরের মন্দায় আমাদের দেশের শিল্প খাতগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। ফলে রফতানি কমে গেছে। এতে শিল্পে কাজের পরিধিও কমে গেছে। শ্রমিকের চাহিদাও কমে গেছে। আরেকটি হচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আমাদের দেশের উৎপাদনশীল খাতের পরিবর্তে সেবা খাতের দিকে ঝুঁকছে। উৎপাদনশীল খাত থেকে সেবা খাতে কমই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। তাছাড়া কয়েকদিন পর পরই শোনা যায়, সেবা খাতগুলোতে কর্মী ছাঁটাই। এর ফলে বেকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আমাদের বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র বিদেশ গমন। বিগত কয়েক বছর ধরে জনশক্তি রফতানির পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে । অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান কমার সঙ্গে সঙ্গে বহির্বিশ্বেও আমাদের জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের এই হ্রাস দেশের অর্থনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত।
বর্তমানে প্রায় চার কোটি সত্তর লাখ লোক বেকার। প্রতিবছর বিশ লাখ লোক বেকারের তালিকায় আসছে যা সত্যিই উদ্বেগজনক। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি হুমকির মুখে পড়বে। স্বাভাবিক বেকারত্বের হার থেকে প্রকৃত বেকারত্বের হার এক শতাংশ বৃদ্ধি পেলে মোট দেশজ উৎপাদন দুই শতাংশ হ্রাস পায়। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে দেশে জিডিপির স্থিরমূল্য প্রবৃদ্ধি ২০১৪-১৫ র্অথবছরে ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ধার্য করেছে সরকার। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা এর জন্য হুমকিসরূপ। ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে প্রায় ২২ হাজার ৩৮০ বিলিয়ন টাকার সমমূল্যের দেশজ উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু বেকারত্ব সমস্যা যদি দূর করা না যায় তবে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করা দুষ্কর হবে।
সরকারের লক্ষ্য ছিল ২০১৩ সালের মধ্যে মোট দারিদ্র্য ২৫%-এ কমিয়ে আনা। ২০২১ সালের মধ্যে ১৫%-এ কমিয়ে আনা। কিন্তু বেকারত্বের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ১৯৯১-৯২ সালে ৫১.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল । ২০০৫ সালে ৩১৪ % হারে বৃদ্ধি পেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫৬ মিলিয়নে দাঁড়ায়। এই হারে বাড়তে থাকলে ২০১৩ সালে ৫৭.৩ ও ২০২১ সাল নাগাদ ৫৯.৮ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করবে। আমরা দেখতে পাই যে আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু এই মাথাপিছু আয় বাড়ার অন্যতম কারণ ধনীদের আয় বৃদ্ধি। দিন দিন আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমিকদের মজুরি বাড়লেও উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে তাদের জীবন আগে থেকে অনেক বেশি দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। বেকারত্ব দূর করার জন্য সরকারকে যেমন বিভিন্নমুখী উদ্যোগ নিতে হবে তেমনি উচ্চমূল্যস্ফীতি জনিত সমস্যারও সমাধান করতে হবে। সরকারকে যদি ২০২১ সালের মধ্যে এই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হয় তবে অবশ্যই বেকার সমস্যার সমাধান করে এই জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে।
No comments