সহজিয়া কড়চা-চিনিলাম আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায় by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আইয়ুব-মোনায়েম সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা খাড়া করলে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ব্যক্তিগত মমতার সৃষ্টি হয়। তাঁর ছয় দফাকে অতিক্রম করে নেতা হিসেবে তিনি হয়ে ওঠেন মুখ্য: পূর্ব বাংলার অল্প সময়ে অতি বেশি পাওয়ার জন্য কাতর মধ্যবিত্তরা শুধু নয়, প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখপাত্র।
ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নস্যাত্ হয়ে গেলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এসে ঘোষণা দেন, যথাসময়ে সাধারণ নির্বাচন দিয়ে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে পাঠিয়ে তিনি বিদায় নেবেন। সমাজতান্ত্রিক শিবিরে থাকলেও অনেকের মতো আমিও মনে করি আগামীতে কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগের যে সরকার আসছে, তাকে বছর দুই সমর্থন দেওয়া আমাদের কর্তব্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের মালিকেরা শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব অর্পণ করতে সম্মত হলো না। পরবর্তী পরিস্থিতি যা হওয়ার তাই হলো।
বাহাত্তরের সরকার ছিল আমাদের সব মানুষের সরকার, তাকে সহযোগিতা করা প্রত্যেকের কর্তব্য। কারণ, নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা সরকারের কয়েকজন মানুষের কর্ম নয়—সব মানুষের সম্মিলিত কাজ। মানুষের বিশ্বাস ছিল, স্বাধীনতার আগে নেতারা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নে যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন, তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠাই হবে সরকারের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করলাম, তা হলো না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ প্রভৃতি কারণে মানুষ হতাশ হয়। বাহাত্তরে যখন প্রথম সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো, তখন বেদনায় নীল মানুষগুলোর নিশ্চয়ই মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই পঙিক্ত: চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়।
প্রথম সরকারের প্রধান চার-পাঁচজন নেতা ছাড়াও অন্য নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে আমরা সারা দেশ ঘোরাফেরা করেছি। মিজানুর রহমান চৌধুরী, কোরবান আলী, আবদুস সামাদ আজাদ, শেখ আবদুল আজিজ, মোল্লা জালালউদ্দিন, সোহরাব হোসেন, ইউসুফ আলি, জহুর আহমদ চৌধুরী, ফণীভূষণ মজুমদার, ড. কামাল হোসেন, আবদুল মান্নান, আবদুল মোমেন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ মন্ত্রীকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। তাঁরা কেউই খারাপ মানুষ ছিলেন না। রুটিন দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য যে বাড়তি পরিশ্রম করা দরকার, তা তাঁরা করার প্রয়োজন মনে করেননি। প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা ছিল না কোনো মন্ত্রীর মধ্যেই। তখন অত সিকিউরিটি বা কড়াকড়ি ছিল না। ক্যাবিনেট মিটিংয়ের আশপাশে ঘুরঘুর করলেও কেউ বাধা দিত না। এখনকার নতুন মনের মানুষের কাছে বিস্ময়কর মনে হবে এবং কথাটা শুনতে মোটেই ভালো লাগবে না, তা হলো—স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিনটি বছরই মন্ত্রিপরিষদে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও খোন্দকার মোশতাক। অফিসার ও দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলতে পারতেন এই দুই নেতাই।
সব দোষ ও দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে সেটাও হবে তাদের ওপর খুবই অবিচার। দেশের সর্বনাশের জন্য যুবনেতাদের দায়ভার কে বহন করবে? আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধও সূচনা করেন যুবনেতারা। স্বাধীনতার পরে তাঁরা কোথায় ছিলেন? স্বাধীনতার দাবিতে জনমত গঠন প্রথম শুরু করেন মওলানা ভাসানী, কিন্তু স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তিনি ও তাঁর সাহাবারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেননি। মাঠেময়দানে সরকারের সমালোচনা করেই তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেন।
ষাটের দশকের অধিকাংশ ছাত্র-যুবনেতা ছিলেন সংগ্রামী ও মিলিট্যান্ট। পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁরা ছিলেন আপসহীন। অকারণে জেলজুলুম খেটেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাই করেন তাঁরা। সেনাবাহিনীর লোকেরা পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করেছেন শেষ মুহূর্তে। নানা রকম অভ্যন্তরীণ কলহ সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যুবনেতাদের অবদান রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতার পরে তাঁদের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি। কিন্তু এ সময়ই তাঁরা জাতিকে হতাশ করেন সবচেয়ে বেশি। রণমুখী নেতারা অর্থবিত্তমুখী হয়ে ওঠেন। জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই হয়ে ওঠে তাঁদের কাছে বড়। স্বাধীন দেশকে দেওয়ার মতো কোনো ধনই আর তাঁদের কাছে সঞ্চিত ছিল না।
কোনো জাতি উন্নত হয়ে ওঠে তার জনগণের অসামান্য শ্রম ও মেধাবী মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের যোগফলে। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা ও যুবনেতাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ধার ছিল না। মাঠেঘাটে অনর্গল বক্তৃতা দেওয়া আর দেশের দূরভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবনা করা, দুই রকমের কাজ। ইনটেলেকচুয়াল ভ্যাকুম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতার ফলে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অতিদ্রুত বিপজ্জনক পথে ধাবিত হয়। ১০০ বছর নয়, ১০ বছর পর দেশটির কী হবে, তা ভাবার কেউ ছিলেন না। নতুন রাষ্ট্রে চিন্তা ও বুদ্ধিচর্চাকে উত্সাহিত করা হলো না। তা করা হলো না এই ভয়ে যে, তাতে অগ্রহণযোগ্য ভিন্নমতের প্রকাশ ঘটতে পারে। মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্রচর্চাকে শত্রুতামূলক ব্যাপার বলে গণ্য করা হলো।
রাষ্ট্রে পাঁচ ভাগ কাজ করেন রাজনীতিকেরা, ৯৫ ভাগ কাজ করতে হয় কর্মকর্তাদের। পাকিস্তান আমলে নিযুক্ত আমলারা আদর্শগতভাবে যা-ই হোন না কেন, তাঁদের মোটামুটি ভালোই দক্ষতা ছিল। বিশেষ করে, সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের অফিসাররা ছিলেন কমনওয়েলথ দেশগুলোর দক্ষ কর্মকর্তাদের সমকক্ষ। প্রশাসনে হোক, বিচার বিভাগে হোক, পুলিশে হোক, হিসাব বিভাগে হোক, অথবা যে ক্যাডারেই হোক, সেকালের অফিসারদের শিক্ষাদীক্ষায় ঘাটতি ছিল না। দক্ষ আমলা ও লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় একবার আমার সঙ্গে আলোচনায় বলছিলেন, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের যেসব বাঙালি অফিসার উপসচিব এবং পূর্বপাকিস্তান সরকারের যাঁরা যুগ্ম সচিব পর্যায়ে ছিলেন, তাঁদের দক্ষতা ছিল এবং রাষ্ট্র চালানোর অভিজ্ঞতাও তাঁদের ছিল। তাঁদের মান ভারতের অফিসারদের চেয়ে মোটেই নিচু ছিল না।
দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পরে যখন আমাদের বেশিসংখ্যক সুশিক্ষিত ও দক্ষ আমলার প্রয়োজন, তখনই আমলাতন্ত্রকে তছনছ করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পরে আমলাতন্ত্রে যাঁরা প্রবেশ করেন, তাঁরা ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদে চাকরি পান, যোগ্যতায় নয়। পাকিস্তানে প্রতিবছর সিএসএস পরীক্ষা হতো, নিরপেক্ষ পাবলিক সার্ভিস কমিশন ছিল, মেধাবীরাই আসতেন প্রশাসনে। স্বাধীনতার পরে মেধার স্থান দখল করল খোশামোদ।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলকে সংসদে আসতে দেওয়া হলো না, আমলাতন্ত্র তছনছ হলো, যুবনেতারা ব্যবসা-বাণিজ্য, লাইসেন্স পারমিট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাঠ চুকে গেল, বুদ্ধিজীবীরা খোশামুদে হয়ে উঠলেন এবং পাঞ্জাবির পকেটের সংখ্যা বাড়ালেন, ব্যবসায়ীরা মুনাফার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে থাকলেন। একপর্যায়ে কাগজপত্রে যেটুকু গণতন্ত্র ছিল, তা-ও গেল। আমার মতো মানুষ মনে মনে বলল: স্বদেশকে চিনিলাম আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়।
পাকা ১৫টি বছর সামরিক একনায়কত্ব। দীর্ঘ রক্তাক্ত আন্দোলনের ভেতর দিয়ে স্বৈরাচারের পতন হয়। ১৯৯১-তে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ভেবেছিলাম, দেশে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র আসছে। অনভিজ্ঞ বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভা একরকম চালাল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে গিয়ে তাঁদের বাসনা হলো, আরও দুই-তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকবেন। গেল গণতন্ত্র নস্যাত্ হয়ে।
আবার আন্দোলন। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হলো। ওই পদ্ধতি গণতন্ত্রের সঙ্গে ঠিকমতো খাপ খায় না। তবু মেনে নিতে হলো ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই’। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এল শেখ হাসিনার সরকার। তিনিও ছিলেন অনভিজ্ঞ। কিন্তু মেয়াদের অর্ধেক সময় তিনি ভালোই চালালেন। তারপর ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, মোহাম্মদপুর প্রভৃতি জায়গা পরিণত হলো গণতন্ত্রের বধ্যভূমিতে। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে লাগলেন ফেনী, নারায়ণগঞ্জসহ সোনার বাংলার বিভিন্ন পরগনার শাসনকর্তারা। ওই সব পরগনার শাসকেরা চেঙ্গিস খাঁর চেয়েও দুর্ধর্ষ হয়ে উঠলেন। এত কষ্টে পাওয়া গণতন্ত্রের হার্ট অ্যাটাক হলো। ২০০১-এর নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করল। আওয়ামী লীগ সরকারের বাড়াবাড়ির জবাবটি জনগণ দিল নেতিবাচক কায়দায়। বিএনপি পেল বিপুলসংখ্যক আসন এবং জামায়াতের নেতারা বেগম জিয়ার আশীর্বাদে বাংলার সুবেদারি পেয়ে গেলেন। খালেদা জিয়া দাবি করলেন, তাঁর দল মধ্যপন্থী লিবারেল ডেমোক্র্যাট। কিন্তু দেখা গেল, তাঁর হূদ্যতা দেশের উচ্চশিক্ষিত আলেম-ওলামাদের সঙ্গে নয়, গ্রাম্য কাঠমোল্লাদের সঙ্গে, তাবিজ-কবজ বিক্রেতাদের সঙ্গে এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের বাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞ কোনো ভাই বা শায়খ-মুফতির সঙ্গে। তিনি এক শ ভাগ নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে ইসলামি ধর্মান্ধতাতন্ত্র কায়েম করলেন। তখন আমরা বাংলার যেদিকে তাকাতাম, দেখতে পেতাম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লাল সালুর ভাষায়, ‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি।’ বাংলাদেশের ভাইটি ও তার ওস্তাদকে বাঁচাতে গিয়ে সরকারের ওপর বিদেশিরা গেল বিগড়ে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারের শেষ দিকে একজন সদ্য আগত বিদেশিনী এক পার্টিতে কথা প্রসঙ্গে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হোয়াট ইজ দ্য পজিশন অব টারেক রাহমান ইন দ্য গভর্নমেন্ট?’ আমি তাঁকে বললাম, ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পরে আয়াতুল্লাহ খোমেনির যে পজিশন ছিল, তারেক রহমানেরও বাংলাদেশে তাই। কৌম শহরে ঘরে বসে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ইরান সরকারকে শাসন করতেন, হাওয়া ভবন আমাদের কৌম শহর, সেখানে বসে তারেক রহমান সাহেব মন্ত্রী-সচিবদের শাসন করেন।
আমার আয়াতুল্লাহ খোমেনির বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। অতি সাধারণ ঘর। টাকা-কড়ি তিনি ছুঁয়েও দেখতেন না। কিন্তু তারেক রহমান সাহেবের দৃষ্টি ছিল টাকার দিকেই। তার কারণেও বিদেশিরা বিরক্ত হয়ে ওঠেন বেগম জিয়ার সরকারের ওপর। গণতন্ত্রের পোস্ট অফিস হলো নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনার হলেন পোস্টমাস্টার। গণতন্ত্রের পোস্ট অফিসে বেগম জিয়া ও নিজামীরা এমন পোস্টমাস্টারদের বসালেন, তাঁরা ডাকঘরে বসে সব মানুষের চিঠি খুলে খুলে পড়তেন। একটা ভুয়া নির্বাচনের এন্তেজাম জনগণ বানচাল করে দেয়। তবে সেই সঙ্গে বাংলাদেশ পায় এক গায়েবি আহমদীয় সরকার। গণতন্ত্রের ১২টা বেজে গেল।
২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ যে সরকার গঠিত হয়েছে, এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা—তারা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। এক বছরে অনেক প্রগতিশীল জনকল্যাণমূলক কাজ এই সরকার করেছে। কিন্তু আগবাড়িয়ে অনেক বিরক্তিকর কাজও করেছে। যেমন ঘড়ির কাঁটা নিয়ে টানাটানি, সূর্যের আলোকে জাপটে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা। বিভিন্ন স্থাপনার নামবদলের ফরমান জারি। আজ দলবহির্ভূত মানুষের চেতনার মান উঁচু, তাই তারা ব্যক্তিপূজা করে না, অন্যে করলেও পছন্দ করে না।
কৃষককে সারে ভর্তুকি দেওয়া, স্কুলশিক্ষার্থীদের যথাসময়ে বিনামূল্যে বই দেওয়া, দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে কৃষিঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করা, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ করার ব্যবস্থা করা, ধর্মপন্থী রাজনীতিকদের দমনে রাখা প্রভৃতি কাজ প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু জনগণের মূল দাবি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সুসংহত করা। তা হচ্ছে না। সরকারি ছাত্র-যুবদল টেন্ডারবাজি থেকে শিক্ষকদের পেটাচ্ছে, দখল করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনকে রেখেছে ভীতির মধ্যে।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, বিশেষ করে যাঁদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে, তাঁদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে, বিশেষ পরিবারের সদস্যদের জন্য আলাদা বংশানুক্রমিক নিরাপত্তাব্যবস্থার বিধান নেই। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের বিশেষ নিরাপত্তার যে আইন সংসদে পাস হয়েছে, তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সরকারি আবাসনের বিধানটিও আইনের মাধ্যমে করার দরকার ছিল না। ভারতে গান্ধী-নেহরু পরিবারও সীমাহীন ঝুঁকির মধ্যে, রাষ্ট্র তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিধান করেছে, তবে তা আইন করে নয়। আমাদের সংবিধান সব নাগরিকের সমান নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
বাংলাদেশে অনবরত যাঁরা ‘সন্ত্রাস সন্ত্রাস’ করেন, তাঁরা মোটেই সঠিক কাজ করছেন না। পৃথিবীর কোথায় সন্ত্রাস নেই। পাকিস্তানের অবস্থা হাবিয়া দোজখের চেয়ে খারাপ। ভারতে অগণিত সন্ত্রাসী গ্রুপ। তার মধ্যে অতি বাম ও অতি ডান সবই আছে। আছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। রেনেসাঁর দেশ ইতালির প্রধানমন্ত্রীর নাক এমন ফাটানো ফাটিয়েছে যে, তিনি হাসপাতালে পড়ে ছিলেন অনেক দিন। পোপের মতো মহামান্য আঘাত খেয়েছেন, আহত হননি তেমন। তাঁর এক সহকর্মী আহত হয়েছেন ভালোই। পৃথিবীর কোনো শক্তিমানই আজ আর নিরাপদ নন। বুশের কানের কাছ দিয়ে জুতা উড়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশ আজও অনেক শান্তিপূর্ণ দেশ।
গত তিন বছর কোনো হরতাল-অবরোধ নেই। এক বছর যাবত্ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সুবোধ বালকের মতো চুপচাপ বসে আছে। তার পরও অর্থনৈতিক উন্নতি আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ থাকা মানে বাংলাদেশ ধনকুবের হয়ে যাওয়া নয়। বিদেশিদের আস্থা নেই, বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশি শিল্পোদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে চাইলে হাজারো ঝামেলা-ঝক্কি।
গত এক বছরে বিরোধী দল সরকারকে বিব্রত করেনি, করার মওকাও পায়নি। সরকার বিব্রত হয়েছে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কথাবার্তায়। সংসদে দাঁড়িয়ে কৃষিমন্ত্রীর মতো মানুষও যখন বলেন, একটি বুলেট প্রধানমন্ত্রীকে তাড়া করে ফিরছে, তখন আমাদের শরীর কাঁটা দেয়। ওভাবে বলতে নেই। প্রধানমন্ত্রীও যখন সব মন্ত্রীকে ‘সাবধানে থাকতে’ বলেন, তখন সাধারণ মানুষের চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে তোলার। সেই দায়িত্ব তাঁরা পালন করেননি। তার খেসারত তাঁরা দিয়েছেন। দেশ যে শুধু দীর্ঘ সামরিক শাসন পেয়েছিল তা-ই নয়, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও পায়।
অনেক নাটকের পরে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান সরকারের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবি—একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যাতে টেকসই হয়, তার ব্যবস্থা তারা করবেন। টেকসই গণতন্ত্রের কিছু পূর্বশর্ত আছে। তার মধ্যে একটি হলো ভিন্নমতকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া। সরকারের বাইরের দল ও গোষ্ঠীগুলোকে নির্বিঘ্নে তাদের প্রকাশ্য কাজ চালিয়ে যেতে সহায়তা করা। বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো রেখে সরকারি দলের নেতাদের মামলা মোকদ্দমা তুলে নেওয়া গণতন্ত্রের রীতি নয়।
স্বজনপ্রীতি একটি মানবিক প্রবৃত্তি। চিরকালই মানুষ তা করেছে। প্রিয়জনকে, অনুগতকে, বিশ্বাসভাজনকে কিছু দেওয়ায় আত্মতৃপ্তি আছে। কিন্তু অযোগ্য অনুগতকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে বিপর্যয় ঘটা অনিবার্য। প্রশাসনকে দলীয়করণ একটি আত্মঘাতী প্রবণতা। তাতে ব্যক্তি লাভবান হয়—দেশ, জাতি, সরকার এমনকি সরকারি দল পর্যন্ত হয় ক্ষতিগ্রস্ত। অন্য দলের মানুষকে সন্দেহ করা একটি মানসিক রোগ। আওয়ামী লীগের অবিচল সমর্থক সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত আমিনুল হককে সরিয়ে না দিয়ে আস্থায় রেখে খালেদা জিয়া উপকৃতই হয়েছিলেন।
জনগণকে রাজপথে নামার ব্যবস্থা যদি সরকারি দলই করে দেয়, অন্যের কী করার থাকে? কিশোরগঞ্জ জেলাকে ভেঙে ভৈরবকে জেলা করার আশ্বাস দেওয়ার কী যুক্তি ছিল? একটি নতুন জেলা করা মানে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয়। তা ছাড়া নতুন নতুন জেলা করার দাবি যদি একবার ওঠে, তা সামাল দেওয়ার সাধ্য কোনো সরকারের নেই। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে বিভাগের দাবিতে আন্দোলন ও রাজপথ অবরোধ আমরা দেখেছি। নতুন জেলা করা শুরু হলে বহু ইউনিয়ন থেকেও দাবি উঠবে তাদের জেলায় উন্নীত করা হোক।
এই সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক সুশাসন। আমরা চাই গঠিত হোক একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। গত এক বছরের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট নই। সরকার আরও ভালো করবে, সেটাই প্রত্যাশা। আর বলতে চাই না: চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়।
সরকারের এক বছর পূর্তি হবে কাল। সে সম্পর্কেই লিখতে চেয়েছিলাম। তার পরিবর্তে এই ইতস্তত ভাবনাগুলো প্রকাশ করা হলো।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বাহাত্তরের সরকার ছিল আমাদের সব মানুষের সরকার, তাকে সহযোগিতা করা প্রত্যেকের কর্তব্য। কারণ, নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা সরকারের কয়েকজন মানুষের কর্ম নয়—সব মানুষের সম্মিলিত কাজ। মানুষের বিশ্বাস ছিল, স্বাধীনতার আগে নেতারা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নে যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন, তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠাই হবে সরকারের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করলাম, তা হলো না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ প্রভৃতি কারণে মানুষ হতাশ হয়। বাহাত্তরে যখন প্রথম সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো, তখন বেদনায় নীল মানুষগুলোর নিশ্চয়ই মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই পঙিক্ত: চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়।
প্রথম সরকারের প্রধান চার-পাঁচজন নেতা ছাড়াও অন্য নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে আমরা সারা দেশ ঘোরাফেরা করেছি। মিজানুর রহমান চৌধুরী, কোরবান আলী, আবদুস সামাদ আজাদ, শেখ আবদুল আজিজ, মোল্লা জালালউদ্দিন, সোহরাব হোসেন, ইউসুফ আলি, জহুর আহমদ চৌধুরী, ফণীভূষণ মজুমদার, ড. কামাল হোসেন, আবদুল মান্নান, আবদুল মোমেন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ মন্ত্রীকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। তাঁরা কেউই খারাপ মানুষ ছিলেন না। রুটিন দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য যে বাড়তি পরিশ্রম করা দরকার, তা তাঁরা করার প্রয়োজন মনে করেননি। প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা ছিল না কোনো মন্ত্রীর মধ্যেই। তখন অত সিকিউরিটি বা কড়াকড়ি ছিল না। ক্যাবিনেট মিটিংয়ের আশপাশে ঘুরঘুর করলেও কেউ বাধা দিত না। এখনকার নতুন মনের মানুষের কাছে বিস্ময়কর মনে হবে এবং কথাটা শুনতে মোটেই ভালো লাগবে না, তা হলো—স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে তিনটি বছরই মন্ত্রিপরিষদে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও খোন্দকার মোশতাক। অফিসার ও দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলতে পারতেন এই দুই নেতাই।
সব দোষ ও দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে সেটাও হবে তাদের ওপর খুবই অবিচার। দেশের সর্বনাশের জন্য যুবনেতাদের দায়ভার কে বহন করবে? আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধও সূচনা করেন যুবনেতারা। স্বাধীনতার পরে তাঁরা কোথায় ছিলেন? স্বাধীনতার দাবিতে জনমত গঠন প্রথম শুরু করেন মওলানা ভাসানী, কিন্তু স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে তিনি ও তাঁর সাহাবারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেননি। মাঠেময়দানে সরকারের সমালোচনা করেই তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেন।
ষাটের দশকের অধিকাংশ ছাত্র-যুবনেতা ছিলেন সংগ্রামী ও মিলিট্যান্ট। পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁরা ছিলেন আপসহীন। অকারণে জেলজুলুম খেটেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাই করেন তাঁরা। সেনাবাহিনীর লোকেরা পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করেছেন শেষ মুহূর্তে। নানা রকম অভ্যন্তরীণ কলহ সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যুবনেতাদের অবদান রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতার পরে তাঁদের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি। কিন্তু এ সময়ই তাঁরা জাতিকে হতাশ করেন সবচেয়ে বেশি। রণমুখী নেতারা অর্থবিত্তমুখী হয়ে ওঠেন। জনগণের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই হয়ে ওঠে তাঁদের কাছে বড়। স্বাধীন দেশকে দেওয়ার মতো কোনো ধনই আর তাঁদের কাছে সঞ্চিত ছিল না।
কোনো জাতি উন্নত হয়ে ওঠে তার জনগণের অসামান্য শ্রম ও মেধাবী মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের যোগফলে। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা ও যুবনেতাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ধার ছিল না। মাঠেঘাটে অনর্গল বক্তৃতা দেওয়া আর দেশের দূরভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবনা করা, দুই রকমের কাজ। ইনটেলেকচুয়াল ভ্যাকুম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতার ফলে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অতিদ্রুত বিপজ্জনক পথে ধাবিত হয়। ১০০ বছর নয়, ১০ বছর পর দেশটির কী হবে, তা ভাবার কেউ ছিলেন না। নতুন রাষ্ট্রে চিন্তা ও বুদ্ধিচর্চাকে উত্সাহিত করা হলো না। তা করা হলো না এই ভয়ে যে, তাতে অগ্রহণযোগ্য ভিন্নমতের প্রকাশ ঘটতে পারে। মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্রচর্চাকে শত্রুতামূলক ব্যাপার বলে গণ্য করা হলো।
রাষ্ট্রে পাঁচ ভাগ কাজ করেন রাজনীতিকেরা, ৯৫ ভাগ কাজ করতে হয় কর্মকর্তাদের। পাকিস্তান আমলে নিযুক্ত আমলারা আদর্শগতভাবে যা-ই হোন না কেন, তাঁদের মোটামুটি ভালোই দক্ষতা ছিল। বিশেষ করে, সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের অফিসাররা ছিলেন কমনওয়েলথ দেশগুলোর দক্ষ কর্মকর্তাদের সমকক্ষ। প্রশাসনে হোক, বিচার বিভাগে হোক, পুলিশে হোক, হিসাব বিভাগে হোক, অথবা যে ক্যাডারেই হোক, সেকালের অফিসারদের শিক্ষাদীক্ষায় ঘাটতি ছিল না। দক্ষ আমলা ও লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় একবার আমার সঙ্গে আলোচনায় বলছিলেন, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের যেসব বাঙালি অফিসার উপসচিব এবং পূর্বপাকিস্তান সরকারের যাঁরা যুগ্ম সচিব পর্যায়ে ছিলেন, তাঁদের দক্ষতা ছিল এবং রাষ্ট্র চালানোর অভিজ্ঞতাও তাঁদের ছিল। তাঁদের মান ভারতের অফিসারদের চেয়ে মোটেই নিচু ছিল না।
দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পরে যখন আমাদের বেশিসংখ্যক সুশিক্ষিত ও দক্ষ আমলার প্রয়োজন, তখনই আমলাতন্ত্রকে তছনছ করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পরে আমলাতন্ত্রে যাঁরা প্রবেশ করেন, তাঁরা ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদে চাকরি পান, যোগ্যতায় নয়। পাকিস্তানে প্রতিবছর সিএসএস পরীক্ষা হতো, নিরপেক্ষ পাবলিক সার্ভিস কমিশন ছিল, মেধাবীরাই আসতেন প্রশাসনে। স্বাধীনতার পরে মেধার স্থান দখল করল খোশামোদ।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলকে সংসদে আসতে দেওয়া হলো না, আমলাতন্ত্র তছনছ হলো, যুবনেতারা ব্যবসা-বাণিজ্য, লাইসেন্স পারমিট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাঠ চুকে গেল, বুদ্ধিজীবীরা খোশামুদে হয়ে উঠলেন এবং পাঞ্জাবির পকেটের সংখ্যা বাড়ালেন, ব্যবসায়ীরা মুনাফার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে থাকলেন। একপর্যায়ে কাগজপত্রে যেটুকু গণতন্ত্র ছিল, তা-ও গেল। আমার মতো মানুষ মনে মনে বলল: স্বদেশকে চিনিলাম আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়।
পাকা ১৫টি বছর সামরিক একনায়কত্ব। দীর্ঘ রক্তাক্ত আন্দোলনের ভেতর দিয়ে স্বৈরাচারের পতন হয়। ১৯৯১-তে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ভেবেছিলাম, দেশে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র আসছে। অনভিজ্ঞ বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভা একরকম চালাল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে গিয়ে তাঁদের বাসনা হলো, আরও দুই-তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকবেন। গেল গণতন্ত্র নস্যাত্ হয়ে।
আবার আন্দোলন। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হলো। ওই পদ্ধতি গণতন্ত্রের সঙ্গে ঠিকমতো খাপ খায় না। তবু মেনে নিতে হলো ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই’। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এল শেখ হাসিনার সরকার। তিনিও ছিলেন অনভিজ্ঞ। কিন্তু মেয়াদের অর্ধেক সময় তিনি ভালোই চালালেন। তারপর ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, মোহাম্মদপুর প্রভৃতি জায়গা পরিণত হলো গণতন্ত্রের বধ্যভূমিতে। পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে লাগলেন ফেনী, নারায়ণগঞ্জসহ সোনার বাংলার বিভিন্ন পরগনার শাসনকর্তারা। ওই সব পরগনার শাসকেরা চেঙ্গিস খাঁর চেয়েও দুর্ধর্ষ হয়ে উঠলেন। এত কষ্টে পাওয়া গণতন্ত্রের হার্ট অ্যাটাক হলো। ২০০১-এর নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করল। আওয়ামী লীগ সরকারের বাড়াবাড়ির জবাবটি জনগণ দিল নেতিবাচক কায়দায়। বিএনপি পেল বিপুলসংখ্যক আসন এবং জামায়াতের নেতারা বেগম জিয়ার আশীর্বাদে বাংলার সুবেদারি পেয়ে গেলেন। খালেদা জিয়া দাবি করলেন, তাঁর দল মধ্যপন্থী লিবারেল ডেমোক্র্যাট। কিন্তু দেখা গেল, তাঁর হূদ্যতা দেশের উচ্চশিক্ষিত আলেম-ওলামাদের সঙ্গে নয়, গ্রাম্য কাঠমোল্লাদের সঙ্গে, তাবিজ-কবজ বিক্রেতাদের সঙ্গে এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের বাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞ কোনো ভাই বা শায়খ-মুফতির সঙ্গে। তিনি এক শ ভাগ নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে ইসলামি ধর্মান্ধতাতন্ত্র কায়েম করলেন। তখন আমরা বাংলার যেদিকে তাকাতাম, দেখতে পেতাম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লাল সালুর ভাষায়, ‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি।’ বাংলাদেশের ভাইটি ও তার ওস্তাদকে বাঁচাতে গিয়ে সরকারের ওপর বিদেশিরা গেল বিগড়ে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারের শেষ দিকে একজন সদ্য আগত বিদেশিনী এক পার্টিতে কথা প্রসঙ্গে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হোয়াট ইজ দ্য পজিশন অব টারেক রাহমান ইন দ্য গভর্নমেন্ট?’ আমি তাঁকে বললাম, ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পরে আয়াতুল্লাহ খোমেনির যে পজিশন ছিল, তারেক রহমানেরও বাংলাদেশে তাই। কৌম শহরে ঘরে বসে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ইরান সরকারকে শাসন করতেন, হাওয়া ভবন আমাদের কৌম শহর, সেখানে বসে তারেক রহমান সাহেব মন্ত্রী-সচিবদের শাসন করেন।
আমার আয়াতুল্লাহ খোমেনির বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। অতি সাধারণ ঘর। টাকা-কড়ি তিনি ছুঁয়েও দেখতেন না। কিন্তু তারেক রহমান সাহেবের দৃষ্টি ছিল টাকার দিকেই। তার কারণেও বিদেশিরা বিরক্ত হয়ে ওঠেন বেগম জিয়ার সরকারের ওপর। গণতন্ত্রের পোস্ট অফিস হলো নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনার হলেন পোস্টমাস্টার। গণতন্ত্রের পোস্ট অফিসে বেগম জিয়া ও নিজামীরা এমন পোস্টমাস্টারদের বসালেন, তাঁরা ডাকঘরে বসে সব মানুষের চিঠি খুলে খুলে পড়তেন। একটা ভুয়া নির্বাচনের এন্তেজাম জনগণ বানচাল করে দেয়। তবে সেই সঙ্গে বাংলাদেশ পায় এক গায়েবি আহমদীয় সরকার। গণতন্ত্রের ১২টা বেজে গেল।
২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ যে সরকার গঠিত হয়েছে, এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা—তারা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। এক বছরে অনেক প্রগতিশীল জনকল্যাণমূলক কাজ এই সরকার করেছে। কিন্তু আগবাড়িয়ে অনেক বিরক্তিকর কাজও করেছে। যেমন ঘড়ির কাঁটা নিয়ে টানাটানি, সূর্যের আলোকে জাপটে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা। বিভিন্ন স্থাপনার নামবদলের ফরমান জারি। আজ দলবহির্ভূত মানুষের চেতনার মান উঁচু, তাই তারা ব্যক্তিপূজা করে না, অন্যে করলেও পছন্দ করে না।
কৃষককে সারে ভর্তুকি দেওয়া, স্কুলশিক্ষার্থীদের যথাসময়ে বিনামূল্যে বই দেওয়া, দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে কৃষিঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করা, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ করার ব্যবস্থা করা, ধর্মপন্থী রাজনীতিকদের দমনে রাখা প্রভৃতি কাজ প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু জনগণের মূল দাবি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সুসংহত করা। তা হচ্ছে না। সরকারি ছাত্র-যুবদল টেন্ডারবাজি থেকে শিক্ষকদের পেটাচ্ছে, দখল করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনকে রেখেছে ভীতির মধ্যে।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, বিশেষ করে যাঁদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে, তাঁদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে, বিশেষ পরিবারের সদস্যদের জন্য আলাদা বংশানুক্রমিক নিরাপত্তাব্যবস্থার বিধান নেই। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের বিশেষ নিরাপত্তার যে আইন সংসদে পাস হয়েছে, তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সরকারি আবাসনের বিধানটিও আইনের মাধ্যমে করার দরকার ছিল না। ভারতে গান্ধী-নেহরু পরিবারও সীমাহীন ঝুঁকির মধ্যে, রাষ্ট্র তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিধান করেছে, তবে তা আইন করে নয়। আমাদের সংবিধান সব নাগরিকের সমান নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
বাংলাদেশে অনবরত যাঁরা ‘সন্ত্রাস সন্ত্রাস’ করেন, তাঁরা মোটেই সঠিক কাজ করছেন না। পৃথিবীর কোথায় সন্ত্রাস নেই। পাকিস্তানের অবস্থা হাবিয়া দোজখের চেয়ে খারাপ। ভারতে অগণিত সন্ত্রাসী গ্রুপ। তার মধ্যে অতি বাম ও অতি ডান সবই আছে। আছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। রেনেসাঁর দেশ ইতালির প্রধানমন্ত্রীর নাক এমন ফাটানো ফাটিয়েছে যে, তিনি হাসপাতালে পড়ে ছিলেন অনেক দিন। পোপের মতো মহামান্য আঘাত খেয়েছেন, আহত হননি তেমন। তাঁর এক সহকর্মী আহত হয়েছেন ভালোই। পৃথিবীর কোনো শক্তিমানই আজ আর নিরাপদ নন। বুশের কানের কাছ দিয়ে জুতা উড়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশ আজও অনেক শান্তিপূর্ণ দেশ।
গত তিন বছর কোনো হরতাল-অবরোধ নেই। এক বছর যাবত্ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সুবোধ বালকের মতো চুপচাপ বসে আছে। তার পরও অর্থনৈতিক উন্নতি আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ থাকা মানে বাংলাদেশ ধনকুবের হয়ে যাওয়া নয়। বিদেশিদের আস্থা নেই, বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশি শিল্পোদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে চাইলে হাজারো ঝামেলা-ঝক্কি।
গত এক বছরে বিরোধী দল সরকারকে বিব্রত করেনি, করার মওকাও পায়নি। সরকার বিব্রত হয়েছে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কথাবার্তায়। সংসদে দাঁড়িয়ে কৃষিমন্ত্রীর মতো মানুষও যখন বলেন, একটি বুলেট প্রধানমন্ত্রীকে তাড়া করে ফিরছে, তখন আমাদের শরীর কাঁটা দেয়। ওভাবে বলতে নেই। প্রধানমন্ত্রীও যখন সব মন্ত্রীকে ‘সাবধানে থাকতে’ বলেন, তখন সাধারণ মানুষের চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে তোলার। সেই দায়িত্ব তাঁরা পালন করেননি। তার খেসারত তাঁরা দিয়েছেন। দেশ যে শুধু দীর্ঘ সামরিক শাসন পেয়েছিল তা-ই নয়, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও পায়।
অনেক নাটকের পরে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান সরকারের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবি—একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যাতে টেকসই হয়, তার ব্যবস্থা তারা করবেন। টেকসই গণতন্ত্রের কিছু পূর্বশর্ত আছে। তার মধ্যে একটি হলো ভিন্নমতকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া। সরকারের বাইরের দল ও গোষ্ঠীগুলোকে নির্বিঘ্নে তাদের প্রকাশ্য কাজ চালিয়ে যেতে সহায়তা করা। বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো রেখে সরকারি দলের নেতাদের মামলা মোকদ্দমা তুলে নেওয়া গণতন্ত্রের রীতি নয়।
স্বজনপ্রীতি একটি মানবিক প্রবৃত্তি। চিরকালই মানুষ তা করেছে। প্রিয়জনকে, অনুগতকে, বিশ্বাসভাজনকে কিছু দেওয়ায় আত্মতৃপ্তি আছে। কিন্তু অযোগ্য অনুগতকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে বিপর্যয় ঘটা অনিবার্য। প্রশাসনকে দলীয়করণ একটি আত্মঘাতী প্রবণতা। তাতে ব্যক্তি লাভবান হয়—দেশ, জাতি, সরকার এমনকি সরকারি দল পর্যন্ত হয় ক্ষতিগ্রস্ত। অন্য দলের মানুষকে সন্দেহ করা একটি মানসিক রোগ। আওয়ামী লীগের অবিচল সমর্থক সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত আমিনুল হককে সরিয়ে না দিয়ে আস্থায় রেখে খালেদা জিয়া উপকৃতই হয়েছিলেন।
জনগণকে রাজপথে নামার ব্যবস্থা যদি সরকারি দলই করে দেয়, অন্যের কী করার থাকে? কিশোরগঞ্জ জেলাকে ভেঙে ভৈরবকে জেলা করার আশ্বাস দেওয়ার কী যুক্তি ছিল? একটি নতুন জেলা করা মানে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয়। তা ছাড়া নতুন নতুন জেলা করার দাবি যদি একবার ওঠে, তা সামাল দেওয়ার সাধ্য কোনো সরকারের নেই। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে বিভাগের দাবিতে আন্দোলন ও রাজপথ অবরোধ আমরা দেখেছি। নতুন জেলা করা শুরু হলে বহু ইউনিয়ন থেকেও দাবি উঠবে তাদের জেলায় উন্নীত করা হোক।
এই সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক সুশাসন। আমরা চাই গঠিত হোক একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। গত এক বছরের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট নই। সরকার আরও ভালো করবে, সেটাই প্রত্যাশা। আর বলতে চাই না: চিনিলাম আপনারে আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়।
সরকারের এক বছর পূর্তি হবে কাল। সে সম্পর্কেই লিখতে চেয়েছিলাম। তার পরিবর্তে এই ইতস্তত ভাবনাগুলো প্রকাশ করা হলো।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments