পুলিশের ওপর হিযবুতের চোরাগোপ্তা হামলা
জাতীয় প্রেসকèাবের নির্বাচন এবং অদূরে প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনার ভাষণ চলাকালেই জামায়াত-শিবিরের প্রত্যক্ষ মদদে পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর। চোরাগোপ্তা হামলার সময় পুলিশের সঙ্গে জঙ্গীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। জঙ্গী হামলায় পুলিশ ও পথচারীসহ অন্তত ৫ জন আহত হয়েছেন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে হয়েছে। পুলিশ ও র্যাব দুই দফায় ৩৯ জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জাতীয় প্রেসক্লাবে নির্বাচন এবং সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ চলাকালে এ ধরনের জঙ্গী হামলার বিশেষ কোন উদ্দেশ্য ছিল কি-না তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচনের কারণে প্রেসক্লাব চত্বর ছিল জমজমাট। এছাড়া অদূরে সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ দিচ্ছিলেন। দুপুর ১২টার দিকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্্রীরের শতাধিক নেতাকর্মী বিভিন্ন গলি থেকে বের হয়ে প্রেসক্লাবের বিপরীত পাশে কমিউনিটি সেন্টারের কাছে অবস্থান নেয়। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই জঙ্গীরা আচমকা হিযবুত তাহ্রীরের ব্যানার নিয়ে ঝটিকা মিছিল বের করে। মিছিলটি প্রেসক্লাবের সামনে গিয়েই পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এ সময় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করছিল। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ, পথচারী, যানবাহনে থাকা যাত্রী, প্রেসক্লাবে অবস্থানকারী প্রার্থী, ভোটার ও ভোট দেখতে আসা দর্শনার্থীরা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। মুর্হূতেই বন্ধ হয়ে যায় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় যানবাহন চলাচল।
পুলিশও মিছিলকারীদের ধাওয়া করে। হিযবুত তাহ্রীর নেতাকর্মীরা এ সময় পুলিশ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালনকারীদের লক্ষ্য করে পর পর কয়েকটি বোমা নিক্ষেপ করে। শক্তিশালী বোমাগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এ সময় পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পুলিশ হিযবুত তাহ্রীরের ৭ সদস্যকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, জাহিদুল ইসলাম (৩১), রাশেদ বিন নাজির (২৪), শাহেদ হোসেন (২৫), আলী অহসান (২৫), সুমন (২২), রুহুল আমিন (৩৫) ও হাফিজুর রহমান (২৫)। এরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র।
পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া শুরু হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে জঙ্গীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে হয়। পুলিশ ৫-৭টি টিয়ারশেল ও ২০-২৫ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়লে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। সংঘর্ষে পুলিশ ও পথচারীসহ অন্তত ৫ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে নাজিম উদ্দিন বাবলা (৫০) ও মিরপুর বাঙলা কলেজের ইংরেজী বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র জহিরুল ইসলামের (২৪) পরিচয় জানা গেছে। আহত নাজিম উদ্দিন বাবলা পথচারী। আর জহিরুল ইসলামও নিজেকে পথচারী দাবি করেছেন। তবে কি কারণে ঘটনার সময় প্রেসক্লাবে জহিরুল উপস্থিত ছিলেন তা জানার চেষ্টা চলছে।
পুলিশ ও র্যাবের ধাওয়ার মুখে জঙ্গীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীত পাশের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে। অধিকাংশ মিছিলকারী বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন) ভবনে ঢুকে পড়ে। এ সময় পুলিশ ও র্যাব ভবনের চারদিকে অবস্থান নেয়। দুপুর দেড়টার দিকে ভবনে তল্লাশি চালিয়ে ৩২ হিযবুত তাহ্রীর সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের তাৎক্ষণিকভাবে র্যাব-৩-এর টিকাটুলী কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, সারাদেশ থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের ৫ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী সিডি, বই, লিফলেটসহ আপত্তিকর জিনিসপত্র। তারপরও থেমে নেই নিষিদ্ধ সংগঠনটির তৎপরতা। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা চালানোর নেপথ্য রয়েছে জামায়াত-শিবির। জামায়াত-শিবির জঙ্গীদের মাঠে নামাতে প্রচুর অর্থ খরচ করছে। জামায়াতের অর্থেই মাঠে সক্রিয় রয়েছে হিযবুত তাহ্রীর। সংগঠনটি নানা নামে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রায় প্রতিদিনই নিষিদ্ধ সংগঠনটি দেশের কোথাও না কোথাও চোরাগোপ্তা হামলা বা ঝটিকা মিছিল বের করছে। অনেক সময় গ্রেফতার হচ্ছে। আবার অধিকাংশ সময় গ্রেফতার হচ্ছে না। গত ২১ ডিসেম্বর বরিশালের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে ঝটিকা মিছিলকালে গ্রেফতার হয় হিযবুত তাওহীদ নামে সংগঠিত হওয়া হিযবুত তাহ্রীরের ৫ সদস্য। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ দাজ্জাল বই, সিডি, বিভিন্ন ধরনের লিফলেট উদ্ধার করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০২ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে উত্তরায় বৈদেশিক অর্থায়নে পরিচালিত একটি এনজিও কার্যালয়ে হিযবুত তাহ্রীরের ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোলটেবিল বৈঠকের মধ্য দিয়ে হিযবুত তাহ্রীরের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম চালুর ঘোষণা দেয় কমিটি। ঘোষণার এক মাস পর মার্চ থেকেই সংগঠনটি আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। হিযবুত তাহ্রীর গঠনের পর সংগঠনটির নিজস্ব কোন স্থায়ী অফিস ছিল না। এ সময় জামায়াতে ইসলামীর নির্দেশে ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁটাবন এলাকার খায়রুন্নেছা ভবনে তাদের নিজস্ব কার্যালয়ে হিযবুত তাহ্রীরকে স্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করে দেয়।
২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রবিরোধী এবং জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িত থাকার দায়ে হিযবুত তাহ্রীরের কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর আগে ২০০৮ সালে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কার্যক্রমসহ জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে পাকিস্তান সরকার সেদেশে হিযবুত তাহ্্রীরের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর ৩ জন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তারপরও থেমে নেই জঙ্গী সংগঠনটির কার্যক্রম।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে জামায়াত-শিবির সারাদেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চোরাগুপ্তা হামলা চালাচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সারাদেশের বিভিন্ন চোরাগুপ্তা হামলায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর, জেএমবি, হুজি এবং উগ্র ইসলামী ও মৌলবাদী সংগঠন গুলো অংশ নিচ্ছে। মূলত জামায়াতের টাকায় আবারও মাঠে নেমেছে হিযবুত তাহ্রীর। সংগঠনের নেতাকর্র্মীরা গ্রেফতার এড়াতে হিযবুত তাহ্রীর নামের পরিবর্তে হিযবুত তাওহীদ নামে সংগঠিত হয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেসব এলাকায় জামায়াত-শিবিরের অবস্থান শক্ত, সেসব এলাকায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর বেশি তৎপর। পুরনো সম্পর্ক আর অর্থের কারণে স্বাভাবিকভাবেই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীর সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচন চলাকালে এবং অদূরে সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ চলাকালে পুলিশের ওপর হামলা চালায় হিযবুত তাহ্রীর। এর পেছনে আর কোন উদ্দেশ্য ছিল কি-না তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। হিযবুত তাহ্রীর তাদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে জানান দিতেই এমন হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে।
No comments