শ্রদ্ধাঞ্জলি-সহজ মানুষ by কাজল রশীদ

জুতা পরতে এবং ইংরেজি পড়তে বলতেন তিনি। যদিও আপাদমস্তক ছিলেন একজন গৃহী বাউল। ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’ (গুরুসদয় দত্ত)। ‘হাতের কাছে হয় না খবর, কী দেখতে যাও দিল্লি-লাহোর’ (লালন সাঁই)। এসবের উল্টো ভাসান কি ছিলেন মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন?


যাঁর মেধা ও মননের প্রজ্ঞা ছিল সমকালের ‘সহজ মানুষ’-এর মাঝে অন্যতম। ভেতর ও বাহিরকে, দূর ও নিকটকে, দেশ ও বিদেশকে দেখার শাণিত দৃষ্টি ছিল তাঁর, যা তাঁকে করেছিল স্বাতন্ত্র্যবোধে উজ্জীবিত ভিন্ন এক মহীরুহ। সাহিত্য সাধনায় ও শিক্ষকতায় যার অফুরান নজির বিদ্যমান।
বিদায়ী শতাব্দীর কয়েক দশক তিনি কাটিয়েছেন রাজধানী ঢাকাতেই। তার পরও ক্ষণিকের জন্যও বিচ্যুত হননি হুঁকোবিলাস আর লোকসংগীত সংগ্রহের প্রিয় অনুধ্যান থেকে। তাঁর মুখে জুতা ও ইংরেজিপ্রীতির কথায় বিস্ময় থাকলেও অস্বাভাবিক কিংবা অপ্রত্যাশিত নয়। কেননা, হারামণির নায়ক রবীন্দ্রনাথ পড়াতে গিয়ে অবলীলায় হাজির করতেন সাদি, রুমি হাফিজ কিংবা শেক্সপিয়ার, শেলি, কিটসকে।
মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের জীবন উৎসর্গীকৃত ছিল লোকসাহিত্য সংগ্রহে। হারামণির সর্বশেষ খণ্ডের (ত্রয়োদশ) ভূমিকায় যার সাক্ষ্য মেলে: ‘বাংলাদেশের আনাচে কানাচে যে পল্লী-গানের কত অসংখ্য মণিমুক্তা লুক্কায়িত রহিয়াছে তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। গত ষাট বৎসর ধরিয়া এই পল্লী-গানের সন্ধানে ঘুরিয়াছি, ছাত্রজীবনে ও সরকারি কর্মজীবনের ফুরসতে এবং অবসর জীবনে। তাহাতে এই দৃঢ় ধারণা জন্মিয়াছে যে আমাদের দেশ মহৎ এবং ইহার লোকসংগীত সমাচার বিশ্বে আদর পাইবার যোগ্য।’
লোকসাহিত্য সংগ্রহে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরোক্ষ অনুপ্রেরণায় (পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। আহমদ শরীফের ভাষায়: নব যৌবনে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ও অবনীন্দ্রনাথের আদরপুষ্ট হয়েছিলেন)।
লোকসাহিত্য সংগ্রহে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের আত্মনিবেদন ঘটে প্রবাসী পত্রিকা পাঠে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটির ওই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ সংগৃহীত লালনের গান ছাপা হয়, যা কৈশোরক কবি মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনকে লালনের গান সংগ্রহে প্রেরণা জোগায়, উদ্বুদ্ধ করে।
নিজ গ্রাম পাবনার মুরারীপুরের প্রেমদাস বৈরাগীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেন লালনের একটি গান। পাঠিয়ে দেন প্রবাসীতে। ছাপা হয় ১৩৩০ সালের আশ্বিন সংখ্যায়। লালনের গান দিয়ে শুরু। একে একে সংগ্রহ করেন পল্লিবাংলার লোককবিদের অনন্য রত্নরাজি। ছাত্রত্বে, কর্মজীবনে কিংবা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর সব সময়ই উন্মুখ থেকেছেন লোকসংগীত সংগ্রহ করে জাতিকে উপহার দেওয়ার মহান ব্রতে। তাঁর অনুসন্ধানী চোখ আর তীক্ষধী শ্রবণেন্দ্রিয় খুঁজে ফিরত কোথায় বাজে লালনের একতারা, কোন পথে হেঁটে যায় একাকী বাউল, কোথাকার কোন অজপাড়াগাঁয়ের বিয়েবাড়ি মুখর হয় মেয়েলি গানে, কোথায় বেজে ওঠে বারোমাসি গান।
বাউল-ফকিরদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অনন্য ক্ষমতা ছিল মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের। গ্রামবাংলার আমজনতার সঙ্গে একাত্ম হতে, ছোট-বড় সবার মন হরণ করতে তাঁর তুলনা মেলা ভার। শুধু কি গ্রামীণ মানুষ? শহুরে মানুষ কিংবা বিদ্বজ্জন—সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারার ঈর্ষণীয় প্রতিভা ছিল তাঁর। এ কারণে সমকালে অনেকের সঙ্গেই চেনাজানা যেমন ছিল, তেমনই ছিল গভীরতর সখ্য। এ প্রসঙ্গে আবারও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম স্মরণ করতেই হয়, যাঁর আশীর্বাণী ও সহযোগিতায় ধন্য হয়েছিলেন তিনি। বাংলার বিশাল পথ-প্রান্তরের নামহীন, গোত্রহীন বাউল-ফকিরদের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় যোগাযোগ ও আন্তরিক সম্পর্ক, যার দৌলতেই আমরা পেয়েছি ত্রয়োদশ খণ্ডে হারামণির মতো লোকসংগীতের অমূল্য রত্নরাজি। লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনার মতো তিন খণ্ডে বিভক্ত গবেষণাগ্রন্থ। সব মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা ৪২।
ছাত্র হিসেবে কৃতবিদ্য ছিলেন মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার্সে প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে এমএ পাস করেন। তাঁর আগে আর কোনো মুসলিম ছাত্র প্রথম শ্রেণী পাননি। অমূল্য সব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশে-বিদেশে পেয়েছেন অনন্য সব সম্মান, স্বীকৃতি, সংবর্ধনা, পদক। ১৯০৪ সালের আজকের দিনে জন্মেছিলেন তিনি। মারা যান ১৯৮৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। জীবদ্দশায় তিনি গৌরবতিলক ও উষ্ণীষে অভিনন্দিত হলেও মৃত্যু-পরবর্তী তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিসেবে যে লজ্জা আমাদের আহত করে, তাঁর একটি করুণ দৃষ্টান্ত হলো মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন—যিনি আজ বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। অথচ তাঁর অবদানে আমরা কতভাবেই না প্রতিনিয়ত স্নাত হচ্ছি।
লোকসংগীত সংগ্রহের পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন নিরাভরণ জীবন যাপন করে গেছেন। ছিলেন বিশ্বমানব, আবার একই সঙ্গে বাঙালিও। আর ছিলেন সহজ মানুষের উপাসক। ‘সহজ মানুষ ভজে দেখনা রে মন দিব্যজ্ঞানে/ পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে’ (লালন সাঁই)। সহজ মানুষে আরাধন করে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন সহজ মানুষের মূর্ত প্রতীক। তাই খুঁজে পেয়েছিলেন সহজ মানুষদের, যাঁদের ভজে সিঞ্চন করেছেন লোকসাহিত্যের অমূল্য নিধি হারামণি। তাঁকে নিয়ে আসাদ চৌধুরী লিখেছেন: যে-গভীর সত্যবাণী নিরক্ষর গীতিকার কবিদের/ ঠোঁটে ঠোঁটে কেঁদে উঠেছিলো—/ তাকে তুমি ছড়ালে নিখিলে।
kazalrashid@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.