আগে রূপরেখা দিন, পরে আলোচনা ও সমাধান হতে পারে by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
১৮ দল সংবিধানে নির্বাচনকালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন চায়। গণফোরাম, বিকল্প ধারা এবং আরো দু-একটি ছোট দলও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে। তবে ১৮ দলের সঙ্গে অন্য দলগুলো এক মঞ্চে নেই। কেননা ১৮ দলের সঙ্গে জামায়াত রয়েছে।
১৮ দলের বর্তমান আন্দোলন যতটা না তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য, এর চেয়ে এ আন্দোলনের পেছনে জামায়াতের প্রধান এজেন্ডা অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করার দাবি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতি কারো কারো দুর্বলতা ও সমর্থন থাকলেও ১৮ দলের সঙ্গে অথবা ১৯৯৫-৯৬ সালের মতো যুগপৎভাবে আন্দোলনে নামছে না অন্য কোনো দল অথবা জোটই। এরই মধ্যে ২৬ ডিসেম্বর ১৮ দল ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেছে। ঢাকায় ১৮ দলের প্রধান দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বেশ কয়েকটি পথসভায় ভাষণ দিয়েছেন। ঢাকার বাইরে বড় শহরগুলোতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা গণসংযোগে অংশগ্রহণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। তবে গণসংযোগগুলোতে ব্যাপকসংখ্যক জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী অংশ নিয়ে তাদের দলীয় আটককৃত নেতাদের মুক্তির দাবিতে ব্যাপকভাবে সোচ্চার ছিল। সভাগুলোতে বিএনপির নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি ছাড়াও সরকারের বিরুদ্ধে নানা ব্যর্থতার অভিযোগ তোলেন। ঢাকায় গণসংযোগে ভাষণদানকালে খালেদা জিয়া সরকারের প্রতি আগামী শীতকালীন সংসদ অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল উত্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন, তা করা হলে বিএনপি সংসদ অধিবেশনে ফিরে যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। বিএনপির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা এম কে আনোয়ার সিলেটে গণসংযোগে অংশগ্রহণ করে প্রায় অনুরূপ দাবি করেছেন। ঢাকায় খালেদা জিয়া তাঁর বক্তৃতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করলে সরকারকে মেয়াদ পূর্ণ করার সময় দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন। তা করা না হলে জানুয়ারি মাস থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন আরো জোরদার করা হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। জানুয়ারিতে ১৮ দলীয় জোট রাজপথে আরো বেশি আক্রমণাত্মক থাকবে- এমনটি বেশ স্পষ্ট। কেননা তখন মানবতাবিরোধী অপরাধে আটককৃতদের মধ্য থেকে দু-একজনের বিচারের রায় ঘোষিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুতরাং জামায়াত তখন দলীয় এবং ১৮ দলীয় জোটগতভাবে রাজপথে মারমুখী থাকবে, বিএনপিও প্রচ্ছন্নভাবে এ বিচারের বিরুদ্ধে রয়েছে; তাই মুখে বা নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদারে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বেশ উৎসাহী থাকবেই। ফলে নামে তত্ত্বাবধায়ক হলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ১৮ দলীয় জোট রাজপথ উত্তপ্ত করবে- এটি প্রায় নিশ্চিত। তবে যে বিষয়টি সাধারণ মানুষ বা রাজনীতিসচেতন মহলের কাছে এখনো একেবারেই পরিষ্কার নয় তা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার রূপরেখাটি কী হবে, তা বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোট থেকে এখনো দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা হয়নি। বিষয়টি জরুরি এ কারণে যে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন ও কার্যকারিতা নিয়ে সব মহলেরই নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ আছে। সংবিধানের ৫৮(খ) ও (গ) অনুচ্ছেদ দুটি তখন যেভাবে ছিল, তাতে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা অন্য বিচারপতিদের এই সরকারে না জড়ানোর নির্দেশনা সুপ্রিম কোর্টের রায়েই দেওয়া আছে। অথচ ওই সরকার গঠনে ৫৮(গ) অনুচ্ছেদে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগের জন্য ধারা (১), (২), (৩), (৪) ও (৫)-এ নানাভাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা ছিল। পঞ্চম ধারায় বলা হয়েছিল, 'যদি আপিল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করিতে অসম্মত হন, তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি যত দূর সম্ভব প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের সহিত আলোচনাক্রমে বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক এই অনুচ্ছেদের অধীন উপদেষ্টা হইবার যোগ্য তাহাদের মধ্য হইতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন।'
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে পঞ্চদশ সংশোধন-পূর্ববর্তী বাস্তবতা কতটা জটিল এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অশান্ত, সংঘাতময় করতে পারে তা ২০০৬ সালে জ্বলন্ত প্রমাণ হিসেবেই আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে বিচার বিভাগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার ফলে বিচার বিভাগের অভ্যন্তরে অতি স্বল্প সময়ে যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল তা থেকে দেশের বিচারব্যবস্থাকে বের করে আনা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন না করলেও এ মুহূর্তে বিরোধী দল আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দেশে আন্দোলন করতই, নানা বিতর্ক সৃষ্টি হতোই, জামায়াত-বিএনপি ঘরানা মিডিয়ায় ওই বিচারপতিদের নিয়ে নানা ধরনের কাহিনী প্রচার করতই। আমাদের রাজনৈতিক ও মিডিয়া সংস্কৃতি এখন অনেকটা এ পর্যায়েই চলে গেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ফলে আন্দোলনের ইস্যুতে সাবেক প্রধান অন্য বিচারপতিদের নাম বা তাঁদের রাজনৈতিক চরিত্র উদ্ঘাটনের বিষয়টি আপাতত নেই, আছে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি, যার অতীত রূপরেখা আসলেই ভয়ানকভাবে ত্রুটিপূর্ণ ছিল, সেটির প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে বিদায়ী সরকার ২০০৬ সালেই পেছনে থেকে কলকাঠি নেড়েছিল, ৫৮(গ) অনুচ্ছেদের প্রথম ধারা থেকে একলাফে ষষ্ঠ ধারায় রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে বাধ্য করেছিল। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রধান উপদেষ্টা হয়ে তাঁর ১০ উপদেষ্টাকে এড়িয়েই চলতেন, প্রেসসচিব মুখলেছুর রহমান চৌধুরীকে উপদেষ্টাদের বৈঠকে উপস্থিত থাকতে দিয়ে আইনবহির্ভূত কাজ করেছিলেন। এসব দেখে এক পর্যায়ে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা নতুন চারজনকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিলেন। সেই তত্ত্বাবধায়কের স্বেচ্ছাচারিতার পেছনে বিদায়ী জোট সরকারের মদদ ও শক্তি কতটা প্রবল ও প্রত্যক্ষ ছিল, তা একটু স্মরণ করলেই বোঝা যাবে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কতটা 'নির্দলীয়', কতটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। এখন বিরোধী দল যখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের দাবি করছে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে- এটি কি সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যা ১৯৯৬ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল? বস্তুত তখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা ও কার্যপ্রণালী বিধিবিধান নিয়ে আন্দোলনরত দলগুলো খুব বেশি হোমওয়ার্ক করেনি, সরকারি দল তো তা শুনতেই পায়নি, ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একদলীয় সংসদে তাড়াহুড়া করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি সংবিধানের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ- নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা ৫৮(খ) ও ৫৮(গ)-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি অদ্ভুত উটের পিঠে বাংলাদেশকে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশায় চড়া ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। প্রয়োজন ছিল এটি নিয়ে তখন বা পরে প্রচুর একাডেমিক আলোচনা-পর্যালোচনা করা। আমাদের দেশে মস্তবড় অভাব হচ্ছে কোনো দাবিদাওয়া নিয়েই রাজনৈতিক দলের কোনো সিরিয়াস হোমওয়ার্ক না করা। তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আমরা জাতিগতভাবেই বোধ হয় গভীর চিন্তার প্রয়োজনীয়তা খুব একটা উপলব্ধি করতে চাই না, হালকা কিছু ধারণা দিয়ে বিশেষ কৃতিত্ব নিতে চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর কেউ কেউ এ ব্যবস্থা পৃথিবীর সব দেশকে অনুসরণ করার কথাও উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন, পরিচালনা ও কার্যকারিতা নিয়ে শুরু থেকেই নানা সমস্যা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এটির প্রতিক্রিয়া সর্বোচ্চ বিচারালয়, রাষ্ট্র-রাজনীতিতে কতটা সৃষ্টি হয়েছিল, কেন হয়েছিল এর কোনোটিই পূণর্মূল্যায়ন করা হয়নি। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরও বিষয়টি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের যেভাবে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। সরকারি দল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করার প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলকে যেভাবে যুক্ত করা দরকার ছিল, বিরোধী দল তা এড়িয়ে চলার যে নীতি নিয়েছিল, তা সরকারের জনগণকে স্পষ্ট করা প্রয়োজন ছিল। তা করা হয়নি। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ সরকারি দল বিরোধী দলকে যেমন দিয়েছিল, জনগণ বিষয়টির যৌক্তিকতা বুঝে ওঠার আগেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা 'নাই' হয়ে গেল। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে নানা সন্দেহ দানা বাঁধার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে সন্দেহের সেই অবকাশটুকুকে আশ্রয় করেই ১৮ দলীয় জোট এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মাঠ গরম করার সুযোগ পাচ্ছে। এখন বিরোধী দল দাবি করছে, সরকারকে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনতে। অথচ বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো রূপরেখা এ পর্যন্ত উপস্থাপন করেনি। তারা যদি নির্বাচনকালীন সরকারের গঠন ও প্রক্রিয়া কিভাবে হবে; একটি সরকার থেকে অন্য একটি সরকারে দায়িত্ব হস্তান্তরের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া কী হবে; কারা কী উপায়ে তখন সরকার গঠন করবে; করলে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে কি না; বিশেষ কোনো মহলের প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে কি না- এ বিষয়গুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া খুবই দরকার। বিরোধী দল কী ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চায়- তা তো আগে খোলাসা করে বলতে হবে। বিচারপতিদের তো আর তাতে টানা যাবেই না, এটি আদালতেরই নির্দেশনায় আছে। তাহলে কাদের নিয়ে নির্দলীয় সরকার গঠন সম্ভব, তা পরিষ্কার হওয়া উচিত। মিডিয়ায় এ পর্যন্ত তেমন কোনো সিরিয়াস প্রস্তাবনা নিয়ে বিএনপির কোনো নেতাকে আলোচনা করতে আমরা শুনিনি। এমনকি ড. কামাল হোসেন কিংবা ডা. বি চৌধুরীও ভবিষ্যৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখাটি কী হতে পারে এর কোনো ধারণাই এ পর্যন্ত দেননি। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেছে; একের পর এক হরতাল, অবরোধ, মিছিল, সমাবেশ হচ্ছে; নানা উদ্ভট কথাবার্তা, গালাগালি, চেঁচামেচি হচ্ছে; কিন্তু সিরিয়াস কোনো প্রস্তাব কেউই করছেন না। দেশে যথেষ্টসংখ্যক সংবিধান বিশেষজ্ঞ আছেন বলে অনেকেই দাবি করছেন। তেমন কয়েকজনের সহযোগিতা নিয়ে বিরোধী দল একটি রূপরেখা আগে দাঁড় করুক; আলোচনার জন্য তা মিডিয়ার সম্মুখে তুলে ধরুক; সরকারি দল, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজসহ সবাই আলোচনা করুক। এ ক্ষেত্রে অন্তত একবার মেধার ক্রিয়াশীল চর্চা করা হোক, দেখি না কী হয়।
তা না করে রাস্তায় আন্দোলনের নামে ২০১৩ সালে প্রচুর হরতাল করা যাবে; গাড়ি ভাঙচুর, পোড়াপুড়ি করা যাবে; কর্মীদের রাজপথে বা রাস্তায় বাহাদুরও বানানো যাবে; বহু নিরীহ মানুষের জীবন তাতে যেতেও পারে। কিন্তু এর আসল ফল কী আমি জানি না, কেউ সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারলে খুবই খুশি হব। তা না করে ২০১৩ সালে সরকার উৎখাতের জন্য আন্দোলনের নামে দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ সৃষ্টি করা যেতে পারে। জানি না, সরকার এর বিপরীতে কী করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্যটা কী? দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করা, নাকি সংঘাত-সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকা। এভাবে গণতন্ত্রের আসল পথ রচিত হবে না, বরং তা কেবলই ভাঙবে; এক সময় দেশটা হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ সহ্য করার সব অবস্থান হারিয়েও ফেলতে পারে। তখন সবই আমাদের হারাতে হতে পারে। আসলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার চর্চা করতে হয়। গলাবাজি, সংঘাত ও সংঘর্ষের জন্য নেতা-কর্মীদের মেধা নয় বরং শারীরিক শক্তিরই কেবল অপপ্রয়োগ ঘটাতে হয়, ঘটেও থাকে। এ দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনার আগে সব কিছু চিন্তাভাবনা করে একটা প্রস্তাব আনুন, আলোচনার জন্য ছেড়ে দিন, অবশেষে যাচাই-বাছাই শেষে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চেষ্টা করুন- যা শুধু আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মাথায় রেখেই নয়, দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশ ও জাতিকে বারবার আর অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের কথা শুনতে না হয়, এতে যুক্তও হতে না হয়। বাংলাদেশ এই একটি বিষয় নিয়েই এত বছর সময় ও শক্তির ক্ষয় করেছে। এর পরও সমাধানে উপনীত হতে পারেনি। না পারার কারণ উল্লেখ করেছি। এখন বিষয়টি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলকেই সিরিয়াসলি ভাবতে অনুরোধ করব।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে পঞ্চদশ সংশোধন-পূর্ববর্তী বাস্তবতা কতটা জটিল এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অশান্ত, সংঘাতময় করতে পারে তা ২০০৬ সালে জ্বলন্ত প্রমাণ হিসেবেই আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে বিচার বিভাগকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার ফলে বিচার বিভাগের অভ্যন্তরে অতি স্বল্প সময়ে যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল তা থেকে দেশের বিচারব্যবস্থাকে বের করে আনা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন না করলেও এ মুহূর্তে বিরোধী দল আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দেশে আন্দোলন করতই, নানা বিতর্ক সৃষ্টি হতোই, জামায়াত-বিএনপি ঘরানা মিডিয়ায় ওই বিচারপতিদের নিয়ে নানা ধরনের কাহিনী প্রচার করতই। আমাদের রাজনৈতিক ও মিডিয়া সংস্কৃতি এখন অনেকটা এ পর্যায়েই চলে গেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ফলে আন্দোলনের ইস্যুতে সাবেক প্রধান অন্য বিচারপতিদের নাম বা তাঁদের রাজনৈতিক চরিত্র উদ্ঘাটনের বিষয়টি আপাতত নেই, আছে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি, যার অতীত রূপরেখা আসলেই ভয়ানকভাবে ত্রুটিপূর্ণ ছিল, সেটির প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে বিদায়ী সরকার ২০০৬ সালেই পেছনে থেকে কলকাঠি নেড়েছিল, ৫৮(গ) অনুচ্ছেদের প্রথম ধারা থেকে একলাফে ষষ্ঠ ধারায় রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে বাধ্য করেছিল। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রধান উপদেষ্টা হয়ে তাঁর ১০ উপদেষ্টাকে এড়িয়েই চলতেন, প্রেসসচিব মুখলেছুর রহমান চৌধুরীকে উপদেষ্টাদের বৈঠকে উপস্থিত থাকতে দিয়ে আইনবহির্ভূত কাজ করেছিলেন। এসব দেখে এক পর্যায়ে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা নতুন চারজনকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিলেন। সেই তত্ত্বাবধায়কের স্বেচ্ছাচারিতার পেছনে বিদায়ী জোট সরকারের মদদ ও শক্তি কতটা প্রবল ও প্রত্যক্ষ ছিল, তা একটু স্মরণ করলেই বোঝা যাবে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কতটা 'নির্দলীয়', কতটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। এখন বিরোধী দল যখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের দাবি করছে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে- এটি কি সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যা ১৯৯৬ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল? বস্তুত তখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার রূপরেখা ও কার্যপ্রণালী বিধিবিধান নিয়ে আন্দোলনরত দলগুলো খুব বেশি হোমওয়ার্ক করেনি, সরকারি দল তো তা শুনতেই পায়নি, ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একদলীয় সংসদে তাড়াহুড়া করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি সংবিধানের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ- নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা ৫৮(খ) ও ৫৮(গ)-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি অদ্ভুত উটের পিঠে বাংলাদেশকে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশায় চড়া ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। প্রয়োজন ছিল এটি নিয়ে তখন বা পরে প্রচুর একাডেমিক আলোচনা-পর্যালোচনা করা। আমাদের দেশে মস্তবড় অভাব হচ্ছে কোনো দাবিদাওয়া নিয়েই রাজনৈতিক দলের কোনো সিরিয়াস হোমওয়ার্ক না করা। তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আমরা জাতিগতভাবেই বোধ হয় গভীর চিন্তার প্রয়োজনীয়তা খুব একটা উপলব্ধি করতে চাই না, হালকা কিছু ধারণা দিয়ে বিশেষ কৃতিত্ব নিতে চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর কেউ কেউ এ ব্যবস্থা পৃথিবীর সব দেশকে অনুসরণ করার কথাও উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন, পরিচালনা ও কার্যকারিতা নিয়ে শুরু থেকেই নানা সমস্যা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এটির প্রতিক্রিয়া সর্বোচ্চ বিচারালয়, রাষ্ট্র-রাজনীতিতে কতটা সৃষ্টি হয়েছিল, কেন হয়েছিল এর কোনোটিই পূণর্মূল্যায়ন করা হয়নি। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরও বিষয়টি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের যেভাবে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। সরকারি দল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করার প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলকে যেভাবে যুক্ত করা দরকার ছিল, বিরোধী দল তা এড়িয়ে চলার যে নীতি নিয়েছিল, তা সরকারের জনগণকে স্পষ্ট করা প্রয়োজন ছিল। তা করা হয়নি। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ সরকারি দল বিরোধী দলকে যেমন দিয়েছিল, জনগণ বিষয়টির যৌক্তিকতা বুঝে ওঠার আগেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা 'নাই' হয়ে গেল। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে নানা সন্দেহ দানা বাঁধার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে সন্দেহের সেই অবকাশটুকুকে আশ্রয় করেই ১৮ দলীয় জোট এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মাঠ গরম করার সুযোগ পাচ্ছে। এখন বিরোধী দল দাবি করছে, সরকারকে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনতে। অথচ বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো রূপরেখা এ পর্যন্ত উপস্থাপন করেনি। তারা যদি নির্বাচনকালীন সরকারের গঠন ও প্রক্রিয়া কিভাবে হবে; একটি সরকার থেকে অন্য একটি সরকারে দায়িত্ব হস্তান্তরের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া কী হবে; কারা কী উপায়ে তখন সরকার গঠন করবে; করলে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে কি না; বিশেষ কোনো মহলের প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে কি না- এ বিষয়গুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া খুবই দরকার। বিরোধী দল কী ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চায়- তা তো আগে খোলাসা করে বলতে হবে। বিচারপতিদের তো আর তাতে টানা যাবেই না, এটি আদালতেরই নির্দেশনায় আছে। তাহলে কাদের নিয়ে নির্দলীয় সরকার গঠন সম্ভব, তা পরিষ্কার হওয়া উচিত। মিডিয়ায় এ পর্যন্ত তেমন কোনো সিরিয়াস প্রস্তাবনা নিয়ে বিএনপির কোনো নেতাকে আলোচনা করতে আমরা শুনিনি। এমনকি ড. কামাল হোসেন কিংবা ডা. বি চৌধুরীও ভবিষ্যৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখাটি কী হতে পারে এর কোনো ধারণাই এ পর্যন্ত দেননি। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেছে; একের পর এক হরতাল, অবরোধ, মিছিল, সমাবেশ হচ্ছে; নানা উদ্ভট কথাবার্তা, গালাগালি, চেঁচামেচি হচ্ছে; কিন্তু সিরিয়াস কোনো প্রস্তাব কেউই করছেন না। দেশে যথেষ্টসংখ্যক সংবিধান বিশেষজ্ঞ আছেন বলে অনেকেই দাবি করছেন। তেমন কয়েকজনের সহযোগিতা নিয়ে বিরোধী দল একটি রূপরেখা আগে দাঁড় করুক; আলোচনার জন্য তা মিডিয়ার সম্মুখে তুলে ধরুক; সরকারি দল, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজসহ সবাই আলোচনা করুক। এ ক্ষেত্রে অন্তত একবার মেধার ক্রিয়াশীল চর্চা করা হোক, দেখি না কী হয়।
তা না করে রাস্তায় আন্দোলনের নামে ২০১৩ সালে প্রচুর হরতাল করা যাবে; গাড়ি ভাঙচুর, পোড়াপুড়ি করা যাবে; কর্মীদের রাজপথে বা রাস্তায় বাহাদুরও বানানো যাবে; বহু নিরীহ মানুষের জীবন তাতে যেতেও পারে। কিন্তু এর আসল ফল কী আমি জানি না, কেউ সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারলে খুবই খুশি হব। তা না করে ২০১৩ সালে সরকার উৎখাতের জন্য আন্দোলনের নামে দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ সৃষ্টি করা যেতে পারে। জানি না, সরকার এর বিপরীতে কী করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্যটা কী? দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করা, নাকি সংঘাত-সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকা। এভাবে গণতন্ত্রের আসল পথ রচিত হবে না, বরং তা কেবলই ভাঙবে; এক সময় দেশটা হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ সহ্য করার সব অবস্থান হারিয়েও ফেলতে পারে। তখন সবই আমাদের হারাতে হতে পারে। আসলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার চর্চা করতে হয়। গলাবাজি, সংঘাত ও সংঘর্ষের জন্য নেতা-কর্মীদের মেধা নয় বরং শারীরিক শক্তিরই কেবল অপপ্রয়োগ ঘটাতে হয়, ঘটেও থাকে। এ দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনার আগে সব কিছু চিন্তাভাবনা করে একটা প্রস্তাব আনুন, আলোচনার জন্য ছেড়ে দিন, অবশেষে যাচাই-বাছাই শেষে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চেষ্টা করুন- যা শুধু আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মাথায় রেখেই নয়, দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশ ও জাতিকে বারবার আর অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের কথা শুনতে না হয়, এতে যুক্তও হতে না হয়। বাংলাদেশ এই একটি বিষয় নিয়েই এত বছর সময় ও শক্তির ক্ষয় করেছে। এর পরও সমাধানে উপনীত হতে পারেনি। না পারার কারণ উল্লেখ করেছি। এখন বিষয়টি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলকেই সিরিয়াসলি ভাবতে অনুরোধ করব।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
No comments