টিআইবির খানা জরিপ-দুর্নীতি হ্রাসের চেষ্টা অব্যাহত থাকুক
শুক্রবার জাতীয় খানা জরিপ প্রকাশ করেছে টিআইবি। এক গৃহে বসবাসরত বা একই সঙ্গে খাদ্যগ্রহণরত একককে এ জরিপে খানা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলা থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে প্রতিটি স্তর থেকে প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসইউ) নির্বাচন করা হয়।
শহরাঞ্চল থেকে ১৪০ ও গ্রামাঞ্চল থেকে ২১০টি পিএসইউ বাছাই করা হয়। এ পিএসইউগুলোর মধ্যে পরিচালিত জরিপই খানা জরিপ হিসেবে আখ্যায়িত। সাধারণত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) বড় দুর্নীতিগুলোর তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে দুর্নীতির ধারণা সূচক তৈরি করে। কিন্তু টিআইবির খানা জরিপের লক্ষ্য তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধান, বিশেষ করে সেবা খাতগুলোর ওপর তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ। এ জরিপটি দুই বছর পরপর হয়, ১৯৯৭ থেকে এ পর্যন্ত ছয়টি খানা জরিপ পরিচালিত হয়েছে। এবারের জরিপে ২০১১ সালের মে মাস থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৩টি সেবা খাতের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, সেবা খাতে দুর্নীতি ও হয়রানির হার কমে এসেছে। দুর্নীতির হার প্রায় ৩০ ভাগ কমে আসার ঘটনাটি ইতিবাচক নিঃসন্দেহে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, ঘুষসহ দুর্নীতি ব্যয় বেড়েছে। ২০১০ সালে প্রতিটি খানাকে দুর্নীতির জন্য ব্যয় করতে হতো ৩ হাজার ১৮৪ টাকা, এখন সে ব্যয় দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, পরিমাণগতভাবে দুর্নীতি কমলেও, এর ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাত ছাড়া অন্য সব খাতের দুর্নীতিই কমেছে। আর দুর্নীতির ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে আছে শ্রম অভিবাসন খাত। দ্বিতীয় স্থান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার। যে ১৩টি খাতের ওপর জরিপ পরিচালিত হয়েছে, সেগুলো সাধারণের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। দৈনন্দিন প্রয়োজনেই এসব সেবা গ্রহণ করতে হয় সাধারণ মানুষকে। আর সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের নানামুখী দুর্নীতির শিকার হতে হয়। দুর্নীতি কিছুটা কমেছে, সেটি নিশ্চয় স্বস্তির বিষয়, কিন্তু যে দুর্নীতি রয়ে গেছে তার চাপ কম নয়। টিআইবি বা অন্য কোনো সংস্থার জরিপে উঠে না এলেও এ ধরনের দুর্নীতির অভিজ্ঞতা প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো, বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে সেবা খাতের দুর্নীতি কমানো। কেননা এগুলো সাধারণ মানুষকে সরাসরি আক্রান্ত করে। বিভিন্ন সেবা সম্পর্কে সাধারণ্যে এতটাই নেতিবাচক ধারণা যে, লোকে বাধ্য না হলে স্বেচ্ছায় নির্দিষ্ট কিছু সেবা গ্রহণে আগ্রহী হন না। কোনো কোনো সেবার জন্য উৎকোচ, হয়রানি, সময়ক্ষেপণকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরা হয়। পরিস্থিতি এখনও সন্তোষজনক নয়। শ্রম অভিবাসন খাতে উন্নতি করতে হলে এ খাতে সেবার মান উন্নত করতেই হবে। অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, প্রতিশ্রুত কাজ না দেওয়া, অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কারণে শুধু দেশের সেবাগ্রহীতারাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, বিদেশে আমাদের শ্রম বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে এ খাতটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আইন-শৃঙ্খলা সেবার মান বাড়ানোর জন্যও বিশেষ উদ্যোগ আসা দরকার। স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে খাতওয়ারি নানা পদক্ষেপ জরুরি। টিআইবি কিছু পরামর্শ দিয়েছে। যেমন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের তদারকি বাড়ানো, জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন বাস্তবায়ন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালীকরণ। এসব ক্ষেত্রে সরকারের মনোযোগ আসবে বলে আমরা আশা করি। টিআইবির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদন ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলে তা নাগরিকদের আশ্বস্ত করবে। তবে শুধু ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয়, এ ক্ষেত্রে পরামর্শগুলোকে আমলে নিতে হবে, পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কাজ করে যেতে হবে। খানা জরিপের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা দিল তা এগিয়ে নিতে সরকারের তৎপরতা অব্যাহত থাকুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
No comments