শুভ হোক নতুন বছর by আশানুজ্জামান
শুরুটা বরং ওদের দিয়েই করি। পূর্ণ আর অথৈ। এবার তারা তৃতীয় আর চতুর্থ শ্রেণীতে উঠল। দুজনই স্বনামধন্য দুটি স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তাই খুব খুশি। তবে এ জন্যই চরম উত্কণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই সময় পার করতে হয়েছে তাদের মা-বাবাকে। তাদেরও এ বয়সেই অংশ নিতে হয়েছে ভর্তিযুদ্ধে।
তার আগে নিয়মিত ক্লাস, বাড়ির কাজ, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি, কোচিং—সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা। ‘খুব কষ্ট হইছে আমার। এত কষ্ট জীবনেও করি নাই।’ অথৈর কথা পাশে বসেই শুনছিলেন তার মা শাহান আরা বেগম। আর হাসছিলেন। বললেন, ‘কষ্ট তো শুধু ও করেনি...যাক হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভালোয় ভালোয় সুযোগ পেল ভালো স্কুলে।’
এই ভালোয় ভালোয় ‘সুযোগ’ হয়নি বলেই আরও অনেক মা-বাবার দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। ছেলে-মেয়েকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে না পারলে তো শান্তি নেই কারও।
মা-বাবাদের অশান্তি আর তৃপ্তি, ছোটদের অমানুষিক পরিশ্রম, আর নানা ধরনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, উত্কণ্ঠা-প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে চলে গেল ২০০৯।
আর আজকের সকালের আলোয় যে দিনটি আমরা শুরু করলাম, তাতে বদলে গেছে বছর। গ্রেগরিয়ান বর্ষের নতুন একটি সংখ্যা এসে হাজির হয়েছে। এসেছে নতুন একটি নাম। ২০১০।
শুভ হোক নতুন বছর।
প্রতিটি নতুন বছরই স্বপ্ন, সম্ভাবনা, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির প্রসঙ্গ টেনে আনে। অনেক জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড়াই আমরা। বিগত বছরটি কেমন গেল, কেমন যাবে নতুন বছর, বিশেষ কোনো লক্ষ্য বা পরিকল্পনা আছে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে।
২০০৯ আর ২০১০-এর সন্ধিদিনে এ রকম নানা বিষয়ে কথা হলো কিছু মানুষের সঙ্গে।
৫৫ বছর বয়স মো. জামালউদ্দীনের। পেশায় গ্রন্থাগারিক। বললেন, ‘আমাদের তো সময় শেষ। তেমন কিছু প্রত্যাশা নাই। সন্তানেরা সুখে থাক, দেশটা ভালোভাবে চলুক—এটাই চাই। কিন্তু আমার সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝি, দেশটা ভালো নাই।’
এ রকমই ভাবছেন সেলিনা আক্তার চৌধুরী। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই নারীর কণ্ঠেও একই সুর। ‘গেল বছরটা ভালো গেছে। তবে সেটা তো মন্দের ভালো। সেই দুর্নীতি, যানজট, দ্রব্যমূল্য কোনোটারই উন্নতি দেখলাম না। দেখি, নতুন বছরে কী হয়।’ এই নতুন বছরে একটা পদোন্নতির আশা করছেন নেওয়াজ ইব্রাহিম। ‘পদোন্নতিটা গত বছর একটুর জন্য আটকে ছিল। এ বছর হয়ে যাবে আশা করছি। আরও আগেই এটা পাওয়ার কথা আমার...। সবখানেই দুর্নীতি। এভাবে চললে তো আসলে অচল হয়ে পড়ব আমরা।’ এত সব সমস্যার সমাধানে রাজনীতিবিদদের মানসিক পরিবর্তনের কথা বললেন রেজওয়ান হামিদ। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক এই তরুণ বললেন—‘আমাদের সব আছে, শুধু দেশপ্রেম নেই। এ জায়গাতে পরিবর্তন চাই আমি। পাশের দেশ ভারত উন্নতির শিখরে চলে যাচ্ছে। অথচ প্রায় একই রকম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা পিছিয়ে আছি। নিজেরা একটু সত্ আর দায়বদ্ধ হলেই এ দেশের চেহারা বদলে যাবে।’ সেই বদলে যাওয়া সময়ের কান্ডারি যারা হবে, তাদের কী অবস্থা?
পূর্ণ আর অথৈর চেয়ে একটু বড় রনি। এখনই বাসে হেলপারি করে উপার্জন করতে হয় তাকে। নতুন বছরের ছোঁয়া লাগেনি তার গায়ে। রনি জানাল, ‘একটি মোবাইল ফোন আর এমপিথ্রি কিনুম। গেল বছরেই কিনতাম, কিন্তু অসুখ হইছিল, তাই কিনি নাই।’ নতুন বছর বিশেষ কোনো প্রত্যাশা নিয়ে আসছে না নীলা বা রাফসানের জন্যও। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এ দুজনের মাথায় শুধুই পড়াশোনা। খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তা না হলে তো ভালো কোথাও চান্স পাব না। এসব পরীক্ষায় ভালো করেছেন হাবিব। সুযোগও পেয়েছেন ভালো জায়গায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে। তবু ভালো নেই তিনি। বললেন, ‘সুযোগ তো পেলাম। এখন চিন্তা হচ্ছে, থাকব কোথায়। হলে থাকতে ভয় পাচ্ছি। মিছিলটিছিল করতে হয় যদি...। বাইরে কোথাও মেসে থাকব, তা-ও তো সম্ভব না, এত কষ্ট করেও যদি ভালোভাবে না থাকতে পারি।’
ভালো থেকে-না থেকেই পড়াশোনা শেষ করেছেন শিরিন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চাকরি পাচ্ছেন না। হলও ছাড়তে হয়েছে। না পেরে এখন গ্রামের বাড়িতে থাকছেন। সেখান থেকেই চেষ্টা করছেন চাকরির জন্য। নতুন বছরে তাঁর সঙ্গী এই চাকরি না পাওয়ার দুশ্চিন্তা। কয়েক দিন আগে চাকরি পেয়েছেন মো. রফিক। হল ছেড়ে নতুন বাসায় উঠেছেন। বললেন, ‘এখন চিন্তা হচ্ছে বিয়ে ঠেকানো। মা-বাবা উঠেপড়ে লেগেছেন। এ বছরটি আমার বিয়ে ঠেকিয়ে রাখার সংগ্রামেই কেটে যাবে।’ একই সংগ্রাম করছেন অনার্সপড়ুয়া সোনিয়াও। দরিদ্র মা-বাবা তাঁকে বিয়ে দিতে চাইছেন। বিয়ে ঠিকও হয়েছে এক জায়গায়। তবে তিনি এখনই বিয়ে করবেন না। তাই বরপক্ষের কাছে সময় চেয়ে নিয়েছেন এক বছরের জন্য। বললেন, ‘এই এক বছরের মধ্যে বাবার জন্য একটি দোকান করে দেব। অনেক দিন থেকে টাকা জমাচ্ছি। আমি চলে গেলে তাঁদের দেখার কেউ থাকবে না তো...। আগামী বছরটি তাই আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জন্য। প্রতিটি দিনই মানুষ বেঁচে থাকে ভালো থাকার চেষ্টায়। এত চেষ্টা, এত পরিশ্রম, কষ্ট, আর ত্যাগ—সবই ওই ভালো থাকার জন্য। আর ভালো রাখার জন্য।
নতুন বছরের শুরুতে আমাদের চাওয়া, প্রতিটি মানুষের ভালো থাকার ইচ্ছাটা বাঁচুক। ভালো থাকুক সবাই। তাহলে দেশটাও ভালো থাকবে।
তবে যাঁরা ভালো হলে সত্যিকার অর্থেই দশ ও দেশ ভালো থাকার সুযোগ পায়, সেসব ওপরওয়ালারা যেন তাঁদের গুরুত্ব বুঝতে পারেন—এটাই প্রার্থনা। তাঁরা ভালো হোন। ভালো থাকুন। আর সবাইকে ভালো রাখুন। আজ নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই।
এই ভালোয় ভালোয় ‘সুযোগ’ হয়নি বলেই আরও অনেক মা-বাবার দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। ছেলে-মেয়েকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে না পারলে তো শান্তি নেই কারও।
মা-বাবাদের অশান্তি আর তৃপ্তি, ছোটদের অমানুষিক পরিশ্রম, আর নানা ধরনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, উত্কণ্ঠা-প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে চলে গেল ২০০৯।
আর আজকের সকালের আলোয় যে দিনটি আমরা শুরু করলাম, তাতে বদলে গেছে বছর। গ্রেগরিয়ান বর্ষের নতুন একটি সংখ্যা এসে হাজির হয়েছে। এসেছে নতুন একটি নাম। ২০১০।
শুভ হোক নতুন বছর।
প্রতিটি নতুন বছরই স্বপ্ন, সম্ভাবনা, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির প্রসঙ্গ টেনে আনে। অনেক জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড়াই আমরা। বিগত বছরটি কেমন গেল, কেমন যাবে নতুন বছর, বিশেষ কোনো লক্ষ্য বা পরিকল্পনা আছে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে।
২০০৯ আর ২০১০-এর সন্ধিদিনে এ রকম নানা বিষয়ে কথা হলো কিছু মানুষের সঙ্গে।
৫৫ বছর বয়স মো. জামালউদ্দীনের। পেশায় গ্রন্থাগারিক। বললেন, ‘আমাদের তো সময় শেষ। তেমন কিছু প্রত্যাশা নাই। সন্তানেরা সুখে থাক, দেশটা ভালোভাবে চলুক—এটাই চাই। কিন্তু আমার সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝি, দেশটা ভালো নাই।’
এ রকমই ভাবছেন সেলিনা আক্তার চৌধুরী। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই নারীর কণ্ঠেও একই সুর। ‘গেল বছরটা ভালো গেছে। তবে সেটা তো মন্দের ভালো। সেই দুর্নীতি, যানজট, দ্রব্যমূল্য কোনোটারই উন্নতি দেখলাম না। দেখি, নতুন বছরে কী হয়।’ এই নতুন বছরে একটা পদোন্নতির আশা করছেন নেওয়াজ ইব্রাহিম। ‘পদোন্নতিটা গত বছর একটুর জন্য আটকে ছিল। এ বছর হয়ে যাবে আশা করছি। আরও আগেই এটা পাওয়ার কথা আমার...। সবখানেই দুর্নীতি। এভাবে চললে তো আসলে অচল হয়ে পড়ব আমরা।’ এত সব সমস্যার সমাধানে রাজনীতিবিদদের মানসিক পরিবর্তনের কথা বললেন রেজওয়ান হামিদ। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক এই তরুণ বললেন—‘আমাদের সব আছে, শুধু দেশপ্রেম নেই। এ জায়গাতে পরিবর্তন চাই আমি। পাশের দেশ ভারত উন্নতির শিখরে চলে যাচ্ছে। অথচ প্রায় একই রকম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা পিছিয়ে আছি। নিজেরা একটু সত্ আর দায়বদ্ধ হলেই এ দেশের চেহারা বদলে যাবে।’ সেই বদলে যাওয়া সময়ের কান্ডারি যারা হবে, তাদের কী অবস্থা?
পূর্ণ আর অথৈর চেয়ে একটু বড় রনি। এখনই বাসে হেলপারি করে উপার্জন করতে হয় তাকে। নতুন বছরের ছোঁয়া লাগেনি তার গায়ে। রনি জানাল, ‘একটি মোবাইল ফোন আর এমপিথ্রি কিনুম। গেল বছরেই কিনতাম, কিন্তু অসুখ হইছিল, তাই কিনি নাই।’ নতুন বছর বিশেষ কোনো প্রত্যাশা নিয়ে আসছে না নীলা বা রাফসানের জন্যও। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এ দুজনের মাথায় শুধুই পড়াশোনা। খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তা না হলে তো ভালো কোথাও চান্স পাব না। এসব পরীক্ষায় ভালো করেছেন হাবিব। সুযোগও পেয়েছেন ভালো জায়গায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে। তবু ভালো নেই তিনি। বললেন, ‘সুযোগ তো পেলাম। এখন চিন্তা হচ্ছে, থাকব কোথায়। হলে থাকতে ভয় পাচ্ছি। মিছিলটিছিল করতে হয় যদি...। বাইরে কোথাও মেসে থাকব, তা-ও তো সম্ভব না, এত কষ্ট করেও যদি ভালোভাবে না থাকতে পারি।’
ভালো থেকে-না থেকেই পড়াশোনা শেষ করেছেন শিরিন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চাকরি পাচ্ছেন না। হলও ছাড়তে হয়েছে। না পেরে এখন গ্রামের বাড়িতে থাকছেন। সেখান থেকেই চেষ্টা করছেন চাকরির জন্য। নতুন বছরে তাঁর সঙ্গী এই চাকরি না পাওয়ার দুশ্চিন্তা। কয়েক দিন আগে চাকরি পেয়েছেন মো. রফিক। হল ছেড়ে নতুন বাসায় উঠেছেন। বললেন, ‘এখন চিন্তা হচ্ছে বিয়ে ঠেকানো। মা-বাবা উঠেপড়ে লেগেছেন। এ বছরটি আমার বিয়ে ঠেকিয়ে রাখার সংগ্রামেই কেটে যাবে।’ একই সংগ্রাম করছেন অনার্সপড়ুয়া সোনিয়াও। দরিদ্র মা-বাবা তাঁকে বিয়ে দিতে চাইছেন। বিয়ে ঠিকও হয়েছে এক জায়গায়। তবে তিনি এখনই বিয়ে করবেন না। তাই বরপক্ষের কাছে সময় চেয়ে নিয়েছেন এক বছরের জন্য। বললেন, ‘এই এক বছরের মধ্যে বাবার জন্য একটি দোকান করে দেব। অনেক দিন থেকে টাকা জমাচ্ছি। আমি চলে গেলে তাঁদের দেখার কেউ থাকবে না তো...। আগামী বছরটি তাই আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জন্য। প্রতিটি দিনই মানুষ বেঁচে থাকে ভালো থাকার চেষ্টায়। এত চেষ্টা, এত পরিশ্রম, কষ্ট, আর ত্যাগ—সবই ওই ভালো থাকার জন্য। আর ভালো রাখার জন্য।
নতুন বছরের শুরুতে আমাদের চাওয়া, প্রতিটি মানুষের ভালো থাকার ইচ্ছাটা বাঁচুক। ভালো থাকুক সবাই। তাহলে দেশটাও ভালো থাকবে।
তবে যাঁরা ভালো হলে সত্যিকার অর্থেই দশ ও দেশ ভালো থাকার সুযোগ পায়, সেসব ওপরওয়ালারা যেন তাঁদের গুরুত্ব বুঝতে পারেন—এটাই প্রার্থনা। তাঁরা ভালো হোন। ভালো থাকুন। আর সবাইকে ভালো রাখুন। আজ নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই।
No comments