সময়ের কথা-এই দিন দিন নয়... by অজয় দাশগুপ্ত
যে দিনটি যায়, সেটাই ভালো ছিল_ এমন কথা লোকমুখে শোনা যায়। পাকিস্তান শাসনামলে শোনা যেত, ব্রিটিশ আমলই ভালো ছিল। ১৯৭১ সালের পর কয়েকটি বছর যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সর্বত্র শুধু 'নাই নাই' রব, তখনও শোনা গেছে, এত রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা তাহলে কেন?
২০১২ সাল বিদায় নিচ্ছে। কেমন ছিল বছরটি? এ প্রশ্নে 'ভালো ছিলাম' বলা লোকের সংখ্যা খুব বেশি হবে কি? সংসারের কষ্টের কথা বলবেন অনেকে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কথাও আসবে।
ব্যবসা কেমন চলছে, এমন কথা ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত কাউকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর মিলবে, ভালো নেই। নিত্যপণ্যের বাজার থেকে ফেরার পথে কারও কাছে টেলিভিশন ক্যামেরার সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করবেন, বাজার কেমন_ উত্তর প্রায় সবার জানা, সব কিছুতে আগুন। সংসার চালানো যাচ্ছে না। যে দোকানি ১০০ টাকায় কেনা পণ্য অতিরিক্ত লাভে বিক্রি করছে ১৩০-১৪০ টাকায়_ সেও বলবে, ভালো নেই। যে সরকারদলীয় কর্মী অস্ত্র দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে সেও বলবে, এই আমলে ত্যাগের মূল্যায়ন নেই। বিএনপির যে কর্মীরা এক সময়ে হাওয়া ভবনের বদৌলতে ভাগ্য ফিরিয়েছে তারা বলবে, দল ক্ষমতায় থাকার সময়ে আমাদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। আগামীতে যেন এটা মনে রাখা হয়।
কেন এমন হয়? এক পরিচিত চাকরিজীবী বলছিলেন তার বাসা বদলানোর অভিজ্ঞতার কথা। আশির দশকের শুরুতে এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে তার রাজধানী ঢাকার বুকে সংসার জীবন শুরু। বাসা বদল করে যখন ২ রুমের বাড়িতে গেলেন, সব মালপত্র বহন করতে দরকার পড়ল মাত্র একটা ঠেলাগাড়ি। পরের বাসা বদলানোর সময় লাগল একটি ট্রাক। আর সর্বশেষ বাসা বদলালেন যখন, প্রয়োজন পড়ল একটি ট্রাকের তিনটি ট্রিপ। এক সময়ে পছন্দ করে কেনা কিছু জিনিস শেষ পর্যন্ত ফেলে দিলেন। মাঝারি আকারের ছোট ফ্রিজটি সাত বছর চলেছে। নতুন বড় ফ্রিজ কেনার সময় দেখা গেল, আগেরটা রাখার স্থান নেই। পুরাতন ইলেক্ট্রনিক দ্রব্য কেনাবেচা করে এ ধরনের একটি দোকানে সেটি বিক্রি করতে চাইলে যে নামমাত্র দাম বলা হয় তাতে মাথায় রক্ত ওঠার মতো অবস্থা। রঙিন টিভি বদলেছেন, বড় পর্দার সেট কিনেছেন। পুরাতনটির কোনো দাম নেই। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনে বোধকরি সবারই কমবেশি একই অভিজ্ঞতা।
সুখের সংজ্ঞা কী? দুটি পরিবারের অনুভূতি এ প্রসঙ্গে বলতে চাই। একটি পরিবারে জমকালো পার্টির আয়োজন করেছেন গৃহকর্ত্রী_ উপলক্ষ, অফিসে স্বামীর পদমর্যাদা উন্নত হওয়ার পাশাপাশি মাসিক বেতন ২৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। এর চেয়ে সুখের খবর পরিবারে আর কী হতে পারে! পার্টিতে উপস্থিত ছিল অফিসেরই আরেকটি পরিবার। তখনই জানা গেল, ওই পরিবারের কর্তারও বেতন বেড়েছে মাসে ১৫ হাজার টাকা। খবরটি কেবল পার্টিতে আসার কিছু আগে জেনেছেন। অফিসে আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বেতনও এভাবে বেড়েছে। প্রথম পরিবার এ খবর শোনার পর অভিনন্দন জানালেন বটে, কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রথম ব্যক্তির বেতন যদি মাসে ১৫ হাজার টাকা না বেড়ে ৫ হাজার টাকাও বাড়ত এবং অফিসে আর কারও না বাড়ত তাহলে সুখের মাত্রা বেশি হতো। 'সবার সুখে আমার সুখ'_ এ প্রবাদ সব ক্ষেত্রে কিন্তু সত্য না-ও হতে পারে! সবাই সমান_ এটা অনেকেই মানসিকভাবে মেনে নিতে পারে না।
বিদায়ী বছরটির কথায় ফিরে আসি। দুর্নীতিই কি বছরের আলোচিত ঘটনা? সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক নামে একটি স্বল্প পরিচিত গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিল। একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনায় বিশিষ্টজনরা বললেন, হলমার্কের কর্ণধার যত সহজে সরকার পরিচালিত একটি ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, সেটা জেনে দেশের বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ লোক নিজেদের হাত কামড়াচ্ছে এটা ভেবে যে, জীবনে কিছুই করা গেল না। এই দলে বড় বড় ঋণখেলাপি থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাসহ অনেকেই রয়েছেন। তাদের অপরাধ চাপা থাকেনি। কিন্তু হলমার্ক চুপি চুপি অনেকটা সময় পার করে দিতে পেরেছে।
পদ্মা সেতুর কাজ থমকে আছে দুর্নীতির অভিযোগে। বরিশাল-খুলনা-যশোর অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন কীভাবে ভেঙে গেল! এ সেতুটি নির্মিত হলে মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল প্রভৃতি জেলার অনেক বাসিন্দা নিজের বাড়িতে থেকেই ঢাকায় প্রতিদিন অফিস করতে পারবে। যেতে-আসতে দরকার পড়বে দেড়-দুই ঘণ্টা করে। ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতেও এখন এর চেয়ে বেশি সময় দরকার পড়ে। কার পাপে এ সেতুর নির্মাণ কাজ থেমে আছে, কে জানাবে।
একটি কৌতুক আছে এভাবে_ নির্বাচনী জনসভায় এক নেতা একের পর এক অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন। এক পর্যায়ে বললেন, আপনাদের নদীতে ব্রিজ করে দেব। মঞ্চে নেতার আশপাশে থাকা সহচরদের একজন সাহস করে কানে কানে বলে গেলেন, লিডার এখানে তো নদী নেই। ব্রিজ বানাবেন কোথায়? এটা শুনে নেতা আরও উৎসাহিত হয়ে বললেন, আপনাদের একটা নদীও খনন করে দেব।
পদ্মা সেতু বানানোর জন্য প্রকৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা কি শুকিয়ে যাবে, এমন প্রশ্ন অনেকে করছেন। দুর্নীতি হয়নি, তার ষড়যন্ত্র হয়েছে_ এমনই অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে বাংলাদেশে সরকারের তত্ত্বাবধানে যেসব উন্নয়ন কাজ হয় তার অনেকগুলোতেই দুর্নীতি হয়। বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের অনেক প্রকল্পেও দুর্নীতি হয়। হাসপাতালে কম দামি ওষুধ কেনা হয় বেশি দাম দেখিয়ে। যে সড়কপথ এক কোটি টাকায় নির্মাণ করা যায় তার ব্যয় দেখানো হয় দ্বিগুণ বা তারও বেশি। স্কুলঘর নির্মাণে আসল লাভ যায় কনট্রাক্টরের পকেটে। এসব দুর্নীতি নিয়ে শত শত উদাহরণ দেওয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এখন সরকারি কাজ বরাদ্দের প্রধান একটি লক্ষ্য থাকে প্রভাবশালীদের নিজের লোককে কাজ পাইয়ে দেওয়া। যিনি কাজটি পাবেন তিনি দয়া করে যেটুকু করবেন, তাতেই ধন্য ধন্য করা উচিত। এক লাখ টাকার প্রকল্প থেকে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প_ সর্বত্রই কমবেশি একই চিত্র। সরকারি কাজের ঠিকাদারি পেতে যে এত মারামারি তার প্রধান কারণ এটাই। যখন যে দল ক্ষমতায় তারাই পাবে সরকারি কাজের ঠিকাদারি_ এটাই রেওয়াজ। বিএনপি আমলে এটা হয়েছে। তার আগে এইচএম এরশাদ আমলের জাতীয় পার্টি এটা করেছে। তার আগে করেছে জিয়াউর রহমানের 'জাতীয়তাবাদী' দল বিএনপি। সীমাহীন কেলেঙ্কারির কারণে তারেক রহমানের হাওয়া ভবন ধিকৃত হয়েছিল এবং তার প্রভাব পড়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে। কিন্তু মহাজোট সরকার কি সরকারি কাজে টেন্ডারবাজি কমাতে পেরেছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চার বছরে দুর্নীতি হলে এত উন্নতি হতে পারত না। কৃষিতে অগ্রগতি ধরা হলে অবশ্যই আমরা উন্নতি দেখি। যুগ যুগের ঘাটতির দেশ বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল। এখন যে পদ্মা সেতু ও গ্রামীণ ব্যাংকের মতো ইস্যুতে শেখ হাসিনার সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের কাছে নত হচ্ছে না তার বড় কারণ এই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।
বাংলাদেশের শিক্ষায় অগ্রগতিও চোখে পড়ার মতো। যে কেউ স্বীকার করবে, গোটা দেশ ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত। শিক্ষার যতটা প্রসার হয়েছে ততটা মান বাড়ছে না_ এ বক্তব্য অনেকে দিচ্ছেন। এর সমাধান হতেই হবে। কিন্তু মান না বাড়লে প্রসারও অর্থহীন মনে করার কারণ নেই। গত তিন বছরে ২০ লাখের মতো ছাত্রী ক্লাস এইটের পরীক্ষায় পাস করেছে_ আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য এক এক বড় অর্জন। সব স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীর কাছে সময়মতো বই পেঁৗছে দেওয়ার নজিরও আসলে বে-নজির। আমরা ভালো কাজ করতে পারি এবং যে সরকারের এত সমালোচনা তাদের দ্বারাও এটা সম্ভব। এমন ভালো কাজ তাহলে কেন বাড়ানো যাবে না?
বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিশ্ব সমাজে স্বীকৃত হওয়া এক অসাধারণ অর্জন। সমুদ্রে রয়েছে তেল-গ্যাস-খনিজ-মাছসহ অনেক অনেক সম্পদ। এসব কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাবে। আমরা নিশ্চয়ই তা পারব।
দেশ যে এগিয়ে চলেছে সেটা অস্বীকার করা যাবে না। গত কয়েক বছরে আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়েছে কি-না, সে প্রশ্ন করা হলে প্রথমে হয়তো 'না-সূচক' উত্তর আসবে। কিন্তু একটু ভাবলেই উত্তর আসবে_ হ্যাঁ, কিছুটা ভালো তো হয়েছেই। দশ বছর আগের তুলনাতেও দেশ এগিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের বছর ১৯৭১ সালে আমরা যেমন ছিলাম, তার চেয়ে অনেক অনেক এগিয়েছি। এ কারণে বলতেই হবে, যে দিন চলে যায় সেটাই ভালো নয়। সামনের দিনও ভালো হতে পারে এবং হচ্ছেও। তবে একদল হয়তো বলবে, যতটা চেয়েছি ততটা ভালো হয়নি। আরেক দল মনে করবে_ হলমার্কের মতো দুর্নীতি না হলে দেশ আরও এগিয়ে যেত। কৃষি বিষয়ে কাজ করেন এমন একজন সংবাদমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সম্প্রতি একসঙ্গে আলোচনায় বলেছেন, গ্রামের মানুষ যতটা ভালো আছে বলে সরকার দাবি করছে, বাস্তবে তার চেয়েও একটু ভালো আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সরকার নিজেও তার সফলতা তুলে ধরতে পারে না। সরকার গ্রামের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে পারলে এবং যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তাতে দুর্নীতি কমাতে পারলে কৃষকরা দেশকে আরও অনেক কিছু দিতে পারে। এই যে ঘরে ঘরে এখন অন্তত ক্লাস এইট পাস একটি ছেলে বা মেয়ে আছে সেটাও কিন্তু তাদের জীবনকে বদলে দিতে পারে এবং দিচ্ছেও। এসব ছেলেমেয়ে যাতে স্কুলে আরও ভালো শিক্ষা পায় সে জন্য ভালো শিক্ষক দরকার। সেজন্য শিক্ষকদের আরও বেশি বেতন দিতে হবে। এভাবে ভালো শিক্ষা পেয়ে যারা বেড়ে উঠবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো করবে, ভালো ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হবে। তারা সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে পরিকল্পনা করবে। তখন দেশের বাইরে কাজের জন্য আরও দক্ষ লোক পাঠানো যাবে। ফলে প্রবাস থেকে আরও বেশি অর্থ আসবে।
এমনটিই সবার কামনা। এ জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই। যে রাজনীতি নেতাকর্মীদের দুর্নীতি খারাপ মনে করে না তাদের চাই না। যে রাজনীতি মানুষের শ্রম ও সৃজনের ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবে তাদেরই চাই নেতৃত্বে।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
ব্যবসা কেমন চলছে, এমন কথা ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত কাউকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর মিলবে, ভালো নেই। নিত্যপণ্যের বাজার থেকে ফেরার পথে কারও কাছে টেলিভিশন ক্যামেরার সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করবেন, বাজার কেমন_ উত্তর প্রায় সবার জানা, সব কিছুতে আগুন। সংসার চালানো যাচ্ছে না। যে দোকানি ১০০ টাকায় কেনা পণ্য অতিরিক্ত লাভে বিক্রি করছে ১৩০-১৪০ টাকায়_ সেও বলবে, ভালো নেই। যে সরকারদলীয় কর্মী অস্ত্র দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে সেও বলবে, এই আমলে ত্যাগের মূল্যায়ন নেই। বিএনপির যে কর্মীরা এক সময়ে হাওয়া ভবনের বদৌলতে ভাগ্য ফিরিয়েছে তারা বলবে, দল ক্ষমতায় থাকার সময়ে আমাদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। আগামীতে যেন এটা মনে রাখা হয়।
কেন এমন হয়? এক পরিচিত চাকরিজীবী বলছিলেন তার বাসা বদলানোর অভিজ্ঞতার কথা। আশির দশকের শুরুতে এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে তার রাজধানী ঢাকার বুকে সংসার জীবন শুরু। বাসা বদল করে যখন ২ রুমের বাড়িতে গেলেন, সব মালপত্র বহন করতে দরকার পড়ল মাত্র একটা ঠেলাগাড়ি। পরের বাসা বদলানোর সময় লাগল একটি ট্রাক। আর সর্বশেষ বাসা বদলালেন যখন, প্রয়োজন পড়ল একটি ট্রাকের তিনটি ট্রিপ। এক সময়ে পছন্দ করে কেনা কিছু জিনিস শেষ পর্যন্ত ফেলে দিলেন। মাঝারি আকারের ছোট ফ্রিজটি সাত বছর চলেছে। নতুন বড় ফ্রিজ কেনার সময় দেখা গেল, আগেরটা রাখার স্থান নেই। পুরাতন ইলেক্ট্রনিক দ্রব্য কেনাবেচা করে এ ধরনের একটি দোকানে সেটি বিক্রি করতে চাইলে যে নামমাত্র দাম বলা হয় তাতে মাথায় রক্ত ওঠার মতো অবস্থা। রঙিন টিভি বদলেছেন, বড় পর্দার সেট কিনেছেন। পুরাতনটির কোনো দাম নেই। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনে বোধকরি সবারই কমবেশি একই অভিজ্ঞতা।
সুখের সংজ্ঞা কী? দুটি পরিবারের অনুভূতি এ প্রসঙ্গে বলতে চাই। একটি পরিবারে জমকালো পার্টির আয়োজন করেছেন গৃহকর্ত্রী_ উপলক্ষ, অফিসে স্বামীর পদমর্যাদা উন্নত হওয়ার পাশাপাশি মাসিক বেতন ২৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। এর চেয়ে সুখের খবর পরিবারে আর কী হতে পারে! পার্টিতে উপস্থিত ছিল অফিসেরই আরেকটি পরিবার। তখনই জানা গেল, ওই পরিবারের কর্তারও বেতন বেড়েছে মাসে ১৫ হাজার টাকা। খবরটি কেবল পার্টিতে আসার কিছু আগে জেনেছেন। অফিসে আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বেতনও এভাবে বেড়েছে। প্রথম পরিবার এ খবর শোনার পর অভিনন্দন জানালেন বটে, কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রথম ব্যক্তির বেতন যদি মাসে ১৫ হাজার টাকা না বেড়ে ৫ হাজার টাকাও বাড়ত এবং অফিসে আর কারও না বাড়ত তাহলে সুখের মাত্রা বেশি হতো। 'সবার সুখে আমার সুখ'_ এ প্রবাদ সব ক্ষেত্রে কিন্তু সত্য না-ও হতে পারে! সবাই সমান_ এটা অনেকেই মানসিকভাবে মেনে নিতে পারে না।
বিদায়ী বছরটির কথায় ফিরে আসি। দুর্নীতিই কি বছরের আলোচিত ঘটনা? সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক নামে একটি স্বল্প পরিচিত গ্রুপ হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিল। একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনায় বিশিষ্টজনরা বললেন, হলমার্কের কর্ণধার যত সহজে সরকার পরিচালিত একটি ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, সেটা জেনে দেশের বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ লোক নিজেদের হাত কামড়াচ্ছে এটা ভেবে যে, জীবনে কিছুই করা গেল না। এই দলে বড় বড় ঋণখেলাপি থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাসহ অনেকেই রয়েছেন। তাদের অপরাধ চাপা থাকেনি। কিন্তু হলমার্ক চুপি চুপি অনেকটা সময় পার করে দিতে পেরেছে।
পদ্মা সেতুর কাজ থমকে আছে দুর্নীতির অভিযোগে। বরিশাল-খুলনা-যশোর অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন কীভাবে ভেঙে গেল! এ সেতুটি নির্মিত হলে মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল প্রভৃতি জেলার অনেক বাসিন্দা নিজের বাড়িতে থেকেই ঢাকায় প্রতিদিন অফিস করতে পারবে। যেতে-আসতে দরকার পড়বে দেড়-দুই ঘণ্টা করে। ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতেও এখন এর চেয়ে বেশি সময় দরকার পড়ে। কার পাপে এ সেতুর নির্মাণ কাজ থেমে আছে, কে জানাবে।
একটি কৌতুক আছে এভাবে_ নির্বাচনী জনসভায় এক নেতা একের পর এক অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন। এক পর্যায়ে বললেন, আপনাদের নদীতে ব্রিজ করে দেব। মঞ্চে নেতার আশপাশে থাকা সহচরদের একজন সাহস করে কানে কানে বলে গেলেন, লিডার এখানে তো নদী নেই। ব্রিজ বানাবেন কোথায়? এটা শুনে নেতা আরও উৎসাহিত হয়ে বললেন, আপনাদের একটা নদীও খনন করে দেব।
পদ্মা সেতু বানানোর জন্য প্রকৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা কি শুকিয়ে যাবে, এমন প্রশ্ন অনেকে করছেন। দুর্নীতি হয়নি, তার ষড়যন্ত্র হয়েছে_ এমনই অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে বাংলাদেশে সরকারের তত্ত্বাবধানে যেসব উন্নয়ন কাজ হয় তার অনেকগুলোতেই দুর্নীতি হয়। বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের অনেক প্রকল্পেও দুর্নীতি হয়। হাসপাতালে কম দামি ওষুধ কেনা হয় বেশি দাম দেখিয়ে। যে সড়কপথ এক কোটি টাকায় নির্মাণ করা যায় তার ব্যয় দেখানো হয় দ্বিগুণ বা তারও বেশি। স্কুলঘর নির্মাণে আসল লাভ যায় কনট্রাক্টরের পকেটে। এসব দুর্নীতি নিয়ে শত শত উদাহরণ দেওয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এখন সরকারি কাজ বরাদ্দের প্রধান একটি লক্ষ্য থাকে প্রভাবশালীদের নিজের লোককে কাজ পাইয়ে দেওয়া। যিনি কাজটি পাবেন তিনি দয়া করে যেটুকু করবেন, তাতেই ধন্য ধন্য করা উচিত। এক লাখ টাকার প্রকল্প থেকে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প_ সর্বত্রই কমবেশি একই চিত্র। সরকারি কাজের ঠিকাদারি পেতে যে এত মারামারি তার প্রধান কারণ এটাই। যখন যে দল ক্ষমতায় তারাই পাবে সরকারি কাজের ঠিকাদারি_ এটাই রেওয়াজ। বিএনপি আমলে এটা হয়েছে। তার আগে এইচএম এরশাদ আমলের জাতীয় পার্টি এটা করেছে। তার আগে করেছে জিয়াউর রহমানের 'জাতীয়তাবাদী' দল বিএনপি। সীমাহীন কেলেঙ্কারির কারণে তারেক রহমানের হাওয়া ভবন ধিকৃত হয়েছিল এবং তার প্রভাব পড়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে। কিন্তু মহাজোট সরকার কি সরকারি কাজে টেন্ডারবাজি কমাতে পেরেছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চার বছরে দুর্নীতি হলে এত উন্নতি হতে পারত না। কৃষিতে অগ্রগতি ধরা হলে অবশ্যই আমরা উন্নতি দেখি। যুগ যুগের ঘাটতির দেশ বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ১৯৭৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল। এখন যে পদ্মা সেতু ও গ্রামীণ ব্যাংকের মতো ইস্যুতে শেখ হাসিনার সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের কাছে নত হচ্ছে না তার বড় কারণ এই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।
বাংলাদেশের শিক্ষায় অগ্রগতিও চোখে পড়ার মতো। যে কেউ স্বীকার করবে, গোটা দেশ ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত। শিক্ষার যতটা প্রসার হয়েছে ততটা মান বাড়ছে না_ এ বক্তব্য অনেকে দিচ্ছেন। এর সমাধান হতেই হবে। কিন্তু মান না বাড়লে প্রসারও অর্থহীন মনে করার কারণ নেই। গত তিন বছরে ২০ লাখের মতো ছাত্রী ক্লাস এইটের পরীক্ষায় পাস করেছে_ আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য এক এক বড় অর্জন। সব স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীর কাছে সময়মতো বই পেঁৗছে দেওয়ার নজিরও আসলে বে-নজির। আমরা ভালো কাজ করতে পারি এবং যে সরকারের এত সমালোচনা তাদের দ্বারাও এটা সম্ভব। এমন ভালো কাজ তাহলে কেন বাড়ানো যাবে না?
বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিশ্ব সমাজে স্বীকৃত হওয়া এক অসাধারণ অর্জন। সমুদ্রে রয়েছে তেল-গ্যাস-খনিজ-মাছসহ অনেক অনেক সম্পদ। এসব কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাবে। আমরা নিশ্চয়ই তা পারব।
দেশ যে এগিয়ে চলেছে সেটা অস্বীকার করা যাবে না। গত কয়েক বছরে আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়েছে কি-না, সে প্রশ্ন করা হলে প্রথমে হয়তো 'না-সূচক' উত্তর আসবে। কিন্তু একটু ভাবলেই উত্তর আসবে_ হ্যাঁ, কিছুটা ভালো তো হয়েছেই। দশ বছর আগের তুলনাতেও দেশ এগিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের বছর ১৯৭১ সালে আমরা যেমন ছিলাম, তার চেয়ে অনেক অনেক এগিয়েছি। এ কারণে বলতেই হবে, যে দিন চলে যায় সেটাই ভালো নয়। সামনের দিনও ভালো হতে পারে এবং হচ্ছেও। তবে একদল হয়তো বলবে, যতটা চেয়েছি ততটা ভালো হয়নি। আরেক দল মনে করবে_ হলমার্কের মতো দুর্নীতি না হলে দেশ আরও এগিয়ে যেত। কৃষি বিষয়ে কাজ করেন এমন একজন সংবাদমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সম্প্রতি একসঙ্গে আলোচনায় বলেছেন, গ্রামের মানুষ যতটা ভালো আছে বলে সরকার দাবি করছে, বাস্তবে তার চেয়েও একটু ভালো আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সরকার নিজেও তার সফলতা তুলে ধরতে পারে না। সরকার গ্রামের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে পারলে এবং যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তাতে দুর্নীতি কমাতে পারলে কৃষকরা দেশকে আরও অনেক কিছু দিতে পারে। এই যে ঘরে ঘরে এখন অন্তত ক্লাস এইট পাস একটি ছেলে বা মেয়ে আছে সেটাও কিন্তু তাদের জীবনকে বদলে দিতে পারে এবং দিচ্ছেও। এসব ছেলেমেয়ে যাতে স্কুলে আরও ভালো শিক্ষা পায় সে জন্য ভালো শিক্ষক দরকার। সেজন্য শিক্ষকদের আরও বেশি বেতন দিতে হবে। এভাবে ভালো শিক্ষা পেয়ে যারা বেড়ে উঠবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো করবে, ভালো ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হবে। তারা সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে পরিকল্পনা করবে। তখন দেশের বাইরে কাজের জন্য আরও দক্ষ লোক পাঠানো যাবে। ফলে প্রবাস থেকে আরও বেশি অর্থ আসবে।
এমনটিই সবার কামনা। এ জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই। যে রাজনীতি নেতাকর্মীদের দুর্নীতি খারাপ মনে করে না তাদের চাই না। যে রাজনীতি মানুষের শ্রম ও সৃজনের ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবে তাদেরই চাই নেতৃত্বে।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments