গণধর্ষিত তরুণীকে বাঁচানো গেল না- শোকে স্তব্ধ ভারত,- প্রণব মনমোহন
সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। সিঙ্গাপুরে নিয়েও তাকে বাঁচানো গেল না। গণধর্ষণের পর দীর্ঘ ১৩ দিন ধরেই মেয়েটিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য লড়াই করছিলেন ডাক্তাররা।
শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত পোনে পাঁচটায় এবং ভারতীয় সময় রাত সোয়া দুটায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন দিল্লীর রাজপথে ধর্ষিত এই প্যারামেডিক ছাত্রী। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিবৃতি দিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচিত এই ছাত্রীর মৃত্যুর কথা জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, আমরা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, রোগীটি মারা গেছেন। চিকিৎসক পিকে ঝা জানিয়েছেন, এয়ার এ্যাম্বুলেন্সের ধকল সহ্য করতে না পারায় তরুণীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার ভারতজুড়ে চরম ক্ষোভ ও ক্রোধ দেখা দিয়েছে। তার মৃত্যুতে ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সোনিয়া গান্ধীসহ ভারতের মন্ত্রীরা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার ভারতের বিভিন্ন নগর ও শহরে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে এসে নীরব প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হয়েছেন। ঘটনার পর থেকে ভারতজুড়ে যে সহিংস প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়, মৃত্যুর পর শনিবারের প্রতিবাদ মিছিল ছিল অনেকটাই অহিংস। খবর দ্য হিন্দু, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও এনডিটিভির।শুক্রবার রাত থেকেই ধর্ষিত ছাত্রীর শারীরিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি হতে থাকে। ধীরে ধীরে তাঁর শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো কাজ করা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
লাশ আনতে ভারতীয় বিমান সিঙ্গাপুরে ॥ মৃত্যুর খবর দিল্লী পৌঁছানোর পর তরুণীর লাশ দেশে আনার জন্য ভারত থেকে একটি বিমান সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। শনিবার রাতে তাঁর লাশ দিল্লী পৌঁছে, সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যরা রয়েছে। মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে তাঁর পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও ছিলেন ভারতের হাইকমিশনার। মৃত্যুর পর হাসপতালের বিফ্রিংয়ে বলা হয়, মাউন্ট অব এলিজাবেথের চিকিৎকরা তাঁকে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন, তবে আমাদের সব চেষ্টা বিফল হয়েছে। তরুণীর শরীরের আঘাতগুলো ছিল মারাত্মক। ঐ সময় সিঙ্গাপুরে ভারতের হাইকমিশনার টিসিএ রাঘবন সাংবাদিকদের বলেন, মৃত্যুর পর তরুণীর পরিবার ভেঙে পড়েছে। মেয়েটির শরীরে আঘাত ছিল মারাত্মক। শুক্রবার সকালেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তরুণীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তখন বলা হয়েছিল, ‘মারাত্মক জখমে তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এই নিয়েই তিনি এখনও বেঁচে আছেন।
তরুণীর মৃত্যুর খবর ভারতে ছড়িয়ে পড়ার পর গণবিক্ষোভের আশঙ্কায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। মোতায়েন করা হয় বিশাল পুলিশবাহিনী। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ইন্ডিয়া গেট যাওয়ার সমস্ত রাস্তা ও ১০টি মেট্রো স্টেশন। এর পরও হাজার হাজার লোক রাস্তায় বেরিয়ে এসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভে শামিল হন। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দায়ীদের শাস্তি দেয়ার অঙ্গীকার করে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তরুণীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও সোনিয়া গান্ধী। গত ১৬ ডিসেম্বর ছেলেবন্ধুকে নিয়ে সিনেমা দেখে ফেরার সময় বাসের মধ্যে ধর্ষণ ও মারধরের পর তাঁর বন্ধুসহ দিল্লীর রাস্তায় চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেয় ছয় পরুষ বাসযাত্রী। গুরুতর আহত ওই তরুণীকে দিল্লীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে তিনটি অস্ত্রোপচারের পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৭ ডিসেম্বর এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়, ভর্তি করা হয় মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে।
নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাইসিনা হিল ॥ দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের বাড়ি ও রাষ্ট্রপতির ভবন রাইসিনা হিল শনিবার মুড়ে ফেলা হয়েছে কড়া নিরাপত্তায়। শনিবার সকালেই সংবাদ মাধ্যমে শীলা দীক্ষিত রাজ্যবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন শান্তি বজায় রাখার জন্য। তরুণীর আত্মার শান্তি কামনা করে ও তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। রাজধানীতে এমন ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে সেই দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। অন্য দিকে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তরুণীর পরিচয় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা না হলেও ভারতের স্থানীয় একটি পত্রিকা তাঁর নাম আমানত বলে উল্লেখ করেছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্দে নারীর নিরাপত্তায় আইন আরও কঠোর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই ওই তরুণীর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে। ওই তরুণী ধর্ষিত হওয়ার পর ভারতজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ধর্ষণকারীদের মৃত্যুদ- এবং নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে মিছিল, সমাবেশ ও বিক্ষোভ চলছে দেশটিতে। ওই তরুণীর মৃত্যুতে শোক জানানোর পাশাপাশি মনমোহন সিং ‘আবেগ’কে প্রতিরোধের শক্তিতে পরিণত করার আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।
মেয়েটি বাঁচার আকুতি ॥ ধর্ষণে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ এ পর্যন্ত ছয় ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। তারা বর্তমানে দিল্লীর তিহার কারাগারে রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে এখন হত্যার অভিযোগ আনার প্রস্তুতি চলছে।
ধর্ষণের পর সামাজিক হেনস্থার ভয়ে আত্মহননের নজির ভারতসহ উপমহাদেশে যথেষ্ট হলেও দিল্লীর ওই মেডিক্যাল ছাত্রীর প্রাণপণ চেষ্টা ছিল বাঁচার। বাসে ধর্ষিত ওই তরুণী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাঁচার আকুতি তাঁর পরিবারকে জানিয়ে যান বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
একজন বীরের মৃত্যু ॥ ধর্ষণের পর বাঁচার এই লড়াইয়ের জন্য ওই তরুণীকে ‘ব্রেভ হার্ট’ অভিহিত করেছে ভারতের সংবাদ মাধ্যম। তাঁর এই মৃত্যুকে ‘বীরের মৃত্যু’ আখ্যায়িত করেছেন দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিও। সিঙ্গাপুরে নেয়ার আগে দিল্লীর হাসপাতালে ছিলেন ওই তরুণী। সেখানে ১৯ ডিসেম্বর মা ও ভাইকে বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি তিনি জানিয়েছিলেন বলে জি নিউজ জানিয়েছে। দিল্লীর হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সর্বাঙ্গে ব্যথা নিয়েও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দুইবার জবানবন্দী দিয়েছিলেন তিনি। ধর্ষণের ওই ঘটনা এবং ধর্ষণকারীদের বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়ে যান তিনি। ধর্ষণকারীদের যে বিচার চান তাও ম্যাজিস্ট্রেটকে বলে গেছেন ওই তরুণী। ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়া ওই তরুণীর বিবৃতিকে ‘সাহসী’ আখ্যায়িত করেছেন সব হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ধর্ষণের শিকার ওই ছাত্রী মারা গেলেও তার পরিবার চায়, তাঁর এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হলেও ভারতের ভূমি যেন নারীদের জন্য নিরাপদ হয়। যেন আর কারও জন্য এই ধরনের পরিণতি না আসে। ধর্ষণের এই ঘটনার জন্য বিতর্কিত মন্তব্য করে একদিন আগেই ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখাজির ছেলে অভিজিত মুখার্জি। তবে রাষ্ট্রপতির মুখে ছিল ওই তরুণীর প্রশস্তি। ওই তরুণীর মৃত্যুর পর প্রণব মুখার্র্জি বলেন, সে আমাদের প্রকৃত বীর।
No comments